'নির্দোষ' গাড়িগুলো আমাকে নির্বাক করে by দিব্যেন্দু দ্বীপ
৫ এপ্রিল ২০১১, ছোট বোনের এইচএসসি পরীক্ষা। ও থাকে শ্যামলী। আমি থাকি জগন্নাথ হলে। আমাদের মা থাকেন বাগেরহাটের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে, আমাদের নামমাত্র বাড়িতে। পরীক্ষার কেন্দ্র গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল। আমি সকাল ৭টায় জগন্নাথ হল থেকে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ৭ নম্বর গাড়িতে উঠলাম।
৭ নম্বর গাড়ি রিকশার গতিতে চললেও শ্যামলী পেঁৗছতে ৩০ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। সোয়া ৭টায় আমি গাড়িতে উঠেছি এই ভেবে নিশ্চিন্ত হলাম যে, অন্তত ৮টার মধ্যে শ্যামলী পেঁৗছে যাব। পত্রিকা পড়তে পড়তে খেয়াল করিনি বাস কোন পর্যন্ত পেঁৗছাল। হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে দেখি কলাবাগান মাঠ, তখন ৮টা বাজতে ২০ মিনিট বাকি। এই পর্যন্ত আসতে এত সময় কেন লাগল তা যেহেতু আমি লক্ষ্য করিনি, তাই এ সম্পর্কে কিছু না বলাই ভালো। এখন সতর্ক হয়ে গাড়ির গতিবিধি লক্ষ্য করছি। লোকাল বাস, রাস্তার বাম পাশ ধরে চলছে। ডান পাশ দিয়ে পরপর প্রাইভেট গাড়িগুলো যাচ্ছে। সাদা সাদা গাড়ি, কোনোটার রঙ কালো, কোনোটা একটু বড়, কোনোটা একটু চওড়া, নানা রঙ ও আকারের। প্রতিটি গাড়িতে একজন বা দু'জন করে যাত্রী, কোনো কোনোটি আবার খালি। ৩২ নম্বর পার হতেই ৭ নম্বর মওকা হাতে পেয়ে গেল। সামনে প্রাইভেট গাড়ির সমুদ্র, ৭ নম্বর আরাম কেদারা দোলানোর মতো হেলতে-দুলতে লাগল। কোনোমতে আসাদগেট পর্যন্ত যাওয়া গেল, এরপর আর গাড়ি সামনে এগোয় না। শুনেছি রাস্তায় জ্যাম হয় শুধু রিকশার জন্য, এখন এই প্রাইভেট গাড়িগুলোর জন্য যা হচ্ছে তার নাম যে ঠিক কী বুঝতে পারছি না। হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ল, মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন অবস্থায় মা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। গভীর রাতে তাকে একদিন বলতে শুনেছিলাম, 'সবকিছুর নাম দিতে নেই।' কোন কথার পিঠে বলেছিলেন তা অবশ্য ঠিক মনে নেই। আজ এত এত প্রাইভেট গাড়ির জন্য রাস্তায় যা হচ্ছে তারও কোনো নাম দিতে নেই। কলেজগেট পর্যন্ত যেতে যেতে ৮টা বেজে গেল। কলেজগেট থেকে শ্যামলী যেতে এক মিনিট লাগে, সেখানে মনে মনে পাঁচ মিনিট হিসাব করে রাখলাম, লাগল ২০ মিনিট। রিকশা না নিয়ে একরকম দৌড়ে বোনের মেসে গিয়ে ওকে নিয়ে বের হলাম। এবার আর মিরপুর রোড দিয়ে আসতে সাহস করলাম না। একটি রিকশা নিলাম জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডের কথা বলে। মোহাম্মদপুর হয়ে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড সে চেনা কি-না জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে সে বলল, 'চেনে'। কিছুদূর যাওয়ার পর ধারণা করে বুঝতে পারলাম সে চেনে না। আরেকটি রিকশা নিয়ে শংকর হয়ে খুব সহজেই এবং সময়মতো সায়েন্স ল্যাব পেঁৗছে গেলাম। তখন বাজে সোয়া ৯টা। মেইন রোড দিয়ে স্কুলের গলিতে ঢোকার মুখ থেকে শুরু করে যতদূর চোখ যায় লোকে লোকারণ্য। পা মেপে মেপে এগোচ্ছি, আশপাশেও তাকাচ্ছি। যতজন পরীক্ষার্থী অভিভাবক তার তুলনায় দেড়গুণ হবে। হঠাৎ মনে পড়ল, আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম নিজে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে, এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম হোস্টেলে থেকে।
না, নিজেকে দিয়ে বিশ্ব বিচার আমি করছি না। অভিভাবকদের আবেগ আমি বুঝি, আমিও তো একই ভূমিকা পালন করছি। একটু সামনে এগোতেই ভ্রম ভাঙল। দূর থেকে বুঝতে পারিনি, এখন দেখছি জনসমুদ্রের মাঝেই রয়েছে ওই ইজ্জতি প্রাইভেট গাড়িগুলো। কোনোটি আসতে চাচ্ছে, কোনোটি যেতে চাচ্ছে। কোনোমতে ফাঁক গলে হাঁটারত মানুষগুলো গন্তব্য পেঁৗছানোর চেষ্টা করছে। ওই সুবর্ণসুন্দর গাড়িগুলোর মধ্যে বসে আছে আরও অধিকতর সুন্দর মানুষগুলো। ফিরতি গাড়িতে ওরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। কেন্দ্রমুখী গাড়ি থেকে পরীক্ষার্থীরা নেমে হাঁটা শুরু করেছে। অভিভাবকও নেমে পেছন পেছন হাঁটছেন। চালক নিচের দিকে তাকিয়ে গাড়ি নিয়ে সকলের পথ আটকে বসে থাকল। টেনে-হেঁচড়ে সবাই এগোচ্ছে, আমরাও এগোচ্ছি। যেন সবাই সমতল বেয়ে এভারেস্টে উঠছে। আমরা পেঁৗছে গেলাম। তখন সাড়ে ৯টা। একশ'-দেড়শ' মিটার পথ হাঁটতে লেগেছে ১৫ মিনিট। ও ভেতরে চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ বাধ্য হয়ে গেটে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কোনোমতে শরীর গলিয়ে পার হওয়া যায় এতটুকু জায়গা পরীক্ষার্থীদের প্রবেশের জন্য অবশিষ্ট থাকল, বাকি জায়গা উৎকণ্ঠিত অভিভাববৃন্দ এবং তাদের অনেকের ইজ্জতি গাড়িগুলো দখল করে রাখল। আমি এখানে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। প্রথমে পরিবারের একটু বর্ণনা দিয়েছি নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতে। হতদরিদ্র পরিবার থেকে এসেছি। কিন্তু ওই গাড়িগুলোর কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। গাড়িগুলো মাঝে মধ্যে আমাকে নির্বাক করে, নির্বোধ করে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
না, নিজেকে দিয়ে বিশ্ব বিচার আমি করছি না। অভিভাবকদের আবেগ আমি বুঝি, আমিও তো একই ভূমিকা পালন করছি। একটু সামনে এগোতেই ভ্রম ভাঙল। দূর থেকে বুঝতে পারিনি, এখন দেখছি জনসমুদ্রের মাঝেই রয়েছে ওই ইজ্জতি প্রাইভেট গাড়িগুলো। কোনোটি আসতে চাচ্ছে, কোনোটি যেতে চাচ্ছে। কোনোমতে ফাঁক গলে হাঁটারত মানুষগুলো গন্তব্য পেঁৗছানোর চেষ্টা করছে। ওই সুবর্ণসুন্দর গাড়িগুলোর মধ্যে বসে আছে আরও অধিকতর সুন্দর মানুষগুলো। ফিরতি গাড়িতে ওরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। কেন্দ্রমুখী গাড়ি থেকে পরীক্ষার্থীরা নেমে হাঁটা শুরু করেছে। অভিভাবকও নেমে পেছন পেছন হাঁটছেন। চালক নিচের দিকে তাকিয়ে গাড়ি নিয়ে সকলের পথ আটকে বসে থাকল। টেনে-হেঁচড়ে সবাই এগোচ্ছে, আমরাও এগোচ্ছি। যেন সবাই সমতল বেয়ে এভারেস্টে উঠছে। আমরা পেঁৗছে গেলাম। তখন সাড়ে ৯টা। একশ'-দেড়শ' মিটার পথ হাঁটতে লেগেছে ১৫ মিনিট। ও ভেতরে চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ বাধ্য হয়ে গেটে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কোনোমতে শরীর গলিয়ে পার হওয়া যায় এতটুকু জায়গা পরীক্ষার্থীদের প্রবেশের জন্য অবশিষ্ট থাকল, বাকি জায়গা উৎকণ্ঠিত অভিভাববৃন্দ এবং তাদের অনেকের ইজ্জতি গাড়িগুলো দখল করে রাখল। আমি এখানে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। প্রথমে পরিবারের একটু বর্ণনা দিয়েছি নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতে। হতদরিদ্র পরিবার থেকে এসেছি। কিন্তু ওই গাড়িগুলোর কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। গাড়িগুলো মাঝে মধ্যে আমাকে নির্বাক করে, নির্বোধ করে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments