মিমির আড়াল যাত্রা by নাজমীন সুলতানা মিমি

বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলা গানের বাণিজ্যিক অসফলতা, শিল্পী-প্রযোজকদের সম্পর্কের টানপোড়েনসহ নানা অস্থিরতায় প্রায় মুখ থুবড়ে পড়া সংগীতাঙ্গনে যে ক’জন নবীন নতুন করে জেগে ওঠবার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন এই তরুণ তুর্কী তাদের অন্যতম। অডিও এবং চলচ্চিত্রের গীতপ্রিয় শ্রোতাদের একটা অংশ এরই মধ্যে নিজের করে নিয়েছেন


তিনি । সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে এই সময়ের তরুণ ও অন্যতম জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী হৃদয় খানের সুর ও সংগীতে মিমির তৃতীয় একক এ্যালবাম ‘আড়াল’। নতুন এককের সাফল্য আর শ্রোতাপ্রিয়তার স্বপ্নে বিভোর স্বপ্নময়ী মিমিকে নিয়ে লিখেছেন লিমন আহমেদ
নোয়াখালীর মেয়ে। জন্মটা সেখানেই হলেও পুলিশ বাবার চাকরির সুবাদে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের নানা প্রান্ত। ছোটবেলা থেকেই গান শুনতে ভালো লাগত, গাইতে ভালো লাগত। তাছাড়া পরিবারেও ছিল শুদ্ধ সংস্কৃতির নির্ভরশীল আশ্রয়। বাবা নিয়মিতই গান করার চেষ্টা করতেন। হারমোনিয়াম সামনে নিয়ে বাবার কণ্ঠে নজরুল-রবীন্দ্রনাথের গান শুনে শুনেই তো মিমির হৃদয়ে সংগীতের বাসর সেজেছিল সেই ক্ষুদে বয়সে। বাবার সামনেই হারমোনিয়ামের সঙ্গে খোলা গলায় সারেগামা সেঁধে উন্মোচিত হয়েছিল আজকের প্রতিভাবান এই গায়িকার গায়কী জীবনের পর্দা। তার সংগীতজীবনের প্রথম গুরু ওস্তাদ তাপস কুমার পাল। তারপর তিনি চট্টগ্রামের সুপরিচিত সংগীত শিক্ষক বিধান রায় বিশ্বাসের কাছেও শিক্ষা নেন। এ দুই ওস্তাদের কাছে মিমি তালিম নিয়েছেন একাধারে ক্ল্যাসিক, রবীন্দ্র-নজরুলসহ পঞ্চ কবির গানে। তবে শিল্পী হওয়ার গোপন ইচ্ছেটা রঙিন ঘুড়ি হয়ে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আকাশে ডানা মেলে ১৯৯৮ সালে। পরিবারের আগ্রহে একরকম কৌতূহলবশতই মিমি অংশ নিয়েছিলেন ওই বছরের জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ প্রতিযোগিতায়। সেবার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন তিনি। তার পরের বছর এসে গান গেয়ে আবারও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করলেন বাংলাদেশ শিশু মৌসুমী প্রতিযোগিতায়। মূলত এই দু’টি সাফল্যই বলা চলে বদলে দিয়েছে মিমির ভাগ্য। বলা যায় তার শিল্পী হবার এটাই টার্নিং পয়েন্ট। তারপর থেকে নিয়মিতই গানের শিল্পী মিমি। ছুটে চলেছেন সাতরঙা রঙিন স্বপ্নগুলোকে পরাণে মাখবেন বলে। সেই মাখামাখির শুরুটা ২০০৬ সালে গাংচিলের ব্যানারে প্রথম একক এ্যালবাম ‘খেয়ালী মন’ প্রকাশের মাধ্যমে।
ধারবাহিকতায় ২০০৯ সালে লেজার ভিশনের প্রযোজনায় বাজারে আসে তার দ্বিতীয় একক এ্যালবাম ‘দিওয়ানা’। নিজেকে প্রকাশ করার এবং শ্রোতাদের কাছে নিজের যোগ্যতার যে পরীক্ষা তিনি এই দুই এ্যালবামে দিতে চেয়েছেন বলা চলে সেখানে তিনি সফল। ইচ্ছেরা ধরা দিয়েছে মনের গহীনে। মিমি সমর্থ হয়েছেন শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে। তার একমাত্র প্রমাণ দেশের সবচাইতে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্রে তার অসংখ্য গানে কণ্ঠ দেয়া। মিমি জানালেন ২০০৪ সাল থেকে প্লেব্যাক সংগীত শিল্পী হিসেবে কাজ করে বড় পর্দায় প্রায় ৩শ’রও বেশি গান গাওয়া হয়ে গেছে তার। এইসব গানে সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর, মনির খান, বাদশা বুলবুল, এস আই টুটুল, পলাশ, এসডি রুবেলের মতো গায়কদের। আর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হল ‘কোটি টাকার কাবিন’, ‘বল না কবুল’, ‘তুমি কত সুন্দর’, ‘অল্প অল্প প্রেমের গল্প’, ‘পরান যায় জ্বলিয়া’, ‘ছোট বোন’, ‘জগত সংসার’, ‘মনে বড় কষ্ট’, ‘তোমারই ছিলাম তোমারই আছি’ ইত্যাদি। চলচ্চিত্রে কাজ করা প্রসঙ্গে মিমি জানান, ‘এখানে আমি অনেক সৌভাগ্যবান। অনেকেই আছেন যারা বহুদিন ধরে গান করলেও এখনও চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পাননি। কিন্তু আমার অনেক আগেই এই সুযোগ হয়েছে। আমার শিল্পী ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু এই চলচ্চিত্র দিয়ে। এটা ভাবতে পারা আমার জন্য বিরাট প্রাপ্তির। চলচ্চিত্র একটি দেশের শিল্পের সবচাইতে বড় ক্যানভাস। এখানে কাজ করতে পারা যে কারও জন্য আনন্দের। আমিও উপভোগ করছি এবং অনেক কিছু শিখছিও।’ সম্প্রতি কণ্ঠ দিলেন বাংলালিংক নিবেদিত ‘অল্প অল্প প্রেমের গল্প’ ডিজিটাল চলচ্চিত্রে। এই ছবিটিতে মিমি বাপ্পা এবং পুলকের সঙ্গে দ্বৈতভাবে গেয়েছেন কাজী নজরুল ইসলামের ‘আলগা করগো খোঁপার বাঁধন’ গানটি। হাতে আছে আরও কয়েকটি ছবির কাজ। একক এ্যালবামে গান এবং চলচ্চিত্রের পাশাপাশি মিমি কণ্ঠ দিয়েছেন বেশ কিছু মিশ্র এ্যালবামেও। তার মধ্যে রয়েছে গাংচিলের ব্যানারে প্রকাশ হওয়া দেশের গান নিয়ে মিক্সড এ্যালবাম ‘শান্তির সাদা কবুতর’-এ সামিনা চৌধুরী, রোমানা ইসলাম প্রমুখ শিল্পীদের সাথে একটি গান ছিল মিমির। আইয়ুব বাচ্চুর আয়োজনে ‘অনুভবে’ এ্যালবামে দু’টি গান করেছেন তিনি। এ্যালবামটি ২০১১ সালে ফাহিম মিউজিকের প্রযোজনায় বাজারে আসে। সম্প্রতি আরমান খানের সংগীতে মিক্সড এ্যালবাম ‘কানামাছি মৌমাছি’-তে একটি গানে অংশ নিয়েছেন এই তরুণ গায়িকা। এখানেই থেমে নেই মিমি। তার প্রতিভার আলোতে উদ্ভাসিত হয়েছে বিজ্ঞাপনের সাম্রাজ্যও। বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রের জিঙ্গেলেও গেয়েছেন এই তন্বী গায়িকা। এর মধ্যে আছে প্রাণ মিল্ক বিস্কুট, এলিট মেহেদি, ফরচুন হসপিটাল, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, আইভি মেহেদী, স্যামসাং এয়ারকন্ডিশন ইত্যাদি। গানের বাইরে উপস্থাপনাও করেছেন মিমি। ইটিভিতে প্রচারিত ‘মিউজিক বিট’ ও আরটিভিতে প্রচারিত ‘নতুনের জয়গান’ দুটি সংগীত বিষয়ক অনুষ্ঠানে নিয়মিত উপস্থাপনা করতেন তিনি। তবে এখন সংগীত নিয়ে বেশি ব্যস্ত বলে উপস্থাপনাটা আপাতত বন্ধ রেখেছেন। বর্তমানে মিমির ব্যস্ত সময় কাটছে মঞ্চে। এই তো গেল ঈদের আগেই লম্বা সফর শেষ করে দেশে ফিরলেন আমেরিকা থেকে। তবে সব খবরকে পেছনে রেখে মিমির নতুন খবর হচ্ছে সম্প্রতি বাজারে এসেছে তার তৃতীয় একক এ্যালবাম। এ্যালবামটির সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন এই সময়ের তরুণ ও অন্যতম জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী হৃদয় খান। অগ্নিবীণার ব্যানারে প্রকাশিত হওয়া এ্যালবামটিতে মিমির কণ্ঠে রয়েছে ৮টি গান। লিখেছেন মিলন মাহমুদ ও মাহবুব আর গুঞ্জন। প্রায় এক বছর খাটুনির ফসল এই এ্যালবাম। নিজের একক নতুন এই প্রজেক্ট নিয়ে যেমন উচ্ছ্বসিত মিমি তেমনি আশাবাদী শ্রোতারা। আর শ্রোতাদের মুগ্ধতাই একমাত্র সাফল্য হবে তার। এ্যালবামে মেলোডি, সফট মেলোডি, সেমি ক্লাসিক্যাল ও হিপহপ ঘরানার গানগুলোর মধ্যে ‘আড়াল’, ‘মেঘ’, ‘কত কাঁদাবে’, ‘বলো না ভালোবাসি’, ‘কি নেশা’, ‘অসহায় মন’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ‘আড়াল’ এ্যালবামের ‘আড়ালে’ ও ‘মেঘ’ গানের ভিডিওচিত্র ধারণের কাজ শেষ করেছেন সম্প্রতি। আর এই দুটি গানের ভিডিওচিত্রের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন হৃদয় খান। খুব শীঘ্রই মিউজিক ভিডিওগুলো প্রচারে যাবে বিভিন্ন টিভি-চ্যানেলে। গান বাজনার পাশাপাশি শান্ত মরিয়ম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে মিমি সোসিওলজি এ্যান্ড এ্যানথ্রপলজিতে এমএসএস করছেন। তিন বোন আর এক ভাইয়ের মাঝে সবার বড় বলে পরিবারের প্রতি রয়েছে তার অসীম প্রেম আর দরদ। বাবা মোঃ আবুল কাশেম অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। মা জেসমিন আক্তার। সুন্দর, সুখী পরিবারের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার আত্মীক বন্ধনে মিমি এগিয়ে চলেছেন গানের ভুবনে।

No comments

Powered by Blogger.