চরাচর-সীমান্তের টোকাই by বিশ্বজিৎ পাল বাবু

রাব্বি, ফারুক, সেন্টু, হুমায়ুন, খায়রুল, আজিদ, শাহীন, সুমন, রাজীব- ওদের বয়স আট থেকে ১২ বছর। ওরা সীমান্তের টোকাই। কেউ ডাকে কুলি। সীমান্তেই ওদের কাজকাম। এ বয়সেই ওরা ধরেছে সংসারের হাল। পাসপোর্টের মাধ্যমে এপার-ওপার হওয়া যাত্রীদের মালামাল টেনে নিয়ে যা পায়, তা বাড়তি আয় হিসেবে তাদের সংসারে যোগ হয়।


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে অন্তত ১০-১২টি শিশু এ পেশায় নিয়োজিত। কেউ আবার রপ্তানি হওয়া পাথর কুড়িয়ে বাড়তি আয় করে। একসঙ্গে পিতা-পুত্রকেও পাওয়া যায় এ পেশায়। সীমান্তে বসে কথা হলে ওরা জানায় সুখ-দুঃখের কাহিনী। সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডের কাছে গিয়ে দেখা যায়, ছয়-সাতটি শিশুর একটি দল মাটিতে বসে আছে। তাদের অপলক দৃষ্টি ভারতের দিকে। কখনো পেছন ফিরে তাকাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। এই বুঝি ভারী ব্যাগ নিয়ে যাত্রী এলো!
এরই মধ্যে ভারত থেকে তিন যাত্রীকে আসতে দেখে নো ম্যানস ল্যান্ডের বাঁশ অতিক্রম করে ওরা সবাই ছুটে যায় ভারতের অভ্যন্তরে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল ব্যাগ নেওয়ার জন্য সবার এ কী আকুতি। স্যার দেন না, আমি নেই, আঙ্কেল দেন না, আমি নেই, দাদা আমি আজকা প্যাসেঞ্জার পাইছি না ইত্যাদি কথাবার্তা ভেসে আসছিল কানে। কথার একপর্যায়ে আজিদের হাতে ব্যাগ তুলে দিলেন যাত্রীরা। পঙ্গু (ডান হাতের কব্জির অংশ নেই) আজিদকে দেখে হয়তো কিছুটা দরদই লেগেছিল তাঁদের।
কথা প্রসঙ্গে সীমান্তের ওই টোকাইরা জানায়, ব্যাগ বহনে তাদের নির্ধারিত কোনো দর নেই। খুশি হয়ে যে যা দেয়, তাতেই তারা খুশি হয়। তবে মাঝেমধ্যে একটু বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রতিদিন তাদের গড় আয় এক থেকে দেড় শ টাকা। কখনো সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে সাত শ টাকাও আয় হয় তাদের।
টোকাই রাব্বি জানায়, তার বাবা ইমিগ্রেশনের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সে সবার ছোট। চার বোনের বিয়ে হয়েছে। ব্যাগ টেনে যে টাকা আয় হয়, তা সে তুলে দেয় মায়ের হাতে। যাঁরা বেশি টাকা দেন, তাঁরা রাব্বির কাছে দামি লোক। দামি লোক সে নাকি পোশাক আর বেশভূষা দেখেই চিনতে পারে।
ফারুক ও তার বাকপ্রতিবন্ধী বাবা রশিদ মিয়া এই একই পেশায় জড়িত। দুই ভাই ও চার বোনের সংসার। ফারুক শঙ্কা প্রকাশ করে বলে, 'ভাই আমডারে লইয়া বেশি লেইককেন না। তাইলে কইলাম রুজি বন্ধ অইয়া যাইব। অহন বিডিআর (বিজিবি), বিএসএফ কিছু কয় না। আফনে লেখলে আমডার ব্যাগ টানা হেরা বন্ধ কইরা দিব।'
সেন্টু বলে, 'সরকার যদি আমডারে একটা কার্ড কইরা দেয়, তাইলে আমডার লাইগ্যা বালা অইব। তহন আর আমডার কোনো ডর থাকত না।' তার মতে, বাংলাদেশের বড় বড় গার্মেন্ট ব্যবসায়ী কিংবা পদস্থ কোনো কর্মকর্তার ব্যাগ টানতে পারলে বেশি টাকা পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ টাকা না দিয়েই চলে যায় বলে
অভিযোগ তার।
বিশ্বজিৎ পাল বাবু

No comments

Powered by Blogger.