ডিএনএ পরীক্ষা শুধুই লোকদেখানো! by পারভেজ খান
ডিএনএ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শরীফ আখতারুজ্জামান বললেন, 'ডিএনএ পরীক্ষা করে কখনো হত্যাকারী বা সম্ভাব্য হত্যাকারী শনাক্ত করা সম্ভব নয়। কোনো দেশের ডিএনএ প্রতিবেদনে এটা কখনো বলাও হয় না।
এ ধরনের পরীক্ষায় যেসব ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়, সেগুলোই পৃথক করে উল্লেখ করা হয়। আর পরীক্ষায় প্রাপ্ত সেই ডিএনএ প্রোফাইলগুলো কার, সেটা বের করাও সম্ভব নয়। তবে কেউ যদি সন্দেহভাজনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা নমুনা ডিএনএ প্রোফাইল পাঠিয়ে থাকে, তবে তার সঙ্গে পরীক্ষায় পাওয়া প্রোফাইলের মিল খুঁজে পাওয়া গেলে সেটা বলা সম্ভব যে উভয় প্রোফাইল একই ব্যক্তির।'
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্তে র্যাব সর্বশেষ যে ডিএনএ পরীক্ষার পথ ধরেছে, সেটা সম্পর্কে এভাবে নানাজনের মতো বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিরাও প্রশ্ন তুলছেন। তাঁদের কেউ মনে করছেন, র্যাবের এই চেষ্টা স্রেফ সময় ক্ষেপণ। কেউ বলছেন, এটা শুধুই আইওয়াশ তথা লোকদেখানো। আবার কেউ 'শাক দিয়ে মাছ ঢাকা', 'নেই কাজ তো খৈ ভাজ'- এ রকমও বলছেন।
সম্প্রতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের জায়গায় পাওয়া বিভিন্ন আলামত র্যাবের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয় ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। ডিএনএ হলো 'ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক এসিড'। এটা থাকে জীবকোষের মধ্যকার ক্রোমোজোমের ভেতরে যে জিন, তার মধ্যে। একেক জীবের যে একেক রকম চেহারা ও বৈশিষ্ট্য হয়, এর কারণ একেক জীবের ডিএনএর নকশা একেক রকম। এমনকি একেক মানুষের ডিএনএ নকশাও একেক রকম। আর এই ডিএনএর মাধ্যমেই কোনো জীব বা প্রাণীর চেহারা ও বৈশিষ্ট্য তার সন্তানের মধ্যে বাহিত হয়। কোনো জীবকোষ পরীক্ষা করে সেই জীবের ডিএনএর নকশা পাওয়া সম্ভব। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের জায়গায় পাওয়া আলামত যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাগারে পরীক্ষা করে জানানো হয়, তাতে কয়েক ধরনের ডিএনএ নকশা পাওয়া গেছে। অর্থাৎ কয়েক ব্যক্তির কোষ পাওয়া গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এরা কারা? কতজনকে ধরে ধরে পরীক্ষা করে মেলানো হবে ওই ডিএনএ কার? আর কারোটা মিললেই তো আর বলা যাবে না, সে-ই খুনি! মজার কথা হলো, ওই ডিএনএ র্যাব-পুলিশের কোনো সদস্যেরও হতে পারে। কারণ, তাঁরাও ঘটনাস্থলে গেছেন, আলামত খালি হাতে নাড়াচাড়া করেছেন এবং তাঁদের দেহকোষও আলামতের গায়ে লেগে থাকতে পারে। আবার সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের ডিএনএ-ও পাওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশের একমাত্র অপরাধ বিদ্যা অধ্যয়নের স্থান মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিদ্যা ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান সাদী কালের কণ্ঠকে বলেন, এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রে এই ডিএনএ পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে এক ব্যক্তির যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতে সে নির্দোষও প্রমাণিত হয়। তাই শুধু ডিএনএর ওপর ভিত্তি করে তদন্ত সম্ভব নয়। তা ছাড়া মরদেহের শরীরে কোনো ব্যক্তির স্পর্শ পাওয়া গেলেও সেই স্পর্শ বা ডিএনএ প্রোফাইল মৃত্যুর আগের না পরের, সেটা পরীক্ষায় বের করা সম্ভব নয়। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর অসংখ্য ব্যক্তি ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। অনেকেই মরদেহ এবং আশপাশের জিনিসপত্র স্পর্শ করেছেন।
ডিএনএ পরীক্ষায় সবারই উপস্থিতি প্রমাণিত হবে। এর অর্থ এই নয় যে, এরা সবাই খুনি। মূলত তদন্তেই বের হয়ে আসবে, খুনি কে বা কারা। এ ছাড়া সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে পুলিশের ক্রাইম সিন টিম পৌঁছায় অনেক পরে। এর আগেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট হয়ে গেছে। এটিও তদন্ত কাজের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একজন কর্মকর্তা অনেকটা ক্ষিপ্ততার সঙ্গে এই প্রতিবেদককে বলেন, 'ডিবি পুলিশের দুই মাসের তদন্ত আপনারা সহ্য করতে পারলেন না। আমাদের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার হাজারো অভিযোগ আনলেন। রাজপথে নামলেন। আমরা স্বীকার করছি, তদন্তে আশাব্যঞ্জক কোনো সফলতা দেখাতে পারিনি। কিন্তু র্যাব করছেটা কী? ওদের তো পুলিশের চেয়ে অনেক আধুনিক প্রযুক্তি আছে। ওরাও তো আজ পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারল না। গ্রেপ্তার দূরে থাক, হত্যাকাণ্ডের মোটিভও বের হলো না। লাশ উঠিয়ে ভিসেরা করাল। রেজাল্ট জিরো। এখন দেশ রেখে বিদেশে আলামত পাঠিয়ে ডিএনএ করাচ্ছে। ডিএনএ কি খুনি শনাক্ত করে? এগুলো আইওয়াশ মাত্র। শাক দিয়ে মাছ ঢাকছে। আর আপনারাও এখন চুপ। যত পারেন, শুধু পুলিশের সঙ্গে!'
ডিএনএ বিশেষজ্ঞ ড. শরীফ আখতারুজ্জামান বলেন, 'র্যাব কেন আলামত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছে, সেটা একমাত্র র্যাবই বলতে পারবে। তবে আমি মনে করি, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে যে ডিএনএ পরীক্ষা করানো হচ্ছে বলে আমি শুনেছি, বাংলাদেশের ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে সেই পরীক্ষা করানো সম্ভব। এতে খরচও অনেক কম পড়ত। অথচ র্যাব বা সরকারের কোনো সংস্থা এ ব্যাপারে আমার বা আমাদের সঙ্গে কোনো কথা বলেনি।'
আখতারুজ্জামান বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মাইক্রো স্যাটেলাইট মার্কার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সারা বিশ্বে একই প্রযুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত হয় কডিক্স, বাংলাদেশে হচ্ছে আইডেন্টি ফাইলার। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের এফবিআই ব্যবহার করে ১২টি মার্কার। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যবহার করা হয় ১৫টি। বাংলাদেশ অনেক ডিএনএ পরীক্ষাই সফলভাবে সম্পন্ন করেছে এবং সেটা এ দেশের আদালতে গৃহীতও হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন সাবেক আইজিপি বলেন, র্যাব কেন এটা করছে বা বাংলাদেশে কেন এই পরীক্ষা করাল না সেটা তাঁর কাছেও বোধগম্য নয়, বরং রহস্যজনক। দেশে করা হলে সরকারেরও অনেক অর্থ অপচয় রোধ করা যেত।
সাবেক ওই আইজিপি আরো বলেন, প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে পুলিশ বা র্যাবের কাছে ডেটা বেইজড প্রোফাইল নেই। কিছু সন্ত্রাসীর ক্ষেত্রে হাতের ছাপ সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। তবে পুলিশকে ম্যানেজ করে অনেক অপরাধীই এই ছাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকে। এ ছাড়া যেসব অপরাধী গ্রেপ্তার হয়নি, তাদের তো ছাপ সংরক্ষণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর জানা মতে, এই ঘটনায় পুলিশ এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজন কারোই হাতের ছাপ বা ডিএনএ প্রোফাইল সংরক্ষণ করেনি, যাদের সঙ্গে পরীক্ষার নকশার মিল পাওয়া যাবে।
সাবেক আইজিপি আরো বলেন, তথ্য আর প্রমাণ বের করার আরো অনেক প্রযুক্তি ও কৌশলই পুলিশ ও র্যাবের জানা আছে। বাংলাদেশে হাজার হাজার খুনের ঘটনা শনাক্ত হচ্ছে, আসামি গ্রেপ্তার হচ্ছে। অতীতে কারো ক্ষেত্রে এই খুনি ধরতে ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হয়নি। ধরা পড়ার পর শত প্রমাণ পাওয়ার পরও কেউ যদি সেটা অস্বীকার করে, সে ক্ষেত্রে এই ডিএনএ পরীক্ষা বেশি কাজে লাগে। ফলে সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের নামে যা চলছে তাতে এই মুহূর্তে তাঁর কাছে আইওয়াশ বা সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। তাঁর মতে, যদি এমন হয়, কিছু একটা করতে হবে বলেই করা, তাহলে আর বলার কিছু নেই।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিদ্যা ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই মামলার তদন্তে অগ্রগতি নিয়ে আমি নিজেই সন্দিহান। উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি আছে বলে মনে হয় না। ডিএনএ পরীক্ষা তদন্তের একটি অংশ মাত্র। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, ডিএনএ করে খুনি শনাক্ত করা যায় না। সম্ভাব্য খুনিকে পাওয়া গেলে এটা একটা সহায়ক শক্তি হতে পারে মাত্র।'
ওমর ফারুক বলেন, 'আমাদের দেশে অপরাধীদের ডিএনএ প্রোফাইল অথবা ছাপ ধরে রাখার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এখনো তৈরি হয়নি। এটা খুবই জরুরি। যেহেতু, পুলিশ বা র্যাব এখন পর্যন্ত কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি, সেহেতু এখন প্রয়োজন, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্রিমিনাল মোটিভ কী ছিল সেটা স্পষ্টভাবে খুঁজে বের করা। আর এটা বের করার পর দেখতে হবে, এই ঘটনার আগে বা পরে ঘটে যাওয়া এ ধরনের অন্য কোনো ঘটনার সঙ্গে এর কোনো সাদৃশ্য আছে কি না। পাওয়া গেলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, হত্যাকারীরা পেশাদার খুনি। তখন আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর বের হয়ে আসতে পারে।'
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান আরো বলেন, 'বিভিন্ন মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, সঠিক তদন্ত আর আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক রহস্যই খোলাসা হয়ে আসছে। কিন্তু এই ঘটনার ক্ষেত্রে এ রকম কেন হচ্ছে সেটা অনেকেরই প্রশ্ন। প্রশ্ন আছে, এই তদন্ত আসলে লোকদেখানো কি না। আসলে আমাদের দেশে যাঁরা এই তদন্তকাজগুলো করেন, তাঁদের একাধারে যেমন নানান প্রতিবন্ধকতা আছে, তেমনি অনেকের শিক্ষারও অভাব আছে।'
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বললেও র্যাবের আইন ও মিডিয়া উইংসের পরিচালক কমান্ডার সোহায়েল বলেন, আদালতের নির্দেশক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রে আলামত পাঠিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করানো হচ্ছে। এ ছাড়া কনটাক্ট ডিএনএ ও টাস্ড ডিএনএ বাংলাদেশে হয় না বলে তিনি জানান।
কমান্ডার সোহায়েল আরো বলেন, তিনিও মনে করেন না যে একমাত্র ডিএনএ পরীক্ষাতেই খুনি বের করা সম্ভব। তবে খুনি শনাক্ত করতে এটা সহায়ক হবে এবং এই পরীক্ষাটা তাঁদের তদন্তেরই একটি অংশ।
কমান্ডার সোহায়েলের বক্তব্যের ব্যাপারে ডিএনএ বিশেষজ্ঞ ড. শরীফ আখতারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে টাস্ড ডিএনএ এবং কনটাক্ট ডিএনএ হয় না, এটি ঠিক নয়। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এই পরীক্ষা এখানেও করা সম্ভব। তবে কেউ করাতে না চাইলে সেটা ভিন্ন কথা।
ঘটনার পর সাগর বা রুনির ডিএনএ সংরক্ষণ করা হয়নি। ডিবি পুলিশও এটি করাননি। এখন র্যাবকে সেটা করতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘটনা ঘটেছে রাতের যেকোনো সময়। আলামত যাতে নষ্ট না হয়ে যায়, সে কারণে পুলিশের ক্রাইম সিন টিম সকাল পৌনে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে যায়। কিন্তু এর আগেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট হয়ে যায়। অনেকেই মৃতদেহ ও পাশে পড়ে থাকা ধারালো অস্ত্র স্পর্শ করেছে। আর সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতিও ছিল ভিন্ন। এ ছাড়া সেই মুহূর্তে ডিএনএ পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ হয়নি বলেই করা হয়নি।
No comments