আলবদর ১৯৭১ by মুনতাসীর মামুন

(পূর্ব প্রকাশের পর) বিভিন্ন সেক্টরে তাদের নাস্তানাবুদ করে দেয়া হয়েছিল। ভারতে এই ছিল আলবদরের কাছে সত্যিকার ঈদ আনন্দের বিশাল তবে উদাস দিবস।এই বর্ণনা ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হাম কদমে সঙ্কলিত।


১৯৭১ সালের অক্টোবরে ছাত্র সংঘের বা আলবদরদের একটি দল তাদের সুপার বস মওদুদীর সঙ্গে সাক্ষাত করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ নেয়ার জন্য। আলবদররা তাকে জানাল
‘মওলানা, আমরা ফিরে গিয়ে জেহাদের ময়দানে যাব। আপনার দোয়ার ছায়াতলে আমরা পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছব। সেখানে ভারত তার সৈন্যসামন্ত ও সহযোগীদের দিয়ে আলোচিত যুদ্ধ চাপিয়ে রেখেছে।
মওদুদী জানান, সুস্থ থাকলে তিনিও লড়াইয়ে থাকতেন। তিনি জানালেন
১. দুই পাকিস্তানকে ইসলামের বন্ধনই টিকিয়ে রাখতে পারত, কিন্তু শাসকরা সেদিকে মনোযোগ দেয়নি।
২. রাজনৈতিক দলগুলোই মাশাআল্লা বন্ধনকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের ঝা-াবাহী দু’দল মিথ্যা সব ওয়াদা করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।
৩. যতটুকু ঐক্য ছিল ইয়াহিয়া খানের ‘অন্ধ আর্মি এ্যাকশন’ তা নষ্ট করে দিয়েছে।
[তার এ মনোভাব গোলাম আযমদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। বরং গোলামরা মনে করতেন, আর্মি এ্যাকশন ছিল পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখার উপায়]।
৪. ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করবে। সোভিয়েত রাশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা তাতে সমর্থন যোগাবে।
[আমেরিকা সমর্থন যোগায়নি]
৫. আল্লাহ না করুন এ রকম পরিস্থিতি হলে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে।
৬. তা যদি না হয়, যে ক্ষতি হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের তা সামলাতে ৫০ বছর লাগবে। পরস্পরের আস্থায় আনতে সময় লাগবে।
এরপর মওদুদী যা বলেন তা প্রণিধানযোগ্য
“একটা কথা সব সময় মনে রাখবেন। সেনারা কারও ওপর বেশি দিন আস্থা রাখে না। তাদের স্বভাব হলো, বিপদ কাটিয়ে ওঠার পর সর্ব প্রথম সাহায্যকারীদের আক্রমণ করে।”
মওদুদী আরও বলেন
“আমার কাছে ইসলামী ছাত্রসংঘের ছেলেরা আমার ছেলের চাইতেও প্রিয়। ছাত্রসংঘের কোন কর্মীর শাহাদাতের খবর আমার ওপর অভিঘাতের সৃষ্টি করে। কিন্তু আপনারা ইকামতে দ্বীনের দায়িত্ব পালনের যে পথে এগিয়ে যাচ্ছেন সে পথে হিজরত ও শাহাদাত একটি মাইল ফলক। এ ধরনের আরজ এলে আজীমতের [অবিচলতা] পথ ত্যাগ করবেন না।”
শেষ রক্ষা হলো না। শের নিয়াজী বিল্লি নিয়াজীতে পরিণত হয়ে সঙ্গীসাথীদের নিয়ে রেসফোর্সের ময়দানে আত্মসমর্পণ করেÑ যেখানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানে আমাকে অনেকে বলেছেন, পাকিস্তান টিভিতে মাত্র ৩০ সেকেন্ডের জন্য আত্মসমর্পণের চিত্র দেখানো হয়েছিল। এটি দেখেই পাকিদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। দলে দলে লোক রাস্তায় নেমে আসে। ক্রোধে, ক্ষোভে, দুঃখে তারা তখন আত্মহারা। দিকে দিকে মাতম। হিন্দু ভারতের কাছে, কমজোর বাঙালীর কাছে ইসলামের রক্ষকরা হেরে গেল! এ ঘটনা তারা মেনে নিতে পারছিল না।
বাংলাদেশেও আলবদররা বিষয়টি মেনে নিতে পারছিল না। পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। তারাও ক্ষোভে, দুঃখে কাতর হয়ে গিয়েছিল। আত্মসমর্পণের ঠিক আগের কিছু বিবরণ দিয়েছেন মনসুর তার গ্রন্থেÑ

আমরা অস্ত্র সমর্পণ করছি ‘কর্নেল বললেন’
“আবু আতের (চিলাহাটি, রংপুর) বলেন, ৩ ডিসেম্বরের আগে এ রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ হচ্ছিল। কিন্তু যেদিন যুদ্ধের ঘোষণা হল, অন্যায়ভাবে এবং কোনরূপ সংঘর্ষ ছাড়াই পাকবাহিনী চিলাহাটি ছেড়ে চলে এলো আর তহসিল নীলফামারী থেকেও তাদের সৈন্যদের বের করে নিয়ে পশ্চাদপসরণ করে ১০ মাইল পেছনে কামারগঞ্জে গিয়ে শিবির স্থাপন করল। এসব কিছুই হঠাৎ করে এবং কোন শলাপরামর্শ ছাড়াই করা হয়। আগের নিয়মে রণাঙ্গনের দিকে আলবদর চার মাইল সামনে ছিল। যদিও আমাদের এই দলটি পাকবাহিনীর কমান্ডের অধীনেই ছিল।
নতুন পরিস্থিতিতে আলবদরের মতো পাকবাহিনীর তরুণ সৈনিকরাও খুবই চিন্তিত ও অসন্তুষ্ট ছিল। তারা এ কথা বুঝতে পারছিল না যে, বিনা কারণে নিজস্ব এলাকা ছেড়ে কেন চলে যাওয়া হচ্ছে। ভারতীয় সৈন্য পাকিস্তান এলাকায় প্রবেশ করছিল। তাদের প্রথম লাইনের মোকাবেলা আলবদর দুই দিন ধরে বাঙ্কারের মাধ্যমে করছিল। আলবদরের কাছে শুধুমাত্র স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ছিল। যুদ্ধের প্রচ-তা বৃদ্ধি পেলে পাক আর্মি অনেক পেছনে থেকে কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করে। আর আলবদরকে পেছনে সরে আসার বার্তা পাঠায়। আমরা পেছনে সরে এসে দোসার থানায় চলে এলাম। এরই ফাঁকে রণাঙ্গনে নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল।
৭ দিন পর্যন্ত আমাদের মাঝে কোন যুদ্ধ হয়নি। শুধু ভারতীয় হেলিকপ্টার মাঝে মাঝে চক্কর দিয়ে চলে যেত। আমাদের রাইফেল তাদের কিছুই করতে পারেনি। আমরা তখনও পাক আর্মির চেয়ে তিন মাইল সামনে খানসামা নামক স্থানে মোর্চা করে রেখেছিলাম।
অষ্টম দিন ভারতীয় বাহিনী হেলিকপ্টার ও ট্যাঙ্কের সাহায্যে আলবদরের মোর্চা (বাঙ্কার) গুলোর ওপর হামলা চালায়। তখন আলবদর ক্যাম্পে মাত্র ৯৫ জন ক্যাডেট ছিল। এক ঘণ্টা পর্যন্ত ঘোরতর যুদ্ধ চলছিল। গাছের জঙ্গলের কারণে দুশমন আমাদের শক্তির সঠিক আন্দাজ করতে পারেনি। তারা সামনে আসতে ইতস্তত করছিল।
আমাদের পেছন থেকে পাক আর্মি ট্যাঙ্কের গোলাবর্ষণ শুরু করে। ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, যা ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত ছিল। আর ভারতীয় বাহিনী নতুন করে ফোর্স আসা সত্ত্বেও পশ্চাদপসরণ করে। কিন্তু পাক আর্মি এডভান্স করেনি। তবে সাপ্লাই লাইন ঠিক রাখে এবং আমাদের কাছে নতুন অস্ত্র সরবরাহ করা হয়।
এই পরিস্থিতিতে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সিপাহী বেশারত বড় দুঃসাহস নিয়ে লড়াই করে। তিনি চায়না এন্টি ট্যাঙ্ক গানের সাহায্যে দুশমনের দুটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেন। কিন্তু আরেকটি ট্যাঙ্কের গোলার আঘাতে তিনি শহীদ হয়ে যান। তার সঙ্গে ৩ জন রাজাকার ও ৭ জন আলবদর শহীদ হয়ে যান। পরের দিন ১২টার সময় পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। তখন পাক আর্মি অন্যায়ভাবে পশ্চাদপসরণ করে। তারা ৭ মাইল পেছনে সরে আসে।
আলবদর ৪ মাইল সামনে ভারতীয় বাহিনীর সামনাসামনি ছিল। পাক বাহিনীর আর্মি আরও পেছনে সরে এসে দরওয়ানি রেলওয়ে স্টেশনে শিবির স্থাপন করে। পরের দিন কর্নেল সাহেব আলবদর কমান্ডারকে ডেকে বললেন, এখন আপনারা নিজেদের বাঁচার ব্যবস্থা নিজেরা করুন। আমরা অস্ত্র সমর্পণ করছি।
এ কথা বলেই কোন জবাবের অপেক্ষা না করেই তিনি একটি জীপের ওপর সাদা পতাকা উড়িয়ে দুশমনের সারির দিকে চলে গেলেন।
এবার পাকবাহিনী ছিল সামনে আর আলবদর পেছনে। পাক আর্মির অফিসাররা হেলিকপ্টারের সাহায্যে ঢাকা রওনা হয়ে গেল। আমরা আলবদররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম অথবা দেশত্যাগ করলাম।

তোমরা চৌদ্দশ’ বছরের ইতিহাসের গাদ্দার
ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম (চট্টগ্রাম) বলেন যে, ১৬ ডিসেম্বর সকালে আমি আলবদর ক্যাডেট সলিমুল্লাহকে বললাম যে, পাকিস্তানী বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করছে। সে তখন তা মানতে অস্বীকার করে এবং একে ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু আমি যখন তাকে বললাম যে, এটি ঠাট্টা নয়, সত্যি। তখন তার ওপর কিয়ামত কা- ঘটে গেল। তার চোখ দুটি যেন ফেটে পড়ল এবং দুঃখের প্রচ-তায় ঢলে পড়ছিল। আমি তাকে ধরলে সে আমার মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে রইল। আমি তাকে বললাম যে, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত সেনারা এটা চাচ্ছিল না, কিন্তু তাদেরকে এ কাজ করার হুকুম দেয়া হয়েছে।
এ কথা শুনে সে দাঁড়িয়েছে গেল। রাগে তার চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল। সে বলল, ‘এ হুকুম কে দিয়েছে?’ আমি বললাম, ‘খুব সম্ভব ইয়াহিয়া খানের হুকুম।’
সলিমুল্লাহ গর্জে উঠলেন, “ওহে ইয়াহিয়া খানের হুকুম মান্যকারীরা! তোমাদের কী কায়েদে আজমের এই হুকুম মনে নেই যে, কখনও যদি পাকিস্তানের হেফাজতের জন্য লড়াই করতে হয়, ময়দানে লড়বে, সমুদ্রে লড়বে, শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়বে, কোন অবস্থাতেই দুশমনের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করবে না।’
আমি নীরব ছিলাম, আর সলিমুল্লাহর আবেগ-আশ্রিত গর্জন অব্যাহত ছিল।
‘হে জালেমরা! দুশমনের সামনে অস্ত্র সমর্পণকারীরা! তোমরা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিভাবে মুখ দেখাবে?’
সলিমুল্লাহ ফিরে যাবার জন্য ঘুরলে আমি তাকে বারণ করতে গিয়ে আস্তে করে বললাম, ‘এখন সেখানে ফৌজ অস্ত্র সমর্পণ করছে। এ সময় আলবদর সেখানে লড়াই করতে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কাজেই এখন উচিত হবে যে, আপনি...’
আমি এটুকুই বলেছি, তিনি আমাকে জোরে বলছেন যে, ‘বাঘের একদিনের জীবন গ-ারের একশ’ বছরের বেঁচে থাকার চাইতে উত্তম।’ তারপর সে সবেগে বাইরে চলে গেল। আজ আমার জানা নেই যে, সে এখন কোন অবস্থায় আছে।

আসামের জঙ্গল হতে গেরিলা যুদ্ধের প্রোগ্রাম
আহমদুর রহমান (খুলনা) তার এলাকার অবস্থা সম্পর্কে জানান যে, ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় ফৌজ যশোরকে পদানত করে খুলনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। যশোর থেকে পাক আর্মির একটি বড় অংশ খুলনা এসে গিয়েছিল। কিন্তু খুলনা থেকে সমুদ্র পথ ছাড়া অন্য কোন রাস্তা ছিল না।
যশোর থেকে আসা আলবদর সাথীরা বললেন যে, ঘোরতর যুদ্ধ হচ্ছিল, আমরা সবাই আগের নিয়মে সম্মুখ-বাঙ্কারে ছিলাম। তখন পেছন থেকে কোন ফৌজি অর্ডার আসার কারণে অথবা কোন কৌশলগত কারণে আমাদের না জানিয়েই পাকিস্তানী বাহিনী আস্তে আস্তে যশোর ছেড়ে দেয়। আমাদের অধিকাংশ সাথী বাঙ্কারের মধ্যেই নির্যাতনের শিকার হয়েই পিষ্ট হয়েছেন। তাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন প্রাণ রক্ষা করতে সক্ষম হয়, যারা চুপে চুপে খুলনা চলে এসেছে।
এ অবস্থা জানতে পেরে আমরা ভীষণ কষ্ট পেলাম। কিন্তু যুদ্ধ তো দুঃখকষ্ট সহ্য করার জন্যই। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের কাছে অস্ত্র সমর্পণের সিগন্যাল আসে। কিন্তু আমাদের কমান্ডার বি. মুহাম্মদ হায়াত খান এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। এতদসত্ত্বেও তিনি আমাদের জানিয়ে দিলেন যে, পরিস্থিতি ঘোলাটে। ‘আপনারা চাইলে আমাদের সাথে যেতে পারেন। অন্যথায় নিজেদের ঠিকানা ঠিক করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর।’
একটু পরেই বৈঠক হলো, যেখানে ১১ জন রোকন উপস্থিত হলেন। তাদের মধ্যে ৯ জন ছিলেন খুলনার, আর দু’জন যশোরের। প্রথম প্রস্তাব ছিল লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে যাব। দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল নিজেদের শক্তি ধরে রাখা হোক। যাতে ইসলামী আন্দোলনের কাজ অব্যাহত রাখা যায়। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি সংখ্যাগরিষ্ঠের মত অনুযায়ী পাস হয়ে যায়। এরপর আমরা সাথীদেরকে প্রয়োজন অনুসারে টাকা-পয়সা সরবরাহ করলাম। আর তাদের বললাম যে, ‘আপনারা যেখানে ইচ্ছা আত্মগোপন করুন।’ এরপর আমরা জোর করে আমাদের কর্মীদের খুলনাছাড়া করি। কিন্তু একই সাথে এই স্কিম নিয়েও চিন্তা-ভাবনা অব্যাহত রাখলাম যে, আসামের জঙ্গলে আত্মগোপন করে দীর্ঘদিন যাবত ভারতীয় বাহিনীর নাকে দম দেয়া যাবে।
এ কথাটির ওপর আলোচনা চলছিল। এ সময় পাকিস্তান আর্মির দু’জন মেজর তৎক্ষণাৎ এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমরাও আপনাদের সাথে যাব।’ এরপর সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে খোরাকী, ওষুধপত্র, হালকা অস্ত্র ও হাতবোমার একটি তালিকা তৈরি করা হলোা। তারপর ১শ’ প্রাণ উৎসর্গ সাথীদেরও বাছাই করা হলো। যারা স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে মজবুত ছিলেন। কিন্তু যথাসময়ে সেই পরিকল্পনা রহিত করা হয়।
৭ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় ভারতীয় বাহিনী খুলনায় প্রবেশ করে। কিন্তু তখনও পাকিস্তানী অফিসাররা অস্ত্র সমর্পণের ব্যাপারে ইতস্তত করছিলেন। কিন্তু তা কতক্ষণ পর্যন্ত?

আপনারা যুদ্ধ করতে না চাইলে বাঙ্কার আমাদের কাছে দিয়ে দেন
আব্দুস সালাম (রাজশাহী) বলেন যে, রাজশাহীতে ৯ ডিসেম্বর আর্মি সারেন্ডার করে। ১৮ ডিসেম্বর আমরা রাজশাহী থেকে তিন মাইল দূরে নাটোর ব্রি. হেড কোয়ার্টার চলে গিয়েছিলাম। প্রায় ৮ জন আমার সঙ্গে ছিল। এরা সবাই নর্থ বেঙ্গলের বিভিন্ন এলাকা হতে এসেছিল। তাদের মধ্যে রাজশাহীরও ৩ জন সাথী ছিল।
পাবনা ও বগুড়া জেলা ৮ ডিসেম্বরের আগেই আর্মি ছেড়ে দিয়েছিল। সেখান থেকেও আমাদের বাছাই করা কর্মী ও আলবদরের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত মুজাহিদরা নাটোর পৌঁছে। এটি ছিল নর্থ বেঙ্গলের ব্রি. হেড কোয়ার্টার। নাটোরে আমরা ৮ জন আলবদর ছিলামÑ আব্দুল কাউয়ুম, ফারুকুর রহমান, গোলাম আলী মিয়া, আবুল হাশেম, আজীজুদ্দীন, আবদুল জব্বার, কুরবান, আসগর ও আমি।
যশোর ৬ ডিসেম্বর আমদের হাতছাড়া হয়েছিল। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার পতন পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী ও ইন্ডিয়ান আর্মি রাজশাহী শহরের ওপর কোন হামলা করেনি। ঢাকার পতনের পর আমরা আর্মির কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, ‘আপনারা তো অস্ত্র সমর্পণ করবেন না।’ তখন তারা বলতেন যে, ‘প্রশ্নই ওঠে না’। যেহেতু আমাদের পূর্ণ আস্থা ছিল যে, রাজশাহী সংরক্ষিত থাকবে। সেখানকার রেডিও স্টেশনও আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আমরা ফৌজকে বলে রেখেছিলাম যে, ‘যদি আপনারা লড়াই করতে না চান তাহলে বাঙ্কার আমাদের কাছে ছেড়ে দেবেন।’
১৮ ডিসেম্বর কমান্ডার বললেন যে, আমরা আর্মিকে নাটোরে শিফ্ট করছি। তারা ওই সময়ও আমাদের বলেননি যে, তারা সারেন্ডার করতে যাচ্ছেন। আমরা এটাকে সাময়িক কৌশল মনে করে তাদের সঙ্গে নাটোরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১, সকাল বেলা আমরা দেখলাম যে, ছাউনির চারদিকে ভারতীয় ফৌজ ও মুক্তি বাহিনী পজিশন নিয়ে রেখেছে। এ সময় ভারতীয় কর্নেল সাহেব বললেন যে, ‘আমরা যে পাঁচজন লোক আছি, আমরা কোথায় যাব?’ ‘এটাই উচিত যে, একটি সামরিক সংগঠনের অন্তর্ভক্ত হিসেবে আমাদেরকেও সেনাবাহিনীর সাথে রাখুন।’ কিন্তু ভারতীয় সেনারা বললেন যে, আমরা কোন বাঙালী রাজাকারকে এরেস্ট করব না, তাদের বিষয় মুক্তিবাহিনীই ফয়সালা করবে। মোটকথা, সকাল সাড়ে ৮টার সময় যথারীতি অস্ত্র সমর্পণ করা হয়। আর আমরা তা দেখতে থাকলাম। মনে হচ্ছিল যে, সমগ্র দুনিয়ার শয়তান যেন আমদেরকে দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল।

আপনারা চাইলে আমাকে মেরে ফেলুন
আবু নসর ফারুকীর (ঢাকা) বর্ণনা মোতাবেক ধানমণ্ডি ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন শাহেদ ভাই। ১৫ ডিসেম্বর রাতে খাজা খায়রুদ্দীন সাহেবের ফোন এল যে, ‘পাক ফৌজ সারেন্ডার করছে, আপনার চিন্তা কী?’
শাহেদ ভাই জবাব দিলেন, ‘ফৌজ সারেন্ডার করতে পারে, কিন্তু শাহেদ অস্ত্র সমর্পণ করবে না।’ ফোনের মাধ্যমে এটিই ছিল আমদের সর্বশেষ যোগাযোগ। এরপর ভারতের গেরিলা ব্রিগেড ফোনের সকল তার কেটে দেয়। আমরা তৎক্ষণাৎ দুটি গাড়ি প্রস্তুত করি। এগুলোর উপর লাউড স্পীকার বসিয়ে লোকদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য শহরে টহল শুরু করে দিলাম। আমরা তকবির ধ্বনি দিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে ছোট ছোট বক্তব্য দিয়ে লোকজনকে নিশ্চয়তা দিচ্ছিলাম যে, আমরা দুশমনকে নাস্তানুবদ করে ছাড়ব।
বিভিন্ন স্থানে লোকেরা আমাদের সেøাগানের জবাব এ ধরনের আবেগ ও জোশ নিয়ে প্রদান করে। আমরা রাত আড়াইটা পর্যন্ত শহরের প্রায় বড় বড় সড়ক প্রদক্ষিণ করি। অবশেষে মুহাম্মাদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে পৌঁছলাম, যেখানে আল বদরের সাথীরা একত্রিত হয়েছিল। এখানে আমরা একটি গ্রুপ গঠন করলাম। যেই গ্রুপকে জমিয়তের (সংঘ) দফতর ১৫ পুরানা পল্টনে খুররম মাহমুদের বাড়ি ও আলবদর এজুকেশন সেন্টারে নিয়ে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার দায়িত্ব দিলাম। ঐ লোকেরা চলে গেল। অন্য সাথীদেরকে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিলাম। এ কাজ থেকে অবসর হয়ে আমি পুনরায় মুহাম্মদপুর পৌঁছলাম। সেখানে অবস্থা বলার মতো ছিল না। রাত বিনিদ্রায় কাটল। না ফৌজ না ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ হলো। আর না বোঝা গেল যে, লোকজন কি চিন্তা করছে। দ্বিতীয় দিন আমরা যৎকিঞ্চিৎ নাশতা বিতরণ করেছিলাম। এ সময় রোকন ভাই এফ.এম কামাল এলেন। আর বললেন, মুস্তাফা শওকত ইমরান দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছেন। তার কাছ থেকে এটাও জানা গেল যে, যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেছে। এটা ছিল আমাদের জন্য ১৬ ডিসেম্বরের অলক্ষুণে সংবাদ।
কিছুক্ষণ পর সাদা পোশাকে আবৃত পাক বাহিনীর একজন মেজর এলেন। তিনি বললেন যে, ‘সারেন্ডার হয়ে গেছে, আপনারা যেখানে ভাল মনে করেন সেখানে চলে যান।’ আমাদের সাথীদের এই দুর্ঘটনা বিশ্বাসই হচ্ছিল না। কয়েকজন জোশওয়ালা সঙ্গী ক্ষেপে উঠলেন। তখন ফৌজি অফিসার বললেন যে, ‘আপনারা চাইলে আমাকে মেরে ফেলতে পারেন, কিন্তু আমি তো হুকুম তামিল করতে গিয়ে আপনাদেরকে অস্ত্র সমর্পণ ও জান বাঁচানোর পরামর্শ দিতে এসেছি।’
ঐ সময়ে আমাদের মধ্যে যে আবেগ তরঙ্গায়িত ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দুশমন তার লোকলস্কর নিয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে এসে পৌঁছল, তখনও পর্যন্ত ঢাকায় প্রবেশ করেনি।
এ রকম অনেক বর্ণনা আছে। আমি আর বিস্তৃত করব না। শুধু সবশেষে চিফ জল্লাদ আশরাফুজ্জামানে বিবরণটি উদ্ধৃত করছি। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.