শ্রদ্ধাঞ্জলি- দেশব্রতী নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী by সুমনকুমার দাশ

সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে কয়েক শ মানুষ। প্রত্যেকের হাতে নানা রঙের ফুলের তোড়া। একসময় ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় প্রতিকৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া এক ছাত্রী গেয়ে ওঠেন, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’। এভাবেই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় গতকাল বুধবার (২৯ আগস্ট) দেশব্রতী নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামীর ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছে


সিলেটবাসী। ১৯৯৩ সালের এই দিনে সিলেটবাসীকে কাঁদিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন না-ফেরার দেশে।
তাঁর প্রয়াণের পর থেকে প্রতিবছর নিয়মিতভাবে সিলেট নগরের চালিবন্দর এলাকায় তাঁরই প্রতিষ্ঠিত উমেশচন্দ্র-নির্মলাবালা ছাত্রাবাসে শোকাহত সিলেটের মানুষ তাঁর স্মরণে আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। প্রতিবারের মতো এবারের স্মরণসভায়ও বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যাংক-কর্মকর্তা, আইনজীবী, সাহিত্য-সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ অংশ নেয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, ‘মৃত্যুর অল্প সময়ের মধ্যেই নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী এখন সিলেটবাসীর কাছে বিস্মৃতপ্রায় একটি নামে পরিণত হতে চলেছেন। এ রকম গুণী মানুষকে সঠিক মূল্যায়ন করতে না পারাটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আগামী প্রজন্মের সঠিক বেড়ে ওঠার স্বার্থেই তাঁর জীবন ও কর্মকে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।’
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা আজীবন দেশব্রতী নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামীর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের প্রধান কবি প্রয়াত শামসুর রাহমান স্মৃতিচারণা করে লিখেছিলেন, ‘নিঃস্বার্থ কর্মযোগী ছিলেন নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী। এই বিশিষ্ট সমাজসেবক সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামে। তিনি গান্ধীবাদকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। এই আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটি, যতদূর তাঁকে বুঝতে পেরেছি, মানুষকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছিলেন।’
শামসুর রাহমান আরও লিখেছিলেন, ‘১৯৭৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীনতাসংগ্রামে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তাঁকে লালকেল্লায় সংবর্ধিত করেন। তখন ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে ভারতে থাকতে অনুরোধ জানান। এই অনুরোধে কৃপা কিংবা করুণার নামগন্ধ ছিল না, বরং ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের একজন অগ্রসৈনিককে মর্যাদাদানের আগ্রহ এবং সদিচ্ছা। কিন্তু নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী ভারতে বসবাস করার তাগিদ বোধ করেননি, জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সিলেটেই থাকবেন বলে নিজের কাছেই যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। সিলেটবাসীর কাছে তিনি বিবেচিত হবেন একটি জীবন্ত ইতিহাস হিসেবে।’
সিলেটের বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী ছিলেন পরিচিত মুখ। তাঁর সোচ্চার ও বলিষ্ঠ কণ্ঠ বিপ্লবী মানুষের চেতনায় প্রবল দৃঢ়তা নিয়ে আসত। তাঁর উদ্যোগ ও অনুপ্রেরণায় সিলেট অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তিনি নিজেও পরিচালনা করেছেন সমাজসেবামূলক একাধিক সেবাসদন এবং আশ্রম। তাঁর সমাজসেবা নিয়ে কবি বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন, ‘নিরাশ্রয় অসহায় অনাথজনের আশ্রয়দাতা, সাহায্যকারী, সাহসদাতা, এই সৌম্য, শান্ত, স্বল্পবাক মানুষটা নীরবে দৃঢ়প্রত্যয়ে সামান্য সম্বল নিয়ে বিরাট কর্মভার বহন করে গিয়েছেন। তাই তাঁকে শ্রদ্ধা না করে থাকা যায় না।’
সিলেটসহ বাংলাদেশে যখনই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে, তখনই তিনি আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গরিব মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নৈশ বিদ্যালয় ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনসহ দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার ও সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন জনহিতকর কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের এই সক্রিয় কর্মী অন্তত বিশবার কারাভোগ করেছেন। নীতির প্রশ্নে ছিলেন অবিচল। অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনের আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হননি।
অবিভক্ত ভারতবর্ষে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনার সময় মহাত্মা গান্ধী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু, সর্দার প্যাটেল, চিত্তরঞ্জন দাশ, ধীরেন দত্ত, বীরেন গুহ, পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত, ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে বহু গুণী মানুষের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৬ সালে নোয়াখালীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দুর্গত ব্যক্তিদের সেবাকার্য পরিচালনা করেন এবং মহাত্মা গান্ধীর শান্তি মিশনে যোগদান করেন। সিলেটের নিপীড়িত চা-শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে তাঁদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
কর্মযোগী নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী ১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে মৌলভীবাজার জেলার কালাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা পণ্ডিত নদীয়া চাঁদ গোস্বামী। ছাত্র অবস্থায় সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক জনশক্তি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সিলেটের সাংবাদিকতা অঙ্গনেও তাঁর সুনাম ছিল সুবিদিত। সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে তাঁর লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ রয়েছে। ১৯৬২ সালে সিলেট নগরের চালিবন্দর এলাকায় গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন উমেশচন্দ্র-নির্মলাবালা ছাত্রাবাস। সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এ ছাত্রাবাসের আবাসিক হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে।
চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতা বিনোদ বিহারী চৌধুরী তাঁর বন্ধু নিকুঞ্জবিহারীর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে এক লেখায় লিখেছিলেন, ‘তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী, তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি আপামর জনসাধারণের হূদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। তাঁর অকৃত্রিম স্বদেশানুরাগ ও ঐকান্তিক ও নিঃস্বার্থ মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন।’ তাঁর মতো আমরাও বলি—নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামীর মৃত্যু নেই। তিনি সিলেটবাসীর স্মৃতিতে চির অমর। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
সুমনকুমার দাশ
সিলেট প্রতিনিধি

No comments

Powered by Blogger.