দেশের দুই কোটি মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকিতেঃ আশ্বাস নয়, পদক্ষেপ চাই
পানির এই দেশে পানিই এখন সমস্যার কারণ হয়ে উঠেছে। শহরে পানির অভাবে মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত। পয়সা দিয়ে কিনে খাওয়া পানিও বিশুদ্ধ কিনা নিশ্চিত নয় কেউ। গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও মারাত্মক। সেখানে সেচের পানি দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় কৃষকের দুর্ভোগ বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক দূষণে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এখন খাদ্যশস্যেও আর্সেনিকের মাত্রা বেশি ধরা পড়ায় পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক বলা চলে। দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে আর্সেনিক দূষণ বৃদ্ধি পেলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তেমন গা করেনি। ফলে এখন বিপদ ঘাড়ে চেপে বসার উপক্রম হয়েছে। তারপরও বিষয়টি উপেক্ষা করার মানসিকতা সবাইকে হতবাক না করে পারে না। বিশ্ব পানি দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের প্রায় ২ কোটি মানুষের আর্সেনিক ঝুঁকিতে বসবাসের কথা বলা হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করা ছাড়াও এই পানিতে উত্পাদিত শস্যও আর্সেনিকদুষ্ট হয়ে পড়ার কথাও গবেষণা রিপোর্টে জানা গেছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল কর্তৃক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত জরিপ এবং সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে সেচ কাজে ব্যবহৃত পানিতে উচ্চমাত্রার আর্সেনিকের কারণে খাদ্যশস্যে দূষণের বিষয়টি প্রকাশ পায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে যেখানে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে ১৪০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক সহনীয়—সেখানে ফরিদপুর অঞ্চলে বোরো ধানের চালের ভাত খেলে সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়ে ১৫০ শতাংশ বেশি আর্সেনিক শরীরে প্রবেশ করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে এক কেজি মাটিতে ২০ মিলিগ্রাম আর্সেনিক থাকার কথা, সেখানে ফরিদপুরের কোনো কোনো অঞ্চলের মাটিতে ৮০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি খুবই ভয়াবহ। ফলে খাদ্যচক্রে আর্সেনিকের উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের প্রতিক্রিয়ায় জনস্বাস্থ্য খাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বলা হয়েছে প্রায় দুই হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। এ সবই জাতি হিসেবে আমাদের ভবিষ্যতকে বিপদাপন্ন করে তোলার জন্য যথেষ্ট, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
তবে সময় থাকতে এই বিপদ কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা নেয়াই আসল কথা। এক্ষেত্রে যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে। পানি দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত মন্ত্রীরা বিষয়টি নিয়ে আমাদের মোটেই নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। তাদের মুখে শুধু আশ্বাসের কথাই শোনা গেছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ঝুঁকিতে বসবাসকারী মানুষকে আর্সেনিকমুক্ত নিরাপদ পানি সরবরাহের নতুন পরিকল্পনা প্রণয়নের এখনই সময়, বলেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর্সেনিক আক্রান্তদের চিকিত্সা সেবায় সরকারের নানা পদক্ষেপ হাতে নেয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে কৃষিমন্ত্রী সবাইকে চমকে দিয়ে আর্সেনিক দূষণ সম্পর্কে গবেষকদের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে এ সম্পর্কে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ২০১১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে তার সরকার বদ্ধপরিকর। বিদ্যুত্, দ্রব্যমূল্যের মতো নানা বিষয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির পর মন্ত্রীদের এমন আশ্বাসে কেউ আর ভরসা রাখতে সাহস পায় না। আওয়ামী মহাজোট নেতাদের কথামত পা ফেলে এর মধ্যেই মানুষের মাথার চুল ছেঁড়ার উপক্রম হয়েছে। এক্ষণে বাস্তবতা স্বীকার করে আর্সেনিকের দ্রুত বিস্তার রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপই সবাই দেখতে চায়। অন্যথায় আসন্ন বিপদের হাত থেকে কেউই রেহাই পাবে না এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
No comments