মানুষের শত্রুমিত্রঃ কে রুখবে এই পরাজয়? by মাহমুদ শামসুল হক
২০১০ সালের মার্চে এই পরিবারে একবারও ভাতের হাঁড়ি চাপেনি চুলায়। গৃহস্বামী হজরতের বয়স ষাটের ওপরে। ঢাকায় এসেছে কুড়ি বছর হলো। এই দুদশকে নিজের টাকায় কেনা হয়নি একটি জামা, গেঞ্জি কিংবা শীতকালে একটি চাদর। চার মাস আগে তেজগাঁও কলেজের একজন ছাত্র একটি পুরনো পাঞ্জাবি দিয়েছিল আর একটি গ্যাবাডিনের প্যান্ট। সেই যে পরেছেন আর খোলেননি।
সাবান তো দূরের কথা, একবার শুধু বৃষ্টিতে ভিজেছে, শুকিয়েছে শরীরেই। রেল সড়কের পাশে পাঁচফুট বাই আট ফুট একটি জায়গা হজরতের পলিথিন মোড়া ছৈ। সরকারি ভাষায় জবরদখল। সেখানে তার একমাত্র পুত্র ফাইল্যা জন্মসূত্রে পঙ্গু অবস্থায় কেবল শুয়ে থাকে। একমাথা জট আর চামড়ার ছাউনি দেয়া হাড্ডিসার দেহ নিয়ে দিনমান ভিক্ষে করে স্ত্রী জবিতন। কুড়ি বছর আগের এক সন্ধ্যায় হজরত নববধূকে নিয়ে চড়েছিল ঢাকাগামী ময়মনসিংহের ট্রাকে। সঙ্গে ছিল আরও আঠারজন। তাদের কারও হদিস তার আজ জানা নেই। হজরতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার চোখ। কোটর থেকে বেরিয়ে আসা এমন রক্তাভ চোখ ঢাকায় বিরল। মনে হয় ফেলে আসা দীর্ঘ গ্রাম জীবনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ দুটি ঠেলে বেরিয়েছে। মৃত এক গ্রামের স্মৃতি তাকে হাতছানি দিয়ে আজও ডাকে। কিন্তু ফেরার পথ একেবারে রুদ্ধ। রাতের ট্রাকে চাপলে অনায়াসে ফিরে যেতে পারবে সেখানে। কিন্তু দাঁড়াবে কোথায়? সেই কবে স্রেফ দাঁড়ানোর জন্যই এই প্রাচীন শহরে এসেছিল। ভেবেছিল, এক দিন কোচর ভর্তি টাকাকড়ি নিয়ে গ্রামে ফিরে যাবে। বউকে কথাও দিয়েছিল। ঢাকায় পা দিয়েই উধাও হয়ে যায় সব অঙ্গীকার। ঢাকা তাকে কাজ দেয়নি। ভিক্ষা দিয়েছে। তা দিয়েই ক্রমাগত অর্ধাহার। উপরে আকাশ নিচে নর্দমা, মশামাছি, কোলাহল আর পুলিশের ভয় নিয়ে কী অবাক বেঁচে থাকা! এটি একজন সাবেক ক্ষেতমজুরের জীবন কাহিনী।
বর্তমানে গ্রামে যেসব ভূমিচ্যুত ক্ষেতমজুর আছে, নগরীর আধা ভদ্রলোকেরা যাদের ‘মফিজ’ বলে শনাক্ত করে তারাও কিন্তু ঢাকা প্রবাসী হজরত আলীর চেয়ে খুব একটা ভালো নেই। তাদেরও মাথার উপরে কেবল আকাশ, পায়ের তলায় পরের মাটি। যেন সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে বেঁচে আছে। সংখ্যায় কেবল বাড়ছে মহামারীর মতো। কথিত সবুজ বিপ্লব থেকে শুরু করে উন্নয়নের তাবত জোয়ারে এদের ঘাম এবং রক্ত মিশেছে; কিন্তু সেই বিপ্লব বা উন্নয়নের তারা কেউ নয়। ব্যালট বাক্স বলে কিছু না থাকলে এদের উপস্থিতিকেই অস্বীকার করত রাজনৈতিক দলগুলো।
ভূমিহীন মজুরের চেয়ে যারা কিঞ্চিত্ ভালো আছেন তাদেরও নিজের শরীরের মতো একখানা চালা তোলার, চারখানা খুঁটি পোঁতার জমি নেই। এমন লাখো মানুষ আত্মগোপন করে আছে প্রতিটি জেলার মানচিত্রে। হজরত আলী গংদের নিয়ে সরকার নাকি খুব ভাবছে। দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে নথিপত্র ঠিক করছে। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেও সেই দীর্ঘ মেয়াদ পূর্ণ হলো না। এদিকে নগরের টাকাঅলা লোকজন বিশেষত ‘ভূমিদস্যু’রা গ্রামকে কেবলই পেছনে হটিয়ে দিচ্ছে। সেখানে তারা বাংলো বানাচ্ছে, কারখানা গড়ছে, তৈরি করছে পিকনিক স্পট, নাটক-সিনেমার শ্যুটিং পল্লী। এদিকে হটে যাওয়া ভূমিহারা মানুষ ছুটে আসছে নগরে, রাজধানীতে। অদৃশ্য এ মিছিল। মুখে কোনো স্লোগান নেই। দাবি-দাওয়া নেই। এই মৌন মিছিলের পদভারে রাজধানীর ভেতর কাঁপছে। যেন শত্রু অধিকৃত স্বদেশ থেকে তারা পালিয়ে এসেছে ছিন্নবস্ত্রে। এদের কেউ হয়তো এক দিন ফিরে যাবে গ্রামে এবং ফের পরিণত হবে ক্ষেতমজুর, আবার কেউ হবে ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা।
আমাদের রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ-গবেষকরা ঢাকায় বসে যে ‘মাটি ও মানুষ’ সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ, পরিসংখ্যান রচনা করেন তার সঙ্গে বাস্তবের মিল অতি সামান্য কিংবা একেবারেই নেই। তারা শুধু এটাই জানেন যে, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধ বা রাজনৈতিক ঘটনা সমাজের ভারসাম্যে আঘাত হানলেই নিরন্ন মানুষ হামলে পড়ে শহরে খাবার সন্ধানে। নদী ভাঙন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তারা ছুটে আসে ঢাকায়। এ কথা অবশ্য মিথ্যা নয়। কিন্তু তারা জানেন না, এরকম কত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে প্রতিদিন বাংলাদেশের গ্রামে, লোকাল ট্রেন, রাতের বেলার মানুষবাহী ট্রাকে। ক্ষুধার বিশাল গহ্বরের গভীরতা ও আয়তন সম্পর্কে নগরবাসী সুধীদের ধারণা আক্ষরিক অর্থেই সামান্য কিংবা ইউটোপিয়ান। ক্ষেতমজুর যে দাস-মজুরে পরিণত হচ্ছে সে কথাও তারা জানেন না। মানুষ বিক্রি হচ্ছে। মজুর আগাম শ্রম বিক্রি করছে, ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা ফেরি করে বিক্রি করছে ভুখা-নাঙ্গারা। যারা দেশে সারা বছর অযৌক্তিক রাজনৈতিক হাঙ্গামা, আগাম নেতা নির্বাচন, সংসদে বচসা করেন তাদের পক্ষে সমাজের এই নিগূঢ় তত্ত্ব জানা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। তারা জানেন না, এখন গ্রামদেশের ক্ষেতমজুর মানে গোলাম আর শহরে তাদের যে অংশ বাঁচতে এসেছে তারা ভিক্ষুক। এদের সংখ্যা দুদিক থেকেই আরও বাড়বে। ভূমিদস্যু বাড়লে চোর ছ্যাঁচর বাড়বে। নগর-সামন্ত বাড়লে গোলাম বাড়বে। চতুর বাড়লে ফতুর বাড়বে। এ জন্য পুঁজিবাদের কাছে দাসখত দেয়া অর্থনীতিবিদের সূত্র কোনো কাজে আসবে না। রাজনীতির অন্ধচক্রে গণদারিদ্র্যের ইস্যুটি কেবলই পাক খাবে। নতুন নতুন ফর্মুলা আসবে, সবার জন্য ডালভাত আসবে, দিনবদলের বিচিত্র তাবিজ আসবে। উন্নয়নের জোয়ার আসবে, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন আসবে। আর ক্ষুধার্ত মানুষ চষে ফিরবে সারা দেশ ভাতের বিনিময়ে দাস হওয়ার জন্য, এমনকি রুটি দিয়ে সম্ভ্রমহানির লজ্জা ঢাকার জন্য। গ্রামের সীমান্তে আছড়ে পড়বে মজুর-বিস্ফোরণ প্রতিদিন, প্রতিদিন গ্রাম ভাঙবে আর শহর ছুটে যাবে বিপন্নতার দিকে। কে রুখবে মানুষের এই নিকৃষ্টতম পরাভব, পরাজয়?
বর্তমানে গ্রামে যেসব ভূমিচ্যুত ক্ষেতমজুর আছে, নগরীর আধা ভদ্রলোকেরা যাদের ‘মফিজ’ বলে শনাক্ত করে তারাও কিন্তু ঢাকা প্রবাসী হজরত আলীর চেয়ে খুব একটা ভালো নেই। তাদেরও মাথার উপরে কেবল আকাশ, পায়ের তলায় পরের মাটি। যেন সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে বেঁচে আছে। সংখ্যায় কেবল বাড়ছে মহামারীর মতো। কথিত সবুজ বিপ্লব থেকে শুরু করে উন্নয়নের তাবত জোয়ারে এদের ঘাম এবং রক্ত মিশেছে; কিন্তু সেই বিপ্লব বা উন্নয়নের তারা কেউ নয়। ব্যালট বাক্স বলে কিছু না থাকলে এদের উপস্থিতিকেই অস্বীকার করত রাজনৈতিক দলগুলো।
ভূমিহীন মজুরের চেয়ে যারা কিঞ্চিত্ ভালো আছেন তাদেরও নিজের শরীরের মতো একখানা চালা তোলার, চারখানা খুঁটি পোঁতার জমি নেই। এমন লাখো মানুষ আত্মগোপন করে আছে প্রতিটি জেলার মানচিত্রে। হজরত আলী গংদের নিয়ে সরকার নাকি খুব ভাবছে। দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে নথিপত্র ঠিক করছে। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেও সেই দীর্ঘ মেয়াদ পূর্ণ হলো না। এদিকে নগরের টাকাঅলা লোকজন বিশেষত ‘ভূমিদস্যু’রা গ্রামকে কেবলই পেছনে হটিয়ে দিচ্ছে। সেখানে তারা বাংলো বানাচ্ছে, কারখানা গড়ছে, তৈরি করছে পিকনিক স্পট, নাটক-সিনেমার শ্যুটিং পল্লী। এদিকে হটে যাওয়া ভূমিহারা মানুষ ছুটে আসছে নগরে, রাজধানীতে। অদৃশ্য এ মিছিল। মুখে কোনো স্লোগান নেই। দাবি-দাওয়া নেই। এই মৌন মিছিলের পদভারে রাজধানীর ভেতর কাঁপছে। যেন শত্রু অধিকৃত স্বদেশ থেকে তারা পালিয়ে এসেছে ছিন্নবস্ত্রে। এদের কেউ হয়তো এক দিন ফিরে যাবে গ্রামে এবং ফের পরিণত হবে ক্ষেতমজুর, আবার কেউ হবে ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা।
আমাদের রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ-গবেষকরা ঢাকায় বসে যে ‘মাটি ও মানুষ’ সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ, পরিসংখ্যান রচনা করেন তার সঙ্গে বাস্তবের মিল অতি সামান্য কিংবা একেবারেই নেই। তারা শুধু এটাই জানেন যে, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধ বা রাজনৈতিক ঘটনা সমাজের ভারসাম্যে আঘাত হানলেই নিরন্ন মানুষ হামলে পড়ে শহরে খাবার সন্ধানে। নদী ভাঙন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তারা ছুটে আসে ঢাকায়। এ কথা অবশ্য মিথ্যা নয়। কিন্তু তারা জানেন না, এরকম কত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে প্রতিদিন বাংলাদেশের গ্রামে, লোকাল ট্রেন, রাতের বেলার মানুষবাহী ট্রাকে। ক্ষুধার বিশাল গহ্বরের গভীরতা ও আয়তন সম্পর্কে নগরবাসী সুধীদের ধারণা আক্ষরিক অর্থেই সামান্য কিংবা ইউটোপিয়ান। ক্ষেতমজুর যে দাস-মজুরে পরিণত হচ্ছে সে কথাও তারা জানেন না। মানুষ বিক্রি হচ্ছে। মজুর আগাম শ্রম বিক্রি করছে, ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা ফেরি করে বিক্রি করছে ভুখা-নাঙ্গারা। যারা দেশে সারা বছর অযৌক্তিক রাজনৈতিক হাঙ্গামা, আগাম নেতা নির্বাচন, সংসদে বচসা করেন তাদের পক্ষে সমাজের এই নিগূঢ় তত্ত্ব জানা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। তারা জানেন না, এখন গ্রামদেশের ক্ষেতমজুর মানে গোলাম আর শহরে তাদের যে অংশ বাঁচতে এসেছে তারা ভিক্ষুক। এদের সংখ্যা দুদিক থেকেই আরও বাড়বে। ভূমিদস্যু বাড়লে চোর ছ্যাঁচর বাড়বে। নগর-সামন্ত বাড়লে গোলাম বাড়বে। চতুর বাড়লে ফতুর বাড়বে। এ জন্য পুঁজিবাদের কাছে দাসখত দেয়া অর্থনীতিবিদের সূত্র কোনো কাজে আসবে না। রাজনীতির অন্ধচক্রে গণদারিদ্র্যের ইস্যুটি কেবলই পাক খাবে। নতুন নতুন ফর্মুলা আসবে, সবার জন্য ডালভাত আসবে, দিনবদলের বিচিত্র তাবিজ আসবে। উন্নয়নের জোয়ার আসবে, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন আসবে। আর ক্ষুধার্ত মানুষ চষে ফিরবে সারা দেশ ভাতের বিনিময়ে দাস হওয়ার জন্য, এমনকি রুটি দিয়ে সম্ভ্রমহানির লজ্জা ঢাকার জন্য। গ্রামের সীমান্তে আছড়ে পড়বে মজুর-বিস্ফোরণ প্রতিদিন, প্রতিদিন গ্রাম ভাঙবে আর শহর ছুটে যাবে বিপন্নতার দিকে। কে রুখবে মানুষের এই নিকৃষ্টতম পরাভব, পরাজয়?
No comments