যুগসন্ধিক্ষণে নজরুলের গান by গৌতম পাণ্ডে
‘কাব্যে ও সাহিত্যে আমি কি দিয়েছি, জানি না। আমার আবেগে যা এসেছিল, তাই আমি সহজভাবে বলেছি। আমি যা অনুভব করেছি, তাই আমি বলেছি। এতে আমার কৃত্রিমতা ছিল না। কিন্তু সঙ্গীতে যা দিয়েছি, সে সম্বন্ধে আজ কোনও আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে, ইতিহাসে লেখা হবে, তখন আমার কথা সবাই স্মরণ করবেন,
এ বিশ্বাস আমার আছে। সাহিত্যে আমার দান কতটুকু, তা জানা নেই। তবে এটুকু মনে আছে সঙ্গীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি।’ নিজের সঙ্গীত সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলামের এই উক্তি থেকে একটি বিষয় অনুমেয় যে, তিনি সঙ্গীত নিয়ে অত্যন্ত উচ্চাশা পোষণ করতেন। এ কেবল একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞের পক্ষেই সম্ভব। এ প্রেক্ষিতে বলা যায় নজরুল ইসলাম যত বড় কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার বা নাট্যকার ছিলেন তার চেয়ে অনেক গুণে বড় ছিলেন একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে। সঙ্গীতজ্ঞ দেবব্রত দত্ত সঙ্গীত তত্ত্বে নজরুল প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন ‘কাব্য ও সুরবৈভব একই সুরসূত্রে সম্পৃক্ত করে মালাকার (নজরুল) তাঁর উত্তরসূরীদের জন্য যে সুরগীতি সৃষ্টি করে গেছেন, তার সত্যিকারের মূল্যায়ন আজও সম্ভব হয়নি। কবি নজরুল সঙ্গীত জগতে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুরকার। যা কোন অবস্থাতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। সুতরাং এই সুরের জাদুস্পর্শ একদিন জনচিত্ত জয় করবেই।’
গণসংস্কৃতির সঙ্গে বহু সূত্রে যুক্ত নজরুল সঙ্গীত। নারী জাগরণ, যুব জাগরণ, ছাত্রদল, অসাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলিম মিলন, লেটো, ভাঙা, সর্বহারা, মার্চ, সাম্য, ভক্তি, লোক, পল্লী, ভাটিয়ালি, সাঁওতালি, খেমটা, ঝুমুর, গজল ও হাসির গানের বিরাট একটি ডালি নিয়েও বাংলার আপামর জনসাধারণকে আলোড়িত করছে নজরুলসঙ্গীত। নজরুল গান লিখতেন মজলিসে বসে, সুর করতেন রিহার্সালের কোলাহলে, গান গাইতেন মানুষের সভায়। পঞ্চ কবির সঙ্গে থাকলে তো তাঁর মতো প্রতিভার তুলনা হবেই। বাংলা সঙ্গীতের প্রাক আধুনিক যুগ ছিল রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত ও অতুল প্রসাদের যুগ। এই চার প্রধান সঙ্গীতজ্ঞের গীতি রচনার বিচিত্র ধারার সঙ্গে, নতুন গীতিপন্থার মধ্যবর্তী সেতু রূপে বাংলা সঙ্গীতের আধুনিকতার স্তম্ভ স্বরূপ আবির্ভূত হন কাজী নজরুল ইসলাম। গীত সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন স্বমহিমায় মহিমান্বিত। তাঁর উত্তরসূরীরা ছিলেন উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতির পৃষ্ঠপোষক, যেখানে ছিল ধ্রুপদী ধারার রস এবং সুরের ক্ষেত্রে নানা নিয়মনীতির অনুশাসন। কিন্তু নজরুল ছিলেন তাঁদের থেকে ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন উত্তরভারতীয় মুসলিম সঙ্গীত পদ্ধতির যোগ্য উত্তরসূরী। তিনি বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন উত্তরভারতীয় খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরী, কাজরী, হোরী, লাউনী, নাত, গজল, কাওয়ালী প্রভৃতি বিচিত্র রকমের রঙদার সুরের ঐশ্বর্যে। তিনি বাংলা গানের নতুন নতুন শাখা-প্রশাখা পল্লবিত করে গানের ভুবনকে সুরের সুবাসে সুরভিত করেছেন। এবং সব সুর পিয়াসী মানুষের তৃষিত হৃদয়কে ভরে দিয়েছেন নব নব সৃষ্টির জোয়ারে। নজরুলসঙ্গীতের বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তী এক বিস্ময়ের ব্যাপার। তিনি বাংলা গজল রচনার ক্ষেত্রে আরবী, ফার্সী, তুর্কী, উর্দু প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করে গজলকে সার্থকভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। তাঁর কারণেই বাংলা গানে প্রথম ঠাঁই পেল বুলবুল, সাকী, বেহেশত, গুলবাগ, শিরনী, মিনার প্রভৃতি আরবী ও ফার্সী শব্দ। সংস্কৃতবাহী ভাষাকে ভাব, ছন্দ, লালিত্য ও শব্দ দিয়ে গেঁথে এনে দুর্বোধ্য না করে সহজ ও সাবলীলভাবে বাংলাভাষায় আসন করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। যেমন তার ‘অরুণ কেন করুণ আঁখি’ গানটিতে তিনি সাকী, শারাব আরবী এবং দিল, শিরাজী প্রভৃতি ফারসী শব্দ ব্যবহার করেছেন। আবার কখনও ছন্দ, মাত্রা ও লয়জনিত কারণে তিনি আরবী ও ফার্সী শব্দকে ভেঙে ছোট করেও প্রয়োগ করেছেন তার গানে। যেমন ‘তাওফিক’ থেকে ‘তৌফিক’, ‘রওশন’ থেকে ‘রোশন’ বা ‘রেশমী’ প্রভৃতি। এছাড়া তাঁর লোকসঙ্গীত ও হাসির গানেও লোকজ শব্দের ব্যবহার আছে আবলীলায়। যেমন ‘নাকে নথ দুলাইয়া চলে, কাঁখে কলস পোলা কোলে’।
নজরুল ইসলাম ইরানী কবি হাফিজ বা ওমর খৈয়ামের কাব্যরীতির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই রীতিতে তাঁর গানে ও গজলে উপমার এক জগৎ তিনি গড়ে তুলেছেন। যেমন ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোপায় তারার ফুল, কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল’।
সুরের বৈচিত্র্য নজরুলের গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। গজলের তালছাড়া ‘শায়ের’ তিনি বাংলা গানে প্রথম প্রয়োগ করেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ তিনি ভ্রমণ করেন এবং সেই দেশের গানের সুরের ফ্রেমে বাংলা কথা বসিয়ে তিনি বহু গান রচনা করেছেন। এর মধ্যে একটি হলোÑ‘শুকনো পাতার নুপুর পায়ে’। গজলের মতো নজরুল বাংলা গানের আর একটি ধারা তৈরি করেন সেটা হলো তাঁর ইসলামী গান। তিনি বাঙালী জাতেিক উদ্বুদ্ধ করে রচনা করেছেন হামদ, নাত, মার্সিয়া, মোনাজাত ইত্যাদি। বিশুদ্ধ রাগে গান রচনা ও সুর করা ছাড়া তিনি ততোধিক রাগেও গান রচনা করেছেন। নজরুলের দেশপ্রেম ও জাতীয় ভাবোন্মাদনার প্রকাশ পায় তাঁর কোরাস গান রচনা শৈলীতে। যেমন ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, ‘আমরা শক্তি আমরা বল’ ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর সৈনিক জীবন মার্চ সঙ্গীত লিখতে উদ্বুদ্ধ করে তাঁকে। নজরুল তাঁর কীর্তন গানে রাধা কৃষ্ণের বাল্যলীলা, প্রেমলীলা প্রভৃতির যেমন সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন তেমনি তাঁর শ্যামা সঙ্গীতেও কালীর কালো ও অগ্নিরূপের বর্ণনাও করেছেন। নজরুলসঙ্গীতের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো বাণী, সুর ও তালের মধ্যে সুসামঞ্জস্য।
বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুল মুসলিম ঘরানার সার্থক উত্তরসূরী। তাঁর গানের বাণী, সুরবৈচিত্র্য, নব নব শাখা-প্রশাখা বিস্তারে বাংলা গানের ভুবনে তিনি একজন যুগস্রষ্টার আসনে আসীন হয়েছেন। তাঁর প্রতিভার স্পর্শে বাংলা গান যে নতুন হাওয়ার পাল তুলেছিল, তা আজও অব্যাহত গতিতে চলছে। আজও তা চির নতুন, চির বৈচিত্র্যময়, আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
গণসংস্কৃতির সঙ্গে বহু সূত্রে যুক্ত নজরুল সঙ্গীত। নারী জাগরণ, যুব জাগরণ, ছাত্রদল, অসাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলিম মিলন, লেটো, ভাঙা, সর্বহারা, মার্চ, সাম্য, ভক্তি, লোক, পল্লী, ভাটিয়ালি, সাঁওতালি, খেমটা, ঝুমুর, গজল ও হাসির গানের বিরাট একটি ডালি নিয়েও বাংলার আপামর জনসাধারণকে আলোড়িত করছে নজরুলসঙ্গীত। নজরুল গান লিখতেন মজলিসে বসে, সুর করতেন রিহার্সালের কোলাহলে, গান গাইতেন মানুষের সভায়। পঞ্চ কবির সঙ্গে থাকলে তো তাঁর মতো প্রতিভার তুলনা হবেই। বাংলা সঙ্গীতের প্রাক আধুনিক যুগ ছিল রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত ও অতুল প্রসাদের যুগ। এই চার প্রধান সঙ্গীতজ্ঞের গীতি রচনার বিচিত্র ধারার সঙ্গে, নতুন গীতিপন্থার মধ্যবর্তী সেতু রূপে বাংলা সঙ্গীতের আধুনিকতার স্তম্ভ স্বরূপ আবির্ভূত হন কাজী নজরুল ইসলাম। গীত সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন স্বমহিমায় মহিমান্বিত। তাঁর উত্তরসূরীরা ছিলেন উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতির পৃষ্ঠপোষক, যেখানে ছিল ধ্রুপদী ধারার রস এবং সুরের ক্ষেত্রে নানা নিয়মনীতির অনুশাসন। কিন্তু নজরুল ছিলেন তাঁদের থেকে ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন উত্তরভারতীয় মুসলিম সঙ্গীত পদ্ধতির যোগ্য উত্তরসূরী। তিনি বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন উত্তরভারতীয় খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরী, কাজরী, হোরী, লাউনী, নাত, গজল, কাওয়ালী প্রভৃতি বিচিত্র রকমের রঙদার সুরের ঐশ্বর্যে। তিনি বাংলা গানের নতুন নতুন শাখা-প্রশাখা পল্লবিত করে গানের ভুবনকে সুরের সুবাসে সুরভিত করেছেন। এবং সব সুর পিয়াসী মানুষের তৃষিত হৃদয়কে ভরে দিয়েছেন নব নব সৃষ্টির জোয়ারে। নজরুলসঙ্গীতের বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তী এক বিস্ময়ের ব্যাপার। তিনি বাংলা গজল রচনার ক্ষেত্রে আরবী, ফার্সী, তুর্কী, উর্দু প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করে গজলকে সার্থকভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। তাঁর কারণেই বাংলা গানে প্রথম ঠাঁই পেল বুলবুল, সাকী, বেহেশত, গুলবাগ, শিরনী, মিনার প্রভৃতি আরবী ও ফার্সী শব্দ। সংস্কৃতবাহী ভাষাকে ভাব, ছন্দ, লালিত্য ও শব্দ দিয়ে গেঁথে এনে দুর্বোধ্য না করে সহজ ও সাবলীলভাবে বাংলাভাষায় আসন করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। যেমন তার ‘অরুণ কেন করুণ আঁখি’ গানটিতে তিনি সাকী, শারাব আরবী এবং দিল, শিরাজী প্রভৃতি ফারসী শব্দ ব্যবহার করেছেন। আবার কখনও ছন্দ, মাত্রা ও লয়জনিত কারণে তিনি আরবী ও ফার্সী শব্দকে ভেঙে ছোট করেও প্রয়োগ করেছেন তার গানে। যেমন ‘তাওফিক’ থেকে ‘তৌফিক’, ‘রওশন’ থেকে ‘রোশন’ বা ‘রেশমী’ প্রভৃতি। এছাড়া তাঁর লোকসঙ্গীত ও হাসির গানেও লোকজ শব্দের ব্যবহার আছে আবলীলায়। যেমন ‘নাকে নথ দুলাইয়া চলে, কাঁখে কলস পোলা কোলে’।
নজরুল ইসলাম ইরানী কবি হাফিজ বা ওমর খৈয়ামের কাব্যরীতির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই রীতিতে তাঁর গানে ও গজলে উপমার এক জগৎ তিনি গড়ে তুলেছেন। যেমন ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোপায় তারার ফুল, কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল’।
সুরের বৈচিত্র্য নজরুলের গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। গজলের তালছাড়া ‘শায়ের’ তিনি বাংলা গানে প্রথম প্রয়োগ করেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ তিনি ভ্রমণ করেন এবং সেই দেশের গানের সুরের ফ্রেমে বাংলা কথা বসিয়ে তিনি বহু গান রচনা করেছেন। এর মধ্যে একটি হলোÑ‘শুকনো পাতার নুপুর পায়ে’। গজলের মতো নজরুল বাংলা গানের আর একটি ধারা তৈরি করেন সেটা হলো তাঁর ইসলামী গান। তিনি বাঙালী জাতেিক উদ্বুদ্ধ করে রচনা করেছেন হামদ, নাত, মার্সিয়া, মোনাজাত ইত্যাদি। বিশুদ্ধ রাগে গান রচনা ও সুর করা ছাড়া তিনি ততোধিক রাগেও গান রচনা করেছেন। নজরুলের দেশপ্রেম ও জাতীয় ভাবোন্মাদনার প্রকাশ পায় তাঁর কোরাস গান রচনা শৈলীতে। যেমন ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, ‘আমরা শক্তি আমরা বল’ ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর সৈনিক জীবন মার্চ সঙ্গীত লিখতে উদ্বুদ্ধ করে তাঁকে। নজরুল তাঁর কীর্তন গানে রাধা কৃষ্ণের বাল্যলীলা, প্রেমলীলা প্রভৃতির যেমন সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন তেমনি তাঁর শ্যামা সঙ্গীতেও কালীর কালো ও অগ্নিরূপের বর্ণনাও করেছেন। নজরুলসঙ্গীতের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো বাণী, সুর ও তালের মধ্যে সুসামঞ্জস্য।
বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুল মুসলিম ঘরানার সার্থক উত্তরসূরী। তাঁর গানের বাণী, সুরবৈচিত্র্য, নব নব শাখা-প্রশাখা বিস্তারে বাংলা গানের ভুবনে তিনি একজন যুগস্রষ্টার আসনে আসীন হয়েছেন। তাঁর প্রতিভার স্পর্শে বাংলা গান যে নতুন হাওয়ার পাল তুলেছিল, তা আজও অব্যাহত গতিতে চলছে। আজও তা চির নতুন, চির বৈচিত্র্যময়, আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
No comments