আন্তপরিবহনের সমতাভিত্তিক উন্নয়ন বিধান by এ এম এম শওকত আলী
আন্তপরিবহন মাধ্যম বা ইন্টারমোডাল ট্রান্সপোর্ট (Intermodal Transport) ব্যবস্থার অসম উন্নয়নের ফলে দেশের জনগোষ্ঠীর ভোগান্তির শেষ নেই। পরিবহন ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের নীতি সব সময়ই অসম উন্নয়নের দোষে দুষ্ট ছিল। বিশেষ করে আশির দশকে শুরু নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। এর ফলে সড়ক ও জনপথ ক্ষেত্রেই উন্নতি হয়েছে সর্বাধিক। সার্বিক পরিবহন ব্যবস্থার কোনো প্রেক্ষিত পরিকল্পনার কথা শোনা যায়নি।
এ ধরনের পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ ১৯৮০ সালে বিভিন্ন ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য যথা_খাদ্য ও সার পরিবহনের পরিমাণ ও গুরুত্ব বর্তমানে অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে যোগ করা যায় আমদানি ও রপ্তানিতব্য পণ্যাদি। সাধারণ যাত্রীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এসব ক্ষেত্র বিবেচনা ও সুপারিশ করার জন্য ১৯৮৫ সালে পরিকল্পনা কমিশন কাজ শুরু করে। এ সময়ে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত খাদ্য ও সারের চাহিদার পরিমাণ এবং পরিবহনের জন্য আন্তপরিবহন মাধ্যমের ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয় নির্ণয়-সংক্রান্ত কৃষি মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বাধীন গঠিত কমিটিতে সংশ্লিষ্ট অন্যদের মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের একজন যুগ্ম প্রধানকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ কমিটি যথাসময়ে প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করে। পরিকল্পনা কমিশনের সমীক্ষার বিষয়ে এই প্রতিবেদনে আন্তপরিবহন মাধ্যমকে প্রক্ষেপিত চাহিদা অনুযায়ী সমতাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি গুরুত্ব আরোপ করে। পর্যালোচনার সময় কয়েকটি বিষয় প্রতিভাত হয়। আন্তপরিবহন মাধ্যমের ক্ষেত্রগুলো মূলত ছিল সড়ক ও জনপথ, রেলপথ এবং নৌপথ। দেখা যায়, মালামাল ও যাত্রী পরিবহনের জন্য নৌপথেই সবচেয়ে কম মূল্য দিতে হয়। এর পর রেলপথ। সর্বাধিক মূল্য সড়কপথে। সুতরাং কৌশল হিসেবে নৌপথের পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধিই হবে যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এর জন্য প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো শীতের মৌসুমে নাব্যের অভাব।
রেলপথের বিষয়েও বেশ প্রতিবন্ধকতা ছিল। প্রধান বাধা ছিল রেলের ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে। রেলপথ পরিচালনার বিষয়েও একাধিকবার কাঠামোগত সংস্কারের অজুহাতে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৭১ পূর্ববর্তী সময়ে শীর্ষ পরিচালনা সংস্থা ছিল রেলওয়ে বোর্ড। এ ধারা ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে অক্ষুণ্ন রাখা হয়। ওই সময় রেলওয়ের বাজেটও ছিল সার্বিক বাজেট থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এ কারণে এ সংস্থাটির রেলওয়ে পরিচালনার বিষয়ে স্বাধীনতা ও ক্ষমতাও ছিল। এ স্বাধীনতা ও ক্ষমতার ওপর পরবর্তী পর্যায়ে দুটি বড় ধরনের আঘাত আসে। এক. পৃথক রেলওয়ে বাজেটকে সার্বিক বাজেটের সঙ্গে একীভূত করা হয়। দুই. রেলওয়ে বোর্ডকে বিলুপ্ত করা হয়। এর পরিবর্তে রেলওয়ে প্রশাসনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ কাঠামো এখন বিদ্যমান।
রেলপথসহ এর প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্য একটি প্রধান বাধা ছিল নীতি-সম্পর্কিত। রেলওয়েও বাণিজ্যিক সংস্থা হিসেবে পরিচালিত হবে না, সেবামূলক সংস্থা হিসেবে। এর সঙ্গে যোগ হয় রেলওয়ের বেসরকারিকরণের যুক্তি। এ যুক্তি জোরালোভাবে বিদেশি সাহায্য সংস্থারাই সরকারকে অনুসরণ করতে বলে। একই সঙ্গে রেলওয়ের জন্য বিদেশি সাহায্যও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। এরই ধারাবাহিকতায় দক্ষতা ও যাত্রীবান্ধব সেবা দেওয়ার ক্ষমতা ও মান হ্রাস পায়। এ নিয়ে সরকারের কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ বা উদ্বেগ নেই। একসময় রেলওয়ের পরিবহন ক্ষমতা ও যাত্রীবান্ধব সেবার মানের বিষয়টি ছিল সর্বজনবিদিত। বর্তমানে অবস্থা শোচনীয়। ক্ষমতা ও সেবার মান বিধ্বস্ত ও পর্যুদস্ত। একটি বাস্তব উদাহরণ এ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক হবে।
জুলাই ৩০, ২০১১ ময়মনসিংহে নগর স্বাস্থ্যসেবা কৌশল-সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায় উপস্থিত ও অংশগ্রহণ করার জন্য দুজন সাবেক সচিবকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ময়মনসিংহে যেতে হবে। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের অবর্ণনীয় অবস্থার বিষয় অবহিত হয়ে সচিবদ্বয় রেলপথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দুজনই চাকরিরত অবস্থায় রেলওয়েতে আগে কাজ করেছেন। একজন বহু আগে ১৯৭২ সালে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে উপসচিব ছিলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল রেলপথ। অন্যজন ছিলেন রেলওয়ে বিভাগের সচিব, ৯০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। তিস্তা এঙ্প্রেস কমলাপুর থেকে যাত্রা করবে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে। ময়মনসিংহে পেঁৗছার সময় সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট। এ দুই সচিবের সহযাত্রী একজন অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিবও ছিলেন। তিস্তা এঙ্প্রেস ছাড়ল দুই ঘণ্টা দেরিতে। গন্তব্যে পেঁৗছাল রাত ১২টার একটু আগে। প্রথম শ্রেণীর যাত্রীপ্রতি ভাড়া ছিল মাত্র ১১০ টাকা। শুধু যাত্রীবান্ধবই নয়, দরিদ্র যাত্রীবান্ধবও বটে। যাত্রীর ভিড়ও ছিল যথেষ্ট। ৩১ জুলাই ঢাকায় ফেরার কথা। পথে এক সহযাত্রী যিনি এ পথে প্রায়ই আসা-যাওয়া করেন, তাঁর কাছে শোনা গেল যে ট্রেনে ফেরার কথা সেটা প্রায় সময়ই দেরি করে আসে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা এখনো যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছে জানা গেল মূল সমস্যা ইঞ্জিন ও কোচের দারুণ অভাব। প্রথম শ্রেণীতে বসার ঠাঁই নেই। ট্রেনে ওঠার পরই দেখা গেল অসহ্য গরম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। গরম হওয়ার কারণ পাখা চালানোর ব্যবস্থা চালু করতে সময় লাগবে।
এ কারণে সড়কপথেই ফিরতে হয়েছিল অনেক কষ্টে। সড়কে গাড়িতে চলা ছিল কঠিন। সড়কপথে ভাড়া করা মাইক্রোবাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। এ পাঁচ হাজারের বিপরীতে ৫০০ টাকাও কি প্রথম শ্রেণীর জন্য নির্ধারণ করা যায় না। অন্তত ৩০০ টাকা, যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করা হবে। সহনশীলভাবে ভাড়া বাড়ালে রেলওয়েরও কিছু আয় বৃদ্ধি হতো। তবে এখানেও কিন্তু আছে। তা হলো_সার্বিক বাজেটের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পর রেলওয়ের রাজস্বও মূল বাজেটের সঙ্গে একীভূত হবে। সরকারের এখন উচিত হবে রেলওয়ের অর্থায়ন ও উন্নতির জন্য একটি যুক্তিযুক্ত কৌশল নির্ধারণ করা। যদি একে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালাতে হয়, তাহলে বাণিজ্যিক কৌশলই অবলম্বন করতে হবে। আর যদি নিছক সেবা প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে চালাতে হয়, তাহলে সরকারকেই সব খরচ বহন করতে হবে।
সড়কপথ উন্নয়নের জন্য আশির দশক থেকেই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। মূলত দুটি সংস্থা এ সড়ক ও জনপথ উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করে থাকে। এক. সড়ক ও জনপথ বিভাগ। দুই. স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ। এ দুই বিভাগের মধ্যে কে কোথায় কী ধরনের কাজ করবে তা পরিকল্পনা কমিশন লিখিতভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছে। মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ। এদের মধ্যে সিটি করপোরেশনই নিজ অধিক্ষেত্রে কিছু কাজ করে। তবে এ নিয়েও আছে অস্পষ্টতা। সিটি করপোরেশন এলাকার অনেক সড়কই হয় সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধিক্ষেত্রভুক্ত অথবা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের। মুখেই বলা হয় স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আন্তপরিবহন ব্যবস্থার বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে সড়ক ও জনপথের উন্নতিই হয়েছে সর্বাধিক। এর জন্য সমস্যাও হয়েছে অনেক। নিরাপদ সড়ক নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক চলছে। হাইকোর্টও এ-সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছে। সরকারের আশু অগ্রাধিকার সড়ক সংস্কার। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল অন্তত আগামী কয়েক মাস বড় ধরনের কোনো পুনর্বাসন হবে না। বৃষ্টির জন্য এখন গর্তগুলোকে কোনো রকমে ভরে দিয়ে যান চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অর্থ বরাদ্দের কোনো সমস্যা নেই। প্রয়োজন কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণ। পত্রিকান্তরে আরো দেখা যায়, সার্বিক অব্যবস্থাপনার জন্য অসন্তুষ্ট হয়ে যোগাযোগমন্ত্রীসহ সচিবকে বলেছেন যে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সড়ক মেরামতের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে বহু আগেই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ নির্দেশ যে পালিত হয়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে রেলওয়ের টিকিট যাত্রীরা পাচ্ছে না। ঈদ আসন্ন। সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা ভঙ্গুর। সড়কের দুর্দশার জন্য রেলের ওপর চাপ অত্যধিক। নতুন কিছু ট্রেনও চালু হবে। প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন ও কোচের অভাব। অন্যদিকে প্রকৌশলীরা টাকার অভাবের কথা প্রকাশ্যে বলছেন। কোনটা সত্যি?
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
এসব ক্ষেত্র বিবেচনা ও সুপারিশ করার জন্য ১৯৮৫ সালে পরিকল্পনা কমিশন কাজ শুরু করে। এ সময়ে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত খাদ্য ও সারের চাহিদার পরিমাণ এবং পরিবহনের জন্য আন্তপরিবহন মাধ্যমের ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয় নির্ণয়-সংক্রান্ত কৃষি মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বাধীন গঠিত কমিটিতে সংশ্লিষ্ট অন্যদের মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের একজন যুগ্ম প্রধানকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ কমিটি যথাসময়ে প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করে। পরিকল্পনা কমিশনের সমীক্ষার বিষয়ে এই প্রতিবেদনে আন্তপরিবহন মাধ্যমকে প্রক্ষেপিত চাহিদা অনুযায়ী সমতাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি গুরুত্ব আরোপ করে। পর্যালোচনার সময় কয়েকটি বিষয় প্রতিভাত হয়। আন্তপরিবহন মাধ্যমের ক্ষেত্রগুলো মূলত ছিল সড়ক ও জনপথ, রেলপথ এবং নৌপথ। দেখা যায়, মালামাল ও যাত্রী পরিবহনের জন্য নৌপথেই সবচেয়ে কম মূল্য দিতে হয়। এর পর রেলপথ। সর্বাধিক মূল্য সড়কপথে। সুতরাং কৌশল হিসেবে নৌপথের পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধিই হবে যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এর জন্য প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো শীতের মৌসুমে নাব্যের অভাব।
রেলপথের বিষয়েও বেশ প্রতিবন্ধকতা ছিল। প্রধান বাধা ছিল রেলের ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে। রেলপথ পরিচালনার বিষয়েও একাধিকবার কাঠামোগত সংস্কারের অজুহাতে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৭১ পূর্ববর্তী সময়ে শীর্ষ পরিচালনা সংস্থা ছিল রেলওয়ে বোর্ড। এ ধারা ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে অক্ষুণ্ন রাখা হয়। ওই সময় রেলওয়ের বাজেটও ছিল সার্বিক বাজেট থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এ কারণে এ সংস্থাটির রেলওয়ে পরিচালনার বিষয়ে স্বাধীনতা ও ক্ষমতাও ছিল। এ স্বাধীনতা ও ক্ষমতার ওপর পরবর্তী পর্যায়ে দুটি বড় ধরনের আঘাত আসে। এক. পৃথক রেলওয়ে বাজেটকে সার্বিক বাজেটের সঙ্গে একীভূত করা হয়। দুই. রেলওয়ে বোর্ডকে বিলুপ্ত করা হয়। এর পরিবর্তে রেলওয়ে প্রশাসনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ কাঠামো এখন বিদ্যমান।
রেলপথসহ এর প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্য একটি প্রধান বাধা ছিল নীতি-সম্পর্কিত। রেলওয়েও বাণিজ্যিক সংস্থা হিসেবে পরিচালিত হবে না, সেবামূলক সংস্থা হিসেবে। এর সঙ্গে যোগ হয় রেলওয়ের বেসরকারিকরণের যুক্তি। এ যুক্তি জোরালোভাবে বিদেশি সাহায্য সংস্থারাই সরকারকে অনুসরণ করতে বলে। একই সঙ্গে রেলওয়ের জন্য বিদেশি সাহায্যও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। এরই ধারাবাহিকতায় দক্ষতা ও যাত্রীবান্ধব সেবা দেওয়ার ক্ষমতা ও মান হ্রাস পায়। এ নিয়ে সরকারের কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ বা উদ্বেগ নেই। একসময় রেলওয়ের পরিবহন ক্ষমতা ও যাত্রীবান্ধব সেবার মানের বিষয়টি ছিল সর্বজনবিদিত। বর্তমানে অবস্থা শোচনীয়। ক্ষমতা ও সেবার মান বিধ্বস্ত ও পর্যুদস্ত। একটি বাস্তব উদাহরণ এ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক হবে।
জুলাই ৩০, ২০১১ ময়মনসিংহে নগর স্বাস্থ্যসেবা কৌশল-সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায় উপস্থিত ও অংশগ্রহণ করার জন্য দুজন সাবেক সচিবকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ময়মনসিংহে যেতে হবে। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের অবর্ণনীয় অবস্থার বিষয় অবহিত হয়ে সচিবদ্বয় রেলপথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দুজনই চাকরিরত অবস্থায় রেলওয়েতে আগে কাজ করেছেন। একজন বহু আগে ১৯৭২ সালে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে উপসচিব ছিলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল রেলপথ। অন্যজন ছিলেন রেলওয়ে বিভাগের সচিব, ৯০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। তিস্তা এঙ্প্রেস কমলাপুর থেকে যাত্রা করবে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে। ময়মনসিংহে পেঁৗছার সময় সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট। এ দুই সচিবের সহযাত্রী একজন অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিবও ছিলেন। তিস্তা এঙ্প্রেস ছাড়ল দুই ঘণ্টা দেরিতে। গন্তব্যে পেঁৗছাল রাত ১২টার একটু আগে। প্রথম শ্রেণীর যাত্রীপ্রতি ভাড়া ছিল মাত্র ১১০ টাকা। শুধু যাত্রীবান্ধবই নয়, দরিদ্র যাত্রীবান্ধবও বটে। যাত্রীর ভিড়ও ছিল যথেষ্ট। ৩১ জুলাই ঢাকায় ফেরার কথা। পথে এক সহযাত্রী যিনি এ পথে প্রায়ই আসা-যাওয়া করেন, তাঁর কাছে শোনা গেল যে ট্রেনে ফেরার কথা সেটা প্রায় সময়ই দেরি করে আসে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা এখনো যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছে জানা গেল মূল সমস্যা ইঞ্জিন ও কোচের দারুণ অভাব। প্রথম শ্রেণীতে বসার ঠাঁই নেই। ট্রেনে ওঠার পরই দেখা গেল অসহ্য গরম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। গরম হওয়ার কারণ পাখা চালানোর ব্যবস্থা চালু করতে সময় লাগবে।
এ কারণে সড়কপথেই ফিরতে হয়েছিল অনেক কষ্টে। সড়কে গাড়িতে চলা ছিল কঠিন। সড়কপথে ভাড়া করা মাইক্রোবাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। এ পাঁচ হাজারের বিপরীতে ৫০০ টাকাও কি প্রথম শ্রেণীর জন্য নির্ধারণ করা যায় না। অন্তত ৩০০ টাকা, যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করা হবে। সহনশীলভাবে ভাড়া বাড়ালে রেলওয়েরও কিছু আয় বৃদ্ধি হতো। তবে এখানেও কিন্তু আছে। তা হলো_সার্বিক বাজেটের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পর রেলওয়ের রাজস্বও মূল বাজেটের সঙ্গে একীভূত হবে। সরকারের এখন উচিত হবে রেলওয়ের অর্থায়ন ও উন্নতির জন্য একটি যুক্তিযুক্ত কৌশল নির্ধারণ করা। যদি একে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালাতে হয়, তাহলে বাণিজ্যিক কৌশলই অবলম্বন করতে হবে। আর যদি নিছক সেবা প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে চালাতে হয়, তাহলে সরকারকেই সব খরচ বহন করতে হবে।
সড়কপথ উন্নয়নের জন্য আশির দশক থেকেই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। মূলত দুটি সংস্থা এ সড়ক ও জনপথ উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করে থাকে। এক. সড়ক ও জনপথ বিভাগ। দুই. স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ। এ দুই বিভাগের মধ্যে কে কোথায় কী ধরনের কাজ করবে তা পরিকল্পনা কমিশন লিখিতভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছে। মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ। এদের মধ্যে সিটি করপোরেশনই নিজ অধিক্ষেত্রে কিছু কাজ করে। তবে এ নিয়েও আছে অস্পষ্টতা। সিটি করপোরেশন এলাকার অনেক সড়কই হয় সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধিক্ষেত্রভুক্ত অথবা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের। মুখেই বলা হয় স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আন্তপরিবহন ব্যবস্থার বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে সড়ক ও জনপথের উন্নতিই হয়েছে সর্বাধিক। এর জন্য সমস্যাও হয়েছে অনেক। নিরাপদ সড়ক নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক চলছে। হাইকোর্টও এ-সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছে। সরকারের আশু অগ্রাধিকার সড়ক সংস্কার। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল অন্তত আগামী কয়েক মাস বড় ধরনের কোনো পুনর্বাসন হবে না। বৃষ্টির জন্য এখন গর্তগুলোকে কোনো রকমে ভরে দিয়ে যান চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অর্থ বরাদ্দের কোনো সমস্যা নেই। প্রয়োজন কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণ। পত্রিকান্তরে আরো দেখা যায়, সার্বিক অব্যবস্থাপনার জন্য অসন্তুষ্ট হয়ে যোগাযোগমন্ত্রীসহ সচিবকে বলেছেন যে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সড়ক মেরামতের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে বহু আগেই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ নির্দেশ যে পালিত হয়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে রেলওয়ের টিকিট যাত্রীরা পাচ্ছে না। ঈদ আসন্ন। সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা ভঙ্গুর। সড়কের দুর্দশার জন্য রেলের ওপর চাপ অত্যধিক। নতুন কিছু ট্রেনও চালু হবে। প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন ও কোচের অভাব। অন্যদিকে প্রকৌশলীরা টাকার অভাবের কথা প্রকাশ্যে বলছেন। কোনটা সত্যি?
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments