নগর উন্নয়ন-ভিয়েনা কেন শ্রেষ্ঠ শহর by শাহনেওয়াজ বিপ্লব
পুলিশের চাকরি অস্ট্রিয়ায় সবচেয়ে সম্মানিত। স্কুল-কলেজগুলোতে শৈশব থেকেই ছেলেমেয়েদের স্বপ্নের চাকরি হচ্ছে পুলিশ। গত বছর জনমত জরিপে অস্ট্রিয়ার পুলিশ ১ নম্বরে, বিচার বিভাগ ২ নম্বরে. রাজনীতিকরা ৩ নম্বরে স্থান পেয়েছেন।
দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের বিবদমান কোনো পক্ষ থেকে অথবা সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে ১ গ্গ্নাস পানি পান করাও দণ্ডনীয় অপরাধ; চা, কফি পান অথবা টাকা-পয়সা নেওয়া তো দূরের কথা। আইন এখানে গরিব-ধনী সবার জন্য সমান
মানুষের কাছে স্বর্গের ধারণাটি কী রকম? প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাহিত্য ও চিত্রকলায় মানুষ তার কল্পনায় যতখানি স্বর্গের ছবি আঁকতে পেরেছে তা ঠিক এ রকম :স্বর্গ হবে মনোরম, সি্নগ্ধ, সাজানো-গোছানো আর ছিমছাম। সেই পরিবেশটাই অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে খুঁজে পেয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত লিভিং স্ট্যান্ডার্ড নির্ণায়ক ব্রিটেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট। তাদের জরিপে ভিয়েনা পৃথিবীতে বসবাসের জন্য দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ শহর নির্বাচিত হয়েছে। এক নম্বরে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। আর তৃতীয় স্থানে রয়েছে কানাডার ভ্যাংকুভার। এ ছাড়া প্রথম ১০টি শহরের মধ্যে রয়েছে কানাডার টরন্টো, কানাডার ক্যালগারি, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড, সিডনি, ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি, অস্ট্রেলিয়ার পার্থ ও নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড।
আর বিশ্বে বসবাসের উপযোগিতা বিবেচনায় সবচেয়ে অযোগ্য শহর হয়েছে ঢাকা। নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্য সুবিধা, গণপরিবহন, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামোসহ ৩০টি মানদণ্ড বিবেচনায় ১৪০টি শহর নিয়ে চালানো জরিপে ঢাকা শহরের অবস্থান সর্বনিম্নে।
এ প্রতিষ্ঠানের গত বছরের জরিপ অনুযায়ী ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৯তম। সেবার ১৪০তম হয়েছিল জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারে। হারারে এবারও শেষ ১০টি শহরের মধ্যে আছে। নিচের দিকের ১০টি শহরের মধ্যে ঢাকা ছাড়াও রয়েছে নাইজেরিয়ার লাগোস, জিম্বাবুয়ের হারারে, আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, পাকিস্তানের করাচি, লিবিয়ার ত্রিপোলি আর ইরানের তেহরান।
জরিপে বলা হয়েছে, ভিয়েনায় রয়েছে সুসজ্জিত সব ভবন আর পার্ক। গণপরিবহন ছাড়াও সাইকেলের প্রভূত ব্যবহার শহরে প্রতিদিনের পরিবহনের খরচ সম্প্র্রতি ১ ইউরোতে নিয়ে এসেছে নগর কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া ১৭ লাখ বাসিন্দার এ শহরে গুরুতর অপরাধের ঘটনা বিরল।
ভিয়েনা লোয়ার অস্ট্রিয়া প্রদেশে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম উভয় দিকে ৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট সুন্দর, ছবির মতো সাজানো গোছানো একটি শহর। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতেই ভিয়েনার গোড়াপত্তন হয়। তবে ভিয়েনার আধুনিক নগর যাত্রার শুরু ৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে। এর বয়স ১ হাজার বছরের বেশি হলেও এখনও এটি যেন চিরনতুন এক শহর। ভিয়েনা মোট ২৩টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। এক একটি প্রশাসনিক অঞ্চল বাংলাদেশের এক একটি ইউনিয়ন পরিষদের মতো পরিসরের। কোনো কোনোটি এর চেয়েও ছোট। এ প্রশাসনিক অঞ্চলগুলো করা হয়েছে ঠিক এভাবে, যেন যে কোনো সমস্যায় ৫ মিনিটের ভেতর পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড অথবা জরুরি বিভাগে কর্মরত ডাক্তাররা ওই এলাকায় যেতে পারেন।
প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলের কাউন্সিলর ও ভিয়েনার মেয়র জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও কার্যত ভিয়েনার পুরো প্রশাসন পরিচালনা করেন সরকার নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট। এসব প্রশাসনিক অঞ্চলে ঠিক কত লোক বাস করছে, তার সঠিক হিসাব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রয়েছে। কেউ বাসা পরিবর্তন, অন্য প্রদেশে বসবাস অথবা দেশান্তরী হতে চাইলে ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতেই হবে।
কারও সন্তানের কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার বয়স হলে ম্যাজিস্ট্রেটরাই চিঠি দিয়ে জানান, প্রশাসনিক অঞ্চলের কোন কিন্ডারগার্টেনে ছেলে বা মেয়েকে ভর্তি করাবেন। কিন্ডারগার্টেন থেকে প্রাইমারি স্কুল হয়ে হাই স্কুল পর্যন্ত শিশুদের পড়াশোনার ব্যাপারটা মা-বাবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটরাই অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করেন।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিস্ময়কর এক অগ্রগতি সাধন করেছে। ভিয়েনায় চলাচলকারী বাস, ট্রেন, ট্রাম এবং আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো রেল_ সবই সরকারি। ৩০ ইউরো দিয়ে একটি যাতায়াত কার্ড কেনার পর জনগণ সারা মাস ভিয়েনার যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাতায়াত করতে পারে। ভিয়েনার যে কোনো প্রান্তে যাতায়াতের জন্য ৫ মিনিট পরপর বাস, ট্রেন, ট্রাম ও মেট্রোর ব্যবস্থা রয়েছে। এসব পরিবহনে সাধারণত টিকিট চেকিং হয় না। জনগণ নিজ দায়িত্বেই টিকিট কেটে থাকেন। ভিয়েনায় রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড-১, আন্ডারগ্রাউন্ড-২ এবং আন্ডারগ্রাউন্ড-৩ মেট্রো রেল, যার মাধ্যমে পুরো শহরকে অতি অল্প সময়ে যানজটহীন দ্রুত যাতায়াতের এক শ্রেষ্ঠ শহরে পরিণত করেছে।
এবার আসি নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথায়। অস্ট্রিয়ায় গুরুতর অপরাধ অথবা খুনোখুনির ঘটনা বলা চলে একেবারেই বিরল। অন্যভাবে বলা যায়, অস্ট্রিয়া একটি পুলিশি রাষ্ট্র। পুলিশ কঠোর হস্তে এখানে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে। রয়েছে ওয়াটার পুলিশ, যারা ভিয়েনার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত দানিয়ুব নদীতে টহল দিচ্ছে প্রতিদিন। রয়েছে আকাশ থেকে হেলিকপ্টারযোগে শক্তিশালী ক্যামেরা দিয়ে নিরাপত্তা তল্লাশি। এ ছাড়া ভিয়েনার ওয়াটার পুলিশ কর্তৃক সপ্তাহে একবার ডুবুরি দিয়ে দানিয়ুব নদীর তলদেশ তল্লাশির ব্যবস্থা রয়েছে। ভিয়েনায় যে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় পুলিশকে ৩ থেকে ৫ মিনিটের ভেতর হাজির হতেই হবে। না পারলে রয়েছে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা। দ্রুততম সময়ের ভেতর উপস্থিত হওয়ার জন্য ভিয়েনার প্রতিটি পাড়ায় রয়েছে একটি থানা। সেসব থানা কর্তৃর্ক রয়েছে সার্বক্ষণিক টহলের ব্যবস্থা। পুলিশের জন্য রয়েছে সার্বক্ষণিক মানসিক ডাক্তার, যাদের কাজ হচ্ছে পুলিশদের চাঙ্গা রাখা, যাতে কোনো ব্যর্থতায় অথবা অসফল অপারেশনের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে না যায়।
পুলিশের চাকরি অস্ট্রিয়ায় সবচেয়ে সম্মানিত। স্কুল-কলেজগুলোতে শৈশব থেকেই ছেলেমেয়েদের স্বপ্নের চাকরি হচ্ছে পুলিশ। গত বছর জনমত জরিপে অস্ট্রিয়ার পুলিশ ১ নম্বরে, বিচার বিভাগ ২ নম্বরে. রাজনীতিকরা ৩ নম্বরে স্থান পেয়েছেন।
দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের বিবদমান কোনো পক্ষ থেকে অথবা সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে ১ গ্গ্নাস পানি পান করাও দণ্ডনীয় অপরাধ; চা, কফি পান অথবা টাকা-পয়সা নেওয়া তো দূরের কথা। আইন এখানে গরিব-ধনী সবার জন্য সমান।
দায়িত্ব পালন ব্যতিরেকেও পুলিশ তার অবসরে অথবা ছুটির সময়ে কারও কাছ থেকে কোনো সুবিধা নিতে পারবে না। পুলিশের কনস্টেবল থেকে অফিসার সবার বেতন ১৫০০ থেকে ২০০০ ইউরোতে বাঁধা। পুলিশ এখানে বেতনের বাইরে এক কানাকড়িরও প্রত্যাশা করতে পারে না।
পুলিশি নিরাপত্তার বাইরে ভিয়েনায় রয়েছে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা। প্রতিটি হাসপাতাল সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে চলেছে রোগীদের।
সব হাসপাতালে রয়েছে সর্বাধুনিক হেলিকপ্টার অ্যাম্বুলেন্স। ভিয়েনার যে কোনো স্থানে যে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় ৫ মিনিটের ভেতর রোগীর কাছে ডাক্তারকে পেঁৗছাতেই হবে। না হলে জরুরি বিভাগ এবং দুর্ঘটনা বিভাগের ডাক্তার ও নার্সদের রয়েছে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা।
ভিয়েনায় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অথবা ডায়াগনোসিসের জন্য ডাক্তারদের কোনো ফি দিতে হয় না জনগণকে। ফার্মেসি থেকেও ওষুধ কিনতে হয় না নিজের খরচে। রাষ্ট্র এখানে স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করেছে।
যে কারণেই হোক; ভিয়েনায় ডাক্তাররা রোগী অথবা রোগীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা অসংযত আচরণ করতে পারবে না। ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার আগে রোগীর কেস হিস্ট্রি অথবা চিকিৎসা-ইতিহাস শুনতে হবে ডাক্তারকে নিরুদ্বিগ্ন হয়ে।
এমনকি চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা ডাক্তারের চিকিৎসার মান নিয়ে সরাসরি অসন্তুষ্ট রোগীকে জিজ্ঞেস করতে হবে, সে অন্য কোনো ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে আগ্রহী কি-না। তাছাড়া সিরিয়াল দেওয়া রোগীদের নির্ধারিত সময়ের দশ থেকে পনের মিনিটের বাইরে বসিয়ে রাখা হয় না।
ভিয়েনায় বেশিরভাগ ডাক্তারই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না। দু'একজন করলেও রোগীরা ব্যবস্থাপত্র নেয় না ওসব ডাক্তারের। ফলে সরকারি চাকরিতেই ফিরে আসতে হয় ডাক্তারদের শেষ পর্যন্ত। একজন ডাক্তার তৈরি করতে সাধারণ জনগণের বিপুল অঙ্কের করের টাকা ব্যয় হয় বলে ওখানকার ডাক্তাররা সনদ অর্জন শেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতেই ফিরে আসেন চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য। আমাদের দেশের মতো ক্লিনিক ব্যবস্থা ভিয়েনায় নেই। ধনী-গরিব সবার জন্যই সমান সুবিধা নিয়েই সদা উন্মুক্ত সরকারি হাসপাতাল।
এ ছাড়া ভিয়েনায় নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে ফায়ার ব্রিগেড। সড়ক দুর্ঘটনা অথবা অগি্নকাণ্ডস্থলে ৫ মিনিটের ভেতর ফায়ার ব্রিগেড কর্মীদের পেঁৗছাতেই হবে। না হলে রয়েছে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা। তবে ভিয়েনায় বাড়িঘরে সাধারণত আগুন লাগে না। কারণ প্রতিটি পাড়ায় রয়েছে ফায়ার ব্রিগেড এবং সেসব ফায়ার ব্রিগেডে রয়েছে প্রতিটি বাড়ি বা দোকানের নম্বরধারী অগি্ননির্বাপণ সফটওয়্যার। কোথাও আগুন লাগার আশঙ্কা থাকলে ফায়ার ব্রিগেড স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানতে পারে ইলেকট্রনিক সংকেতের মাধ্যমে। জনগণকে ফোন করে ফায়ার ব্রিগেডে খবর দেওয়ার দরকার হয় না।
সর্বক্ষেত্রেই এমন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে ভিয়েনায়, যা চোখে না দেখলে শুধু লেখা পড়ে আন্দাজ করা কঠিন। আর এ নিরাপত্তা ব্যবস্থাই ভিয়েনাকে আজ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভেতর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহরে পরিণত করেছে।
শাহনেওয়াজ বিপ্লব :গল্পকার, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত
shahnewazbiplob@hotmail.com
মানুষের কাছে স্বর্গের ধারণাটি কী রকম? প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাহিত্য ও চিত্রকলায় মানুষ তার কল্পনায় যতখানি স্বর্গের ছবি আঁকতে পেরেছে তা ঠিক এ রকম :স্বর্গ হবে মনোরম, সি্নগ্ধ, সাজানো-গোছানো আর ছিমছাম। সেই পরিবেশটাই অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে খুঁজে পেয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত লিভিং স্ট্যান্ডার্ড নির্ণায়ক ব্রিটেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট। তাদের জরিপে ভিয়েনা পৃথিবীতে বসবাসের জন্য দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ শহর নির্বাচিত হয়েছে। এক নম্বরে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। আর তৃতীয় স্থানে রয়েছে কানাডার ভ্যাংকুভার। এ ছাড়া প্রথম ১০টি শহরের মধ্যে রয়েছে কানাডার টরন্টো, কানাডার ক্যালগারি, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড, সিডনি, ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি, অস্ট্রেলিয়ার পার্থ ও নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড।
আর বিশ্বে বসবাসের উপযোগিতা বিবেচনায় সবচেয়ে অযোগ্য শহর হয়েছে ঢাকা। নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্য সুবিধা, গণপরিবহন, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামোসহ ৩০টি মানদণ্ড বিবেচনায় ১৪০টি শহর নিয়ে চালানো জরিপে ঢাকা শহরের অবস্থান সর্বনিম্নে।
এ প্রতিষ্ঠানের গত বছরের জরিপ অনুযায়ী ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৯তম। সেবার ১৪০তম হয়েছিল জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারে। হারারে এবারও শেষ ১০টি শহরের মধ্যে আছে। নিচের দিকের ১০টি শহরের মধ্যে ঢাকা ছাড়াও রয়েছে নাইজেরিয়ার লাগোস, জিম্বাবুয়ের হারারে, আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, পাকিস্তানের করাচি, লিবিয়ার ত্রিপোলি আর ইরানের তেহরান।
জরিপে বলা হয়েছে, ভিয়েনায় রয়েছে সুসজ্জিত সব ভবন আর পার্ক। গণপরিবহন ছাড়াও সাইকেলের প্রভূত ব্যবহার শহরে প্রতিদিনের পরিবহনের খরচ সম্প্র্রতি ১ ইউরোতে নিয়ে এসেছে নগর কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া ১৭ লাখ বাসিন্দার এ শহরে গুরুতর অপরাধের ঘটনা বিরল।
ভিয়েনা লোয়ার অস্ট্রিয়া প্রদেশে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম উভয় দিকে ৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট সুন্দর, ছবির মতো সাজানো গোছানো একটি শহর। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতেই ভিয়েনার গোড়াপত্তন হয়। তবে ভিয়েনার আধুনিক নগর যাত্রার শুরু ৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে। এর বয়স ১ হাজার বছরের বেশি হলেও এখনও এটি যেন চিরনতুন এক শহর। ভিয়েনা মোট ২৩টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। এক একটি প্রশাসনিক অঞ্চল বাংলাদেশের এক একটি ইউনিয়ন পরিষদের মতো পরিসরের। কোনো কোনোটি এর চেয়েও ছোট। এ প্রশাসনিক অঞ্চলগুলো করা হয়েছে ঠিক এভাবে, যেন যে কোনো সমস্যায় ৫ মিনিটের ভেতর পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড অথবা জরুরি বিভাগে কর্মরত ডাক্তাররা ওই এলাকায় যেতে পারেন।
প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলের কাউন্সিলর ও ভিয়েনার মেয়র জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও কার্যত ভিয়েনার পুরো প্রশাসন পরিচালনা করেন সরকার নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট। এসব প্রশাসনিক অঞ্চলে ঠিক কত লোক বাস করছে, তার সঠিক হিসাব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রয়েছে। কেউ বাসা পরিবর্তন, অন্য প্রদেশে বসবাস অথবা দেশান্তরী হতে চাইলে ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতেই হবে।
কারও সন্তানের কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার বয়স হলে ম্যাজিস্ট্রেটরাই চিঠি দিয়ে জানান, প্রশাসনিক অঞ্চলের কোন কিন্ডারগার্টেনে ছেলে বা মেয়েকে ভর্তি করাবেন। কিন্ডারগার্টেন থেকে প্রাইমারি স্কুল হয়ে হাই স্কুল পর্যন্ত শিশুদের পড়াশোনার ব্যাপারটা মা-বাবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটরাই অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করেন।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিস্ময়কর এক অগ্রগতি সাধন করেছে। ভিয়েনায় চলাচলকারী বাস, ট্রেন, ট্রাম এবং আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো রেল_ সবই সরকারি। ৩০ ইউরো দিয়ে একটি যাতায়াত কার্ড কেনার পর জনগণ সারা মাস ভিয়েনার যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাতায়াত করতে পারে। ভিয়েনার যে কোনো প্রান্তে যাতায়াতের জন্য ৫ মিনিট পরপর বাস, ট্রেন, ট্রাম ও মেট্রোর ব্যবস্থা রয়েছে। এসব পরিবহনে সাধারণত টিকিট চেকিং হয় না। জনগণ নিজ দায়িত্বেই টিকিট কেটে থাকেন। ভিয়েনায় রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড-১, আন্ডারগ্রাউন্ড-২ এবং আন্ডারগ্রাউন্ড-৩ মেট্রো রেল, যার মাধ্যমে পুরো শহরকে অতি অল্প সময়ে যানজটহীন দ্রুত যাতায়াতের এক শ্রেষ্ঠ শহরে পরিণত করেছে।
এবার আসি নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথায়। অস্ট্রিয়ায় গুরুতর অপরাধ অথবা খুনোখুনির ঘটনা বলা চলে একেবারেই বিরল। অন্যভাবে বলা যায়, অস্ট্রিয়া একটি পুলিশি রাষ্ট্র। পুলিশ কঠোর হস্তে এখানে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে। রয়েছে ওয়াটার পুলিশ, যারা ভিয়েনার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত দানিয়ুব নদীতে টহল দিচ্ছে প্রতিদিন। রয়েছে আকাশ থেকে হেলিকপ্টারযোগে শক্তিশালী ক্যামেরা দিয়ে নিরাপত্তা তল্লাশি। এ ছাড়া ভিয়েনার ওয়াটার পুলিশ কর্তৃক সপ্তাহে একবার ডুবুরি দিয়ে দানিয়ুব নদীর তলদেশ তল্লাশির ব্যবস্থা রয়েছে। ভিয়েনায় যে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় পুলিশকে ৩ থেকে ৫ মিনিটের ভেতর হাজির হতেই হবে। না পারলে রয়েছে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা। দ্রুততম সময়ের ভেতর উপস্থিত হওয়ার জন্য ভিয়েনার প্রতিটি পাড়ায় রয়েছে একটি থানা। সেসব থানা কর্তৃর্ক রয়েছে সার্বক্ষণিক টহলের ব্যবস্থা। পুলিশের জন্য রয়েছে সার্বক্ষণিক মানসিক ডাক্তার, যাদের কাজ হচ্ছে পুলিশদের চাঙ্গা রাখা, যাতে কোনো ব্যর্থতায় অথবা অসফল অপারেশনের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে না যায়।
পুলিশের চাকরি অস্ট্রিয়ায় সবচেয়ে সম্মানিত। স্কুল-কলেজগুলোতে শৈশব থেকেই ছেলেমেয়েদের স্বপ্নের চাকরি হচ্ছে পুলিশ। গত বছর জনমত জরিপে অস্ট্রিয়ার পুলিশ ১ নম্বরে, বিচার বিভাগ ২ নম্বরে. রাজনীতিকরা ৩ নম্বরে স্থান পেয়েছেন।
দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের বিবদমান কোনো পক্ষ থেকে অথবা সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে ১ গ্গ্নাস পানি পান করাও দণ্ডনীয় অপরাধ; চা, কফি পান অথবা টাকা-পয়সা নেওয়া তো দূরের কথা। আইন এখানে গরিব-ধনী সবার জন্য সমান।
দায়িত্ব পালন ব্যতিরেকেও পুলিশ তার অবসরে অথবা ছুটির সময়ে কারও কাছ থেকে কোনো সুবিধা নিতে পারবে না। পুলিশের কনস্টেবল থেকে অফিসার সবার বেতন ১৫০০ থেকে ২০০০ ইউরোতে বাঁধা। পুলিশ এখানে বেতনের বাইরে এক কানাকড়িরও প্রত্যাশা করতে পারে না।
পুলিশি নিরাপত্তার বাইরে ভিয়েনায় রয়েছে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা। প্রতিটি হাসপাতাল সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে চলেছে রোগীদের।
সব হাসপাতালে রয়েছে সর্বাধুনিক হেলিকপ্টার অ্যাম্বুলেন্স। ভিয়েনার যে কোনো স্থানে যে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় ৫ মিনিটের ভেতর রোগীর কাছে ডাক্তারকে পেঁৗছাতেই হবে। না হলে জরুরি বিভাগ এবং দুর্ঘটনা বিভাগের ডাক্তার ও নার্সদের রয়েছে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা।
ভিয়েনায় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অথবা ডায়াগনোসিসের জন্য ডাক্তারদের কোনো ফি দিতে হয় না জনগণকে। ফার্মেসি থেকেও ওষুধ কিনতে হয় না নিজের খরচে। রাষ্ট্র এখানে স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করেছে।
যে কারণেই হোক; ভিয়েনায় ডাক্তাররা রোগী অথবা রোগীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা অসংযত আচরণ করতে পারবে না। ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার আগে রোগীর কেস হিস্ট্রি অথবা চিকিৎসা-ইতিহাস শুনতে হবে ডাক্তারকে নিরুদ্বিগ্ন হয়ে।
এমনকি চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা ডাক্তারের চিকিৎসার মান নিয়ে সরাসরি অসন্তুষ্ট রোগীকে জিজ্ঞেস করতে হবে, সে অন্য কোনো ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে আগ্রহী কি-না। তাছাড়া সিরিয়াল দেওয়া রোগীদের নির্ধারিত সময়ের দশ থেকে পনের মিনিটের বাইরে বসিয়ে রাখা হয় না।
ভিয়েনায় বেশিরভাগ ডাক্তারই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না। দু'একজন করলেও রোগীরা ব্যবস্থাপত্র নেয় না ওসব ডাক্তারের। ফলে সরকারি চাকরিতেই ফিরে আসতে হয় ডাক্তারদের শেষ পর্যন্ত। একজন ডাক্তার তৈরি করতে সাধারণ জনগণের বিপুল অঙ্কের করের টাকা ব্যয় হয় বলে ওখানকার ডাক্তাররা সনদ অর্জন শেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতেই ফিরে আসেন চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য। আমাদের দেশের মতো ক্লিনিক ব্যবস্থা ভিয়েনায় নেই। ধনী-গরিব সবার জন্যই সমান সুবিধা নিয়েই সদা উন্মুক্ত সরকারি হাসপাতাল।
এ ছাড়া ভিয়েনায় নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে ফায়ার ব্রিগেড। সড়ক দুর্ঘটনা অথবা অগি্নকাণ্ডস্থলে ৫ মিনিটের ভেতর ফায়ার ব্রিগেড কর্মীদের পেঁৗছাতেই হবে। না হলে রয়েছে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা। তবে ভিয়েনায় বাড়িঘরে সাধারণত আগুন লাগে না। কারণ প্রতিটি পাড়ায় রয়েছে ফায়ার ব্রিগেড এবং সেসব ফায়ার ব্রিগেডে রয়েছে প্রতিটি বাড়ি বা দোকানের নম্বরধারী অগি্ননির্বাপণ সফটওয়্যার। কোথাও আগুন লাগার আশঙ্কা থাকলে ফায়ার ব্রিগেড স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানতে পারে ইলেকট্রনিক সংকেতের মাধ্যমে। জনগণকে ফোন করে ফায়ার ব্রিগেডে খবর দেওয়ার দরকার হয় না।
সর্বক্ষেত্রেই এমন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে ভিয়েনায়, যা চোখে না দেখলে শুধু লেখা পড়ে আন্দাজ করা কঠিন। আর এ নিরাপত্তা ব্যবস্থাই ভিয়েনাকে আজ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভেতর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহরে পরিণত করেছে।
শাহনেওয়াজ বিপ্লব :গল্পকার, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত
shahnewazbiplob@hotmail.com
No comments