জেলা প্রশাসক সম্মেলন-শাসক বনাম সেবক
জেলা প্রশাসকদের সম্মেলন সাংবৎসরিক রীতি। এ ধরনের সম্মেলনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের বার্তা যায় মাঠ পর্যায়ে এবং সেখান থেকেও মেলে মূল্যবান অভিজ্ঞতা ও সুপারিশ। এ সময়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে জেলার পুলিশ প্রশাসনের সমন্বয়ের অভাবের প্রসঙ্গ কমবেশি থাকেই। মঙ্গলবার শুরু হওয়া সম্মেলনেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ যোগাযোগ, দ্রব্যমূল্য, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ নানা ইস্যু আলোচনায় উঠে আসে। আসন্ন রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকারের উদ্বেগের প্রতিধ্বনিও শোনা যায়। অভিযোগ উত্থাপিত হয় জনপ্রতিনিধিদের অযাচিত হস্তক্ষেপের বিষয়ে। কোনো কোনো ডিসি তো সরাসরিই বলেছেন, জেলার সংসদ সদস্যদের নির্দেশনা না মানলে আক্রোশের শিকার হতে হয়। সরকারের জন্য এ অভিযোগ যে যথেষ্টই বিব্রতকর তাতে সন্দেহ নেই। নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রসারের বিষয়টি তুলেছেন জেলা প্রশাসকরা। ডিসি বা জেলা প্রশাসক হিসেবে পরিচিত এসব দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতা বৃদ্ধি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার প্রদান এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনা কমিটির প্রধান হিসেবে সরকারি কর্মকর্তাদের মনোনয়ন প্রদানের সুপারিশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা প্রশাসকদের মুক্ত আলোচনা শুনেছেন এবং জবাবি ভাষণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করেই সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আমরা মনে করি, জনগণের দ্বারপ্রান্তে সরকারি সেবা পেঁৗছে দেওয়া এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ বহুলাংশে নির্ভর করে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ডে সমন্বয়ের ওপর। প্রত্যেকে তার জন্য নির্দিষ্ট গণ্ডিতে থেকে কাজ করে গেলে এবং অপরের কাজে সব ধরনের সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে চললে এমনকি অনেক কঠিন সমস্যারও সমাধান সহজ হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। প্রতি বছরই দেখা যায়, সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায় না। এমনকি বরাদ্দ করা অর্থ ফেরত প্রদানের ঘটনাও ঘটে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের অদক্ষতার পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে এবং বিষয়টিকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বাড়ানোর প্রয়োজন হলে সেটা করা যেতেই পারে; কিন্তু এটাই একমাত্র দাওয়াই মনে করা হলে ভুল হবে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জেলা প্রশাসকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তারা প্রশাসক নন বরং জনগণের সেবক। প্রকৃতপক্ষে এ বক্তব্যের অন্তর্নিহিত বার্তা স্পষ্ট_ প্রশাসনে কাঙ্ক্ষিত গতিশীলতা আনা এবং জনমুখী চরিত্র অর্জনের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের কর্তৃত্বের মনোভাব থেকে সরে আসতেই হবে। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় সহযোগিতা আবশ্যকীয় শর্ত। নিজ নিজ এলাকায় পছন্দের ডিসি-এসপি এবং টিএনও-ওসি নিয়োগের রীতি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার পথে গুরুতর প্রতিবন্ধক। এতে জনকল্যাণ পদে পদে উপেক্ষিত হয় এবং প্রাধান্য পায় সংকীর্ণ দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থ। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে হলেও প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করা হচ্ছে। জেলা ও উপজেলাগুলোতে এখন অনেক সরকারি ও আধা-সরকারি দফতর। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে তাদের কাজে সমন্বয় রেখে চলাও গুরুত্বপূর্ণ।
No comments