আজ তৌহিদ, কাল আমি, পরশু আপনি তারপর ...? by আসিফ ত্বাসীন
আরও একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু। ঝরে পড়ল আরও একটি প্রাণ। এভাবেই দিন যায়, দিন আসে। ঘটনাচক্রে পুরনো সবকিছুই বারংবার ঘুরে-ফিরে আসে। টনক নড়ে না কারও। কেউ নজর দেয় না সাধারণের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিদিন চরম নিরাপত্তাহীনতায় চলাফেরা করছেন ৪০ হাজারেরও বেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী।
ক্যাম্পাসের সবক’টি প্রবেশ পথ অরক্ষিত অবস্থায় থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মধ্য দিয়ে নির্বিঘেœ চলাচল করছে ভারি যানবাহন। এসব যানবাহনের নিচে চাপা পড়ে ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ক্যাম্পাসেই নিহত হয়েছেন এক শিক্ষক ও শিক্ষকের স্ত্রীসহ ৯ শিক্ষার্থী। আর বিভিন্ন সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আহত হয়েছেন অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
রাজধানীর শাহবাগ মোড় একটি ব্যস্ততম সড়ক। এখান দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করে হাজার হাজার গাড়ি। শাহবাগের ফুটপাথে হাঁটে লাখ লাখ মানুষ। একদিন ঘণ্টাখানেকের জন্যও শাহবাগ মোড় বন্ধ থাকলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় রাজধানীর প্রায় সব এলাকার মানুষকে। রাজধানীর ব্যস্ততম এ মোড়টিতে ওভার ব্রিজ কিংবা আন্ডারপাসের (পাতাল সড়ক) দাবি বহু পুরান। কিন্তু বার বার কেবল আশ্বাসই পাওয়া গেছে। বাস্তবায়ন হয়নি কিছু, দেখা যায়নি কোন আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে দুর্ঘটনা কমাতে এখানে সব ধরনের যানবাহন প্রবেশ বন্ধ করারও দাবি অনেক পুরান। কিন্তু বার বার দুর্ঘটনা ঘটলেও এর কোন সমাধান হচ্ছে না।
মঙ্গলবার ব্যস্ততম শাহবাগের রাস্তাটি পার হতে গিয়েই প্রাণ দিতে হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মেধাবী ছাত্র মোঃ তৌহিদুজ্জামানকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে এরই প্রবেশ মুখ থেকে ঘাতক বাস কেড়ে নিল একটা প্রাণ। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ট্রাফিক আইন ভেঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছিল ড্রাইভার। তার বেপরোয়া গতিই সকলের চোখের সামনে কেড়ে নিয়েছে এক উদ্দাম জীবন। তৌহিদের বন্ধুদের আক্ষেপ, যদি এখানে একটা আন্ডারপাস এতদিনে নির্মাণ হয়ে যেত তবে আর তাকে হারাতে হতো না।
বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা গাড়ি ভাঙ্গল, আগুন দিল, স্থাপনা ভাঙ্গল, পুলিশ বক্স জ্বালিয়ে দিল...। কিন্তু আদৌ কি তাদের দাবি পূরণ হবার। বারংবার একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। ২০০৫ সালের ২৮ মে থেকে ২০১২ সালের ২৮ আগস্ট। সাত বছরের বেশি সময়ে একটি প্রতিশ্রুতিও পূরণ করতে পারল না কেউ। বাস্তবায়িত হলো না কারও স্বপ্ন। পরিণামে ঝরে পড়ল আরও একটি তাজা প্রাণ।
২০০৫ সালের ২৮ মে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী শাম্মী আক্তার হ্যাপী। তাঁর মৃত্যুর পরও একই কাহিনী। ছাত্রদের উত্তাল মিছিল, সমাবেশ, ভাংচুর, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও। ছাত্রদের থামাতে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং তৎকালীন ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা শাহবাগে আন্ডারপাস তৈরি করে দেয়ার ঘোষণা দেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হবে কাজ। কিন্তু সে সপ্তাহ আজও কাটেনি। আবারও ফিরে এসেছে আরেকটি আন্দোলন। এবারও কি শেষ পর্যন্ত তা-ই হবে? আন্দোলন চলবে দিনের পর দিন? প্রশাসন আশ্বাসের ফেনা তুলবে? তারপর কি স্তিমিত হয়ে যাবে সেই আন্দোলন যতদিন না আরেকটি লাশ পড়ে? এমন প্রশ্নগুলোই বুধবার তুলেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তাদের ভাষায়, ‘আজ তৌহিদ, কাল আমি, পরশু আপনি, তারপর...?’
২০১০ সালে সরকারের মেট্রো রেল প্রকল্প হাতে নিয়ে সেটি আলোচনা থেকেই উঠে যায়। এরপরে আন্ডারপাস বা মেট্রো রেল কোনটিই বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এর মাশুল গুনতে হলো সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র তৌহিদুজ্জামানকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি প্রবেশ পথ শাহবাগ মোড়, পলাশী মোড়, নীলক্ষেত, হাইকোর্ট মোড় ও চানখাঁরপুল-শহীদ মিনার। এ প্রবেশপথগুলোর গেটে নিরাপত্তাকর্মী থাকলেও তাদের বসতে দেখা যায় না। এর ফলে ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন বাস ও ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের ভারি যানবাহন চলাচল করছে, যা নিষিদ্ধ। প্রবেশপথগুলোর গেট নতুনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ মফিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা তিন মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথগুলোতে অত্যাধুনিক গেট নির্মাণের লক্ষ্যে সরকারের স্থাপত্য বিভাগে একটি নকশা প্রণয়ন করে দিতে চিঠি দিয়েছি। তারা কয়েকবার ক্যাম্পাসে এসে এগুলো পরিদর্শন করেছেন। আশা করি শীঘ্রই তারা এ নকশা আমাদের হাতে দেবেন এবং তারপর আমরা নির্মাণ কাজ শুরু করব।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৯১ সাল থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের স্ত্রীসহ ৯ শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। ২০০৫ সালের ২৮ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্রী শাম্মী আক্তার হ্যাপীর পরই আন্ডারপাস নির্মাণের দাবি ওঠে এবং সরকারের প্রতিশ্রুতিও পাওয়া যায়। এ নির্মাণ কাজ শুরুর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ২০০৫ সালের ১২ জুন একটি চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু ওই বছর কোন কাজ শুরু না করায় পরবর্তী বছর ৯ মে একই স্থানে বাস চাপায় নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের আরেক ছাত্র মোবারক হোসেন। পরে আন্ডারপাস নির্মাণের দাবিতে আবারও আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এস এম ফায়েজ, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আ ফ ম ইউসুফ হায়দারসহ ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ নগর ভবনে ডিসিসির মেয়রের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি। ২০১০ সালে আওয়ামী সরকার আন্ডারপাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে শাহবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মেট্রো রেল চালুর প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে এগুতেই পারেনি সরকার।
এর আগে ২০০৯ সালের ২২ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক পরিমল কুমার সাহার স্ত্রী অনিমা রানী সাহা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। ‘৯৬ সালের ১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এতে দু’দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে। ’৯২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় আরবি বিভাগের ছাত্র মোঃ আব্দুর রশিদ আনসারীর মৃত্যু হয়। ’৯১ সালের ২৭ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মির্জা গালিব, লিটন ও মিজান নিহত হন। ওই ঘটনায় এক পথশিশুও নিহত হয়। এর আগে একই বছরের ২০ জুন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের সামনে মাহবুবুর রহমান নামের এক ছাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়।
এদিকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ক্যাম্পাসে বহিরাগত যানবাহন চলাচল বন্ধ করার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা জানান, ক্যাম্পাসে আমাদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। যেকোন মুহূর্তে আমাদের সহপাঠী তৌহিদুজ্জামানের ন্যায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলেও তারা অভিযোগ তোলেন।
যথারীতি এ বছরও আশ্বাস প্রদান শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক আমজাদ আলী বলেন, শাহবাগ মোড়ে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে বৈঠক করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
No comments