মূল রচনা-হালিমের বিশ্বজয় by কবির হোসেন
ছোট্টবেলা থেকে ফুটবলই ছিল ধ্যানজ্ঞান। স্বপ্নেও ভাবেননি জীবিকার অবলম্বন ফুটবল একদিন তাঁকে এনে দেবে বিশ্বস্বীকৃতি। মাগুরার শালিখা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ছয়ঘরিয়ার আবদুল হালিম নাম লিখিয়েছেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। বল মাথায় নিয়ে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রমের বিশ্ব রেকর্ড এখন তাঁর।
বিস্তারিত এবারের মূল রচনায় ছেলেবেলা থেকেই হালিমের ফুটবলের দিকে ঝোঁক। মাঠে খেলা দেখলেই ছুটে যান। বল নিয়ে খেলোয়াড়দের পায়ের কারুকাজ মুগ্ধ হয়ে দেখতেন হালিম। এর মধ্যেই ঘটল জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সেই ঘটনা। হালিমের বয়স তখন দশ কি বারো। সীমাখালী বিদ্যালয় মাঠে আন্তস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা। ফুটবল নিয়ে মাঠে এলাকার বড় ভাই বিল্লাল হোসেন। বিল্লাল ভাই কী খেলাটাই না দেখালেন সেবার! বল শূন্যে রেখে টানা দশ-দশবার হেড! ওরিব্বাস!! হালিমের চোখ যাকে বলে একদম ছানাবড়া। সেই থেকে আবদুল হালিমের মাথায় খুঁটি গেড়ে বসল ফুটবলের কৌশল রপ্ত করার চিন্তা।
হালিম সহপাঠীদের সঙ্গে ফুটবল খেলা শুরু করলেন। কিন্তু স্রেফ ফুটবলে লাথি মেরে গোল করে তাঁর মন ভরে না। ফুটবল বেশিক্ষণ হাতে রাখার আকর্ষণেই গোলরক্ষক হিসেবে খেলা শুরু করলেন। জায়গা হলো সীমাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ফুটবল দলে।
বয়স যখন ১৭
হালিমের বয়স তখন ১৭। ততদিনে গোলরক্ষক হিসেবে এলাকায় বেশ কিছুটা নামডাকও হয়েছে তাঁর।
সীমাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে আবারও বসেছে ফুটবলের আসর। সেবার দর্শকদের মন জিতে নিলেন খুলনা থেকে আসা নাম না জানা এক খেলোয়াড়। এই লোক বিল্লাল ভাইয়ের চেয়েও ওস্তাদ লোক। হেড করে মাথায় ও কপালে বল রাখতে পারেন ৩০ সেকেন্ডের মতো। হালিমের বহুদিনের ইচ্ছাটা এবার মনের মধ্যে প্রবল বেগে ডানা ঝাপ্টাঝাপ্টি শুরু করল। শুরু করলেন কঠোর অনুশীলন। টানা এক বছর চলল সাধনা। এর মধ্যে ফুটবলই হালিমের জীবন ও জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছে। এটা সেই ১৯৯১ সালের গল্প।
বন্ধুর পথ
পরিশ্রম আর সাধনার জোরে কি না হয়। ফুটবল নিয়ে খেলা দেখানোর কৌশলে আস্তে-ধীরে দক্ষ হয়ে উঠতে থাকেন হালিম। মাথায় বল নিয়ে নারকেল বা খেজুর গাছে ওঠা, সাঁতার কাটা, জামাকাপড় পরা সব কৌশলই দখলে চলে আসে তাঁর। বল নিয়ে মাথায়, নাকে, কপালে সব জায়গায় রেখে খেলা দেখাতে পারেন। দুটি বল আঙুলের ওপর ঘোরাতে পারেন। ছয় ফুট লম্বা কাঠির ওপর বল ঘোরাতে পারেন। বল মাথায় নিয়ে মাটিতে গড়াতে পারেন। পারেন শূন্যে ঝুলতে। এক হাতে বালতি আর অন্য হাতে মগ নিয়ে নলকূপ চেপে বালতিতে পানি ভরে গায়ে সাবান মেখে গোসল করতে পারেন। হালিম বাইসাইকেল বা মোটরসাইকেলে চড়ে মাথায় বল নিয়ে চমর্যাকার সব নৈপুণ্য দেখাতে পারেন। মিছিল বা শোভাযাত্রায় মাথায় বল নিয়ে থাকতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
১৯৯৪ সালেই আবদুল হালিম ২৪ ঘণ্টা ১০ মিনিট মাথায় ফুটবল নিয়ে থাকার বিরল কাজটি করে ফেলেন। রপ্ত করেন একসঙ্গে ১১টি ফুটবল নিয়ে প্রায় ৪০টি চমক লাগানো কলাকৌশল।
ফুটবলের নানা কৌশল আয়ত্ত করার পর দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক আসতে থাকে তাঁর। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ‘ফুটবল কসরত’ দেখানো শুরু করেন তিনি। ডাক এল ঢাকা থেকেও। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডানের খেলা হবে ; আবদুল হালিম সেখানে বল নিয়ে হাজির। বিরতিতে দর্শক উপভোগ করত তাঁর ফুটবলের নানা কসরত।
কিন্তু গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস? সে তো বহুদূরের পথ। কীভাবে হালিম পৌঁছে গেলেন সেখানে?
২০০৫ সালে প্রথম গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস (বিশ্ব রেকর্ড তালিকাভুক্তি ও যাচাই-বাছাইয়ের প্রধান আন্তর্জাতিক সংস্থা) কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন হালিম। ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়। হালিম সহযোগিতা নিলেন যাঁরা এসব ভালো বোঝেন তাঁদের। তবে সেই কাজটাও খুব সহজ ছিল না। হালিম বলছিলেন,
‘মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু স্বপ্ন বারবার হাতছানি দিত। আবার যোগাযোগ করতাম। ইংরেজি না বোঝায় সমস্যা হতো। বারবার নানা জায়গায় নানা লোকের কাছে গিয়ে ধরনা দিয়েছি। ইন্টারনেট ঘেঁটে আবেদন-নিবেদনে অনেক ঝক্কিঝামেলা। তাও হাল ছাড়িনি।’
বহু চেষ্টার পর হালিম আবেদনকারী হিসেবে গিনেস কর্তৃপক্ষের তালিকাভুক্ত হন। তারপর? ‘আমি ওদের আমার রেকর্ড সম্পর্কে জানাই। কিন্তু গিনেস কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায়, মাথায় বল রাখা নয়, বল নিয়ে কতদূর অতিক্রম করতে পারব সেই রেকর্ডটি তাদের দরকার। তারা কিছু নির্দেশনা দেয়। আমি চেষ্টা করতে থাকি।’
গিনেস কর্তৃপক্ষ জানায়, কয়েকটি উপায়ে রেকর্ডটি স্বীকৃতির জন্য চেষ্টার সুযোগ রয়েছে। এরমধ্যে এক. গিনেস বিচারকদের দৈনিক সাড়ে চার হাজার পাউন্ড ফি পরিশোধ করলে তাঁরা বাংলাদেশে এসে রেকর্ড দেখে ঘোষণা করতে পারেন।
দুই. প্রথম দফায় কর্তৃপক্ষ ছয়-সাত সপ্তাহ নির্দেশনা দেবে। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী, সব কাজ করতে হবে। দ্বিতীয় দফায় ৪৯ দিনের মধ্যে একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে রেকর্ডটি গড়ার ভিডিও ফুটেজ ধারণ এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে পাঠাতে হবে। এ জন্য কোনো টাকাপয়সা লাগবে না।
হালিম বলছিলেন, ‘পেটের ভাতই ভালোভাবে জোটে না, তার ওপর এত খরচের কথা শুনে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। সাহায্য-সহযোগিতার জন্য বহুজনের কাছে যাই। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।’
পরে হালিম দ্বিতীয় প্রস্তাবটির দিকে ঝোঁকেন। এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়ান মোহামেডান লিমিটেডের স্থায়ী সদস্য ফজলুর রহমান।
গিনেস কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী, স্থানীয় পর্যায়ে তাঁর নেতৃত্বে রেকর্ড পর্যবেক্ষণ ও ভিডিও ধারণের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান হন ফজলুর রহমান। এ ছাড়া ফুটবল ফেডারেশনের একজন, পত্রিকার সম্পাদক, বিচারক ও একজন রেফারিকে কমিটির সদস্য করা হয়। ওই কমিটির সামনে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে হালিমের বিশ্বজয়ের ভিডিও ফুটেজ ধারণ করে গিনেস কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়।
গত বছরের ২২ অক্টোবর বল মাথায় নিয়ে নিজেকে বিশ্বসেরা প্রমাণের পরীক্ষায় নামেন হালিম। সেদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বল মাথায় নিয়ে ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার পথ হাঁটেন তিনি। ৩৮ ল্যাপে এ দূরত্ব অতিক্রম করতে তিনি সময় নেন দুই ঘণ্টা ৪৯ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড।
কিন্তু এই অসাধারণ কাজটি ধারণ করতে গিয়ে বাধল বিপত্তি। হালিমের রেকর্ড পর্যবেক্ষণ কমিটির প্রধান ফজলুর রহমান জানালেন সেই বিপত্তির কথা।
‘রেকর্ডটির ভিডিও ধারণ করা নিয়ে মহা ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল আমাকে। রেকর্ডটি একটানা ধারণ করতে হবে। কথা ছিল গিনেস কর্তৃপক্ষের মুঠোফোনে নির্দেশ দেওয়ার পর ভিডিও ধারণের কাজ শুরু করতে হবে। একটানা চলবে ধারণকাজ। কিন্তু ঝামেলা হলো, এমন কোনো ভিডিও ক্যামেরার ক্যাসেট পাওয়া গেল না যেটা টানা তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলবে। হালিম আরও অনেক সময় ধরে বল মাথায় দূরত্ব অতিক্রম করতে পারতেন। কিন্তু কেবল ভিডিও ধারণের কারিগরি সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা সে সুযোগ নিতে পারিনি। তাহলে হয়তো রেকর্ডটি এমন জায়গায় পৌঁছাত যা আর কেউ ভাঙতে পারত না।’
শেষ পর্যন্ত সার্থক হয়েছে সব পরিশ্রম। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ওয়েবসাইটে উঠে গেছে আবদুল হালিম আর তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশের নাম।
গিনেস কর্তৃপক্ষ ৩ নভেম্বর ভিডিও ফুটেজ পায়। এগুলো পর্যবেক্ষণ করে তারা ১৩ জানুয়ারি হালিমের বিশ্ব রেকর্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করে। পরে ২৪ জানুয়ারি গিনেসের ওয়েবসাইটে সংযুক্ত হয় হালিমের নাম। স্বীকৃতির সনদ হালিম হাতে পান গত ৩১ জানুয়ারি।
এর আগে বল মাথায় নিয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রমের রেকর্ডটি ছিল মালয়েশিয়ার ই মিং লোর। তিনি ১১ দশমিক ১২৯ কিলোমিটার অর্থার্যা ১১ কিলোমিটার ১২৯ মিটার পথ অতিক্রম করে ২০০৯ সালের ২১ অক্টোবর ওই রেকর্ড গড়েছিলেন।
কষ্টের দিনলিপি
গিনেসে নাম ওঠানোর যুদ্ধ জয় করেছেন আবদুল হালিম। কিন্তু দারিদ্র্যের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ বুঝি শেষ হওয়ার নয়। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টে দিন চলে। আবদুল হালিম জানান, কেবল সহযোগিতার অভাবে প্রায় দেড় যুগ আগে এমন রেকর্ড করেও গিনেস রেকর্ডসে নাম ওঠানো সম্ভব হয়নি।
বাবা মো. সানাউল্লাহ পাটোয়ারি, স্ত্রী নাসিমা খাতুন, ছেলে সুমন হোসেন (১৪) ও শাহিন হোসেনকে (১২) নিয়ে হালিমের সংসার। বৈমাত্রেয় এক ভাইসহ তাঁরা মোট পাঁচ ভাই। হালিম সবার বড়।
বাবার জায়গাজমি নেই। দিনমজুর। তাঁর বয়স যখন ১১-১২, তখন মা মারা যান। অভাবের সংসার। তাই বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করতেন। যে কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয় পার হওয়ার পর আর পড়ালেখা এগোয়নি।
অজপাড়াগাঁয়ের এক অতি সাধারণ ছেলে হালিমের বিশ্বজয়ী হয়ে ওঠার পেছনে সেই শুরু থেকেই লেগে ছিলেন যে মানুষটি, তাঁর নাম ইফতেখার আলম। মাগুরা জেলার সাবেক জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা। হালিম বলছিলেন, ‘ইফতেখার স্যার আমারে মাটি থেকে তুলে এখানে এনেছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করা যাবে না। তিনি না থাকলে আমি বিশ্ব রেকর্ড করতে পারতাম না। অভাবের তাড়নায় মাঠে জোন (কামলা) দিয়েছি। রাজমিস্ত্রির জুগালের (সহযোগী) কাজ করেছি। সার্কাস দলে ফুটবলের কসরত দেখিয়েছি। ’
হালিমের বিশ্বজয়ের খবরে আনন্দিত মো. ইফতেখার আলম বলেন, ‘১৯৯৩ সালের দিকে আমি সীমাখালীতে একটি ফুটবল খেলার ফাইনাল খেলায় অতিথি হিসেবে যাই। ওই সময় ওর নৈপুণ্য দেখে মুগ্ধ হই। আমার স্বপ্ন ও বিশ্বাস ছিল, একদিন হালিম বিশ্বজয় করবে।’
হালিমকে এছাড়াও নানাভাবে সহযোগিতা করেছে ওয়ালটন।
হালিমের খোঁজে
গিনেসে নাম লেখানো আবদুল হালিমকে এখন খুঁজে পাওয়া বড়ই মুশকিল।
শীত মৌসুম। তাই হালিমের ব্যস্ততাও বেশি। জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ফুটবল নিয়ে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। বিভিন্ন জায়গায় ফুটবলের কসরত দেখান। মুঠোফোনে যোগাযোগ করে পাওয়া গেল হালিমকে। খুব ব্যস্ত। কথা বলার সময় নেই। জানালেন, বড় ছেলে সুমন হোসেন (১৪) দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার চিকির্যাসার জন্য প্রায় আট লাখ টাকা প্রয়োজন। এ জন্য তিনি দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন। স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় রয়েছেন।
পরিচিত-অপরিচিত সবার কাছে যাচ্ছেন ছেলেকে বাঁচাতে। ছেলের চিকির্যাসার পেছনে ছুটতে গিয়ে আয়-রোজগারও বন্ধ। হালিম বললেন, ইতিহাসের পাতায় নাম ওঠার স্বীকৃতি পেয়ে তিনি দারুণ উচ্ছ্বসিত। তবে ছেলের অসুস্থতার কারণে মনে সুখ নেই। তবে তার পরও হালিম দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘আমি একটি ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করেছি। ভবিষ্যতে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ফুটবল নিয়ে আরও রেকর্ড করব, যা এর আগে কেউ করে দেখাতে পারেনি।’
হালিম সহপাঠীদের সঙ্গে ফুটবল খেলা শুরু করলেন। কিন্তু স্রেফ ফুটবলে লাথি মেরে গোল করে তাঁর মন ভরে না। ফুটবল বেশিক্ষণ হাতে রাখার আকর্ষণেই গোলরক্ষক হিসেবে খেলা শুরু করলেন। জায়গা হলো সীমাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ফুটবল দলে।
বয়স যখন ১৭
হালিমের বয়স তখন ১৭। ততদিনে গোলরক্ষক হিসেবে এলাকায় বেশ কিছুটা নামডাকও হয়েছে তাঁর।
সীমাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে আবারও বসেছে ফুটবলের আসর। সেবার দর্শকদের মন জিতে নিলেন খুলনা থেকে আসা নাম না জানা এক খেলোয়াড়। এই লোক বিল্লাল ভাইয়ের চেয়েও ওস্তাদ লোক। হেড করে মাথায় ও কপালে বল রাখতে পারেন ৩০ সেকেন্ডের মতো। হালিমের বহুদিনের ইচ্ছাটা এবার মনের মধ্যে প্রবল বেগে ডানা ঝাপ্টাঝাপ্টি শুরু করল। শুরু করলেন কঠোর অনুশীলন। টানা এক বছর চলল সাধনা। এর মধ্যে ফুটবলই হালিমের জীবন ও জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছে। এটা সেই ১৯৯১ সালের গল্প।
বন্ধুর পথ
পরিশ্রম আর সাধনার জোরে কি না হয়। ফুটবল নিয়ে খেলা দেখানোর কৌশলে আস্তে-ধীরে দক্ষ হয়ে উঠতে থাকেন হালিম। মাথায় বল নিয়ে নারকেল বা খেজুর গাছে ওঠা, সাঁতার কাটা, জামাকাপড় পরা সব কৌশলই দখলে চলে আসে তাঁর। বল নিয়ে মাথায়, নাকে, কপালে সব জায়গায় রেখে খেলা দেখাতে পারেন। দুটি বল আঙুলের ওপর ঘোরাতে পারেন। ছয় ফুট লম্বা কাঠির ওপর বল ঘোরাতে পারেন। বল মাথায় নিয়ে মাটিতে গড়াতে পারেন। পারেন শূন্যে ঝুলতে। এক হাতে বালতি আর অন্য হাতে মগ নিয়ে নলকূপ চেপে বালতিতে পানি ভরে গায়ে সাবান মেখে গোসল করতে পারেন। হালিম বাইসাইকেল বা মোটরসাইকেলে চড়ে মাথায় বল নিয়ে চমর্যাকার সব নৈপুণ্য দেখাতে পারেন। মিছিল বা শোভাযাত্রায় মাথায় বল নিয়ে থাকতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
১৯৯৪ সালেই আবদুল হালিম ২৪ ঘণ্টা ১০ মিনিট মাথায় ফুটবল নিয়ে থাকার বিরল কাজটি করে ফেলেন। রপ্ত করেন একসঙ্গে ১১টি ফুটবল নিয়ে প্রায় ৪০টি চমক লাগানো কলাকৌশল।
ফুটবলের নানা কৌশল আয়ত্ত করার পর দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক আসতে থাকে তাঁর। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ‘ফুটবল কসরত’ দেখানো শুরু করেন তিনি। ডাক এল ঢাকা থেকেও। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডানের খেলা হবে ; আবদুল হালিম সেখানে বল নিয়ে হাজির। বিরতিতে দর্শক উপভোগ করত তাঁর ফুটবলের নানা কসরত।
কিন্তু গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস? সে তো বহুদূরের পথ। কীভাবে হালিম পৌঁছে গেলেন সেখানে?
২০০৫ সালে প্রথম গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস (বিশ্ব রেকর্ড তালিকাভুক্তি ও যাচাই-বাছাইয়ের প্রধান আন্তর্জাতিক সংস্থা) কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন হালিম। ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়। হালিম সহযোগিতা নিলেন যাঁরা এসব ভালো বোঝেন তাঁদের। তবে সেই কাজটাও খুব সহজ ছিল না। হালিম বলছিলেন,
‘মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু স্বপ্ন বারবার হাতছানি দিত। আবার যোগাযোগ করতাম। ইংরেজি না বোঝায় সমস্যা হতো। বারবার নানা জায়গায় নানা লোকের কাছে গিয়ে ধরনা দিয়েছি। ইন্টারনেট ঘেঁটে আবেদন-নিবেদনে অনেক ঝক্কিঝামেলা। তাও হাল ছাড়িনি।’
বহু চেষ্টার পর হালিম আবেদনকারী হিসেবে গিনেস কর্তৃপক্ষের তালিকাভুক্ত হন। তারপর? ‘আমি ওদের আমার রেকর্ড সম্পর্কে জানাই। কিন্তু গিনেস কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায়, মাথায় বল রাখা নয়, বল নিয়ে কতদূর অতিক্রম করতে পারব সেই রেকর্ডটি তাদের দরকার। তারা কিছু নির্দেশনা দেয়। আমি চেষ্টা করতে থাকি।’
গিনেস কর্তৃপক্ষ জানায়, কয়েকটি উপায়ে রেকর্ডটি স্বীকৃতির জন্য চেষ্টার সুযোগ রয়েছে। এরমধ্যে এক. গিনেস বিচারকদের দৈনিক সাড়ে চার হাজার পাউন্ড ফি পরিশোধ করলে তাঁরা বাংলাদেশে এসে রেকর্ড দেখে ঘোষণা করতে পারেন।
দুই. প্রথম দফায় কর্তৃপক্ষ ছয়-সাত সপ্তাহ নির্দেশনা দেবে। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী, সব কাজ করতে হবে। দ্বিতীয় দফায় ৪৯ দিনের মধ্যে একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে রেকর্ডটি গড়ার ভিডিও ফুটেজ ধারণ এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে পাঠাতে হবে। এ জন্য কোনো টাকাপয়সা লাগবে না।
হালিম বলছিলেন, ‘পেটের ভাতই ভালোভাবে জোটে না, তার ওপর এত খরচের কথা শুনে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। সাহায্য-সহযোগিতার জন্য বহুজনের কাছে যাই। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।’
পরে হালিম দ্বিতীয় প্রস্তাবটির দিকে ঝোঁকেন। এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়ান মোহামেডান লিমিটেডের স্থায়ী সদস্য ফজলুর রহমান।
গিনেস কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী, স্থানীয় পর্যায়ে তাঁর নেতৃত্বে রেকর্ড পর্যবেক্ষণ ও ভিডিও ধারণের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান হন ফজলুর রহমান। এ ছাড়া ফুটবল ফেডারেশনের একজন, পত্রিকার সম্পাদক, বিচারক ও একজন রেফারিকে কমিটির সদস্য করা হয়। ওই কমিটির সামনে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে হালিমের বিশ্বজয়ের ভিডিও ফুটেজ ধারণ করে গিনেস কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়।
গত বছরের ২২ অক্টোবর বল মাথায় নিয়ে নিজেকে বিশ্বসেরা প্রমাণের পরীক্ষায় নামেন হালিম। সেদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বল মাথায় নিয়ে ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার পথ হাঁটেন তিনি। ৩৮ ল্যাপে এ দূরত্ব অতিক্রম করতে তিনি সময় নেন দুই ঘণ্টা ৪৯ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড।
কিন্তু এই অসাধারণ কাজটি ধারণ করতে গিয়ে বাধল বিপত্তি। হালিমের রেকর্ড পর্যবেক্ষণ কমিটির প্রধান ফজলুর রহমান জানালেন সেই বিপত্তির কথা।
‘রেকর্ডটির ভিডিও ধারণ করা নিয়ে মহা ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল আমাকে। রেকর্ডটি একটানা ধারণ করতে হবে। কথা ছিল গিনেস কর্তৃপক্ষের মুঠোফোনে নির্দেশ দেওয়ার পর ভিডিও ধারণের কাজ শুরু করতে হবে। একটানা চলবে ধারণকাজ। কিন্তু ঝামেলা হলো, এমন কোনো ভিডিও ক্যামেরার ক্যাসেট পাওয়া গেল না যেটা টানা তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলবে। হালিম আরও অনেক সময় ধরে বল মাথায় দূরত্ব অতিক্রম করতে পারতেন। কিন্তু কেবল ভিডিও ধারণের কারিগরি সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা সে সুযোগ নিতে পারিনি। তাহলে হয়তো রেকর্ডটি এমন জায়গায় পৌঁছাত যা আর কেউ ভাঙতে পারত না।’
শেষ পর্যন্ত সার্থক হয়েছে সব পরিশ্রম। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ওয়েবসাইটে উঠে গেছে আবদুল হালিম আর তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশের নাম।
গিনেস কর্তৃপক্ষ ৩ নভেম্বর ভিডিও ফুটেজ পায়। এগুলো পর্যবেক্ষণ করে তারা ১৩ জানুয়ারি হালিমের বিশ্ব রেকর্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করে। পরে ২৪ জানুয়ারি গিনেসের ওয়েবসাইটে সংযুক্ত হয় হালিমের নাম। স্বীকৃতির সনদ হালিম হাতে পান গত ৩১ জানুয়ারি।
এর আগে বল মাথায় নিয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রমের রেকর্ডটি ছিল মালয়েশিয়ার ই মিং লোর। তিনি ১১ দশমিক ১২৯ কিলোমিটার অর্থার্যা ১১ কিলোমিটার ১২৯ মিটার পথ অতিক্রম করে ২০০৯ সালের ২১ অক্টোবর ওই রেকর্ড গড়েছিলেন।
কষ্টের দিনলিপি
গিনেসে নাম ওঠানোর যুদ্ধ জয় করেছেন আবদুল হালিম। কিন্তু দারিদ্র্যের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ বুঝি শেষ হওয়ার নয়। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টে দিন চলে। আবদুল হালিম জানান, কেবল সহযোগিতার অভাবে প্রায় দেড় যুগ আগে এমন রেকর্ড করেও গিনেস রেকর্ডসে নাম ওঠানো সম্ভব হয়নি।
বাবা মো. সানাউল্লাহ পাটোয়ারি, স্ত্রী নাসিমা খাতুন, ছেলে সুমন হোসেন (১৪) ও শাহিন হোসেনকে (১২) নিয়ে হালিমের সংসার। বৈমাত্রেয় এক ভাইসহ তাঁরা মোট পাঁচ ভাই। হালিম সবার বড়।
বাবার জায়গাজমি নেই। দিনমজুর। তাঁর বয়স যখন ১১-১২, তখন মা মারা যান। অভাবের সংসার। তাই বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করতেন। যে কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয় পার হওয়ার পর আর পড়ালেখা এগোয়নি।
অজপাড়াগাঁয়ের এক অতি সাধারণ ছেলে হালিমের বিশ্বজয়ী হয়ে ওঠার পেছনে সেই শুরু থেকেই লেগে ছিলেন যে মানুষটি, তাঁর নাম ইফতেখার আলম। মাগুরা জেলার সাবেক জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা। হালিম বলছিলেন, ‘ইফতেখার স্যার আমারে মাটি থেকে তুলে এখানে এনেছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করা যাবে না। তিনি না থাকলে আমি বিশ্ব রেকর্ড করতে পারতাম না। অভাবের তাড়নায় মাঠে জোন (কামলা) দিয়েছি। রাজমিস্ত্রির জুগালের (সহযোগী) কাজ করেছি। সার্কাস দলে ফুটবলের কসরত দেখিয়েছি। ’
হালিমের বিশ্বজয়ের খবরে আনন্দিত মো. ইফতেখার আলম বলেন, ‘১৯৯৩ সালের দিকে আমি সীমাখালীতে একটি ফুটবল খেলার ফাইনাল খেলায় অতিথি হিসেবে যাই। ওই সময় ওর নৈপুণ্য দেখে মুগ্ধ হই। আমার স্বপ্ন ও বিশ্বাস ছিল, একদিন হালিম বিশ্বজয় করবে।’
হালিমকে এছাড়াও নানাভাবে সহযোগিতা করেছে ওয়ালটন।
হালিমের খোঁজে
গিনেসে নাম লেখানো আবদুল হালিমকে এখন খুঁজে পাওয়া বড়ই মুশকিল।
শীত মৌসুম। তাই হালিমের ব্যস্ততাও বেশি। জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ফুটবল নিয়ে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। বিভিন্ন জায়গায় ফুটবলের কসরত দেখান। মুঠোফোনে যোগাযোগ করে পাওয়া গেল হালিমকে। খুব ব্যস্ত। কথা বলার সময় নেই। জানালেন, বড় ছেলে সুমন হোসেন (১৪) দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার চিকির্যাসার জন্য প্রায় আট লাখ টাকা প্রয়োজন। এ জন্য তিনি দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন। স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় রয়েছেন।
পরিচিত-অপরিচিত সবার কাছে যাচ্ছেন ছেলেকে বাঁচাতে। ছেলের চিকির্যাসার পেছনে ছুটতে গিয়ে আয়-রোজগারও বন্ধ। হালিম বললেন, ইতিহাসের পাতায় নাম ওঠার স্বীকৃতি পেয়ে তিনি দারুণ উচ্ছ্বসিত। তবে ছেলের অসুস্থতার কারণে মনে সুখ নেই। তবে তার পরও হালিম দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘আমি একটি ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করেছি। ভবিষ্যতে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ফুটবল নিয়ে আরও রেকর্ড করব, যা এর আগে কেউ করে দেখাতে পারেনি।’
No comments