বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৭৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আহমেদ হোসেন, বীর প্রতীক দক্ষ ও সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী দুপুরে একযোগে আক্রমণ চালাল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি বড় দলের নেতৃত্বে আহমেদ হোসেন।


তাঁরা বেশির ভাগ ইপিআর সদস্য। চারদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি—মেশিনগানের অবিরাম গুলি, ট্যাংকের ঘড় ঘড় শব্দ, কামান-মর্টারের গোলাবর্ষণ। মহা এক ধ্বংসযজ্ঞ।
ডানে-বাঁয়ে প্রায় আধা মাইলের বেশি এলাকাজুড়ে চলছে যুদ্ধ। আহমেদ হোসেনের ওপর দায়িত্ব তাঁদের মূল আক্রমণকারী দলকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ থেকে রক্ষা করার। এ ছাড়া পাকিস্তানি সেনারা এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়লে বা পেছন দিয়ে প্রতি আক্রমণের চেষ্টা চালালে তাদের আটকাতে হবে। তা না হলে যুদ্ধে বিজয় কষ্টকর হয়ে পড়বে। এ দায়িত্বটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
আহমেদ হোসেন সহযোদ্ধাদের নিয়ে সেই দায়িত্বটা যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে থাকলেন। পাকিস্তানি সেনাদের বেশ কয়েকটি প্রতি আক্রমণ সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করলেন। তাঁর ও সহযোদ্ধাদের বীরত্বে ব্যর্থ হয়ে গেল পাকিস্তানিদের সব প্রচেষ্টা।
বিকেলের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সকল প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল। পিছিয়ে যেতে থাকে তারা। মিত্রবাহিনীর ট্যাংকগুলো ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে। দখল হয়ে গেল শত্রুর একটি বড় ঘাঁটি। এ ঘটনা ময়দানদিঘিতে। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর।
ময়দানদিঘি পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার অন্তর্গত। বোদা-পঞ্চগড় সড়কের পাশে এর অবস্থান। পঞ্চগড় দখল করার পর মুক্তিযোদ্ধারা ময়দানদিঘি আক্রমণ করেন। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দুর্ভেদ্য বাংকার ও প্রতিরক্ষা তৈরি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল।
ময়দানদিঘি আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিত্রবাহিনীও যোগ দেয়। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ছিল কয়েকটি ট্যাংক। মুক্তিযোদ্ধাদের মূল শক্তি ছিলেন ইপিআর সদস্যরা। তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন ৭০-৭৫ জন। আর ছিলেন স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। সব মিলে সংখ্যা ২০০। তাঁরা কয়েকটি দলে বিভক্ত ছিলেন। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন আহমেদ হোসেন।
আহমেদ হোসেন চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন ঠাকুরগাঁও ইপিআর উইংয়ে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন ৬ নম্বর সেক্টরের ভজনপুর সাব-সেক্টরে। রানীর বন্দর, চাম্পাতলী, খানসামা, পঞ্চগড়, নুনিয়াপাড়াসহ আরও কয়েক স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ২৮ জুলাই নুনিয়াপাড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে তিনি আহত হন। সুস্থ হয়ে পুনরায় যুদ্ধে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আহমেদ হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৭৫।
আহমেদ হোসেনের পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার কুসুমপাড়া গ্রামে। তবে তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাস করতেন ঠাকুরগাঁওয়ে। তাঁর বাবার নাম আছাদ আলী মাস্টার, মা জমিলা খাতুন। স্ত্রী মতিয়া খানম। তাঁদের পাঁচ ছেলে দুই মেয়ে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৬ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.