অর্থনীতি ॥ ভাল খবরের পাশাপাশি খারাপ খবরও আছে by ড. আর এম দেবনাথ

বাংলাদেশের মিডিয়াকে বোঝা বড় মুষ্কিল। জিনিসের দাম যখন বাড়ে তখন প্রতিদিন রিপোর্টিংÑ যা করাই উচিত। কিন্তু তা হয় অনেক ক্ষেত্রে একপেশে। তবু মানলাম। কিন্তু যখন জিনিসের দাম কমে তখন মিডিয়া তা ব্যাপকভাবে ‘কভার’ করবে না কেনÑ এ বিষয়টা আমি বুঝি না। যেমন এবার বুঝতে পারছি না রমজানের পণ্যমূল্য রিপোর্টিং।


প্রতিবছর আমাদের ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ীরা রোজাদারকে ভীষণ কষ্ট দেন। সকল প্রকার জিনিসের দাম রোজার আগেই বাড়িয়ে দেন। কিন্তু এবার? এবার দেখা গেল ভিন্ন রকম। এবার রোজার মাস তেল, চিনি, পিঁয়াজ, ছোলা, খেজুর ইত্যাদির দাম ছিল বেশ স্থিতিশীল। অনেক পণ্যের দাম ছিল নিম্নমুখী। এজন্য নতুন বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদের সাহেবকে ধন্যবাদ দেয়া দরকার। তিনি কথা কম বলেন। কিন্তু কাজটি করে ফেলেছেন। অগ্রিম বাজার ব্যবস্থার ফলে রোজায় এবার মানুষের কষ্ট হয়নি। এটি যেমন তার প্রচেষ্টায় হয়েছে তেমনি হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারের কারণেও। আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক পণ্যের দাম হ্রাস পেয়েছে গত কিছুদিনের ব্যবধানে। এর সুফল আমরা পাচ্ছি। সুফল আরও পাচ্ছি চালের দাম স্থিতিশীল থাকার কারণে। চালের দাম স্থিতিশীল নয়, অনেক ক্ষেত্রে নিচের দিকে স্থিতিশীল। এতে গরিব মানুষ, নিম্নমধ্যবিত্ত উপকৃত হচ্ছে সন্দেহ নেই। অভিযোগ আছে কৃষকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। এটা এই মুহূর্তে বোধ ঠিক নয়, অন্তত পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ বিক্রেতা-কৃষকরা ধান-চাল ছেড়ে দিয়েছেন আগেই। এখন শ্রাবণ শেষে ভাদ্র মাস। আমন রোপণের সময়। এখন কৃষকের হাতে চাল থাকার সম্ভাবনা কম। এখন বরং সমস্যা বৃষ্টির জলের যা দরকার আমনের জন্য। খবর এটা এখনও বেশ কম। তবু ভরসা প্রকৃতিই। আশা করা যায় সরকারের যে স্টক আছে তাতে সমস্যা হবে না। কিন্তু সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে ফলনের ওপর। কারণ অনাবৃষ্টি, খরা ইত্যাদির কারণে বিশ্বে খাদ্যসশ্যের ফলন কম হতে পারে খবর পাওয়া যাচ্ছে। যাক এটা ভিন্ন সমস্যা। আমি লিখতে চাই সর্বশেষ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে।
দেখা যাচ্ছে অর্থনীতি এখন বেশ কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। এই মূল্যস্ফীতির খবর ছিল উদ্বেগের। প্রায় বছর দেড়েক পর খবর পাওয়া গেল অবশেষে মূল্যস্ফীতি কমতির দিকে। তবে এটা কতদিন অব্যাহত থাকবে তা বড় প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল না থাকলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই কঠিন। বিশেষ করে তেলের দাম অস্থিতিশীল হলে আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই কাজে লাগাবে নাÑ এটা বহুদিনের অভিজ্ঞতা। এই প্রেক্ষাপটে প্রত্যাশা আন্তর্জাতিক বাজার ঠিক থাকবে। তবে দেশের ভেতর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখন বেশ সক্রিয় মনে হচ্ছে। তারা অহেতুক ঋণ সম্প্রসারণ হোক তা চায় না। অহেতুক আমদানি বাড়ুক তাও তারা চায় না। এতে দেখা যাচ্ছে আমদানি বিল হ্রাস পেয়েছে। এর ফল আমরা পেয়েছি। ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’-এর চাপ নিয়ন্ত্রণে আছে। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। মাঝে মনে হয়েছিল ডলারের দাম ডিসেম্বরের মধ্যে ১০০ টাকা হয়ে যাবে। এটা হয়নি। যারা ক্যাশ ডলার নোট কেনা শুরু করেছিল তাদের লোকসানের মুখোমুখি হতে হয়েছে বলে খবর। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভেও উর্ধগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উল্লেখযোগ্য হারে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য না পেয়েও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বাড়ছে। আমদানি হ্রাস, বিশেষ করে চাল আমদানি হ্রাস, রফতানি বৃদ্ধি ও রেমিটেন্স বৃদ্ধির কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। অথচ কিছুদিন আগেও মনে হয়েছিল রিজার্ভ বোধ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে। এই আশঙ্কা দূরীভূত হয়েছে। নিঃসন্দেহে ঐ খবরগুলো সরকারের জন্য সুখকর। চারদিকে নানা ধরনের দুঃসংবাদ। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি হ্রাস, আমদানি হ্রাস, রেমিটেন্স বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, ডলারের স্থিতিশীল মূল্য ইত্যাদি খবর নিশ্চয়ই ভাল খবর। প্রতিবেশী দেশগুলোর অবস্থা টালমাটাল। ভারত ও চীনে ভীষণ মন্দা চলছে। এসব খবর প্রতিদিন দেখছি। সেই তুলনায় বাংলাদেশের বাজার এখন মোটামুটি নিম্ন আছে। তবে বেশ কিছু উদ্বেগেরও খবর আছে।
মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে রফতানির প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছিল। জুলাই মাসে আবার সেই প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। কিন্তু বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের গার্মেন্টস দাম হারাচ্ছে। অর্থাৎ ইউনিটপ্রতি দাম হারাচ্ছে বাংলাদেশের পণ্য। এটা মোট পাওয়া আয়ে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। রফতানিকারকরা ইতোমধ্যেই নানা ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করছেন। এছাড়া আমানতের বাজারের অস্থিতিশীলতা এখনও কাটেনি। সর্বশেষ খবরে দেখা যাচ্ছে ২০১২ সালের জুলাই মাসে আমানত বেড়েছে অনেক কম হারে। বছরের তুলনায়ও ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কম। অথচ ব্যাংকিং ক্ষেত্রে ঋণের সম্প্রসারণ আগেই বেশি ঘটে গেছে। তার নিয়ন্ত্রণ একটা কঠিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমানত প্রত্যাশানুযায়ী না বাড়লে ব্যাংকগুলোর তারল্য সমস্যা কাটবে না। কাটতে পারে ‘ক্যাল রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট’ কমালে। সর্বশেষ খবরে দেখা যাচ্ছে ‘রিজার্ভ ব্যাংক ইন্ডিয়া’ (আরবিআই) সিআরআর করেছে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অবশ্য তাদের ‘স্টেটুইরি লিক্যুইডিটি রেশিও’ (এমএলআর) অনেক বেশি। ছিল ২৪ শতাংশ, কমিয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। তবে একটা বিষয় আছে। ‘সিআরআর’ টাইট রাখার ফলে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা সামাল দিতে গিয়ে আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘লিক্যুইডিটি সাপোর্ট’ দিয়ে যাচ্ছে অবিরত। এতে ব্যাংকগুলো তারল্যের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর দৈনিক ভিত্তিতে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। একদিকে ‘সিআরআর’ বাড়িয়ে বাজার থেকে লিক্যুইডিটি তুলে আবার উদারভাবে ‘লিক্যুইডিটি সাপোর্ট’ দিয়ে পাওয়ার যৌক্তিকতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকই বলতে পারবে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন সরকারের ঋণ। সরকার আগে শুধু সরকারী এবং কয়েকটি ব্যাংক থেকে ঋণ দিত ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রি করে। এখন সব ব্যাংককেই তা দিতে হবে। এই সমস্যার সমাধান না হলে ব্যাংকিং খাতের তারল্য সমস্যার সমাধান হবে না। তবে সরকারী ব্যাংকগুলো বর্তমান নিয়মের ফলে কিছুটা রেয়াত পাবে। সব ব্যাংক থেকেই সরকার যেহেতু ঋণ নেবে, অতএব সরকারী ব্যাংকের ওপর থেকে ঋণের চাপ কিছুটা হলেও কমবে। মোদ্দা কথা এই সমস্যার সমাধান হলে ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না বলেই মনে করি। বস্তুত ২০১২-১৩ অর্থবছরে সরকারের জন্য এটি বড় একটা সমসা হিসেবে অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া যদি পদ্মা সেতুর জন্য নিজস্ব অর্থায়নের দিকেই যেতে হয় তাহলেও অর্থনৈতিক ফ্রন্টে জরুরী অবস্থার উদ্ভব হবেÑ আশা করি এ কথাটা সরকারের নীতি তৈরিতে যারা সাহায্য করেন তাঁরা তা মনে রাখবেন।
এদিকে আরেকটি সমস্যার সৃষ্টি হবে রাজস্ব ক্ষেত্রে। সরকারের রাজস্ব বিভাগ রাজস্ব আদায়ে খুবই উদ্যোগী মনে হচ্ছে। এর জন্য তারা উৎসে কর কর্তনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। এই উন্মাদনায় তারা আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদ থেকে অধিকতর রাজস্ব আদায় করতে চায়। ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে, এসবের ওপর অর্জিত সুদের ওপর থেকে ১০ শতাংশ কর তো কাটা হবেইÑ অধিকন্তু যাদের ‘টিআইএন’ নেই তাদের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ হারে কর কাটা হবে। এতে রাজস্ব এই খাতে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ইতোমধ্যেই ব্যাংকাররা এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন। বিরোধিতা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। কারণ বর্তমান পদক্ষেপ সঞ্চয়পত্র ও আমানতের বাজারকে আবার অস্থিতিশীল করবে। বলা বাহুল্য, এই দুই খাতে অস্থিতিশীলতা চলছে অনেকদিন থেকে। আশা করা গিয়েছিল ২০১২-১৩ অর্থবছরে আমানত ও সঞ্চয়পত্রের বাজার স্থিতিশীল হবে। কিন্তু তা হওয়ার লক্ষণ নেই। ব্যাংকিং ও সঞ্চয়ের বাজারকে অস্থিতিশীল রেখে সরকার শেষ পর্যন্ত কী উদ্দেশ্য পূরণ করে তা দেখার বিষয় বৈ কি!
লেখক : সাবেক অধ্যাপক বিআইবিএম

No comments

Powered by Blogger.