আন্তর্জাতিক-ওবামার কায়রো ভাষণ ও আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা by ইমতিয়াজ আহমেদ
প্রায় দুই বছর আগে বারাক ওবামা আরব বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত কায়রোতে বলেছিলেন, জনগণের ইচ্ছাকেই যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ মূল্য দেবে। ওই অঞ্চলের জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রকাশ ঘটছে গণতন্ত্রের দাবির মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতি সম্মান না দেখালে তার নিজের স্বার্থও কিন্তু বিপন্ন হবে
বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নিয়েছিলেন ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি। ক্ষমতার মেয়াদ ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি মিসরের কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন এবং এর আবেদন ওই দেশটির গণ্ডি ছাড়িয়ে পুরো আরব বিশ্বের ওপরেই পড়বে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাৎক্ষণিক অভিমত প্রকাশ করেন। ভাষণে তিনি আরব দেশগুলোতে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে গণতান্ত্রিক বিধিবিধান চালুর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যবস্থা কারও ওপর চাপিয়ে দিতে চায় না। তবে জনগণের এ ধরনের ইচ্ছার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সম্মান প্রদর্শন করবে। তিনি আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, দেশের সম্পদে মুষ্টিমেয় নয় বরং জনগণের অধিকার, বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এসব বিষয় সামনে নিয়ে আসেন। তিনি এটাও বলেন যে, এসব শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব এজেন্ডা নয় বরং বিশ্বের সর্বত্রই রয়েছে মানবাধিকারের প্রতি সমর্থন। তিনি বলেছিলেন, কেবল নির্বাচনেই গণতন্ত্র নিশ্চিত হয় না। এজন্য মানবাধিকার ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান জানাতে হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে হয়। এতে বিকৃতি ঘটলে গণতন্ত্র থাকে না।
তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন ২০০৯ সালের ৪ জুন। আরব বিশ্বের প্রায় কোনো দেশেই গণতন্ত্রের শাসন না থাকা ছিল এর প্রেক্ষাপট। সর্বত্রই ছিল কর্তৃত্ববাদী শাসন। মুক্তবুদ্ধির চর্চা ছিল অকল্পনীয়। সিভিল সোসাইটিকে দাঁড়াতেই দেওয়া হচ্ছিল না। আর এ সুযোগে দেশে দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল জঙ্গিবাদী শক্তি। তারা নিজেদের শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদের পতাকা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। একইসঙ্গে তারা সোচ্চার হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কারণ এ দেশটি তাদের শাসকদের পাশে থাকছিল পূর্ণ শক্তি নিয়ে। তারা বলতে থাকে সত্যিকার ইসলাম কায়েম করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও লড়তে হবে।
আমরা দেখেছি যে, আরব দেশগুলোর জনগণের মধ্যে জঙ্গিবাদের প্রতি তেমন সমর্থন নেই। কিন্তু তাদের দেশে গণতন্ত্র না থাকার জন্য যে শাসকরা দায়ী তাদের প্রতি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। তারা জঙ্গিবাদের সমর্থক নয়, কিন্তু এ শক্তির হুমকির মুখে শাসকদের পাশেও দাঁড়াচ্ছে না। জঙ্গিবাদের মোকাবেলায় সক্রিয় হতেও উৎসাহ দেখাচ্ছে না। কিন্তু তারা সুযোগ পেলেই এ অভিমত বলিষ্ঠ কণ্ঠে জানাতে ভোলেনি যে, একমাত্র গণতন্ত্রই জঙ্গিবাদের থাবা থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে। ওবামার কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া ভাষণ এ ক্ষেত্রে ছিল একটি নতুন বার্তা। এতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানগত পরিবর্তন সম্পর্কে আমরা একটি ধারণা পেয়ে যাই। কিন্তু আরব দেশগুলোর সব শাসক এমন বার্তার মর্ম উপলব্ধি করেছে সেটা বলা চলে না। তিনি বলেছিলেন, জনগণ গণতন্ত্র চায় এবং এজন্য তারা সক্রিয় হলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে থাকবে।
একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি কিন্তু এ অঞ্চলের ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, সমঝোতা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার গঠনের ধারণা এমনকি পাশ্চাত্যেরও অনেক আগে আরব এলাকায় চালু ছিল। মানব সভ্যতার প্রতি এটা ছিল তাদের মূল্যবান অবদান। এ ঐতিহ্যের ব্যত্যয় ঘটেছে।
তিউনিসিয়া ও মিসরের জনগণ গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে নেমে এলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতি সমর্থন জানায় এবং তা ছিল সক্রিয়। তারা বুঝিয়ে দেয় যে, বেন আলি ও হোসনি মোবারকের সঙ্গে ওয়াশিংটন নেই, বরং রয়েছে জনগণের পাশে। এ ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় কাজ করেছে। দুটি দেশের সামরিক বাহিনীর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত অবস্থান তারা সহজেই বুঝতে পারে এবং ক্ষমতাসীনদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। তারা বেন আলি ও হোসনি মোবারকের পাশে না থাকায় শক্তির ভারসাম্য দ্রুত পাল্টে যায়।
কিন্তু লিবিয়ায় ঠিক এভাবে ঘটনাপ্রবাহ অগ্রসর হয়নি। ষাটের দশকের শেষ দিকে স্বল্প জনসংখ্যার এ দেশটিতে ক্ষমতায় আসেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তিনি বিপ্লবী বুলি আওড়াতে পছন্দ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার মিত্রতা নয়, বরং বৈরিতা ছিল। তার দেশের সামরিক বাহিনীর ওপর মিসর বা তিউনিসিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব নেই। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র চাপ সৃষ্টি করে গাদ্দাফির বিপক্ষে তাদের নিতে পারেনি, যেমনটি পেরেছিল মিসরে। এটাও মনে রাখা দরকার যে, লিবিয়ায় বেশ কিছু জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গত চার দশকে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। মাথাপিছু আয়ে এ দেশটি অনেক আরব দেশের তুলনায় এগিয়ে। স্বাস্থ্য ও বাসস্থান সমস্যার সমাধানে সরকার অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিক্ষার হার আরব দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। গাদ্দাফির এসব ইতিবাচক কাজের পরও জনগণের বড় অংশের মধ্যে গণতন্ত্রের দাবি জোরালো হতে থাকে। দেশের প্রধান শাসক একনায়কে পরিণত হয়েছেন। তিনি আজীবন ক্ষমতার দণ্ড হাতে রাখতে চাইছেন এবং পুত্রদের উত্তরাধিকার হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করেছেন। জনগণ এটা পছন্দ করেনি। তাদের এ নিয়ে ক্ষোভ ও রোষের প্রকাশ ঘটে মিসর ও তিউনিসিয়ায় গণবিক্ষোভ সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। এ দুটি দেশ লিবিয়ার দুই পাশে অবস্থিত। গাদ্দাফি তার অনুগত সেনাবাহিনী দিয়ে গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে নেমে আসা জনগণকে দমন করতে উদ্যোগী হন। এজন্য অনুগত সেনাবাহিনী দিয়ে নিষ্ঠুর উপায় অবলম্বন করেন। বিমান থেকে বোমা হামলা চালানো হয়। সেনা ও বিমানবাহিনীর শীর্ষ নেতারা এটা বুঝতে পারেন যে, গাদ্দাফির সঙ্গেই তাদের ভাগ্য জড়িত। তিনি ক্ষমতায় না থাকলে অর্থাৎ দেশে পরিবর্তন ঘটলে তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। মিসর কিংবা তিউনিসিয়ায় এটা ঘটেনি।
লিবিয়ায় গণবিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে ন্যাটোর নেতৃত্বে পশ্চিমা বাহিনী নো ফ্লাই জোন চালু করে এবং সক্রিয় সামরিক তৎপরতা শুরু করে। এটা করার দাবি সে দেশের জনগণের একটি অংশ থেকেও এসেছে। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা লিবিয়ায় হস্তক্ষেপের জন্য দশকের পর দশক ধরে যে সুযোগ খুঁজছিল সেটা এভাবে পেয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য সুবিধাজনক অবস্থা সৃষ্টি হয় গাদ্দাফির অনুগত সেনাবাহিনীর জনগণের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে। আরব লীগও নো ফ্লাই জোন চালুর প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে।
তবে লিবিয়ায় এ ধরনের হস্তক্ষেপের কারণে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রের আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা না হলেও এক ধরনের প্রশ্ন উঠছেই। গাদ্দাফির আরও কিছুকাল ক্ষমতায় থেকে গেলে তাকে অপসারণের প্রক্রিয়ায় ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি আরও বাড়তে পারে। সৌদি আরবসহ অনেক দেশের শাসকরা এ কথাও বলতে পারেন যে, গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে মাঠে নামার পরিণতি লিবিয়ার মতো হতে পারে।
তবে শাসকরা যাই বলুক না কেন আরব দেশগুলোর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে আসবে বলে মনে হয় না। আমরা দুই দশক আগে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের পক্ষে যে গণজোয়ার দেখেছি এখন সেটাই শুরু হয়েছে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এটা কোন দেশে কীভাবে সফল হবে, সেটা দেখার বিষয়। তবে আদি গণতন্ত্রের ওই অঞ্চলে এ প্রক্রিয়া সফল হবেই। তাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের বন্ধন শত শত বছর আগের ঘটনা। মাঝে এতে ছেদ পড়েছে বটে কিন্তু নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে এবং তা সফল হবেই। কোথাও কোথাও হয়তো শাসকরা ঘটনাপ্রবাহকে সাময়িক সময়ের জন্য ভিন্ন খাতে সরিয়ে নিতে পারে। কোথাও হয়তো ধারণার চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারে; কিন্তু জনগণ থেমে থাকবে না।
মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের এ অভিযাত্রা ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানও সহজ করে দেবে বলে ধারণা করা যায়। এতদিন ইসরায়েল পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে এটা বোঝাত যে, কেবল তাদের দেশেই রয়েছে গণতন্ত্র। মিসর ও তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের পক্ষে জনগণ পথে নেমেছে এবং জয়যুক্ত হয়েছে। অন্যান্য দেশেও তা সফল হবে তাতে সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় স্বাধীন দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকার করে নিতে ইসরায়েলও বাধ্য হবে।
কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, যারা পরাশক্তি তারা মাঝে মধ্যে নানাভাবে বিশ্বকে সেটা জানানোর চেষ্টা করে থাকে। লিবিয়ায় সামরিক শক্তি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটোর মিত্ররা হয়তো সেটাই করছে। তারা সামরিক দাঁত দেখাচ্ছে এবং এভাবে সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষ নতুন করে প্রকাশ পাচ্ছে এমন শঙ্কা স্বাভাবিক। তবে যুগ কিন্তু বদলে যাচ্ছে। লিবিয়ায় যদি যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা ইরাকের মতো আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে সেটা জনগণ মেনে নেবে বলে মনে হয় না। তারা যদি জনগণের প্রত্যাশার বিপরীতে গিয়ে কোটারি গোষ্ঠীকে সমর্থন করে তারও প্রতিরোধ কিন্তু আসবে জনগণের মধ্য থেকেই।
প্রায় দুই বছর আগে বারাক ওবামা আরব বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত কায়রোতে বলেছিলেন, জনগণের ইচ্ছাকেই যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ মূল্য দেবে। ওই অঞ্চলের জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রকাশ ঘটছে গণতন্ত্রের দাবির মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতি সম্মান না দেখালে তার নিজের স্বার্থও কিন্তু বিপন্ন হবে।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন ২০০৯ সালের ৪ জুন। আরব বিশ্বের প্রায় কোনো দেশেই গণতন্ত্রের শাসন না থাকা ছিল এর প্রেক্ষাপট। সর্বত্রই ছিল কর্তৃত্ববাদী শাসন। মুক্তবুদ্ধির চর্চা ছিল অকল্পনীয়। সিভিল সোসাইটিকে দাঁড়াতেই দেওয়া হচ্ছিল না। আর এ সুযোগে দেশে দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল জঙ্গিবাদী শক্তি। তারা নিজেদের শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদের পতাকা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। একইসঙ্গে তারা সোচ্চার হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কারণ এ দেশটি তাদের শাসকদের পাশে থাকছিল পূর্ণ শক্তি নিয়ে। তারা বলতে থাকে সত্যিকার ইসলাম কায়েম করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও লড়তে হবে।
আমরা দেখেছি যে, আরব দেশগুলোর জনগণের মধ্যে জঙ্গিবাদের প্রতি তেমন সমর্থন নেই। কিন্তু তাদের দেশে গণতন্ত্র না থাকার জন্য যে শাসকরা দায়ী তাদের প্রতি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। তারা জঙ্গিবাদের সমর্থক নয়, কিন্তু এ শক্তির হুমকির মুখে শাসকদের পাশেও দাঁড়াচ্ছে না। জঙ্গিবাদের মোকাবেলায় সক্রিয় হতেও উৎসাহ দেখাচ্ছে না। কিন্তু তারা সুযোগ পেলেই এ অভিমত বলিষ্ঠ কণ্ঠে জানাতে ভোলেনি যে, একমাত্র গণতন্ত্রই জঙ্গিবাদের থাবা থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে। ওবামার কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া ভাষণ এ ক্ষেত্রে ছিল একটি নতুন বার্তা। এতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানগত পরিবর্তন সম্পর্কে আমরা একটি ধারণা পেয়ে যাই। কিন্তু আরব দেশগুলোর সব শাসক এমন বার্তার মর্ম উপলব্ধি করেছে সেটা বলা চলে না। তিনি বলেছিলেন, জনগণ গণতন্ত্র চায় এবং এজন্য তারা সক্রিয় হলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে থাকবে।
একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি কিন্তু এ অঞ্চলের ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, সমঝোতা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার গঠনের ধারণা এমনকি পাশ্চাত্যেরও অনেক আগে আরব এলাকায় চালু ছিল। মানব সভ্যতার প্রতি এটা ছিল তাদের মূল্যবান অবদান। এ ঐতিহ্যের ব্যত্যয় ঘটেছে।
তিউনিসিয়া ও মিসরের জনগণ গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে নেমে এলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতি সমর্থন জানায় এবং তা ছিল সক্রিয়। তারা বুঝিয়ে দেয় যে, বেন আলি ও হোসনি মোবারকের সঙ্গে ওয়াশিংটন নেই, বরং রয়েছে জনগণের পাশে। এ ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় কাজ করেছে। দুটি দেশের সামরিক বাহিনীর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত অবস্থান তারা সহজেই বুঝতে পারে এবং ক্ষমতাসীনদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। তারা বেন আলি ও হোসনি মোবারকের পাশে না থাকায় শক্তির ভারসাম্য দ্রুত পাল্টে যায়।
কিন্তু লিবিয়ায় ঠিক এভাবে ঘটনাপ্রবাহ অগ্রসর হয়নি। ষাটের দশকের শেষ দিকে স্বল্প জনসংখ্যার এ দেশটিতে ক্ষমতায় আসেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তিনি বিপ্লবী বুলি আওড়াতে পছন্দ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার মিত্রতা নয়, বরং বৈরিতা ছিল। তার দেশের সামরিক বাহিনীর ওপর মিসর বা তিউনিসিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব নেই। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র চাপ সৃষ্টি করে গাদ্দাফির বিপক্ষে তাদের নিতে পারেনি, যেমনটি পেরেছিল মিসরে। এটাও মনে রাখা দরকার যে, লিবিয়ায় বেশ কিছু জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গত চার দশকে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। মাথাপিছু আয়ে এ দেশটি অনেক আরব দেশের তুলনায় এগিয়ে। স্বাস্থ্য ও বাসস্থান সমস্যার সমাধানে সরকার অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিক্ষার হার আরব দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। গাদ্দাফির এসব ইতিবাচক কাজের পরও জনগণের বড় অংশের মধ্যে গণতন্ত্রের দাবি জোরালো হতে থাকে। দেশের প্রধান শাসক একনায়কে পরিণত হয়েছেন। তিনি আজীবন ক্ষমতার দণ্ড হাতে রাখতে চাইছেন এবং পুত্রদের উত্তরাধিকার হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করেছেন। জনগণ এটা পছন্দ করেনি। তাদের এ নিয়ে ক্ষোভ ও রোষের প্রকাশ ঘটে মিসর ও তিউনিসিয়ায় গণবিক্ষোভ সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। এ দুটি দেশ লিবিয়ার দুই পাশে অবস্থিত। গাদ্দাফি তার অনুগত সেনাবাহিনী দিয়ে গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে নেমে আসা জনগণকে দমন করতে উদ্যোগী হন। এজন্য অনুগত সেনাবাহিনী দিয়ে নিষ্ঠুর উপায় অবলম্বন করেন। বিমান থেকে বোমা হামলা চালানো হয়। সেনা ও বিমানবাহিনীর শীর্ষ নেতারা এটা বুঝতে পারেন যে, গাদ্দাফির সঙ্গেই তাদের ভাগ্য জড়িত। তিনি ক্ষমতায় না থাকলে অর্থাৎ দেশে পরিবর্তন ঘটলে তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। মিসর কিংবা তিউনিসিয়ায় এটা ঘটেনি।
লিবিয়ায় গণবিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে ন্যাটোর নেতৃত্বে পশ্চিমা বাহিনী নো ফ্লাই জোন চালু করে এবং সক্রিয় সামরিক তৎপরতা শুরু করে। এটা করার দাবি সে দেশের জনগণের একটি অংশ থেকেও এসেছে। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা লিবিয়ায় হস্তক্ষেপের জন্য দশকের পর দশক ধরে যে সুযোগ খুঁজছিল সেটা এভাবে পেয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য সুবিধাজনক অবস্থা সৃষ্টি হয় গাদ্দাফির অনুগত সেনাবাহিনীর জনগণের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে। আরব লীগও নো ফ্লাই জোন চালুর প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে।
তবে লিবিয়ায় এ ধরনের হস্তক্ষেপের কারণে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রের আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা না হলেও এক ধরনের প্রশ্ন উঠছেই। গাদ্দাফির আরও কিছুকাল ক্ষমতায় থেকে গেলে তাকে অপসারণের প্রক্রিয়ায় ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি আরও বাড়তে পারে। সৌদি আরবসহ অনেক দেশের শাসকরা এ কথাও বলতে পারেন যে, গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে মাঠে নামার পরিণতি লিবিয়ার মতো হতে পারে।
তবে শাসকরা যাই বলুক না কেন আরব দেশগুলোর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে আসবে বলে মনে হয় না। আমরা দুই দশক আগে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের পক্ষে যে গণজোয়ার দেখেছি এখন সেটাই শুরু হয়েছে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এটা কোন দেশে কীভাবে সফল হবে, সেটা দেখার বিষয়। তবে আদি গণতন্ত্রের ওই অঞ্চলে এ প্রক্রিয়া সফল হবেই। তাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের বন্ধন শত শত বছর আগের ঘটনা। মাঝে এতে ছেদ পড়েছে বটে কিন্তু নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে এবং তা সফল হবেই। কোথাও কোথাও হয়তো শাসকরা ঘটনাপ্রবাহকে সাময়িক সময়ের জন্য ভিন্ন খাতে সরিয়ে নিতে পারে। কোথাও হয়তো ধারণার চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারে; কিন্তু জনগণ থেমে থাকবে না।
মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের এ অভিযাত্রা ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানও সহজ করে দেবে বলে ধারণা করা যায়। এতদিন ইসরায়েল পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে এটা বোঝাত যে, কেবল তাদের দেশেই রয়েছে গণতন্ত্র। মিসর ও তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের পক্ষে জনগণ পথে নেমেছে এবং জয়যুক্ত হয়েছে। অন্যান্য দেশেও তা সফল হবে তাতে সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় স্বাধীন দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকার করে নিতে ইসরায়েলও বাধ্য হবে।
কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, যারা পরাশক্তি তারা মাঝে মধ্যে নানাভাবে বিশ্বকে সেটা জানানোর চেষ্টা করে থাকে। লিবিয়ায় সামরিক শক্তি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটোর মিত্ররা হয়তো সেটাই করছে। তারা সামরিক দাঁত দেখাচ্ছে এবং এভাবে সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষ নতুন করে প্রকাশ পাচ্ছে এমন শঙ্কা স্বাভাবিক। তবে যুগ কিন্তু বদলে যাচ্ছে। লিবিয়ায় যদি যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা ইরাকের মতো আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে সেটা জনগণ মেনে নেবে বলে মনে হয় না। তারা যদি জনগণের প্রত্যাশার বিপরীতে গিয়ে কোটারি গোষ্ঠীকে সমর্থন করে তারও প্রতিরোধ কিন্তু আসবে জনগণের মধ্য থেকেই।
প্রায় দুই বছর আগে বারাক ওবামা আরব বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত কায়রোতে বলেছিলেন, জনগণের ইচ্ছাকেই যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ মূল্য দেবে। ওই অঞ্চলের জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রকাশ ঘটছে গণতন্ত্রের দাবির মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতি সম্মান না দেখালে তার নিজের স্বার্থও কিন্তু বিপন্ন হবে।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments