গোলটেবিল বৈঠক-নগরজীবনে শিশুরা
গত ১৪ মে ২০১২ প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘নগর জীবনে শিশুরা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।সহযোগিতায় ছিল ইউনিসেফ। গোলটেবিলে অংশ নেওয়া সবার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।যাঁরা অংশ নিলেন
জাহাঙ্গীর কবীর নানক
জাহাঙ্গীর কবীর নানক
সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার,
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়
নজরুল ইসলাম
নগর পরিকল্পনাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি
কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
অংশগ্রহণকারী শিশুরা
মো. জীবন হোসেন, টিঅ্যান্ডটি কলোনি
মণি, চানখাঁরপুল বস্তি
সিলভিয়া, চানখাঁরপুল বস্তি
মো. নাদিম হোসেন, লালবাগ বস্তি, পুরান ঢাকা
সম্রাট, টিঅ্যান্ডটি কলোনি
মর্জিনা আক্তার, ফকিরাপুল বস্তি
রুবেল হোসেন, কেরানীগঞ্জ বস্তি
মুক্তা, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ
মাহমুদুল হাসান, চাঁদনীঘাট, পুরান ঢাকা
মো. আসলাম, ইসলামবাগ বস্তি
সোমা আক্তার, ফকিরাপুল বস্তি
রুমা, মাতবর বাজার, পাকাপুল
পপি আক্তার, ইসলামবাগ, পুরান ঢাকা
সাথি আকতার, কালীগঞ্জ, সদরঘাট
সালমা আক্তার, কমর গলির বস্তি, ফকিরাপুল
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
আ লো চ না
আব্দুল কাইয়ুম
প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ মানুষের বসবাস ঢাকা মহানগরে। এই নগরে রয়েছে অনেক বস্তি। এক হিসাব অনুযায়ী, ৪০ লাখ মানুষ বাস করে বস্তিতে। তাদের একটা বড় অংশ শিশু। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে শিশুদের বস্তিতে বাস করতে হয়। অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেললাইনের পাশে রাত কাটায়। তা ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবেশ, বাসস্থান, খাদ্য, বিনোদন—এগুলোর কোনো কিছুই তারা ঠিকমতো পায় না। সিটি করপোরেশন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন। এ জন্য আমরা প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানককে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আরও আমন্ত্রণ জানিয়েছি নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলামকে। শিশুদের কী সমস্যা, কী তারা চায়, কী তাদের ভাবনা—আমরা এ সম্পর্কে খুব বেশি জানি না। তাদের সঙ্গে আমাদের সাধারণত যোগাযোগ হয় না। আজকে বিভিন্ন এলাকার শিশুরা আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে। তাদের মুখ থেকেই সরাসরি তাদের সমস্যাগুলো শুনব।
প্রথমে আমরা আজকের এই আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে শুনব অবহেলিত শিশুদের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের ভাবনা কী।
জাহাঙ্গীর কবির নানক
আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। যে স্বপ্নের দেশের কথা ভাবি, একদিন এই শিশুরা সেটি নির্মাণ করবে। ছাত্রজীবন থেকে এই মানুষগুলোর জন্য রাজনীতি করছি। আপনারা দেখেছেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীও শিশুদের অনেক ভালোবাসেন। শিশু দেখলেই তিনি বুকে জড়িয়ে ধরেন, কোলে তুলে নেন। শিশুদের মধ্যে তিনি শিশু রাসেলের প্রতিচ্ছবি দেখেন। এদের মাঝে উপস্থিত হতে পেরে খুব ভালো লাগছে। এটি আমার জীবনের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। কয়েকজন শিশু আজকের এ আলোচনায় উপস্থিত হয়েছে। এরা দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতিনিধি। বাংলাদেশের সব শিশুর কথা মাথায় রেখে আমাদের আলোচনা হবে।
প্রথমে আমি সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুদের কিছু কথা শুনি। পরে আবার আলোচনা করব।
আব্দুল কাইয়ুম
এখন শিশুদের আলোচনার জন্য অনুরোধ করছি। তোমরা তোমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও অভিজ্ঞতা মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ও অধ্যাপক নজরুল ইসলামের সামনে তুলে ধরবে।
জীবন হোসেন
আমি ফকিরাপুল টিঅ্যান্ডটি কলোনি থেকে এসেছি। আমরা খুব গরিব মানুষ। বস্তি ভালো জায়গা না। এখানেও অনেক কষ্ট করে থাকতে হয়। মা-বাবা সকালবেলা কাজের জন্য বের হয়। কখনো দুপুরে আসে, কখনো রাতে আসে। সময় সময় তাদের কাজ থাকে না। তখন না খেয়ে থাকতে হয়। এ সময় বাবা-মা কাজের জন্য বাইরে যেতে বলে। বাইরে কাগজ টোকাতে হয়। ভিক্ষা করতে হয়। মানুষের এটা-সেটা কাজ করে দিতে হয়। কিছু খারাপ মানুষ আছে। তারা খারাপ কাজ করতে বলে। বলে, ‘পোঁটলাটা অমুক জায়গায় রেখে আয়।’ রাখতে গেলে অনেক সময় পুলিশে ধরে ফেলে। আমাদের অনেক মারে। পুলিশ আমাদের কথা বিশ্বাস করে না। মনে করে, আমরা মাদকের ব্যবসা করি। যে ছেলেটা পোঁটলা দিল পুলিশ তাকে খুঁজে পায় না। আমরাও পাই না। খারাপ মানুষগুলো আমাদের এ রকম খারাপ কাজ করতে বাধ্য করে। তাদের কথা না শুনলে মারে। শুধু এটাই না, তারা বিভিন্ন মাদক খেতে বাধ্য করে। মাননীয় মন্ত্রীকে বলব, আপনি যদি এই সমস্যাগুলো দেখেন, তাহলে কাজ করতে, বেঁচে থাকতে একটু সুবিধা হয়।
মণি
আমি থাকি চানখাঁরপুল এলাকার বস্তিতে। আমি একটা স্কুলে পড়ি। স্কুলের সামনে ড্রেন আছে। ড্রেনে সব সময় ময়লা-আবর্জনা থাকে। ময়লা পানি থাকে। এখান থেকে গন্ধ বের হয়। যখন বৃষ্টি হয়, তখন সমস্যা বেশি হয়। বৃষ্টির পানিতে ময়লা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। গন্ধ তখন আরও বেশি ছড়ায়। এ সময় স্কুলে যাওয়া-আসা করতে অসুবিধা হয়। ক্লাস করতে সমস্যা হয়। মাননীয় মন্ত্রী কি ড্রেনটা ঠিক করে দেবেন?
সিলভিয়া
আমি চানখাঁরপুল বস্তিতে থাকি। আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। এটিএন বাংলায় শিশু সাংবাদিক হিসেবে কাজ করি। যেটা বলতে চাই তা হলো, বস্তিতে অনেক ভালো ছাত্রছাত্রী থাকে। কিন্তু তাদের মেধা বিকাশের কোনো সুযোগ নেই। সচ্ছল পরিবারে দেখি, মা-বাবা ছেলেমেয়েদের রিকশায় বা গাড়িতে করে স্কুলে নিয়ে যান, নিয়ে আসেন। তাদের পোশাক ভালো। থাকা-খাওয়ার পরিবেশ ভালো। বাসায় পড়ানোর জন্য দু-তিনজন শিক্ষক রেখে দেন। ওদের জন্য যেটা সত্যি। বস্তির একজন শিশুর জন্য এটা স্বপ্ন। কখন বাসায় আসি, কখন যাই—এগুলো দেখার সময় বাবা-মায়ের নেই। ইচ্ছা হলে পড়ি, না হলে পড়ি না। মাস্টার রেখে পড়ার প্রশ্নই আসে না। বস্তির মানুষ জেনে গেছে বিদ্যুৎ, ভালো পানি, ভালো খাবার তাদের জন্য নয়। বস্তিতে রাত-দিনের কোনো পার্থক্য নেই। সব সময় শব্দ, কোলাহল, দুর্গন্ধ, মশাদের প্রিয় একটি জায়গা বস্তি। মশারা ২৪ ঘণ্টাই এখানে মানুষকে কামড়াতে পারে। বস্তির অনেককে দেখি, পড়ালেখায় তাদের খুব আগ্রহ। অনেক ইচ্ছা। কিন্তু এমনি একটি পরিবেশে কীভাবে তারা মেধা বিকাশের সুযোগ পাবে? মাননীয় মন্ত্রী, বস্তির শিশুরা যাতে লেখাপড়া করতে পারে, সে দিকটি কি আপনি একটু ভাববেন?
মো. নাদিম হোসেন
পুরান ঢাকার লালবাগ বস্তিতে থাকি। পড়ালেখার পাশাপাশি শিশুদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি। লালবাগ এলাকায় অনেক বস্তি। প্রতিবছর এই বস্তিগুলোতে আগুন লাগে। এ জন্য অন্য এলাকার বস্তি থেকে লালবাগ এলাকার বস্তির নামডাক বেশি। আগুন নিয়ে অনেক কথা হয়। পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়। আবার পরের বছর আগুন লাগে। বস্তিবাসীসহ আশপাশের অনেকেই জানে, আগুন কীভাবে লাগে। কিন্তু ভয়ে কেউ কথা বলবে না। আগুন নিয়ে আমি কিছু বলব না। অন্য একটি বিষয়ের কথা বলতে চাই। লালবাগ এলাকার বস্তিগুলোতে কয়েক হাজার শিশু আছে। তাদের জন্য কোনো খেলার মাঠ নেই। মিরপুর ক্লাবে সপ্তাহে চার দিন ক্রিকেট খেলি। আমার মতো সবার মিরপুরে গিয়ে খেলা সম্ভব নয়। সবার সে সুযোগও হবে না। শিশুরা সব সময় একটু খেলাধুলা করতে চায়। স্কুলে ম্যাডাম বলেন, মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা দরকার। কিন্তু এখানে খেলার মাঠ না থাকায় শিশুরা নানা রকম খারাপ কাজের দিকে চলে যাচ্ছে। খারাপ মানুষেরা শিশুদের খারাপ কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। মাননীয় মন্ত্রীকে বলব, আমাদের এখানে খেলাধুলার জন্য মাঠের ব্যবস্থা করা যায় কি না।
সম্রাট
আমি টিঅ্যান্ডটি কলোনি বস্তিতে থাকি। একটি জরুরি কথা বলার জন্য মন্ত্রীর কাছে এসেছি। মাঝেমধ্যে দেখি, কখনো সরকার, আবার কখনো প্রভাবশালী মানুষ বস্তি ভেঙে ফেলে। বস্তিতে বড় মানুষ থাকে। শিশুরা থাকে। বৃদ্ধরা থাকে। এমনকি অসুস্থ রোগীও থাকে। বস্তি ভেঙে ফেললে আমরা সবাই খুব বিপদে পড়ে যাই। সবচেয়ে বিপদে পড়ে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ রোগীরা। আমাদের মা-বাবা অনেক দিন ধরে, অনেক কষ্ট করে, অল্প অল্প টাকাপয়সা জোগাড় করে যা কিছু জিনিস করে তার কোনো কিছুই নিয়ে আসতে পারি না। আমাদের বস্তিগুলো মাটির সঙ্গে মিশে যায়। আশ্রয়হীন হয়ে পড়ি। চলে আসতে হয় খোলা আকাশের নিচে। তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেখানে-সেখানে রাত কাটাতে হয়। এ অবস্থায় দিন কাটে রেলস্টেশনে ও রেললাইনের পাশে, বাস-ট্রাক স্ট্যান্ডে, বাজারে কিংবা রাস্তাঘাটে। বস্তি খুব ভালো জায়গা না। কিন্তু এই জায়গাগুলো বস্তি থেকে অনেক বেশি বিপজ্জনক। এখানকার লোকজন আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে। মারধর করে। আমাদের দিয়ে খারাপ কাজ করাতে চায়। এভাবে অনেকেই মাদকের সঙ্গে, চুরির সঙ্গে, আরও নানা রকম খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তারা আর ভালো পথে ফিরে আসতে পারে না। আমি যেহেতু বস্তির একজন শিশু, আমার বন্ধুরাও সবাই বস্তিতে থাকে, আমি কখনোই চাই না আমাদের শেষ আশ্রয়টুকু শেষ হয়ে যাক। তার পরও যদি আপনারা ভেঙে ফেলতে চান, তাহলে আমাদের জন্য কোথাও না কোথাও একটু জায়গা করে দেবেন। মন্ত্রীর কাছে এটা আমার বিশেষ অনুরোধ।
মর্জিনা আক্তার
আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। ফকিরাপুলের বস্তিতে থাকি। এখানে ঘরভাড়া খুব বেশি। একটা ঘরের ভাড়া দিতে হয় তিন হাজার টাকা। বেশি ভাড়ার জন্য এক ঘরে আটজন থাকি। এত মানুষ একসঙ্গে থাকা যায় না। অনেক চাপাচাপি করে থাকতে হয়। রাতে গরমে ঘুম হয় না। খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কিছুই করার নেই। জানি, এভাবেই আমাদের থাকতে হবে। আমাদের আয়-রোজগার খুব কম। আমাদের এখানে ৫০ থেকে ৬০ জন মানুষ থাকে। এতগুলো মানুষের জন্য দুটি টয়লেট। একটা গোসলের জায়গা। এখানে শুধু সমস্যা আর সমস্যা। ভালো কিছু নেই। এসব কষ্ট মেনে নিয়েছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অল্প আয়ের সবটুকু ঘরভাড়ায় চলে যায়। ভাড়া দেওয়ার পর খাওয়া-পরা চালাতে অনেক কষ্ট হয়। এত কিছুর পরও যদি খাওয়া-পরাটা ঠিক থাকত, তাহলে অনেকটা ভালো থাকতে পারতাম। অনেক সময় ভাবি, এটা তো খুব বেশি ভাড়া না। কিন্তু আমাদের তো এটাই সব। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আবেদন, আমাদের কম ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা করা যায় কি না বা কোনোভাবে কিছুটা সাহায্য করা যায় কি না।
সিলভিয়া
আমি বলতে চাই, উচ্ছেদের বিষয়ে কোনো আইন করা যায় কি না, যে আইনি বলে উচ্ছেদের আগে তাদের থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। অন্য কোনো ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত কোনো অবস্থাতেই বস্তি ভাঙা যাবে না বা উচ্ছেদ করা যাবে না। মর্জিনা যে কম ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা বা কিছুটা সরকারি সাহায্যের আবেদন করল, সেটা আমারও কথা।
রুবেল হোসেন
কেরানীগঞ্জের একটি বস্তি থেকে এসেছি। বস্তির পরিবেশ খুবই নোংরা। ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা নেই। আমাদের ঘরের পাশেই ময়লা রাখা হয়। দিন-রাত দুর্গন্ধের মধ্যে থাকতে হয়। রান্নাঘরের চারদিক ফাঁকা। ধুলা-বালু, পোকা-মাকড় খাবারের মধ্যে এসে পড়ে। এ খাবার খেয়ে নানা রকম অসুখ-বিসুখ হয়। অসুখ-বিসুখে আরও বড় সমস্যায় পড়তে হয়। বস্তির কাছাকাছি কোনো সরকারি হাসপাতাল নেই। অন্য কোথাও চিকিৎসা করানোর মতো টাকাপয়সা নেই। হাসপাতালগুলোর এমন অবস্থা, তাদের সামনে মরে গেলেও তারা কম পয়সায় চিকিৎসা করবে না। ডাক্তারদের মায়া-মমতা চাই, কিন্তু পাই না। বিনা পয়সায় তো দূরের কথা, কম পয়সায়ও তারা চিকিৎসা করে না। অনেক সময় বেশি অসুস্থ রোগী থাকে, যাদের দূরে নিয়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় না। আবার ডাক্তাররা বস্তির নোংরা পরিবেশ দেখে আসতেও চায় না। এ অবস্থায় আমি মাননীয় মন্ত্রীকে বলতে এসেছি, আমাদের কিছুটা ভালো পরিবেশ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় কি না।
মুক্তা
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে এসেছি। যে বস্তিতে থাকি, সেখানে মেয়েদের উপযোগী গোসলখানা, টয়লেট নেই। ভাঙাচোরা গোসলখানা, টয়লেট। বৃষ্টির সময় ভিজে যেতে হয়। বস্তির চারপাশে উঁচু বিল্ডিং। মেয়েদের গোসল করতে অনেক সমস্যা হয়। বস্তিতে অনেক লোক একসঙ্গে থাকে। তাই টয়লেট ও গোসলের জন্য লাইন দিতে হয়। শিশুদের সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হয়। তাদের কেউ সুযোগ দিতে চায় না। তাদের প্রয়োজনটা কেউ বোঝে না। সবাই তাদের অবহেলা করে। টয়লেট ও গোসলখানা কখনো পরিষ্কার থাকে না। এখান থেকে অনেক রোগজীবাণুু ছড়ায়। বস্তির অনেকেই কলেরা, আমাশয়, জন্ডিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত থাকে। মাননীয় মন্ত্রীকে আমাদের বস্তিতে ভালো টয়লেট ও গোসলখানার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করছি?
মাহমুদুল হাসান
এসেছি পুরান ঢাকার চাঁদনীঘাট থেকে। যে বস্তিতে থাকি, বর্ষার সময় সেখানে পানি উঠে যায়। সারাক্ষণ পচা দুর্গন্ধযুক্ত পানির মধ্যে থাকতে হয়। পচা পানি থেকে আমাদের অনেক অসুখ-বিসুখ হয়। এমনিতে টাকাপয়সার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারি না। বর্ষার সময় এ সমস্যা আরও বেশি হয়। কারণ, এ সময় বাবা-মায়ের কাজ কম থকে। বর্ষার পানির জন্য ঘর থেকে দূরে কোথাও যাওয়া যায় না। আমাদের জিনিসপত্র, খাবার সবই নষ্ট হয়ে যায়। যেখান থেকে বাজার করি, সে বাজারেও পানি উঠে যায়। তখন আমাদের মতো শিশু ও বৃদ্ধদের অনেক অসুবিধায় থাকতে হয়। মাননীয় মন্ত্রীকে বলব, তিনি যেন বস্তি ও বাজারকে বর্ষার পানি থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করেন।
মো. আসলাম
ইসলামবাগ বস্তি থেকে এসেছি। বস্তির চারপাশের কলকারখানায় ২৪ ঘণ্টা শব্দ হয়। বিশেষ করে, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই শব্দ আরও বাড়তে থাকে। বস্তির লোকজন সারা দিন পরিশ্রমের কাজ করে। রাতে তাদের ভালো ঘুম দরকার। কিন্তু শব্দের জন্য ঘুমাতে পারে না। শিশুদেরও সমস্যা হয়। যারা একটু লেখাপড়া করতে চায়, কারখানার শব্দে তাদের অসুবিধা হয়। মাননীয় মন্ত্রী, আশা করি, এই সমস্যার সমাধান করে দেবেন।
সোমা আক্তার
ফকিরাপুল বস্তি থেকে এসেছি। বস্তির চারপাশে খারাপ ছেলেরা আড্ডা দেয়। স্কুলে যাওয়া-আসার সময় খুব বিরক্ত করে। আমাদের দেখলে শিস দেয়, গান-বাজনা শুরু করে। খারাপ কথা বলে। প্রতিবাদ করতে গেলে মারে। বকাঝকা করে। এমনকি রাতে পড়ালেখা করতে গেলেও জানালার পাশে এসে শিস দেয়। এসব কারণে পড়তে পারি না। বাবা-মাকে বলেও কোনো লাভ হয় না। তাঁদের প্রতিবাদ করার শক্তি ও সাহস নেই। মা-বাবা পারেন আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতে। তাঁরা কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। বিয়ে দিয়ে দেন। আমরা অল্প বয়সে বিয়ে করতে চাই না। লেখাপড়া করতে চাই। কিন্তু এই বখাটে ছেলেদের জন্য সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয় না। মাননীয় মন্ত্রী, এই বখাটেদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি না।
আব্দুল কাইয়ুম
এতক্ষণ শিশুদের কাছ থেকে তাদের সমস্যার কথা শুনলাম। শিশুরা, তোমরা যারা বলোনি, তোমাদের কথা আবার শুনব। এবার আমরা সবাই শুনব অধ্যাপক নজরুল ইসলামের কাছ থেকে।
নজরুল ইসলাম
প্রিয় শিশুরা, আজকে তোমাদের জন্য একটি ভালো দিন। মাননীয় মন্ত্রীও তোমাদের পেয়ে খুব খুশি। তিনি বলেছেন তাঁর জন্য এটি একটি ভালো দিন। তোমাদের জন্য এটি একটি বিরাট সুযোগ যে বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারছ। সরাসরি তাঁকে প্রশ্ন করতে পারছ। আমরা ছোটবেলায় এই সুযোগ পাইনি।
তোমরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে কথা বলেছ। বেশ ভালো লেগেছে। আমরা সবাই সরকারের কাছে অনেক কিছু আশা করি। কারণ সবার প্রতি সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। এ জন্য আমাদের সমস্যার কথা সরকারের কাছে বলি। সরকারও আমাদের জন্য কাজ করছে। আমাদের কথা ভাবার জন্য সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় করেছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও কাজ করে। যেমন, ইউনিসেফ তোমাদের লেখাপড়া ও অন্যান্য ব্যাপারে সহায়তা দেয়। আবার পত্রিকাগুলো কোথায় কী আছে না-আছে, কী হলো না-হলো, তোমাদের কী সুবিধা-অসুবিধা, তারা সরকারকে, মানুষকে জানায়। এভাবে সবাই সবার জন্য কাজ করে। আমি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছি। আবার তোমরা কোথায় থাকো, কী করো সেটাও বলতে পারি। কেন বলতে পারি? আমি এই নগর নিয়ে গবেষণা করি। নগরের কোথায় কী আছে, এটা নিয়ে ভাবি। উদ্দেশ্য, নগরের সমস্যা খুঁজে বের করা এবং কীভাবে সমাধান করা যায় সেটি বের করা। কারা সমাধান করবে? সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন সমাধান করবেন। ঢাকা শহর পৃথিবীর মধ্যে একটি বড় শহর। বাংলাদেশের জনসংখ্যা সারা পৃথিবীর মধ্যে অষ্টম। সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা চীনে, ১৩০ কোটি। ভারতে ১২০ কোটি। আমাদের ১৫ কোটি। ১৫ কোটির মধ্যে কেবল ঢাকা শহরে দেড় কোটি। আমরা যদি বলি ঢাকা সিটি করপোরেশন বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উত্তরা, তাহলে এক কোটি। এক কোটির মধ্যে আমরা যাকে বলি বস্তি, সুবিধাবঞ্চিত এলাকা, এখানে বাস করে ৪০ লাখ। তাদের মধ্য থেকে তোমরা কয়েকজন এসেছ। আমি নিজেও তোমাদের কথা ভাবি। আমি তোমাদের লোক। নগর গবেষণাকেন্দ্র নামে আমার একটি সংগঠন আছে। এর বয়স ৪০ বছর হলো। এই গবেষণাকেন্দ্র থেকে তোমাদের জন্য একটা কাজ করেছি। ১৫ লাখ বস্তিবাসী নিয়ে একটি সংগঠন করেছি। তোমাদের মা-বাবারা সেই সংগঠনের সদস্য।
আব্দুল কাইয়ুম
অধ্যাপক নজরুল ইসলামের কথা শুনলাম। এখন আবার মাননীয় মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের কাছ থেকে আমরা শুনতে চাচ্ছি। শিশুরা তো তাদের দুঃখের কথা বলল। মাননীয় মন্ত্রী ও তাঁদের মন্ত্রণালয় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সমস্যা সমাধানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নেবেন কি?
জাহাঙ্গীর কবির নানক
তোমরা জানো এই ঢাকা মহানগরের একটি এলাকার মানুষ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। আমার কাজ বাদ দিয়ে তোমাদের কাছে এসেছি। আজ তোমাদের সবার কথা শুনব। আমার নির্বাচনী এলাকা সবচেয়ে বেশি মাদকের আখড়া। সবচেয়ে বেশি বস্তিবাসী মানুষের বাস। বছিলায় ভোট চাইতে গিয়ে দেখেছি সেটি অজপাড়াগাঁ। এটি আমার নির্বাচনী এলাকার মধ্যে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে। আমার নির্বাচনী এলাকায় সাতটি উর্দুভাষী মানুষের ক্যাম্প রয়েছে। বস্তিবাসীর কষ্টকর জীবন, উর্দুভাষীদের ক্যাম্পের মানুষের মানবেতর জীবন, মাদকের ভয়াবহতা—সবই আমি দেখেছি। তোমরা মাদকের কথা বলেছ। ড্রেনের সমস্যার কথা বলেছ। অন্যান্য সমস্যার কথা বলেছ—সবই ঠিক আছে। আমি এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বিভিন্ন বস্তিতে যে মাদকের রমরমা ব্যবসা ছিল, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন মাদকের কাজে তোমাদের মতো শিশুদের ব্যবহার করছে। এর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছি। আশা করি বন্ধ হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুর পর গ্রামের কথা কেউ ভাবেনি। গ্রামীণ অবকাঠামো দুর্বল হওয়ায় বাংলাদেশের সব গ্রাম থেকে লোক ঢাকার দিকে আসছে। ঢাকা শহরে মানুষের অত্যধিক চাপ পড়ছে। সেই পুরোনো আমলের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা এখন আর কাজ করছে না। তোমরা লক্ষ করেছ, সারা ঢাকা শহরে আগামী ৫০ বছরের হিসাব করে বড় মাপের পাইপ বসাচ্ছি, যাতে আগামী ৫০ বছর ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো থাকে। এই কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতা দূর হবে।
লালবাগের বস্তিতে প্রতিবছর আগুন লাগে। এটা ঠিক। তবে কোথাও আগুন লাগে, কোথাও লাগানো হয়। এই আগুন লাগার কারণও আমি খুঁজে বের করেছি। কোনো বস্তি সরকারের জমিতে। কোনো বস্তি খাসজমিতে। সরকারের জমির বস্তিতে বিভিন্ন গ্রুপের ভাড়া তোলা নিয়ে বিরোধের জন্য আগুন লাগিয়ে দেয়। আবার সরকারের খাসজমি কেউ লিজ নিয়ে নিল। সে চাইবে বস্তি খালি করতে। আগুন লাগানোকেই সে খালি করার উপায় হিসেবে বেছে নেয়। আবার এনজিওর সাহায্য নেওয়ার জন্যও আগুন লাগানো হয়। মোটামুটি এই হচ্ছে বস্তিতে আগুন লাগার ইতিহাস। তোমরা জানো, জেনেভা ক্যাম্পে প্রতিবছর আগুন লাগে। এর কারণ খুঁজে বের করলাম। তোমরা খেয়াল করেছ, এখন আর আগুন লাগে না।
ঢাকা শহরে বিভিন্ন নামে বস্তি আছে। তারা ভাড়া নিচ্ছে। বস্তিতে টয়লেট, গোসলখানা, রান্নার ভালো ব্যবস্থা করে দিচ্ছে না। এগুলো খোঁজখবর নিয়ে বস্তির মধ্যে রাস্তা করে দিয়েছি। টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়েছি। এভাবে কাজ করতে করতে সব বস্তির সমস্যা একসময় দূর হবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তোমরাও এগিয়ে যাচ্ছ। তোমরা অনেক স্মার্ট, অনেক সুন্দর করে কথা বলেছ। অভিভূত হয়েছি তোমাদের কথা শুনে। আমাদের বয়সী মানুষ তোমাদের মতো এত সুন্দর করে কথা বলতে পারবে না।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এর প্রমাণ আজ তোমরাই। আমাদের গার্মেন্টসের কর্মীরা কত ভোরে উঠে কাজে যায়! তারা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা এনে দিচ্ছে। আমি তাদের সম্মান করি। শুধু সরকার নয়, সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে মানুষের সাহায্যের জন্য। আজ তোমরা নতুন চকচকে বই হাতে পাচ্ছ। এগুলো আমাদের উন্নতি। আমাদের সময় বড় ভাইবোনের রেখে দেওয়া পুরোনো বই আমরা পড়তাম।
আমাদের সরকারের সিদ্ধান্ত, কোনো খেলার মাঠ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। খেলার মাঠ রক্ষা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে। খেলার মাঠ উন্নয়ন করছি। মাঠগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল।
মো. আসলাম
আমার একটা কথা আছে,স্যার। ইসলামবাগে আমাদের খেলার মাঠ দখল করে বানানো হয়েছে ট্র্যাকস্ট্যান্ড।
জাহাঙ্গীর কবির নানক
তোমাদের মাঠের ঠিকানা দিয়ে যাও, সেটা অবশ্যই খালি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
ঢাকা শহরটি পুরোপুরি পরিকল্পনাহীনভাবে গড়ে উঠেছে। যার যেখানে ইচ্ছা বাড়ি করছে। মার্কেট করছে। স্কুল-কলেজ করছে। অপরিকল্পিত হওয়ার কারণে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আমরা কিন্তু থেমে নেই, আমরাও কাজ করে যাচ্ছি। গরমের সময় চিন্তা থাকে কোথায় না আবার পানির সমস্যা হয়। সারা দিন দৌড়াতে থাকি। বর্ষার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি দেখলেও চিন্তা হয়, কোথায় যেন পানি জমা হয়ে সমস্যা তৈরি করে। পরিকল্পনাহীনভাবে শহর গড়ে ওঠার জন্য প্রতিনিয়ত সমস্যা হচ্ছে।
বখাটেদের উৎপাত, ইভ টিজিংয়ের কথা আসছে। আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। এই কয়েক দিন আগেও প্রায়ই ইভ টিজিং নিয়ে আলোচনা হতো। এখন সেটা বন্ধ হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। শব্দদূষণের কথা একজন বলেছ। আমি পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানাব। আশা করি কাজ হবে। কারও কোনো অধিকার নেই যে একজন মানুষকে ঘুমাতে না দিয়ে মেশিন চালাবে বা অন্য কোনোভাবে শব্দ করবে। এটা সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ একটা কাজ। বিষয়টা আমরা দেখব। টয়লেটের সমস্যার কথা আসছে। টয়লেটের জন্য আমাদের প্রকল্প আছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সমস্যা থাকবে না। তোমরা জানো আন্তর্জাতিকভাবে শিশু-কিশোরদের বয়সসীমা পরিবর্তন হয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শিশু আইন করা হয়েছিল। তারপর আর এই আইন সংশোধন করা হয়নি। ২০১১ সালে শিশু আইন ঠিক করে নিয়েছি।
আমার নির্বাচনী এলাকায় রয়েছে এসওএস শিশুপল্লি। সেখানে গেলে আমার খুব ভালো লাগে। গত জুমায় সেখানে নামাজ পড়েছি। এসওএস শিশুপল্লির মেয়েরা মাধ্যমিক শেষ করার পর লালমাটিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক থেকে সম্পূর্ণ বিনা বেতনে পড়বে। ছেলেদের জন্য মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উচ্চমাধ্যমিক থেকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছি। স্কুলগুলোতে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ। এ জন্য মিল্কভিটাকে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করছি। তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। তোমরা আমার চোখ খুলে দিয়েছ। তোমাদের কাছ থেকে অনেক বিষয় জানতে পেরেছি।
আব্দুল কাইয়ুম
মাননীয় মন্ত্রী প্রতিটি বিষয় অনেক মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তোমাদের মধ্যে এখনো যারা বলোনি, এবার বলো।
রুমা
মাতবার বাজার পাকাপুল থেকে এসেছি। মায়ের ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করানোর। আমারও ইচ্ছা ছিল। সংসারে অভাবের জন্য দুজনের ইচ্ছাই বাদ গেল। মা পাঠালেন কাগজ টোকাতে। কাগজের বস্তা নিয়ে মানুষের পাশ দিয়ে যেতে হয়। যাওয়ার সময় কারও গায়ে কখনো বস্তাটা একটু লেগে যায়। তখন তারা আমাকে মারে। আমার খুব খারাপ লাগে। আমি অনেক কান্না করি। বাড়ি গিয়ে মাকে বলি, মা-ও কান্না করেন। এখন আর মাকে বলি না। মা মনে করেন, আমাকে এখন কেউ মারে না। কিন্তু এখনো মারে। এর কী কোনো সমাধান আছে?
পপি আকতার
পুরান ঢাকার ইসলামবাগ থেকে এসেছি। যে বস্তিতে থাকি, সেখানে মা-বাবা দুজনই কাজে চলে যান। তাঁদের শিশুসন্তানেরা একা একা বাসায় থাকে। বস্তির আশপাশে পুকুর আছে, নদী আছে, ময়লা-আবর্জনা আছে, মা-বাবা না থাকায় শিশুরা এসব জায়গায় চলে যায়। ফলে তারা পানিতে পড়ে যেতে পারে। ময়লা-আবর্জনা খেয়ে পেটে অসুখ হতে পারে। মাননীয় মন্ত্র্রী এ ব্যাপারে কিছু করতে পারলে ভালো হয়।
সাথি আকতার
আমি কালীগঞ্জ থেকে এসেছি। সেলাই মেশিনের কাজ করি। যে বস্তিতে থাকি সেখানে ঘরভাড়া অনেক বেশি। ঘরভাড়া বেশি হওয়ার কারণে খাওয়া-পরার অনেক সমস্যা হয়। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আবেদন, এ ব্যাপারে কিছু করা যায়?
সালমা আক্তার
ফকিরাপুল কমর গলির বস্তি থেকে এসেছি। যে বস্তিতে থাকি সেখানে অনেক শিশু আছে। এই শিশুদের বাবা-মা সকালে তাদের ঘরে রেখে কাজে যান। কখনো দুপুরে বাসায় ফেরেন। কখনো সন্ধ্যায়। ঘরে কোনো খাবার না রেখেই তাঁরা কাজে যান। শিশুরা না খেতে পেয়ে বস্তির বাইরে যায়। রাস্তায় চলে যায়। তারা খাবারের খোঁজ করতে থাকে। মানুষের কাছ থেকে চেয়ে খায়। এ সুযোগে কিছু দুষ্টুলোক তাদের খাবারের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যায়। তাদের ভিক্ষাসহ খারাপ কাজ করাতে চায়। অনেক সময় পাচার করে দেয়। এ ব্যাপারে মাননীয় মন্ত্রী কী করবেন?
সিলভিয়া
এ সময়টি আমাদের বয়ঃসন্ধির কাল। এ সময় শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়। আমাদের নিজস্ব আলাদা পরিবেশের দরকার হয়। কিন্তু কোনো বস্তিতে সে রকম পরিবেশ নেই। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা মানুষ চলাফেরা করে। তা ছাড়া নিজেদের পরিবারেও বেশি মানুষ থাকে। ছোট্ট একটি ঘর। খাওয়ার সময়, ঘুমোনোর সময় কখনো নিজস্বতা বলে কিছু থাকে না। এতে আমাদের খুব অসুবিধা হয়। মাননীয় মন্ত্রী, এ বিষয়ে কিছু করা যায় কি না।
মাহমুদুল হাসান
আমাদের বস্তির পাশে কামরাঙ্গীর চর নামে একটি বস্তি আছে। এই বস্তির শিশুদের ভিক্ষার কাজে লাগানো হয়। একজন শিশুর জীবনে এর থেকে খারাপ আর কী হতে পারে! মাননীয় মন্ত্রী যেন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন।
মো. আসলাম
বাবা মারা গেছেন। মা আবার বিয়ে করেছেন। নানি খুব কষ্ট করে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমি নিজেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে গিয়েছিলাম। কাজ হলো মেশিনে পাইপ বানানো। এ সময় হাত কেটে ও ভেঙে যেতে পারে। আবার পলিথিন কারখানায় পলিথিন কাটার সময় হাত কেটে যেতে পারে। এ রকম আরও কাজ আছে। ইউনিসেফ সেখান থেকে আমাকে নিয়ে এসেছে। আমার মতো অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। তারাও আমার মতো শিশু। তাদের এ কাজ থেকে ফিরিয়ে আনা যায় কি না বা অন্য কোনো কাজের ব্যবস্থা করা যায় কি না।
জীবন
আমাদের বস্তিতে সকালবেলা বাথরুম এবং হাত-মুখ ধোয়ার জন্য লম্বা লাইন দিতে হয়। এতে আমাদের অসুবিধা হয়। বাথরুম না করে এবং হাত-মুখ না ধুয়ে অনেক সময় স্কুলে যাই। তখন শিক্ষকেরা মারেন। বস্তিতে লোক গাদাগাদি করে থাকে। স্কুল থেকে বাসায় ফিরলে মায়ের সঙ্গে কাজ করি। রাতে বিদ্যুতের অভাবে পড়তে পারি না। পাশে কোথাও গিয়ে পড়ব, সেখানেও দুর্গন্ধ আর মানুষের ভিড়। বস্তির পাশে দুটি মাঠ আছে। সে মাঠে সব সময় ট্রাক থাকে। কখনো খেলাধুলা করতে পারি না। মাননীয় মন্ত্রী, এ বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করবেন কি?
আব্দুল কাইয়ুম
সবার কথা শোনা হলো। শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক বিষয় উঠে এসেছে। সমস্যাগুলো যে কত গভীর তা মাননীয় মন্ত্রীসহ সবাই বুঝতে পারছি। এখন অধ্যাপক নজরুল ইসলামের কাছ থেকে আবার শুনব।
নজরুল ইসলাম
এতক্ষণ শিশুদের অনেক কথা শুনলাম। এ কথার হয়তো কোনো শেষ নেই। কথা চলতেই থাকবে। কিন্তু মানুষকে কোথাও না কোথাও থামতে হয়। তোমাদের কথা মন দিয়ে শুনেছি। তোমরা সবাই কোনো না কোনো বস্তি থেকে এসেছ। এই যে বস্তিতে থাকো, তোমাদের কি খারাপ লাগে? বস্তিতে থাকা কোনো খারাপ বিষয় না। বস্তি শব্দটাও খারাপ না। বস্তি মানে বসতের জায়গা। তুমি কোথায় থাকো সেটা কোনো বড় কথা না। বড় কথা হলো, তুমি কতটুকু ভালো। কতটুকু ভালো মানুষ। আজ থেকে মনে করবা বস্তিতে থাকা কোনো খারাপ কাজ না। যদি না খারাপ কাজ করো।
ঢাকা শহরের ৪০ লাখ মানুষ বস্তিবাসী। সিঙ্গাপুর শহরের নাম শুনেছ? এটা একটা শহর। আবার একটা দেশ। একটাই শহর। একটাই দেশ। লোকসংখ্যা মাত্র ৪০ লাখ। তাহলে ঢাকা শহরে বস্তিবাসী যত, ওদের লোকসংখ্যা তত। এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল ১৪ লাখ ১২ হাজার। পাস করেছে ১২ লাখেরও বেশি। মালদ্বীপ একটি দেশ না? এর জনসংখ্যা কত? মাত্র চার লাখ। আর আমাদের দেশে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল ১৪ লাখ ১২ হাজার। আমাদের সব সংখ্যাই বেশি। এ জন্য কিছু কিছু বিষয় কম পড়ে যায়।
আমাদের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান। লক্ষ করলাম, খাদ্য নিয়ে তোমরা কেউ কিছুই বলোনি। তাহলে মোটামুটি বলা যেতে পারে যে খাদ্যের অভাব আমাদের নেই। তবে আরও ভালো খাদ্য, ভালো পুষ্টি দরকার। তোমরা কেউ কাজ চাওনি। কারণ কাজের বয়স তোমাদের এখনো হয়নি। তোমরা এখনো শিশু।
এরপর হলো বস্ত্র। মনে আছে, যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখনো হাফপ্যান্ট পরে, খালি পায়ে স্কুলে এসেছি। হঠাৎ একদিন শিক্ষক বললেন, তোমরা হাফপ্যান্ট পরে, খালি পায়ে স্কুলে আসবে না। তোমরা এত ছোট্ট তা-ও খালি পায়ে, হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যাও না। তোমরা সবাই ভালো জামাকাপড় পরো। তাহলে বস্ত্রের দিক থেকে ভালো আছি।
শিক্ষা, সবাই স্কুলে যায়। কিন্তু বস্তির অনেকে হয়তো স্কুলে যেতে পারে না। সরকার প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। তার পরও তোমরা অনেকে যেতে পারো না। এ বিষয়ে সরকারের দিক থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। স্কুলে যেন ঠিকমতো লেখাপড়া হয় সে বিষয়টি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তোমরা দুই-তিনজন ছাড়া কেউ প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে যাও না। এটা খুব ভালো। এর মানে হচ্ছে আমাদের স্কুলগুলোতে লেখাপড়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বলেছ। চিকিৎসার খরচ বেশি। ভালো চিকিৎসা অনেক সময় পাওয়া যায় না। তোমরা নিয়মিত স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেবে। ভালো স্বাস্থ্যের জন্য দরকার ভালো পয়োব্যবস্থা। অর্থাৎ ভালো বাথরুম দরকার। ভালো পানি দরকার। তোমরা বলেছ বস্তিতে ভালো বাথরুম নেই। দেশে নিরাপদ পানিরও সমস্যা আছে। এদিকটায় সরকারকে নজর দিতে হবে। ভালো পয়োব্যবস্থা বলতে বোঝায় ভালো বাথরুম, যেখান থেকে ময়লা সরাররি পয়োনিষ্কাশনের লাইন দিয়ে পাগলায় শোধনাগারে চলে যাবে। এই শোধনাগারে কারখানার বর্জ্য মিশে পানি বিষাক্ত হয়ে যায়। সিঙ্গাপুর পৃথিবীর একটি উন্নত শহর। সেখানে বাথরুমের পানি শোধন করে তারা খায়।
তোমাদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। খেলাধুলা করার সুযোগ থাকতে হবে। তোমরা ভালো বলেছ, খেলার মাঠ নেই। বস্তির ছেলেমেয়েদের বেশি সাহস। এরা রাস্তায় খেলাধুলা শুরু করে। অথবা ইসলামবাগের ছেলে মিরপুর গিয়ে খেলে। মাঠের কথা তোমরা বলেছ। আমরাও চাই প্রতিটি বস্তিতে মাঠ থাকতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও খেলাধুলার প্রতি বিশেষ আগ্রহ আছে। তোমাদের মাঠের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মাননীয় মন্ত্রীও তোমাদের কথা দিয়েছেন, মাঠের ব্যবস্থা হবে। গুলশানের একটা পার্ক একবার কর্তৃপক্ষ ওয়ান্ডারল্যান্ড বানাতে চেয়েছিল। আমরা তখন বাধা দিয়ে ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠ হিসেবে রেখে দিয়েছি। তোমরা খেলাধুলা করবে। চিড়িয়াখানায় যাবে। পার্কে ঘুরবে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবে। তোমরা জাদুঘর দেখতে যাবে। প্রয়োজনে আমি ব্যবস্থা করে দেব।
নিরাপত্তা খুব জরুরি। বস্তিতে বাস করার নিরাপত্তা। স্কুলে যাওয়ার নিরাপত্তা। খেলাধুলার নিরাপত্তা। বাবা-মা কাজে গেলে শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকে। এটি একটি বড় সমস্যা। সে ক্ষেত্রে কী করতে হবে? আমরা ঢাকা শহরের বস্তিবাসী মানুষদের নিয়ে সমিতি করেছি। সমিতির লোকজন সবাইকে নিরাপত্তা দেবে। এখানে শিশুকেন্দ্র থাকবে। শিশুরা এখানে নিরাপদে থাকবে। তোমাদের জন্য শিশু একাডেমি আছে। তোমরা সেখানে যাও? কী করতে যাও? অনুষ্ঠান দেখতে যাও। অনুষ্ঠান করতে যাও। দেশে যদি অনেক শিশু একাডেমি থাকত, তাহলে ভালো হতো। এগুলো কে করে দেয়? সরকার। বেসরকারি উদ্যোক্তারাও তোমাদের কল্যাণে এগিয়ে আসেন। তাঁরা স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল করে দেন। এনজিওরা তোমাদের কল্যাণে কাজ করে। এখন তোমাদের এগুলো থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হতে হবে।
যাঁরা টেলিভিশনে টক শো করেন, যাঁরা সাংবাদিকতা করেন, তাঁরা সরকার ও সমাজকে সচেতন করে তোলেন। আমি জানি না বস্তি নিয়ে তাঁরা কখনো আলোচনা করেছেন কি না। আমি বস্তি নিয়ে ৪০ বছর ধরে কাজ করছি। বস্তি নিয়ে আলোচনার জন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বেশি ডাকেনি। দু-একবার ভুলেও ডাকতে পারে। তবে শিশুদের নিয়ে মাঝেমধ্যে আলোচনা হয়। গণমাধ্যমের বড় রকমের দায়িত্ব আছে। যেটা আজ প্রথম আলো তোমাদের জন্য করেছে। প্রতিটি খবরের কাগজ, টেলিভিশন যদি করত, তাহলে সমস্যা অনেক কম হতো। আমাকে এবার বলো কচিকাঁচার মেলার কে সদস্য? খেলাঘরের সদস্য কে? কেউ না। বয়েজ স্কাউট কে কে করো? নানক ভাই করেছেন। আমি করেছি। বয়েজ স্কাউট করলে দেশের বাইরে যাওয়া যায়।
ঝাড়ু দেওয়া থেকে শুরু করে মন্ত্রিত্ব—সব কাজই কাজ। সব কাজকে সম্মান করতে হবে। পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই শিশুদের সহযোগিতা করে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে দেখো না, কোনো একটি শিশু তাঁর কাছে গেলে তাঁকে কোলে তুলে নেন। বিশেষ বিশেষ দিনে শিশুদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন, সময় কাটান। এগুলো হচ্ছে শিশুদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার নিদর্শন। আমরা যখন শিশু ছিলাম, তখন তোমাদের থেকে অনেক বেশি সমস্যা ছিল। তোমরা আজ যে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললে, আমাদের সময় এটি কল্পনাও করতে পারতাম না। এ দিনটি নিশ্চয়ই তোমাদের সারা জীবন স্মরণ থাকবে। এ জন্য তোমরা কাকে ধন্যবাদ দেবে? না, আমাদের দিতে হবে না। ধন্যবাদ দিতে হবে প্রথম আলো ও ইউনিসেফকে, যারা তোমাদের জন্য এই আয়োজন করেছে।
সবশেষে বলি, তোমাদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তোমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাও। নিজে কী হতে চাও স্বপ্ন দেখো। কোনো বাধাই তোমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তোমাদের জন্য কী করতে হবে, সেটা সংবিধানে বলা আছে। শিশুদের জন্য শিশু আইন আছে। শিশুনীতি আছে। সেখানে সরকার প্রতিজ্ঞা করেছে তোমাদের জন্য কী কী করতে হবে। আজকের আলোচনার বিষয় হলো নগরশিশু। নগরশিশুর জন্য জাতীয় নগর নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। এ নীতিতে পরিষ্কার লেখা আছে, সরকার শিশুদের জন্য কী করবে। তাদের লেখাপড়া, স্বাস্থ্য রক্ষা, খেলাধুলা, বিনোদন ইত্যাদি বিষয় সরকার শিশুদের জন্য নিশ্চিত করবে। ঢাকা শহরসহ সব শহরের শিশুদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পার্ক, খেলার মাঠ, বিনোদনকেন্দ্র, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল কোথায় কী হবে, নগর পরিকল্পনার মধ্যে সব বলে দিতে হবে। তা না হলে গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি হবে, কিন্তু পরিকল্পিত নগর হবে না। মাঝেমধ্যে বস্তি উঠিয়ে দিতে দেখি। বস্তি ওঠানোর ব্যাপারে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। দু-চারজন দুষ্ট মানুষের জন্য বস্তি ভেঙে দিলে ওই রাতেই শিশু, বৃদ্ধ, নারীসহ শত শত মানুষকে অসহায় হয়ে পড়তে হয়। পুনর্বাসন ছাড়া কোনো বস্তি ওঠানো যাবে না। প্রত্যেক মানুষকে আশ্রয়ের নিশ্চয়তা সরকারকে দিতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
নজরুল ইসলাম শিশুদের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন এলাকার শিশুরা এখানে উপস্থিত আছে। তারা তাদের অসুবিধাগুলো খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। সরকারের শিশুনীতিমালায় আরও সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, বিশেষ করে চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, জাতীয় জাদুঘরসহ দর্শনীয় জায়গাগুলো আরও বেশি করে দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল, বাসা, বাইরে কোথাও যেন শিশুরা নির্যাতনের শিকার না হয়, সে ব্যাপারে রাষ্ট্র তাদের সাহায্য করবে। এখন সব বিষয় মিলিয়ে এখন বলবেন মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক।
জাহাঙ্গীর কবির নানক
আমি আগেই বলেছি, এটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। এখানে হয়তো কয়েকজন শিশু উপস্থিত হয়েছে। মনে করছি এরা গোটা বাংলাদেশের শিশুদের প্রতিনিধি। শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সব শিশুর সুন্দর ভবিষ্যতের কথা আমাদের ভাবতে হবে। আমরা সে লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছি। জানি, একজন মানুষের জন্মগত কিছু অধিকার থাকে। এর মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, পুষ্টি, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা বিনোদন ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কেন যুদ্ধ করেছিলাম? এই মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তার জন্যই যুদ্ধটি করেছিলাম।
আমাদের উদ্দেশ্য গুলশান, বানানীর শিশুটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার যে সুযোগ পাবে, বস্তিতে জন্ম নেওয়া ওই শিশুটিও একই সুযোগ পাবে। আমরা চাই না বস্তির শিশুটি টোকাই পরিচয়ে বড় হোক। বিভিন্ন সমস্যার কারণে আমাদের দেশ যে গতিতে এগোনোর কথা ছিল, সেভাবে এগোতে পারিনি। আমাদের সংবিধানে শিশুদের যে অধিকার দেওয়া আছে, সেটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে হবে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও বস্তিতে অবস্থানরত শিশু—এদের মধ্যে পরিবেশগত, সামাজিক ও মানসিক পার্থক্য রয়েছে। সরকার সব শ্রেণীর শিশুদের কথা ভাবছে।
২০১১ সালের শিক্ষানীতিতে প্রতিবন্ধী শিশু এবং সাধারণ শিশু এদের জন্য আলাদা শিক্ষানীতি রয়েছে। শিশুদের জন্য আমাদের সবার সচেতন হতে হবে। সবাইকে অবদান রাখতে হবে, বিশেষ করে গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুরা যখন রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। আমরা কি আমাদের গাড়িটি থামাই? তাদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার কথা ভাবি? কিন্তু এ ধরনের কাজের ঐতিহ্য অনেক দেশের মানুষের আছে। মানুষের মধ্যে এখন মূল্যবোধের অনেক অভাব দেখা যায়। আমরা ১৭ মার্চ জাতীয় শিশুদিবস পালন করি। এই দিনটি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনও। কেন করি, শিশুদের প্রতি মানুষের বিবেক জাগ্রত করার জন্য। শিশুদের প্রতি আরও দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে শিশুরাও যাতে মানসিকভাবে বিকশিত হতে পারে সে জন্য।
আমি মানুষকে সবচেয়ে বেশি সম্মান করি। মানুষের ব্যাপারে সব সময় সতর্ক থাকি। আজ তোমাদের মাঝে আসতে ভয় পেয়েছি। কারণ তোমরা কী প্রশ্ন করবা, কী বলবা ইত্যাদি। সরকার তোমাদের জন্য কী করতে চায়, কী করছে, কী ভাবছে—এসব বিষয়ে আমি এখানে আসার আগে তথ্য সংগ্রহ করেছি। নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ড. শিরীন শারমিনের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তিনিও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
আগে যদি জানতাম যে তোমরা এ ধরনের প্রশ্ন করবা, তাহলে আরও লোকজন সঙ্গে নিয়ে আসতাম। আমি এই ভুলটা করেছি। তোমাদের প্রশ্ন শুনে মনে হয়েছে, সচিব, পাবলিক হেলথের চিফ ইঞ্জিনিয়ার, ডিসি ও অন্যদের আনা উচিত ছিল। বস্তিতে টয়লেট নেই, টিউবওয়েল নেই, জিজ্ঞেস করতাম এগুলো কত দিনের মধ্যে করে দেবেন। ডিসি সাহেবকে বলতাম, এই যে মাঠ দখল করে আছে, খালি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আমার নির্বাচনী এলাকায় ‘জনতার আদালতে সাংসদ জাহাঙ্গীর কবির নানক’ নামে একটি অনুষ্ঠান করি। সেখানে তিতাস গ্যাসের প্রতিনিধি, ওয়াসার প্রতিনিধি, পুলিশের প্রতিনিধি সবাই থাকে। চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে এলাকার মানুষের কথা শুনি। আমিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজন সবাই মিলে উত্তর দিই। তোমাদের বিষয়টি বুঝতে পারলে এই লোকগুলো নিয়ে আসতাম। তাতে আরও বেশি সুবিধা হতো। তাঁরা তোমাদের সমস্যার বিষয়টি দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিতেন।
তবে সোনামণিরা, তোমরা আমার চেতনার জায়গাটি খুলে দিয়েছ। একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি এ জায়গায় বসে। অভিভূত হয়েছি তোমাদের প্রতিভায়। ঢাকা শহরে অনেক শিশু আছে, যারা রোদ-বৃষ্টি লাগাতে পারে না। বাইরে বেরোতে পারে না। বেরোলেই হাঁচি-কাশিসহ নানাবিধ সমস্যা হয়। তোমরা হয়েছ ঠিক আমাদের মতো। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, অর্থাৎ আমরা যারা গ্রাম থেকে এসেছি, সবাই তোমাদের মতো। তোমরা আর আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। রোদ-বৃষ্টির মধ্যে খেলেছি। কাদামাটির মধ্যে বড় হয়েছি। তোমাদের যে ভাবনা, তোমাদের যে কথা শুনলাম, নিশ্চিত যে আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছি।
সিলভিয়ার কথা শুনলাম। বস্তিতে থেকেও সে টেলিভিশনে সংবাদ পড়ে। নাদিম হোসেন লালবাগ থেকে মিরপুর যায় ক্রিকেট খেলতে। আসলামসহ সবাই তোমরা কত চটপট কথা বলছ, প্রশ্ন করছ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে কেউ যুক্ত হতে পারছি, কেউ পারছি না। তোমরা এই সমৃদ্ধির সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছ। এনজিওগুলো তোমাদের জন্য কাজ করছে।
সরকারের অনেক কর্মসূচি রয়েছে। যেমন, লালবাগ এলাকায় ৫০০ শিশুকে এক হাজার ৫০০ টাকা করে ভাতা প্রদান করছি। এই প্রকল্পকে দেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে সরকারের। দেশে আট হাজার কেন্দ্র থেকে শিশুদের টাকা দেওয়া হবে। মেট্রোপলিটন এরিয়ায় এনজিওদের সহযোগিতায় ৫৫ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরাতে পেরেছি। শিশুদের চিত্তবিনোদন, খেলাধুলা সংস্কৃতিচর্চা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। সরকার শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, বিশুদ্ধ পানিসহ নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছে। এর সঙ্গে রয়েছে পয়োনিষ্কাশন। আগে স্কুল-কলেজগুলোতে ছেলেমেয়েদের আলাদা টয়লেট ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, ছেলেমেয়েদের আলাদা টয়লেট করতে হবে। এখন যেখানেই স্কুল-কলেজ হচ্ছে, সেখানেই ছেলেমেয়েদের আলাদা টয়লেট হচ্ছে।
এই সরকারের সময় শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তন হয়েছে তোমারা জানো। এখন তোমাদের দুটি পরীক্ষা দিতে হয়। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে। শিক্ষাব্যবস্থায় এটা একটা বিপ্লব। এর জন্য ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের দেশে অনেক সমস্যা আছে। কখনো হতাশ হওয়া চলবে না। এর মধ্যেই তোমাদের সামনের দিকে যেতে হবে। একটা বিশ্বাস সব সময় রাখবা যে মানুষের কোনো পরাজয় নেই। মানুষ তার স্বপ্নের মতোই বড় হতে পারে। একজন মানুষ বড় হওয়ার জন্য যা কিছু দরকার তার সব গুণ তোমাদের মধ্যে আছে। আমরা যা পারিনি, তোমরা তা পারবে; তোমাদের প্রতি এ বিশ্বাস আমার হয়েছে।
আমরা একাত্তরে যুদ্ধ করেছি। বেঁচে থাকার কথা ছিল না। একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম। সেই বাংলাদেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমরা যেখানে শেষ করব, তোমরা সেখান থেকে শুরু করবে। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ, ব্যবসায়ী, সমাজসেবক, যাঁকে পাবা তাকেই বলবা, তোমাদের জায়গা করে দিতে। সুযোগ করে দিতে। সেই কবে সুনির্মল বসু বলেছিলেন, ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র।’ সত্যিই তাই, শেখার কোনো শেষ নেই। সব জায়গা থেকে শেখা যায়।
আজ তোমাদের মধ্যে এসে অনেক শিখেছি। অনেক জেনেছি। তোমরা অনেক প্রশ্ন আমার কাছে করেছ। আমি শুধু একটি কথা বলব, ধাপে ধাপে সবই তোমাদের জন্য করব। আমরা তার প্রমাণ রাখছি। কোটি কোটি বিভিন্ন কালারের নতুন বই বছরের শুরুতে পাচ্ছ। পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো দেশ দেখাতে পারবে না, যারা এত বই বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে দিতে পারে। অনেকেই সমালোচনা করেছিল যে আমরা পারব না। সব সমালোচনার জবাব দিয়ে আমরা পেরেছি। আমরা এগোচ্ছি। তাই অসম্ভবকে সম্ভব করে মাত্র নয় মাসে এ দেশকে স্বাধীন করেছিলাম। অসম্ভবকে সম্ভব করে এক লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র জয় করেছি। আমরা সেই বাঙালি, যারা হিমালয় জয় করেছি। ক্রিকেট খেলায় কোথায় ছিলাম, আজ কোথায় এসেছি। আমরা এই বাংলাদেশের মানুষই তো সব পেরেছি। এই মানুষের মধ্যে আছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ। এঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি কোনো হতাশাবাদী মানুষ না। তোমাদের কথায় বুঝেছি তোমরাও হতাশ না।
তোমরা যে সমস্যাগুলো বলেছ, সব লিখে নিয়েছি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। অন্য যেসব মন্ত্রণালয়ের কাজ আছে তাদের জানাব। তোমরা যারা আজ এখানে এসেছ, তোমাদের অনুরোধ করব, আমার মোহাম্মদপুর এলাকায় আসতে। তোমাদের দেখাব সব জায়গায় না পারলেও কিছু বস্তিতে কাজ করেছি। ইটের রাস্তা করেছি। টিউবওয়েল বসিয়েছি। পাকা টয়লেট করে দিয়েছি। আবার মাঝেমধ্যে কষ্টও পেয়েছি। যেমন, জেনেভা ক্যাম্পে ২৭টি টয়লেট করে দিয়েছি, টিউবওয়েল বসিয়েছি। দুই সপ্তাহ পরে গিয়ে দেখেছি তারা এগুলো ঠিক রাখেনি, নষ্ট করে ফেলেছে। করেও দিতে হবে, আবার রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে। বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা কোনো জিনিস রক্ষা করার চেষ্টা করি না। গাছটা না বাঁচিয়ে ফলটা খেতে চাই।
শহরের বিভিন্ন এলাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র করার পরিকল্পনা রয়েছে। গ্রামে প্রতি আট হাজার মানুষের জন্য আমরা কমিউনিটি ক্লিনিক করেছি। এর ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। বছরের শুরুতে কোটি কোটি বই প্রাপ্তি যেমন বিশ্বে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে আছে, তেমনি কমিউনিটি ক্লিনিকও বিশ্বে একটি নতুন দৃষ্টান্ত। সরকার এমন কিছু কাজ করেছে, যা বিশ্বের জন্য উদাহরণ। প্রধানমন্ত্রী বিজিএমইএর নেতাদের বলেছেন পোশাকশিল্পকে গ্রামে নিয়ে যেতে। তার জন্য যত ভর্তুকি লাগে তিনি দেবেন। সরকারের দিক থেকে যা যা করা সম্ভব, সবই করা হবে। তোমাদের জীবনযাত্রা যেন নির্বিঘ্ন হয়, সে লক্ষ্যে কাজ করছি।
আব্দুল কাইয়ুম
সবাইকে ধন্যবাদ। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হলে অনেক সমস্যারই সমাধান সম্ভব বলে মনে করি। সরকার ও কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই এদিকে মনোযোগ দেবে।
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়
নজরুল ইসলাম
নগর পরিকল্পনাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি
কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
অংশগ্রহণকারী শিশুরা
মো. জীবন হোসেন, টিঅ্যান্ডটি কলোনি
মণি, চানখাঁরপুল বস্তি
সিলভিয়া, চানখাঁরপুল বস্তি
মো. নাদিম হোসেন, লালবাগ বস্তি, পুরান ঢাকা
সম্রাট, টিঅ্যান্ডটি কলোনি
মর্জিনা আক্তার, ফকিরাপুল বস্তি
রুবেল হোসেন, কেরানীগঞ্জ বস্তি
মুক্তা, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ
মাহমুদুল হাসান, চাঁদনীঘাট, পুরান ঢাকা
মো. আসলাম, ইসলামবাগ বস্তি
সোমা আক্তার, ফকিরাপুল বস্তি
রুমা, মাতবর বাজার, পাকাপুল
পপি আক্তার, ইসলামবাগ, পুরান ঢাকা
সাথি আকতার, কালীগঞ্জ, সদরঘাট
সালমা আক্তার, কমর গলির বস্তি, ফকিরাপুল
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
আ লো চ না
আব্দুল কাইয়ুম
প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ মানুষের বসবাস ঢাকা মহানগরে। এই নগরে রয়েছে অনেক বস্তি। এক হিসাব অনুযায়ী, ৪০ লাখ মানুষ বাস করে বস্তিতে। তাদের একটা বড় অংশ শিশু। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে শিশুদের বস্তিতে বাস করতে হয়। অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেললাইনের পাশে রাত কাটায়। তা ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবেশ, বাসস্থান, খাদ্য, বিনোদন—এগুলোর কোনো কিছুই তারা ঠিকমতো পায় না। সিটি করপোরেশন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন। এ জন্য আমরা প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানককে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আরও আমন্ত্রণ জানিয়েছি নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলামকে। শিশুদের কী সমস্যা, কী তারা চায়, কী তাদের ভাবনা—আমরা এ সম্পর্কে খুব বেশি জানি না। তাদের সঙ্গে আমাদের সাধারণত যোগাযোগ হয় না। আজকে বিভিন্ন এলাকার শিশুরা আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে। তাদের মুখ থেকেই সরাসরি তাদের সমস্যাগুলো শুনব।
প্রথমে আমরা আজকের এই আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে শুনব অবহেলিত শিশুদের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের ভাবনা কী।
জাহাঙ্গীর কবির নানক
আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। যে স্বপ্নের দেশের কথা ভাবি, একদিন এই শিশুরা সেটি নির্মাণ করবে। ছাত্রজীবন থেকে এই মানুষগুলোর জন্য রাজনীতি করছি। আপনারা দেখেছেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীও শিশুদের অনেক ভালোবাসেন। শিশু দেখলেই তিনি বুকে জড়িয়ে ধরেন, কোলে তুলে নেন। শিশুদের মধ্যে তিনি শিশু রাসেলের প্রতিচ্ছবি দেখেন। এদের মাঝে উপস্থিত হতে পেরে খুব ভালো লাগছে। এটি আমার জীবনের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। কয়েকজন শিশু আজকের এ আলোচনায় উপস্থিত হয়েছে। এরা দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতিনিধি। বাংলাদেশের সব শিশুর কথা মাথায় রেখে আমাদের আলোচনা হবে।
প্রথমে আমি সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুদের কিছু কথা শুনি। পরে আবার আলোচনা করব।
আব্দুল কাইয়ুম
এখন শিশুদের আলোচনার জন্য অনুরোধ করছি। তোমরা তোমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও অভিজ্ঞতা মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ও অধ্যাপক নজরুল ইসলামের সামনে তুলে ধরবে।
জীবন হোসেন
আমি ফকিরাপুল টিঅ্যান্ডটি কলোনি থেকে এসেছি। আমরা খুব গরিব মানুষ। বস্তি ভালো জায়গা না। এখানেও অনেক কষ্ট করে থাকতে হয়। মা-বাবা সকালবেলা কাজের জন্য বের হয়। কখনো দুপুরে আসে, কখনো রাতে আসে। সময় সময় তাদের কাজ থাকে না। তখন না খেয়ে থাকতে হয়। এ সময় বাবা-মা কাজের জন্য বাইরে যেতে বলে। বাইরে কাগজ টোকাতে হয়। ভিক্ষা করতে হয়। মানুষের এটা-সেটা কাজ করে দিতে হয়। কিছু খারাপ মানুষ আছে। তারা খারাপ কাজ করতে বলে। বলে, ‘পোঁটলাটা অমুক জায়গায় রেখে আয়।’ রাখতে গেলে অনেক সময় পুলিশে ধরে ফেলে। আমাদের অনেক মারে। পুলিশ আমাদের কথা বিশ্বাস করে না। মনে করে, আমরা মাদকের ব্যবসা করি। যে ছেলেটা পোঁটলা দিল পুলিশ তাকে খুঁজে পায় না। আমরাও পাই না। খারাপ মানুষগুলো আমাদের এ রকম খারাপ কাজ করতে বাধ্য করে। তাদের কথা না শুনলে মারে। শুধু এটাই না, তারা বিভিন্ন মাদক খেতে বাধ্য করে। মাননীয় মন্ত্রীকে বলব, আপনি যদি এই সমস্যাগুলো দেখেন, তাহলে কাজ করতে, বেঁচে থাকতে একটু সুবিধা হয়।
মণি
আমি থাকি চানখাঁরপুল এলাকার বস্তিতে। আমি একটা স্কুলে পড়ি। স্কুলের সামনে ড্রেন আছে। ড্রেনে সব সময় ময়লা-আবর্জনা থাকে। ময়লা পানি থাকে। এখান থেকে গন্ধ বের হয়। যখন বৃষ্টি হয়, তখন সমস্যা বেশি হয়। বৃষ্টির পানিতে ময়লা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। গন্ধ তখন আরও বেশি ছড়ায়। এ সময় স্কুলে যাওয়া-আসা করতে অসুবিধা হয়। ক্লাস করতে সমস্যা হয়। মাননীয় মন্ত্রী কি ড্রেনটা ঠিক করে দেবেন?
সিলভিয়া
আমি চানখাঁরপুল বস্তিতে থাকি। আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। এটিএন বাংলায় শিশু সাংবাদিক হিসেবে কাজ করি। যেটা বলতে চাই তা হলো, বস্তিতে অনেক ভালো ছাত্রছাত্রী থাকে। কিন্তু তাদের মেধা বিকাশের কোনো সুযোগ নেই। সচ্ছল পরিবারে দেখি, মা-বাবা ছেলেমেয়েদের রিকশায় বা গাড়িতে করে স্কুলে নিয়ে যান, নিয়ে আসেন। তাদের পোশাক ভালো। থাকা-খাওয়ার পরিবেশ ভালো। বাসায় পড়ানোর জন্য দু-তিনজন শিক্ষক রেখে দেন। ওদের জন্য যেটা সত্যি। বস্তির একজন শিশুর জন্য এটা স্বপ্ন। কখন বাসায় আসি, কখন যাই—এগুলো দেখার সময় বাবা-মায়ের নেই। ইচ্ছা হলে পড়ি, না হলে পড়ি না। মাস্টার রেখে পড়ার প্রশ্নই আসে না। বস্তির মানুষ জেনে গেছে বিদ্যুৎ, ভালো পানি, ভালো খাবার তাদের জন্য নয়। বস্তিতে রাত-দিনের কোনো পার্থক্য নেই। সব সময় শব্দ, কোলাহল, দুর্গন্ধ, মশাদের প্রিয় একটি জায়গা বস্তি। মশারা ২৪ ঘণ্টাই এখানে মানুষকে কামড়াতে পারে। বস্তির অনেককে দেখি, পড়ালেখায় তাদের খুব আগ্রহ। অনেক ইচ্ছা। কিন্তু এমনি একটি পরিবেশে কীভাবে তারা মেধা বিকাশের সুযোগ পাবে? মাননীয় মন্ত্রী, বস্তির শিশুরা যাতে লেখাপড়া করতে পারে, সে দিকটি কি আপনি একটু ভাববেন?
মো. নাদিম হোসেন
পুরান ঢাকার লালবাগ বস্তিতে থাকি। পড়ালেখার পাশাপাশি শিশুদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি। লালবাগ এলাকায় অনেক বস্তি। প্রতিবছর এই বস্তিগুলোতে আগুন লাগে। এ জন্য অন্য এলাকার বস্তি থেকে লালবাগ এলাকার বস্তির নামডাক বেশি। আগুন নিয়ে অনেক কথা হয়। পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়। আবার পরের বছর আগুন লাগে। বস্তিবাসীসহ আশপাশের অনেকেই জানে, আগুন কীভাবে লাগে। কিন্তু ভয়ে কেউ কথা বলবে না। আগুন নিয়ে আমি কিছু বলব না। অন্য একটি বিষয়ের কথা বলতে চাই। লালবাগ এলাকার বস্তিগুলোতে কয়েক হাজার শিশু আছে। তাদের জন্য কোনো খেলার মাঠ নেই। মিরপুর ক্লাবে সপ্তাহে চার দিন ক্রিকেট খেলি। আমার মতো সবার মিরপুরে গিয়ে খেলা সম্ভব নয়। সবার সে সুযোগও হবে না। শিশুরা সব সময় একটু খেলাধুলা করতে চায়। স্কুলে ম্যাডাম বলেন, মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা দরকার। কিন্তু এখানে খেলার মাঠ না থাকায় শিশুরা নানা রকম খারাপ কাজের দিকে চলে যাচ্ছে। খারাপ মানুষেরা শিশুদের খারাপ কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। মাননীয় মন্ত্রীকে বলব, আমাদের এখানে খেলাধুলার জন্য মাঠের ব্যবস্থা করা যায় কি না।
সম্রাট
আমি টিঅ্যান্ডটি কলোনি বস্তিতে থাকি। একটি জরুরি কথা বলার জন্য মন্ত্রীর কাছে এসেছি। মাঝেমধ্যে দেখি, কখনো সরকার, আবার কখনো প্রভাবশালী মানুষ বস্তি ভেঙে ফেলে। বস্তিতে বড় মানুষ থাকে। শিশুরা থাকে। বৃদ্ধরা থাকে। এমনকি অসুস্থ রোগীও থাকে। বস্তি ভেঙে ফেললে আমরা সবাই খুব বিপদে পড়ে যাই। সবচেয়ে বিপদে পড়ে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ রোগীরা। আমাদের মা-বাবা অনেক দিন ধরে, অনেক কষ্ট করে, অল্প অল্প টাকাপয়সা জোগাড় করে যা কিছু জিনিস করে তার কোনো কিছুই নিয়ে আসতে পারি না। আমাদের বস্তিগুলো মাটির সঙ্গে মিশে যায়। আশ্রয়হীন হয়ে পড়ি। চলে আসতে হয় খোলা আকাশের নিচে। তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেখানে-সেখানে রাত কাটাতে হয়। এ অবস্থায় দিন কাটে রেলস্টেশনে ও রেললাইনের পাশে, বাস-ট্রাক স্ট্যান্ডে, বাজারে কিংবা রাস্তাঘাটে। বস্তি খুব ভালো জায়গা না। কিন্তু এই জায়গাগুলো বস্তি থেকে অনেক বেশি বিপজ্জনক। এখানকার লোকজন আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে। মারধর করে। আমাদের দিয়ে খারাপ কাজ করাতে চায়। এভাবে অনেকেই মাদকের সঙ্গে, চুরির সঙ্গে, আরও নানা রকম খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তারা আর ভালো পথে ফিরে আসতে পারে না। আমি যেহেতু বস্তির একজন শিশু, আমার বন্ধুরাও সবাই বস্তিতে থাকে, আমি কখনোই চাই না আমাদের শেষ আশ্রয়টুকু শেষ হয়ে যাক। তার পরও যদি আপনারা ভেঙে ফেলতে চান, তাহলে আমাদের জন্য কোথাও না কোথাও একটু জায়গা করে দেবেন। মন্ত্রীর কাছে এটা আমার বিশেষ অনুরোধ।
মর্জিনা আক্তার
আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। ফকিরাপুলের বস্তিতে থাকি। এখানে ঘরভাড়া খুব বেশি। একটা ঘরের ভাড়া দিতে হয় তিন হাজার টাকা। বেশি ভাড়ার জন্য এক ঘরে আটজন থাকি। এত মানুষ একসঙ্গে থাকা যায় না। অনেক চাপাচাপি করে থাকতে হয়। রাতে গরমে ঘুম হয় না। খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কিছুই করার নেই। জানি, এভাবেই আমাদের থাকতে হবে। আমাদের আয়-রোজগার খুব কম। আমাদের এখানে ৫০ থেকে ৬০ জন মানুষ থাকে। এতগুলো মানুষের জন্য দুটি টয়লেট। একটা গোসলের জায়গা। এখানে শুধু সমস্যা আর সমস্যা। ভালো কিছু নেই। এসব কষ্ট মেনে নিয়েছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অল্প আয়ের সবটুকু ঘরভাড়ায় চলে যায়। ভাড়া দেওয়ার পর খাওয়া-পরা চালাতে অনেক কষ্ট হয়। এত কিছুর পরও যদি খাওয়া-পরাটা ঠিক থাকত, তাহলে অনেকটা ভালো থাকতে পারতাম। অনেক সময় ভাবি, এটা তো খুব বেশি ভাড়া না। কিন্তু আমাদের তো এটাই সব। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আবেদন, আমাদের কম ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা করা যায় কি না বা কোনোভাবে কিছুটা সাহায্য করা যায় কি না।
সিলভিয়া
আমি বলতে চাই, উচ্ছেদের বিষয়ে কোনো আইন করা যায় কি না, যে আইনি বলে উচ্ছেদের আগে তাদের থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। অন্য কোনো ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত কোনো অবস্থাতেই বস্তি ভাঙা যাবে না বা উচ্ছেদ করা যাবে না। মর্জিনা যে কম ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা বা কিছুটা সরকারি সাহায্যের আবেদন করল, সেটা আমারও কথা।
রুবেল হোসেন
কেরানীগঞ্জের একটি বস্তি থেকে এসেছি। বস্তির পরিবেশ খুবই নোংরা। ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা নেই। আমাদের ঘরের পাশেই ময়লা রাখা হয়। দিন-রাত দুর্গন্ধের মধ্যে থাকতে হয়। রান্নাঘরের চারদিক ফাঁকা। ধুলা-বালু, পোকা-মাকড় খাবারের মধ্যে এসে পড়ে। এ খাবার খেয়ে নানা রকম অসুখ-বিসুখ হয়। অসুখ-বিসুখে আরও বড় সমস্যায় পড়তে হয়। বস্তির কাছাকাছি কোনো সরকারি হাসপাতাল নেই। অন্য কোথাও চিকিৎসা করানোর মতো টাকাপয়সা নেই। হাসপাতালগুলোর এমন অবস্থা, তাদের সামনে মরে গেলেও তারা কম পয়সায় চিকিৎসা করবে না। ডাক্তারদের মায়া-মমতা চাই, কিন্তু পাই না। বিনা পয়সায় তো দূরের কথা, কম পয়সায়ও তারা চিকিৎসা করে না। অনেক সময় বেশি অসুস্থ রোগী থাকে, যাদের দূরে নিয়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় না। আবার ডাক্তাররা বস্তির নোংরা পরিবেশ দেখে আসতেও চায় না। এ অবস্থায় আমি মাননীয় মন্ত্রীকে বলতে এসেছি, আমাদের কিছুটা ভালো পরিবেশ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় কি না।
মুক্তা
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে এসেছি। যে বস্তিতে থাকি, সেখানে মেয়েদের উপযোগী গোসলখানা, টয়লেট নেই। ভাঙাচোরা গোসলখানা, টয়লেট। বৃষ্টির সময় ভিজে যেতে হয়। বস্তির চারপাশে উঁচু বিল্ডিং। মেয়েদের গোসল করতে অনেক সমস্যা হয়। বস্তিতে অনেক লোক একসঙ্গে থাকে। তাই টয়লেট ও গোসলের জন্য লাইন দিতে হয়। শিশুদের সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হয়। তাদের কেউ সুযোগ দিতে চায় না। তাদের প্রয়োজনটা কেউ বোঝে না। সবাই তাদের অবহেলা করে। টয়লেট ও গোসলখানা কখনো পরিষ্কার থাকে না। এখান থেকে অনেক রোগজীবাণুু ছড়ায়। বস্তির অনেকেই কলেরা, আমাশয়, জন্ডিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত থাকে। মাননীয় মন্ত্রীকে আমাদের বস্তিতে ভালো টয়লেট ও গোসলখানার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করছি?
মাহমুদুল হাসান
এসেছি পুরান ঢাকার চাঁদনীঘাট থেকে। যে বস্তিতে থাকি, বর্ষার সময় সেখানে পানি উঠে যায়। সারাক্ষণ পচা দুর্গন্ধযুক্ত পানির মধ্যে থাকতে হয়। পচা পানি থেকে আমাদের অনেক অসুখ-বিসুখ হয়। এমনিতে টাকাপয়সার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারি না। বর্ষার সময় এ সমস্যা আরও বেশি হয়। কারণ, এ সময় বাবা-মায়ের কাজ কম থকে। বর্ষার পানির জন্য ঘর থেকে দূরে কোথাও যাওয়া যায় না। আমাদের জিনিসপত্র, খাবার সবই নষ্ট হয়ে যায়। যেখান থেকে বাজার করি, সে বাজারেও পানি উঠে যায়। তখন আমাদের মতো শিশু ও বৃদ্ধদের অনেক অসুবিধায় থাকতে হয়। মাননীয় মন্ত্রীকে বলব, তিনি যেন বস্তি ও বাজারকে বর্ষার পানি থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করেন।
মো. আসলাম
ইসলামবাগ বস্তি থেকে এসেছি। বস্তির চারপাশের কলকারখানায় ২৪ ঘণ্টা শব্দ হয়। বিশেষ করে, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই শব্দ আরও বাড়তে থাকে। বস্তির লোকজন সারা দিন পরিশ্রমের কাজ করে। রাতে তাদের ভালো ঘুম দরকার। কিন্তু শব্দের জন্য ঘুমাতে পারে না। শিশুদেরও সমস্যা হয়। যারা একটু লেখাপড়া করতে চায়, কারখানার শব্দে তাদের অসুবিধা হয়। মাননীয় মন্ত্রী, আশা করি, এই সমস্যার সমাধান করে দেবেন।
সোমা আক্তার
ফকিরাপুল বস্তি থেকে এসেছি। বস্তির চারপাশে খারাপ ছেলেরা আড্ডা দেয়। স্কুলে যাওয়া-আসার সময় খুব বিরক্ত করে। আমাদের দেখলে শিস দেয়, গান-বাজনা শুরু করে। খারাপ কথা বলে। প্রতিবাদ করতে গেলে মারে। বকাঝকা করে। এমনকি রাতে পড়ালেখা করতে গেলেও জানালার পাশে এসে শিস দেয়। এসব কারণে পড়তে পারি না। বাবা-মাকে বলেও কোনো লাভ হয় না। তাঁদের প্রতিবাদ করার শক্তি ও সাহস নেই। মা-বাবা পারেন আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতে। তাঁরা কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। বিয়ে দিয়ে দেন। আমরা অল্প বয়সে বিয়ে করতে চাই না। লেখাপড়া করতে চাই। কিন্তু এই বখাটে ছেলেদের জন্য সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয় না। মাননীয় মন্ত্রী, এই বখাটেদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি না।
আব্দুল কাইয়ুম
এতক্ষণ শিশুদের কাছ থেকে তাদের সমস্যার কথা শুনলাম। শিশুরা, তোমরা যারা বলোনি, তোমাদের কথা আবার শুনব। এবার আমরা সবাই শুনব অধ্যাপক নজরুল ইসলামের কাছ থেকে।
নজরুল ইসলাম
প্রিয় শিশুরা, আজকে তোমাদের জন্য একটি ভালো দিন। মাননীয় মন্ত্রীও তোমাদের পেয়ে খুব খুশি। তিনি বলেছেন তাঁর জন্য এটি একটি ভালো দিন। তোমাদের জন্য এটি একটি বিরাট সুযোগ যে বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারছ। সরাসরি তাঁকে প্রশ্ন করতে পারছ। আমরা ছোটবেলায় এই সুযোগ পাইনি।
তোমরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে কথা বলেছ। বেশ ভালো লেগেছে। আমরা সবাই সরকারের কাছে অনেক কিছু আশা করি। কারণ সবার প্রতি সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। এ জন্য আমাদের সমস্যার কথা সরকারের কাছে বলি। সরকারও আমাদের জন্য কাজ করছে। আমাদের কথা ভাবার জন্য সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় করেছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও কাজ করে। যেমন, ইউনিসেফ তোমাদের লেখাপড়া ও অন্যান্য ব্যাপারে সহায়তা দেয়। আবার পত্রিকাগুলো কোথায় কী আছে না-আছে, কী হলো না-হলো, তোমাদের কী সুবিধা-অসুবিধা, তারা সরকারকে, মানুষকে জানায়। এভাবে সবাই সবার জন্য কাজ করে। আমি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছি। আবার তোমরা কোথায় থাকো, কী করো সেটাও বলতে পারি। কেন বলতে পারি? আমি এই নগর নিয়ে গবেষণা করি। নগরের কোথায় কী আছে, এটা নিয়ে ভাবি। উদ্দেশ্য, নগরের সমস্যা খুঁজে বের করা এবং কীভাবে সমাধান করা যায় সেটি বের করা। কারা সমাধান করবে? সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন সমাধান করবেন। ঢাকা শহর পৃথিবীর মধ্যে একটি বড় শহর। বাংলাদেশের জনসংখ্যা সারা পৃথিবীর মধ্যে অষ্টম। সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা চীনে, ১৩০ কোটি। ভারতে ১২০ কোটি। আমাদের ১৫ কোটি। ১৫ কোটির মধ্যে কেবল ঢাকা শহরে দেড় কোটি। আমরা যদি বলি ঢাকা সিটি করপোরেশন বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উত্তরা, তাহলে এক কোটি। এক কোটির মধ্যে আমরা যাকে বলি বস্তি, সুবিধাবঞ্চিত এলাকা, এখানে বাস করে ৪০ লাখ। তাদের মধ্য থেকে তোমরা কয়েকজন এসেছ। আমি নিজেও তোমাদের কথা ভাবি। আমি তোমাদের লোক। নগর গবেষণাকেন্দ্র নামে আমার একটি সংগঠন আছে। এর বয়স ৪০ বছর হলো। এই গবেষণাকেন্দ্র থেকে তোমাদের জন্য একটা কাজ করেছি। ১৫ লাখ বস্তিবাসী নিয়ে একটি সংগঠন করেছি। তোমাদের মা-বাবারা সেই সংগঠনের সদস্য।
আব্দুল কাইয়ুম
অধ্যাপক নজরুল ইসলামের কথা শুনলাম। এখন আবার মাননীয় মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের কাছ থেকে আমরা শুনতে চাচ্ছি। শিশুরা তো তাদের দুঃখের কথা বলল। মাননীয় মন্ত্রী ও তাঁদের মন্ত্রণালয় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সমস্যা সমাধানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নেবেন কি?
জাহাঙ্গীর কবির নানক
তোমরা জানো এই ঢাকা মহানগরের একটি এলাকার মানুষ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। আমার কাজ বাদ দিয়ে তোমাদের কাছে এসেছি। আজ তোমাদের সবার কথা শুনব। আমার নির্বাচনী এলাকা সবচেয়ে বেশি মাদকের আখড়া। সবচেয়ে বেশি বস্তিবাসী মানুষের বাস। বছিলায় ভোট চাইতে গিয়ে দেখেছি সেটি অজপাড়াগাঁ। এটি আমার নির্বাচনী এলাকার মধ্যে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে। আমার নির্বাচনী এলাকায় সাতটি উর্দুভাষী মানুষের ক্যাম্প রয়েছে। বস্তিবাসীর কষ্টকর জীবন, উর্দুভাষীদের ক্যাম্পের মানুষের মানবেতর জীবন, মাদকের ভয়াবহতা—সবই আমি দেখেছি। তোমরা মাদকের কথা বলেছ। ড্রেনের সমস্যার কথা বলেছ। অন্যান্য সমস্যার কথা বলেছ—সবই ঠিক আছে। আমি এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বিভিন্ন বস্তিতে যে মাদকের রমরমা ব্যবসা ছিল, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন মাদকের কাজে তোমাদের মতো শিশুদের ব্যবহার করছে। এর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছি। আশা করি বন্ধ হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুর পর গ্রামের কথা কেউ ভাবেনি। গ্রামীণ অবকাঠামো দুর্বল হওয়ায় বাংলাদেশের সব গ্রাম থেকে লোক ঢাকার দিকে আসছে। ঢাকা শহরে মানুষের অত্যধিক চাপ পড়ছে। সেই পুরোনো আমলের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা এখন আর কাজ করছে না। তোমরা লক্ষ করেছ, সারা ঢাকা শহরে আগামী ৫০ বছরের হিসাব করে বড় মাপের পাইপ বসাচ্ছি, যাতে আগামী ৫০ বছর ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো থাকে। এই কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতা দূর হবে।
লালবাগের বস্তিতে প্রতিবছর আগুন লাগে। এটা ঠিক। তবে কোথাও আগুন লাগে, কোথাও লাগানো হয়। এই আগুন লাগার কারণও আমি খুঁজে বের করেছি। কোনো বস্তি সরকারের জমিতে। কোনো বস্তি খাসজমিতে। সরকারের জমির বস্তিতে বিভিন্ন গ্রুপের ভাড়া তোলা নিয়ে বিরোধের জন্য আগুন লাগিয়ে দেয়। আবার সরকারের খাসজমি কেউ লিজ নিয়ে নিল। সে চাইবে বস্তি খালি করতে। আগুন লাগানোকেই সে খালি করার উপায় হিসেবে বেছে নেয়। আবার এনজিওর সাহায্য নেওয়ার জন্যও আগুন লাগানো হয়। মোটামুটি এই হচ্ছে বস্তিতে আগুন লাগার ইতিহাস। তোমরা জানো, জেনেভা ক্যাম্পে প্রতিবছর আগুন লাগে। এর কারণ খুঁজে বের করলাম। তোমরা খেয়াল করেছ, এখন আর আগুন লাগে না।
ঢাকা শহরে বিভিন্ন নামে বস্তি আছে। তারা ভাড়া নিচ্ছে। বস্তিতে টয়লেট, গোসলখানা, রান্নার ভালো ব্যবস্থা করে দিচ্ছে না। এগুলো খোঁজখবর নিয়ে বস্তির মধ্যে রাস্তা করে দিয়েছি। টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়েছি। এভাবে কাজ করতে করতে সব বস্তির সমস্যা একসময় দূর হবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তোমরাও এগিয়ে যাচ্ছ। তোমরা অনেক স্মার্ট, অনেক সুন্দর করে কথা বলেছ। অভিভূত হয়েছি তোমাদের কথা শুনে। আমাদের বয়সী মানুষ তোমাদের মতো এত সুন্দর করে কথা বলতে পারবে না।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এর প্রমাণ আজ তোমরাই। আমাদের গার্মেন্টসের কর্মীরা কত ভোরে উঠে কাজে যায়! তারা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা এনে দিচ্ছে। আমি তাদের সম্মান করি। শুধু সরকার নয়, সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে মানুষের সাহায্যের জন্য। আজ তোমরা নতুন চকচকে বই হাতে পাচ্ছ। এগুলো আমাদের উন্নতি। আমাদের সময় বড় ভাইবোনের রেখে দেওয়া পুরোনো বই আমরা পড়তাম।
আমাদের সরকারের সিদ্ধান্ত, কোনো খেলার মাঠ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। খেলার মাঠ রক্ষা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে। খেলার মাঠ উন্নয়ন করছি। মাঠগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল।
মো. আসলাম
আমার একটা কথা আছে,স্যার। ইসলামবাগে আমাদের খেলার মাঠ দখল করে বানানো হয়েছে ট্র্যাকস্ট্যান্ড।
জাহাঙ্গীর কবির নানক
তোমাদের মাঠের ঠিকানা দিয়ে যাও, সেটা অবশ্যই খালি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
ঢাকা শহরটি পুরোপুরি পরিকল্পনাহীনভাবে গড়ে উঠেছে। যার যেখানে ইচ্ছা বাড়ি করছে। মার্কেট করছে। স্কুল-কলেজ করছে। অপরিকল্পিত হওয়ার কারণে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আমরা কিন্তু থেমে নেই, আমরাও কাজ করে যাচ্ছি। গরমের সময় চিন্তা থাকে কোথায় না আবার পানির সমস্যা হয়। সারা দিন দৌড়াতে থাকি। বর্ষার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি দেখলেও চিন্তা হয়, কোথায় যেন পানি জমা হয়ে সমস্যা তৈরি করে। পরিকল্পনাহীনভাবে শহর গড়ে ওঠার জন্য প্রতিনিয়ত সমস্যা হচ্ছে।
বখাটেদের উৎপাত, ইভ টিজিংয়ের কথা আসছে। আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। এই কয়েক দিন আগেও প্রায়ই ইভ টিজিং নিয়ে আলোচনা হতো। এখন সেটা বন্ধ হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। শব্দদূষণের কথা একজন বলেছ। আমি পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানাব। আশা করি কাজ হবে। কারও কোনো অধিকার নেই যে একজন মানুষকে ঘুমাতে না দিয়ে মেশিন চালাবে বা অন্য কোনোভাবে শব্দ করবে। এটা সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ একটা কাজ। বিষয়টা আমরা দেখব। টয়লেটের সমস্যার কথা আসছে। টয়লেটের জন্য আমাদের প্রকল্প আছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সমস্যা থাকবে না। তোমরা জানো আন্তর্জাতিকভাবে শিশু-কিশোরদের বয়সসীমা পরিবর্তন হয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শিশু আইন করা হয়েছিল। তারপর আর এই আইন সংশোধন করা হয়নি। ২০১১ সালে শিশু আইন ঠিক করে নিয়েছি।
আমার নির্বাচনী এলাকায় রয়েছে এসওএস শিশুপল্লি। সেখানে গেলে আমার খুব ভালো লাগে। গত জুমায় সেখানে নামাজ পড়েছি। এসওএস শিশুপল্লির মেয়েরা মাধ্যমিক শেষ করার পর লালমাটিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক থেকে সম্পূর্ণ বিনা বেতনে পড়বে। ছেলেদের জন্য মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উচ্চমাধ্যমিক থেকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছি। স্কুলগুলোতে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ। এ জন্য মিল্কভিটাকে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করছি। তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। তোমরা আমার চোখ খুলে দিয়েছ। তোমাদের কাছ থেকে অনেক বিষয় জানতে পেরেছি।
আব্দুল কাইয়ুম
মাননীয় মন্ত্রী প্রতিটি বিষয় অনেক মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তোমাদের মধ্যে এখনো যারা বলোনি, এবার বলো।
রুমা
মাতবার বাজার পাকাপুল থেকে এসেছি। মায়ের ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করানোর। আমারও ইচ্ছা ছিল। সংসারে অভাবের জন্য দুজনের ইচ্ছাই বাদ গেল। মা পাঠালেন কাগজ টোকাতে। কাগজের বস্তা নিয়ে মানুষের পাশ দিয়ে যেতে হয়। যাওয়ার সময় কারও গায়ে কখনো বস্তাটা একটু লেগে যায়। তখন তারা আমাকে মারে। আমার খুব খারাপ লাগে। আমি অনেক কান্না করি। বাড়ি গিয়ে মাকে বলি, মা-ও কান্না করেন। এখন আর মাকে বলি না। মা মনে করেন, আমাকে এখন কেউ মারে না। কিন্তু এখনো মারে। এর কী কোনো সমাধান আছে?
পপি আকতার
পুরান ঢাকার ইসলামবাগ থেকে এসেছি। যে বস্তিতে থাকি, সেখানে মা-বাবা দুজনই কাজে চলে যান। তাঁদের শিশুসন্তানেরা একা একা বাসায় থাকে। বস্তির আশপাশে পুকুর আছে, নদী আছে, ময়লা-আবর্জনা আছে, মা-বাবা না থাকায় শিশুরা এসব জায়গায় চলে যায়। ফলে তারা পানিতে পড়ে যেতে পারে। ময়লা-আবর্জনা খেয়ে পেটে অসুখ হতে পারে। মাননীয় মন্ত্র্রী এ ব্যাপারে কিছু করতে পারলে ভালো হয়।
সাথি আকতার
আমি কালীগঞ্জ থেকে এসেছি। সেলাই মেশিনের কাজ করি। যে বস্তিতে থাকি সেখানে ঘরভাড়া অনেক বেশি। ঘরভাড়া বেশি হওয়ার কারণে খাওয়া-পরার অনেক সমস্যা হয়। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আবেদন, এ ব্যাপারে কিছু করা যায়?
সালমা আক্তার
ফকিরাপুল কমর গলির বস্তি থেকে এসেছি। যে বস্তিতে থাকি সেখানে অনেক শিশু আছে। এই শিশুদের বাবা-মা সকালে তাদের ঘরে রেখে কাজে যান। কখনো দুপুরে বাসায় ফেরেন। কখনো সন্ধ্যায়। ঘরে কোনো খাবার না রেখেই তাঁরা কাজে যান। শিশুরা না খেতে পেয়ে বস্তির বাইরে যায়। রাস্তায় চলে যায়। তারা খাবারের খোঁজ করতে থাকে। মানুষের কাছ থেকে চেয়ে খায়। এ সুযোগে কিছু দুষ্টুলোক তাদের খাবারের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যায়। তাদের ভিক্ষাসহ খারাপ কাজ করাতে চায়। অনেক সময় পাচার করে দেয়। এ ব্যাপারে মাননীয় মন্ত্রী কী করবেন?
সিলভিয়া
এ সময়টি আমাদের বয়ঃসন্ধির কাল। এ সময় শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়। আমাদের নিজস্ব আলাদা পরিবেশের দরকার হয়। কিন্তু কোনো বস্তিতে সে রকম পরিবেশ নেই। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা মানুষ চলাফেরা করে। তা ছাড়া নিজেদের পরিবারেও বেশি মানুষ থাকে। ছোট্ট একটি ঘর। খাওয়ার সময়, ঘুমোনোর সময় কখনো নিজস্বতা বলে কিছু থাকে না। এতে আমাদের খুব অসুবিধা হয়। মাননীয় মন্ত্রী, এ বিষয়ে কিছু করা যায় কি না।
মাহমুদুল হাসান
আমাদের বস্তির পাশে কামরাঙ্গীর চর নামে একটি বস্তি আছে। এই বস্তির শিশুদের ভিক্ষার কাজে লাগানো হয়। একজন শিশুর জীবনে এর থেকে খারাপ আর কী হতে পারে! মাননীয় মন্ত্রী যেন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন।
মো. আসলাম
বাবা মারা গেছেন। মা আবার বিয়ে করেছেন। নানি খুব কষ্ট করে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমি নিজেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে গিয়েছিলাম। কাজ হলো মেশিনে পাইপ বানানো। এ সময় হাত কেটে ও ভেঙে যেতে পারে। আবার পলিথিন কারখানায় পলিথিন কাটার সময় হাত কেটে যেতে পারে। এ রকম আরও কাজ আছে। ইউনিসেফ সেখান থেকে আমাকে নিয়ে এসেছে। আমার মতো অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। তারাও আমার মতো শিশু। তাদের এ কাজ থেকে ফিরিয়ে আনা যায় কি না বা অন্য কোনো কাজের ব্যবস্থা করা যায় কি না।
জীবন
আমাদের বস্তিতে সকালবেলা বাথরুম এবং হাত-মুখ ধোয়ার জন্য লম্বা লাইন দিতে হয়। এতে আমাদের অসুবিধা হয়। বাথরুম না করে এবং হাত-মুখ না ধুয়ে অনেক সময় স্কুলে যাই। তখন শিক্ষকেরা মারেন। বস্তিতে লোক গাদাগাদি করে থাকে। স্কুল থেকে বাসায় ফিরলে মায়ের সঙ্গে কাজ করি। রাতে বিদ্যুতের অভাবে পড়তে পারি না। পাশে কোথাও গিয়ে পড়ব, সেখানেও দুর্গন্ধ আর মানুষের ভিড়। বস্তির পাশে দুটি মাঠ আছে। সে মাঠে সব সময় ট্রাক থাকে। কখনো খেলাধুলা করতে পারি না। মাননীয় মন্ত্রী, এ বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করবেন কি?
আব্দুল কাইয়ুম
সবার কথা শোনা হলো। শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক বিষয় উঠে এসেছে। সমস্যাগুলো যে কত গভীর তা মাননীয় মন্ত্রীসহ সবাই বুঝতে পারছি। এখন অধ্যাপক নজরুল ইসলামের কাছ থেকে আবার শুনব।
নজরুল ইসলাম
এতক্ষণ শিশুদের অনেক কথা শুনলাম। এ কথার হয়তো কোনো শেষ নেই। কথা চলতেই থাকবে। কিন্তু মানুষকে কোথাও না কোথাও থামতে হয়। তোমাদের কথা মন দিয়ে শুনেছি। তোমরা সবাই কোনো না কোনো বস্তি থেকে এসেছ। এই যে বস্তিতে থাকো, তোমাদের কি খারাপ লাগে? বস্তিতে থাকা কোনো খারাপ বিষয় না। বস্তি শব্দটাও খারাপ না। বস্তি মানে বসতের জায়গা। তুমি কোথায় থাকো সেটা কোনো বড় কথা না। বড় কথা হলো, তুমি কতটুকু ভালো। কতটুকু ভালো মানুষ। আজ থেকে মনে করবা বস্তিতে থাকা কোনো খারাপ কাজ না। যদি না খারাপ কাজ করো।
ঢাকা শহরের ৪০ লাখ মানুষ বস্তিবাসী। সিঙ্গাপুর শহরের নাম শুনেছ? এটা একটা শহর। আবার একটা দেশ। একটাই শহর। একটাই দেশ। লোকসংখ্যা মাত্র ৪০ লাখ। তাহলে ঢাকা শহরে বস্তিবাসী যত, ওদের লোকসংখ্যা তত। এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল ১৪ লাখ ১২ হাজার। পাস করেছে ১২ লাখেরও বেশি। মালদ্বীপ একটি দেশ না? এর জনসংখ্যা কত? মাত্র চার লাখ। আর আমাদের দেশে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল ১৪ লাখ ১২ হাজার। আমাদের সব সংখ্যাই বেশি। এ জন্য কিছু কিছু বিষয় কম পড়ে যায়।
আমাদের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান। লক্ষ করলাম, খাদ্য নিয়ে তোমরা কেউ কিছুই বলোনি। তাহলে মোটামুটি বলা যেতে পারে যে খাদ্যের অভাব আমাদের নেই। তবে আরও ভালো খাদ্য, ভালো পুষ্টি দরকার। তোমরা কেউ কাজ চাওনি। কারণ কাজের বয়স তোমাদের এখনো হয়নি। তোমরা এখনো শিশু।
এরপর হলো বস্ত্র। মনে আছে, যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখনো হাফপ্যান্ট পরে, খালি পায়ে স্কুলে এসেছি। হঠাৎ একদিন শিক্ষক বললেন, তোমরা হাফপ্যান্ট পরে, খালি পায়ে স্কুলে আসবে না। তোমরা এত ছোট্ট তা-ও খালি পায়ে, হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যাও না। তোমরা সবাই ভালো জামাকাপড় পরো। তাহলে বস্ত্রের দিক থেকে ভালো আছি।
শিক্ষা, সবাই স্কুলে যায়। কিন্তু বস্তির অনেকে হয়তো স্কুলে যেতে পারে না। সরকার প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। তার পরও তোমরা অনেকে যেতে পারো না। এ বিষয়ে সরকারের দিক থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। স্কুলে যেন ঠিকমতো লেখাপড়া হয় সে বিষয়টি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তোমরা দুই-তিনজন ছাড়া কেউ প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে যাও না। এটা খুব ভালো। এর মানে হচ্ছে আমাদের স্কুলগুলোতে লেখাপড়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বলেছ। চিকিৎসার খরচ বেশি। ভালো চিকিৎসা অনেক সময় পাওয়া যায় না। তোমরা নিয়মিত স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেবে। ভালো স্বাস্থ্যের জন্য দরকার ভালো পয়োব্যবস্থা। অর্থাৎ ভালো বাথরুম দরকার। ভালো পানি দরকার। তোমরা বলেছ বস্তিতে ভালো বাথরুম নেই। দেশে নিরাপদ পানিরও সমস্যা আছে। এদিকটায় সরকারকে নজর দিতে হবে। ভালো পয়োব্যবস্থা বলতে বোঝায় ভালো বাথরুম, যেখান থেকে ময়লা সরাররি পয়োনিষ্কাশনের লাইন দিয়ে পাগলায় শোধনাগারে চলে যাবে। এই শোধনাগারে কারখানার বর্জ্য মিশে পানি বিষাক্ত হয়ে যায়। সিঙ্গাপুর পৃথিবীর একটি উন্নত শহর। সেখানে বাথরুমের পানি শোধন করে তারা খায়।
তোমাদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। খেলাধুলা করার সুযোগ থাকতে হবে। তোমরা ভালো বলেছ, খেলার মাঠ নেই। বস্তির ছেলেমেয়েদের বেশি সাহস। এরা রাস্তায় খেলাধুলা শুরু করে। অথবা ইসলামবাগের ছেলে মিরপুর গিয়ে খেলে। মাঠের কথা তোমরা বলেছ। আমরাও চাই প্রতিটি বস্তিতে মাঠ থাকতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও খেলাধুলার প্রতি বিশেষ আগ্রহ আছে। তোমাদের মাঠের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মাননীয় মন্ত্রীও তোমাদের কথা দিয়েছেন, মাঠের ব্যবস্থা হবে। গুলশানের একটা পার্ক একবার কর্তৃপক্ষ ওয়ান্ডারল্যান্ড বানাতে চেয়েছিল। আমরা তখন বাধা দিয়ে ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠ হিসেবে রেখে দিয়েছি। তোমরা খেলাধুলা করবে। চিড়িয়াখানায় যাবে। পার্কে ঘুরবে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবে। তোমরা জাদুঘর দেখতে যাবে। প্রয়োজনে আমি ব্যবস্থা করে দেব।
নিরাপত্তা খুব জরুরি। বস্তিতে বাস করার নিরাপত্তা। স্কুলে যাওয়ার নিরাপত্তা। খেলাধুলার নিরাপত্তা। বাবা-মা কাজে গেলে শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকে। এটি একটি বড় সমস্যা। সে ক্ষেত্রে কী করতে হবে? আমরা ঢাকা শহরের বস্তিবাসী মানুষদের নিয়ে সমিতি করেছি। সমিতির লোকজন সবাইকে নিরাপত্তা দেবে। এখানে শিশুকেন্দ্র থাকবে। শিশুরা এখানে নিরাপদে থাকবে। তোমাদের জন্য শিশু একাডেমি আছে। তোমরা সেখানে যাও? কী করতে যাও? অনুষ্ঠান দেখতে যাও। অনুষ্ঠান করতে যাও। দেশে যদি অনেক শিশু একাডেমি থাকত, তাহলে ভালো হতো। এগুলো কে করে দেয়? সরকার। বেসরকারি উদ্যোক্তারাও তোমাদের কল্যাণে এগিয়ে আসেন। তাঁরা স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল করে দেন। এনজিওরা তোমাদের কল্যাণে কাজ করে। এখন তোমাদের এগুলো থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হতে হবে।
যাঁরা টেলিভিশনে টক শো করেন, যাঁরা সাংবাদিকতা করেন, তাঁরা সরকার ও সমাজকে সচেতন করে তোলেন। আমি জানি না বস্তি নিয়ে তাঁরা কখনো আলোচনা করেছেন কি না। আমি বস্তি নিয়ে ৪০ বছর ধরে কাজ করছি। বস্তি নিয়ে আলোচনার জন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বেশি ডাকেনি। দু-একবার ভুলেও ডাকতে পারে। তবে শিশুদের নিয়ে মাঝেমধ্যে আলোচনা হয়। গণমাধ্যমের বড় রকমের দায়িত্ব আছে। যেটা আজ প্রথম আলো তোমাদের জন্য করেছে। প্রতিটি খবরের কাগজ, টেলিভিশন যদি করত, তাহলে সমস্যা অনেক কম হতো। আমাকে এবার বলো কচিকাঁচার মেলার কে সদস্য? খেলাঘরের সদস্য কে? কেউ না। বয়েজ স্কাউট কে কে করো? নানক ভাই করেছেন। আমি করেছি। বয়েজ স্কাউট করলে দেশের বাইরে যাওয়া যায়।
ঝাড়ু দেওয়া থেকে শুরু করে মন্ত্রিত্ব—সব কাজই কাজ। সব কাজকে সম্মান করতে হবে। পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই শিশুদের সহযোগিতা করে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে দেখো না, কোনো একটি শিশু তাঁর কাছে গেলে তাঁকে কোলে তুলে নেন। বিশেষ বিশেষ দিনে শিশুদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন, সময় কাটান। এগুলো হচ্ছে শিশুদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার নিদর্শন। আমরা যখন শিশু ছিলাম, তখন তোমাদের থেকে অনেক বেশি সমস্যা ছিল। তোমরা আজ যে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললে, আমাদের সময় এটি কল্পনাও করতে পারতাম না। এ দিনটি নিশ্চয়ই তোমাদের সারা জীবন স্মরণ থাকবে। এ জন্য তোমরা কাকে ধন্যবাদ দেবে? না, আমাদের দিতে হবে না। ধন্যবাদ দিতে হবে প্রথম আলো ও ইউনিসেফকে, যারা তোমাদের জন্য এই আয়োজন করেছে।
সবশেষে বলি, তোমাদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তোমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাও। নিজে কী হতে চাও স্বপ্ন দেখো। কোনো বাধাই তোমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তোমাদের জন্য কী করতে হবে, সেটা সংবিধানে বলা আছে। শিশুদের জন্য শিশু আইন আছে। শিশুনীতি আছে। সেখানে সরকার প্রতিজ্ঞা করেছে তোমাদের জন্য কী কী করতে হবে। আজকের আলোচনার বিষয় হলো নগরশিশু। নগরশিশুর জন্য জাতীয় নগর নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। এ নীতিতে পরিষ্কার লেখা আছে, সরকার শিশুদের জন্য কী করবে। তাদের লেখাপড়া, স্বাস্থ্য রক্ষা, খেলাধুলা, বিনোদন ইত্যাদি বিষয় সরকার শিশুদের জন্য নিশ্চিত করবে। ঢাকা শহরসহ সব শহরের শিশুদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পার্ক, খেলার মাঠ, বিনোদনকেন্দ্র, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল কোথায় কী হবে, নগর পরিকল্পনার মধ্যে সব বলে দিতে হবে। তা না হলে গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি হবে, কিন্তু পরিকল্পিত নগর হবে না। মাঝেমধ্যে বস্তি উঠিয়ে দিতে দেখি। বস্তি ওঠানোর ব্যাপারে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। দু-চারজন দুষ্ট মানুষের জন্য বস্তি ভেঙে দিলে ওই রাতেই শিশু, বৃদ্ধ, নারীসহ শত শত মানুষকে অসহায় হয়ে পড়তে হয়। পুনর্বাসন ছাড়া কোনো বস্তি ওঠানো যাবে না। প্রত্যেক মানুষকে আশ্রয়ের নিশ্চয়তা সরকারকে দিতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
নজরুল ইসলাম শিশুদের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন এলাকার শিশুরা এখানে উপস্থিত আছে। তারা তাদের অসুবিধাগুলো খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। সরকারের শিশুনীতিমালায় আরও সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, বিশেষ করে চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, জাতীয় জাদুঘরসহ দর্শনীয় জায়গাগুলো আরও বেশি করে দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল, বাসা, বাইরে কোথাও যেন শিশুরা নির্যাতনের শিকার না হয়, সে ব্যাপারে রাষ্ট্র তাদের সাহায্য করবে। এখন সব বিষয় মিলিয়ে এখন বলবেন মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক।
জাহাঙ্গীর কবির নানক
আমি আগেই বলেছি, এটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। এখানে হয়তো কয়েকজন শিশু উপস্থিত হয়েছে। মনে করছি এরা গোটা বাংলাদেশের শিশুদের প্রতিনিধি। শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সব শিশুর সুন্দর ভবিষ্যতের কথা আমাদের ভাবতে হবে। আমরা সে লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছি। জানি, একজন মানুষের জন্মগত কিছু অধিকার থাকে। এর মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, পুষ্টি, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা বিনোদন ইত্যাদি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কেন যুদ্ধ করেছিলাম? এই মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তার জন্যই যুদ্ধটি করেছিলাম।
আমাদের উদ্দেশ্য গুলশান, বানানীর শিশুটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার যে সুযোগ পাবে, বস্তিতে জন্ম নেওয়া ওই শিশুটিও একই সুযোগ পাবে। আমরা চাই না বস্তির শিশুটি টোকাই পরিচয়ে বড় হোক। বিভিন্ন সমস্যার কারণে আমাদের দেশ যে গতিতে এগোনোর কথা ছিল, সেভাবে এগোতে পারিনি। আমাদের সংবিধানে শিশুদের যে অধিকার দেওয়া আছে, সেটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে হবে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও বস্তিতে অবস্থানরত শিশু—এদের মধ্যে পরিবেশগত, সামাজিক ও মানসিক পার্থক্য রয়েছে। সরকার সব শ্রেণীর শিশুদের কথা ভাবছে।
২০১১ সালের শিক্ষানীতিতে প্রতিবন্ধী শিশু এবং সাধারণ শিশু এদের জন্য আলাদা শিক্ষানীতি রয়েছে। শিশুদের জন্য আমাদের সবার সচেতন হতে হবে। সবাইকে অবদান রাখতে হবে, বিশেষ করে গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুরা যখন রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। আমরা কি আমাদের গাড়িটি থামাই? তাদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার কথা ভাবি? কিন্তু এ ধরনের কাজের ঐতিহ্য অনেক দেশের মানুষের আছে। মানুষের মধ্যে এখন মূল্যবোধের অনেক অভাব দেখা যায়। আমরা ১৭ মার্চ জাতীয় শিশুদিবস পালন করি। এই দিনটি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনও। কেন করি, শিশুদের প্রতি মানুষের বিবেক জাগ্রত করার জন্য। শিশুদের প্রতি আরও দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে শিশুরাও যাতে মানসিকভাবে বিকশিত হতে পারে সে জন্য।
আমি মানুষকে সবচেয়ে বেশি সম্মান করি। মানুষের ব্যাপারে সব সময় সতর্ক থাকি। আজ তোমাদের মাঝে আসতে ভয় পেয়েছি। কারণ তোমরা কী প্রশ্ন করবা, কী বলবা ইত্যাদি। সরকার তোমাদের জন্য কী করতে চায়, কী করছে, কী ভাবছে—এসব বিষয়ে আমি এখানে আসার আগে তথ্য সংগ্রহ করেছি। নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ড. শিরীন শারমিনের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তিনিও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
আগে যদি জানতাম যে তোমরা এ ধরনের প্রশ্ন করবা, তাহলে আরও লোকজন সঙ্গে নিয়ে আসতাম। আমি এই ভুলটা করেছি। তোমাদের প্রশ্ন শুনে মনে হয়েছে, সচিব, পাবলিক হেলথের চিফ ইঞ্জিনিয়ার, ডিসি ও অন্যদের আনা উচিত ছিল। বস্তিতে টয়লেট নেই, টিউবওয়েল নেই, জিজ্ঞেস করতাম এগুলো কত দিনের মধ্যে করে দেবেন। ডিসি সাহেবকে বলতাম, এই যে মাঠ দখল করে আছে, খালি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আমার নির্বাচনী এলাকায় ‘জনতার আদালতে সাংসদ জাহাঙ্গীর কবির নানক’ নামে একটি অনুষ্ঠান করি। সেখানে তিতাস গ্যাসের প্রতিনিধি, ওয়াসার প্রতিনিধি, পুলিশের প্রতিনিধি সবাই থাকে। চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে এলাকার মানুষের কথা শুনি। আমিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজন সবাই মিলে উত্তর দিই। তোমাদের বিষয়টি বুঝতে পারলে এই লোকগুলো নিয়ে আসতাম। তাতে আরও বেশি সুবিধা হতো। তাঁরা তোমাদের সমস্যার বিষয়টি দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিতেন।
তবে সোনামণিরা, তোমরা আমার চেতনার জায়গাটি খুলে দিয়েছ। একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি এ জায়গায় বসে। অভিভূত হয়েছি তোমাদের প্রতিভায়। ঢাকা শহরে অনেক শিশু আছে, যারা রোদ-বৃষ্টি লাগাতে পারে না। বাইরে বেরোতে পারে না। বেরোলেই হাঁচি-কাশিসহ নানাবিধ সমস্যা হয়। তোমরা হয়েছ ঠিক আমাদের মতো। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, অর্থাৎ আমরা যারা গ্রাম থেকে এসেছি, সবাই তোমাদের মতো। তোমরা আর আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। রোদ-বৃষ্টির মধ্যে খেলেছি। কাদামাটির মধ্যে বড় হয়েছি। তোমাদের যে ভাবনা, তোমাদের যে কথা শুনলাম, নিশ্চিত যে আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছি।
সিলভিয়ার কথা শুনলাম। বস্তিতে থেকেও সে টেলিভিশনে সংবাদ পড়ে। নাদিম হোসেন লালবাগ থেকে মিরপুর যায় ক্রিকেট খেলতে। আসলামসহ সবাই তোমরা কত চটপট কথা বলছ, প্রশ্ন করছ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে কেউ যুক্ত হতে পারছি, কেউ পারছি না। তোমরা এই সমৃদ্ধির সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছ। এনজিওগুলো তোমাদের জন্য কাজ করছে।
সরকারের অনেক কর্মসূচি রয়েছে। যেমন, লালবাগ এলাকায় ৫০০ শিশুকে এক হাজার ৫০০ টাকা করে ভাতা প্রদান করছি। এই প্রকল্পকে দেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে সরকারের। দেশে আট হাজার কেন্দ্র থেকে শিশুদের টাকা দেওয়া হবে। মেট্রোপলিটন এরিয়ায় এনজিওদের সহযোগিতায় ৫৫ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরাতে পেরেছি। শিশুদের চিত্তবিনোদন, খেলাধুলা সংস্কৃতিচর্চা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। সরকার শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, বিশুদ্ধ পানিসহ নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছে। এর সঙ্গে রয়েছে পয়োনিষ্কাশন। আগে স্কুল-কলেজগুলোতে ছেলেমেয়েদের আলাদা টয়লেট ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, ছেলেমেয়েদের আলাদা টয়লেট করতে হবে। এখন যেখানেই স্কুল-কলেজ হচ্ছে, সেখানেই ছেলেমেয়েদের আলাদা টয়লেট হচ্ছে।
এই সরকারের সময় শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তন হয়েছে তোমারা জানো। এখন তোমাদের দুটি পরীক্ষা দিতে হয়। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে। শিক্ষাব্যবস্থায় এটা একটা বিপ্লব। এর জন্য ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের দেশে অনেক সমস্যা আছে। কখনো হতাশ হওয়া চলবে না। এর মধ্যেই তোমাদের সামনের দিকে যেতে হবে। একটা বিশ্বাস সব সময় রাখবা যে মানুষের কোনো পরাজয় নেই। মানুষ তার স্বপ্নের মতোই বড় হতে পারে। একজন মানুষ বড় হওয়ার জন্য যা কিছু দরকার তার সব গুণ তোমাদের মধ্যে আছে। আমরা যা পারিনি, তোমরা তা পারবে; তোমাদের প্রতি এ বিশ্বাস আমার হয়েছে।
আমরা একাত্তরে যুদ্ধ করেছি। বেঁচে থাকার কথা ছিল না। একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম। সেই বাংলাদেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমরা যেখানে শেষ করব, তোমরা সেখান থেকে শুরু করবে। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ, ব্যবসায়ী, সমাজসেবক, যাঁকে পাবা তাকেই বলবা, তোমাদের জায়গা করে দিতে। সুযোগ করে দিতে। সেই কবে সুনির্মল বসু বলেছিলেন, ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র।’ সত্যিই তাই, শেখার কোনো শেষ নেই। সব জায়গা থেকে শেখা যায়।
আজ তোমাদের মধ্যে এসে অনেক শিখেছি। অনেক জেনেছি। তোমরা অনেক প্রশ্ন আমার কাছে করেছ। আমি শুধু একটি কথা বলব, ধাপে ধাপে সবই তোমাদের জন্য করব। আমরা তার প্রমাণ রাখছি। কোটি কোটি বিভিন্ন কালারের নতুন বই বছরের শুরুতে পাচ্ছ। পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো দেশ দেখাতে পারবে না, যারা এত বই বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে দিতে পারে। অনেকেই সমালোচনা করেছিল যে আমরা পারব না। সব সমালোচনার জবাব দিয়ে আমরা পেরেছি। আমরা এগোচ্ছি। তাই অসম্ভবকে সম্ভব করে মাত্র নয় মাসে এ দেশকে স্বাধীন করেছিলাম। অসম্ভবকে সম্ভব করে এক লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র জয় করেছি। আমরা সেই বাঙালি, যারা হিমালয় জয় করেছি। ক্রিকেট খেলায় কোথায় ছিলাম, আজ কোথায় এসেছি। আমরা এই বাংলাদেশের মানুষই তো সব পেরেছি। এই মানুষের মধ্যে আছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ। এঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি কোনো হতাশাবাদী মানুষ না। তোমাদের কথায় বুঝেছি তোমরাও হতাশ না।
তোমরা যে সমস্যাগুলো বলেছ, সব লিখে নিয়েছি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। অন্য যেসব মন্ত্রণালয়ের কাজ আছে তাদের জানাব। তোমরা যারা আজ এখানে এসেছ, তোমাদের অনুরোধ করব, আমার মোহাম্মদপুর এলাকায় আসতে। তোমাদের দেখাব সব জায়গায় না পারলেও কিছু বস্তিতে কাজ করেছি। ইটের রাস্তা করেছি। টিউবওয়েল বসিয়েছি। পাকা টয়লেট করে দিয়েছি। আবার মাঝেমধ্যে কষ্টও পেয়েছি। যেমন, জেনেভা ক্যাম্পে ২৭টি টয়লেট করে দিয়েছি, টিউবওয়েল বসিয়েছি। দুই সপ্তাহ পরে গিয়ে দেখেছি তারা এগুলো ঠিক রাখেনি, নষ্ট করে ফেলেছে। করেও দিতে হবে, আবার রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে। বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা কোনো জিনিস রক্ষা করার চেষ্টা করি না। গাছটা না বাঁচিয়ে ফলটা খেতে চাই।
শহরের বিভিন্ন এলাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র করার পরিকল্পনা রয়েছে। গ্রামে প্রতি আট হাজার মানুষের জন্য আমরা কমিউনিটি ক্লিনিক করেছি। এর ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। বছরের শুরুতে কোটি কোটি বই প্রাপ্তি যেমন বিশ্বে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে আছে, তেমনি কমিউনিটি ক্লিনিকও বিশ্বে একটি নতুন দৃষ্টান্ত। সরকার এমন কিছু কাজ করেছে, যা বিশ্বের জন্য উদাহরণ। প্রধানমন্ত্রী বিজিএমইএর নেতাদের বলেছেন পোশাকশিল্পকে গ্রামে নিয়ে যেতে। তার জন্য যত ভর্তুকি লাগে তিনি দেবেন। সরকারের দিক থেকে যা যা করা সম্ভব, সবই করা হবে। তোমাদের জীবনযাত্রা যেন নির্বিঘ্ন হয়, সে লক্ষ্যে কাজ করছি।
আব্দুল কাইয়ুম
সবাইকে ধন্যবাদ। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হলে অনেক সমস্যারই সমাধান সম্ভব বলে মনে করি। সরকার ও কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই এদিকে মনোযোগ দেবে।
No comments