এসএসসি ’১২ অদম্য মেধাবী-ভাঙা ঘরে সোনার আলো

‘বাবা অসুস্থ। মা ঝিয়ের কাজ করেন। প্রায়ই উপোস দিতে হয়। তাই অন্যের জমিতে শ্রম দিয়ে সংসার চালাই। বাংলা পরীক্ষার দিনও শুধু আলু সেদ্ধ খেয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছি।’ বলতে বলতে দু-চোখ ভিজে যায় মেনহাজুলের।রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার পোদ্দারপাড়া গ্রামের মেনহাজুল ইসলাম এবার এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পাওয়ার সাফল্য দেখিয়েছে।


শুধু মেনহাজুল নয়, ভবিষ্যতে পড়ার খরচ জোগাতে ইটভাটায় কাজ করা সাতক্ষীরার শাহিন আলম, চরকায় সুতা কেটে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সিরাজগঞ্জের আমেনা খাতুন ও কেরোসিন তেলের অভাবে রাতে পড়তে না পারা নাটোরের সুবর্ণা খাতুন, চা-শ্রমিক মায়ের সন্তান শিমন কেরকেটা ও দিনমজুর পরিবারের কমল চন্দ্র রায় একই রকম কৃতিত্ব দেখিয়েছে। কোনো কিছু দমাতে পারেনি তাদের। এরাই অদম্য মেধাবী।
প্রসঙ্গত, হতদরিদ্র পরিবার থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া মেধাবীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত ৫০ জনকে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল থেকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হবে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারী, প্রতিবন্ধী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়।
মেনহাজুল: পরীক্ষার ফল জানতে সহপাঠীরা যখন বিদ্যালয়ে ছুটছে, পাস করে আনন্দ করছে, তখন অন্যের জমিতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছিল মেনহাজুল। ফল প্রকাশের দিন রাতের বেলায় জানতে পারে, সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। কিন্তু আনন্দ করা তো ভাগ্যে নেই! তাই পরদিনও অন্যের জমিতে ধানকাটার কাজ করতে যায় মেনহাজুল।
অন্যের জমিতে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর তুলে কোনো রকমে মাথা গুঁজে থাকে মেনহাজুলের পরিবার। বাবা কাওছার আলী রোগে ভুগছেন। মা মর্জিনা বেগম ঝিয়ের কাজ করেন। তাই সংসার চালাতে দিনমজুরি শুরু করে মেনহাজুল।
কাওছার আলী বলেন, ‘নিজে খাবার পাই না, ছাওয়ালটাক ফির কেমন করি লেখাপড়া শিখাই কন?’
শাহিন: ফল প্রকাশের দিন তপ্ত রোদে ভাটায় বসে ইট তৈরির কাজ করছিল শাহিন। ঘাম ঝরছিল দর দর করে। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির জন্য টাকা জোগাতে ইটভাটায় কাজে যোগ দেয় সে। কাজ করার সময় খবর পায়, সে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা সদরের সোয়ালিয়া গ্রামের ভ্যানচালক জিয়াদ আলীর ছেলে শাহিন। ফল প্রকাশের দিন জিয়াদ ভ্যান নিয়ে শ্যামনগরের উপজেলা গোডাউন মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন যাত্রীর অপেক্ষায়। প্রতিবেশী কলেজশিক্ষক নন্দ দুলাল বিশ্বাস তাঁকে জানান ছেলের সাফল্যের খবর।
‘সারা জীবন অন্যের বাচ্চাগো স্কুলি পৌঁছে দে আইছি, কিন্তু আমার ছাওয়ালডারে এক দিনের জন্যিও ভ্যানে করে স্কুলি নে যাইনি। ওর জন্যি কিছু করতি পারিনি আমি, কিন্তু বড় একটা পাস দে আমাগো বুকডা ভরিয়ে দেছে’—ছেলের সাফল্যের কথা জানতে চাইলে এভাবেই বলছিলেন আবেগাপ্লুত জিয়াদ। জানালেন, শ্রমিকের কাজ করে পড়ার খরচ জুগিয়েছে শাহিন। কেরোসিনের অভাবে রাতে পড়া হতো না। পরীক্ষার দুই মাস আগে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুস সাত্তার হারিকেন আর তিন লিটার কেরোসিন তেল কিনে দেন। তা দিয়ে রাত জেগে পড়েছে শাহিন।
শ্যামনগরের জোবেদা সোহরাব মডেল একাডেমি থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে শাহিন। চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে চায় সে। তার শিক্ষক আবদুস সাত্তার বলেন, একটু সহায়তা পেলে শাহিন অনেক দূর যেতে পারবে।
আমেনা: আমেনা খাতুন বাবা-মায়ের সঙ্গে চরকায় সুতা কাটাত। তিন-তিনবার যমুনার গ্রাসে বাড়ি ভেঙে যাওয়ায় পরিবারকে সহায়তা ও নিজের পড়ার খরচ চালাতে আর কোনো উপায়ও ছিল না তার। আমেনার পরিবার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার হাট কৈজুরী গ্রামে সরকারি খাসজমিতে কোনোমতে একটি ঘর তুলে বাস করছে। ছয় সদস্যের পরিবারে নিয়মিত দুবেলা দুমুঠো খাবারও জুটত না। এসব প্রতিকূলতা পেরিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।
আমেনার বাবা বাবু শেখ আবেগাপ্লুত হয়ে জানান, লেখাপড়ার ন্যূনতম সুবিধা তিনি দিতে পারেননি। সে এত ভালো ফল করবে, তা কারও জানা ছিল না। এখন চিন্তা করছেন, সামনের পড়াশোনার খরচ কীভাবে চলবে। কথা হয় আমেনার সঙ্গেও। ‘বেশির ভাগ সময়ই চরকায় সুতার কাজ করতে হয়েছে। সাপ্তাহিক চার শত টাকা করে মজুরি পেতাম। প্রতিদিন বিদ্যালয়েও যেতে পারিনি। বান্ধবীদের কাছ থেকে পড়া জেনে নিতাম। স্যাররাই আমার ফরম পূরণের টাকা দেন।’ কথাগুলো বলে যায় আমেনা। তার কৈজুরী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল খালেক জানান, ‘আমরা আমেনাকে সহায়তা দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আশা করি, সে ভবিষ্যতেও ভালো করবে।’
সুবর্ণা: নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী সরকারি গুচ্ছগ্রামের মেয়ে সুবর্ণা খাতুন। বাবা কালাম শেখ শয্যাশায়ী বলে মা সানোয়ারা বেগমকে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতে হয়। মেয়ের সাফল্যে খুশি মা সানোয়ারা বেগম। তবে ভবিষ্যতের খরচের কথা ভেবে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন।
বাবা কালাম শেখ বলেন, ‘আমার সেবা-যত্ন আর সংসারের কাজকাম লিয়া হিমশিম খায়। ছোট বোনকে পড়ায়। তবে মেয়ে আমার কখনো স্কুল কামাই দেয়নি।’ ছাতনী উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। তার বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইন্তাজ আলী জানান, তাঁদের বিশ্বাস ছিল, সুবর্ণা ভালো ফল করবেই।
‘পড়ালেখা করেই ভাগ্যের পরিবর্তন করতে হবে—কথাটা সব সময়ই মাথায় রেখেছি। আমি বিশ্বাস করি, অভাব-অনটন পড়াশোনাকে দমাতে পারে না।’ বলে সুবর্ণা। সুবর্ণার ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া।
শিমন: শিমন কেরকেটা। সিলেটের শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। শিমনের মা জুসপিনা নানোয়ার বিদ্যাবিল চা-বাগানে শ্রমিকের কাজ করেন। থাকেন একই কোম্পানির বর্মাছড়া চা-বাগানে। কোম্পানির জমিতে বসবাসের জন্য একটি ঘর আছে। সেখানে কাজ না থাকলে শিমনদের মাথা গোঁজারও ঠাঁই হয়তো থাকত না। বাবা ২০০৭ সালে মারা গেছেন। ছোট এক প্রতিবন্ধী ভাই আর মাকে নিয়ে শিমনের পরিবার।
ছেলের সাফল্যে গর্বিত হলেও কলেজে ভর্তি আর পড়ার খরচের কথা ভেবে দুশ্চিন্তার কথা জানালেন জুসপিনা। ৪৮ টাকা হাজিরা (মজুরি) পান। প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ ২২ টাকা কাটার পর সপ্তাহে ২৬৬ টাকা হাতে থাকে। এই টাকা দিয়ে খাবেন, না পড়াবেন। তাঁর ছোট ছেলেটা প্রতিবন্ধী। বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে তাঁর।
শিমন ভালো ফলের পেছনে মা, মামাতো ভাই পিউস, তার বিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ অনেকেরই অবদানের কথা জানায়।
কমল: বড় ভাই কমলের জিপিএ-৫ পাওয়ার খুশিতে ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র মিলন রায় বাজার থেকে আধা কেজি খুরমা বাকিতে এনে প্রতিবেশীদের মিষ্টিমুখ করায়। ‘বাবা দিনমজুরি করতে বগুড়ায় গেছেন। বড় ভাই নিরঞ্জন রায়ও কাজের খোঁজে গেছেন কুমিল্লা। মায়ের কাছে টাকা নেই। তাই বাকিতে খুরমা এনেছি। বাবা এলে টাকা পরিশোধ করা হবে।’ জানাল মিলন।
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার দিনমজুর নরেশ চন্দ্র রায়ের মেজো ছেলে কমল। মা শোভা রানীর খুশি চাপা পড়েছে ভবিষ্যতে পড়ার খরচের চিন্তায়। ‘হামরা গরিব মানুষ। ছাওয়াক ঠিকমতো খাবার দিবার পারি না। এলা পড়ার ট্যাকা কে দিবে।’
হাসি নেই কমলের মুখেও, ‘বাবা আর ভাইয়ের ঘাম-ঝরানো পরিশ্রমে কোনো রকমে সংসার চালানোই দায়। তাঁরা আমার পড়ার খরচ কেমন করে দেবেন?’ কমলের ইচ্ছা, ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তি হওয়া।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন: এনামুল হক, সিরাজগঞ্জ; কল্যাণ ব্যানার্জি, সাতক্ষীরা; রহিদুল মিয়া, তারাগঞ্জ (রংপুর); মুক্তার হোসেন, নাটোর; বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) ও মীর মাহমুদুল হাসান, নীলফামারী)

No comments

Powered by Blogger.