সুখবর নেই কুয়েত সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায়- এবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার নিয়ে অশনিসংকেত by শরিফুল হাসান
২০০৮ সালে কুয়েত। পরের বছর সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া। বাংলাদেশের অন্যতম এই তিন শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মূল ভরসা হয়ে ওঠে সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু সেখানেও এখন অশনিসংকেত। জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে কূটনৈতিক যোগাযোগ, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরও সৌদি আরব, কুয়েত ও মালয়েশিয়া থেকে কোনো সুখবর নেই।
এই অবস্থায় যদি আরব আমিরাতও বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই ঈদের আগে থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে আরব আমিরাত। তবে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, দেশটি ভিসা দেওয়া কমিয়ে দিলেও একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে—এমন খবর সঠিক নয়।
তবে মন্ত্রীর এমন কথায় ক্ষুব্ধ জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা। তাঁরা বলছেন, সৌদি আরব, কুয়েত কোনো দেশই আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে লোক নেওয়া বন্ধ করেনি। কাজেই আসলে যদি আরব আমিরাত ভিসা বন্ধ করে থাকে, তাহলে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিত। কারণ, এর আগেও আরব আমিরাত এমআরপি (যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট) ছাড়া ভিসা দেবে না বলার পরও কূটনৈতিক যোগাযোগের পর সে অবস্থান থেকে সরে আসে।
এদিকে সোমবার গালফ নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নেছার আল আওয়াদি আল মেনহালি বলেন, ‘বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়ার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে এখন অনেক যাচাই-বাছাই করে ভিসা দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, যখন অনেক কর্মী ভিসার জন্য আবেদন করেন এবং তাঁদের মধ্যে যদি কারও যোগ্যতা সন্তোষজনক না হয়, তাহলে তাঁকে ভিসা নাও দেওয়া হতে পারে। আওয়াদি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আরব আমিরাতে অনেক ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশি আছে। আমরা সবার আনুপাতিক হার সমান করতে চাই। এ জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, আরব আমিরাত সরাসরি কোনো কথা না বললেও তাদের পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে সংকুচিত করবে এই ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মোট ১৮ লাখ ৭১ হাজার ৫৯২ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে নয় লাখ ৪০ হাজার ৬১৫ জনই অর্থাৎ প্রায় ৫০ শতাংশই গেছে আরব আমিরাতে।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, একসময় প্রতিবছর এক লাখেরও বেশি শ্রমিক সৌদি আরব যেতেন। কিন্তু এখন সেটিও বন্ধ। এই সরকারের প্রায় পৌনে চার বছরে মাত্র ৩৫ হাজার শ্রমিক সৌদি আরবে গেছেন। আরেক শ্রমবাজার কুয়েতে বছরে ৪০-৫০ হাজার শ্রমিক গেলেও গত পৌনে চার বছরে দেশটিতে গেছেন মাত্র ৮৭ জন। আর একই সময় মালয়েশিয়া গেছেন মাত্র ১৫ হাজার কর্মী। এই অবস্থায় আরব আমিরাতই ছিল মূল ভরসা। এ ছাড়া একসময় লিবিয়ায় অনেক শ্রমিক গেলেও যুদ্ধাবস্থার কারণে সেখানে নানা সংকট।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন-চার বছর ধরে সৌদি আরব, কুয়েত ও মালয়েশিয়ার বাজার বন্ধ। এই সময় বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাত টিকে ছিল আরব আমিরাতের ওপর। কিন্তু ঈদের আগে থেকে হঠাৎ করে কোনো ঘোষণা ছাড়াই বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে দেশটি। যদি দ্রুত কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই বাজার চালু করা না যায়, তাহলে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাত ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। কাজেই সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া হোক। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সরকারকে সব ধরনের সহায়তা দেবেন।’
জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা জানিয়েছেন, কেবল নতুন করে ভিসা দেওয়াই বন্ধ করেনি আরব আমিরাত, একই সঙ্গে তারা পুরোনো শ্রমিকদের ভিসা নবায়নও বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি যে ৫০ হাজার লোক আরব আমিরাতে গেছেন, তাঁরাও সেখানে স্থায়ীভাবে কাজ করার ভিসা পাচ্ছেন না। এ ছাড়া আমিরাতে পাঠানোর কথা বলে বাংলাদেশে থাকা অন্তত ৫০ হাজার শ্রমিকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রেখেছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা।
আরব আমিরাত কেন হঠাৎ করে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিল, জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারক ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বলতে পারেননি।
জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আরব আমিরাতের শ্রমবাজার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে, এটা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে একটি সংকট শুরু হয়েছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কেন ভিসা বন্ধ হলো—জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে ভিসা দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে, এমন কথা বলা হলেও এর কোনো ভিত্তি নেই। মূলত কয়েক বছর ধরে আরব আমিরাতে যত প্রবাসী শ্রমিক গেছেন, তার অধিকাংশই বাংলাদেশি। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ২২ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫০ জন বাংলাদেশি দেশটিতে গেছেন। এসব কারণেই দেশটি হয়তো শ্রমিকসংখ্যা আর বাড়াতে চাইছে না। এ ছাড়া বাংলাদেশিদের কেউ কেউ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। সেটিও ভিসা বন্ধ করে দেওয়ার কারণ হতে পারে।
আমিরাতের ভিসা বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এমন খবর সঠিক নয়। গণমাধ্যমে এমন খবর এলেও দেশটির সরকার আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। তবে দেশটি এখন সীমিত আকারে ভিসা দিচ্ছে। আর আমরা সেখানে নিয়মিত খোঁজখবর রাখছি।’
বাজার বন্ধ হয়ে গেছে—জনশক্তি রপ্তানিকারকদের এমন দাবি প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘আরব আমিরাতে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন। এ অবস্থায় তারা লোক নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। সেখানে থাকা কর্মীদের কোনো সমস্যা বা কোনো অবৈধ কর্মী থাকলে, তাঁদের বৈধ করার প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে আরব আমিরাত লোক নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে কি না—জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘এ ইস্যুতে কোনো দেশ কোনো কথা এখনো বলেনি। আর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে হবে, এমন কথাও কেউ বলেনি।’
অভিবাসনবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রামরুর সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আরব আমিরাত বন্ধ থাকলে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে বিপর্যয় নেমে আসবে। সরকারের উচিত কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে সমস্যার সমাধান করা।’
No comments