একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-কবর by রামেন্দু মজুমদার
১৯৫৩ সাল। আগের বছর একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী। সে সময় কারাগারে তাঁর সঙ্গে আরও ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশিম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ,
অধ্যাপক অজিত গুহ প্রমুখ। অপর একটি কক্ষে অন্যদের সঙ্গে ছিলেন প্রগতিশীল সাংবাদিক-সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত। তিনি গোপনে একটি চিঠি পাঠালেন মুনীর চৌধুরীকে। অনুরোধ ছিল একুশের স্মরণে জেলখানার ভেতর রাজবন্দীরা অভিনয় করতে পারে এমন একটি নাটক মুনীর চৌধুরীকে লিখে দিতে হবে। নাটক হবে রাত ১০টার পর জেলের বাতি নিভিয়ে দিয়ে হারিকেনের আলোয়।
নাট্যকারের যখন মঞ্চের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে, মঞ্চায়নের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকে, তখন মঞ্চসফল নাটক লেখা সহজ হয়। কবর তার উজ্জ্বল উদাহরণ। মুনীর চৌধুরী ভাবলেন সেট ও আলোর ব্যবস্থা থাকবে না, তাই সেই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগাতে হবে। তিনি নাটকের ঘটনাস্থল হিসেবে বেছে নিলেন গোরস্থানকে, যেখানে সেটের প্রয়োজন নেই। সময় শেষ রাত। নাটকের শুরুতেই নাট্যকারের নির্দেশ: ‘মঞ্চে কোনোরূপ উজ্জ্বল আলো ব্যবহূত হইবে না। হারিকেন, প্রদীপ ও দিয়াশলাইয়ের কারসাজিতে নাটকের প্রয়োজনীয় ভয়াবহ, রহস্যময়, অশরীরী পরিবেশকে সৃষ্টি করিতে হইবে।’ জেলখানায় নারী চরিত্রের অভিনেত্রী পাওয়া যাবে না বলে কবর নাটকে নাট্যকার কোনো নারী চরিত্র রাখেননি। কেবল নাটকীয় মুহূর্তে ইন্সপেক্টর হাফিজ মাথায় চাদর টেনে নারীর অভিনয় করেন।
নাটকটি মুনীর চৌধুরী লেখা শেষ করেছিলেন ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি আর জেলখানায় অভিনীত হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। ফণী চক্রবর্তীর নির্দেশনায় নাটকটির অভিনয় নাকি বেশ ভালো হয়েছিল। মুনীর চৌধুরী অন্য কক্ষে ছিলেন বলে কবর নাটকের প্রথম অভিনয় দেখতে পারেননি। জেলখানায় যখন অদূরেই অন্য কক্ষে নাটকটি অভিনীত হচ্ছিল, তখন তাঁর মনে কী অনুভূতি হয়েছিল প্রশ্ন করলে মুনীর চৌধুরী জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি নির্লিপ্ত ছিলাম। কেননা জেল এমন জায়গা যেখানে সব রকমের মানসিক উৎকণ্ঠাকে আয়ত্তে আনতে হয়।’
১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় প্রথমবার ও ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে দ্বিতীয়বার মুনীর চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর তিনি মাস দুয়েকের জন্য মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ৯২(ক) ধারা জারি করার পর তৃতীয়বার কারাবরণ করতে হয়েছিল তাঁকে।
১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে সংবাদ পত্রিকার আজাদী সংখ্যায় কবর প্রথম প্রকাশিত হয়। এর ১০ বছর পর হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনের দ্বিতীয় সংস্করণে নাটকটি পুনর্মুদ্রিত হয় এবং ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের শাহীন বুক ক্লাব থেকে অপর দুটি নাটিকা ‘মানুষ’ ও ‘নষ্টছেলে’র সঙ্গে কবর শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
আমাদের বিবেচনায় ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় আজ পর্যন্ত যত নাটক রচিত হয়েছে তার কোনোটিই মুনীর চৌধুরীর কবর নাটককে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। কবর প্রসঙ্গে মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘শুধু কবর নাটকটিতে একুশের তাৎপর্য খোঁজা হলে খানিকটা ভুলই বরং করা হবে। হয়তো আরও বেশি কিছু বলার চেষ্টা করেছি আমি, আরও বেশি কিছু। নিঃসন্দেহে এটি আমার দৃষ্টি উন্মোচনকারী শ্রেষ্ঠ লেখা।’
কবর কেবল মুনীর চৌধুরীর নয়, আমাদের জন্যও দৃষ্টি উন্মোচনকারী শিল্পসৃষ্টি। বাংলাদেশের প্রথম প্রতিবাদী রাজনৈতিক নাটক কবর। কবর-এর হাত ধরেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর রচিত ও প্রযোজিত হয়েছে অনেক প্রতিবাদী নাটক। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের এসব নাটক বাংলাদেশে নাট্যরচনার একটি নতুন ধারার বিকাশ ঘটিয়েছে। এসব রচনা আমাদের নাট্যকর্মীদের সামাজিক দায়বদ্ধতাকে শাণিত করেছে।
১৯৫৬ সালে কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে কবর প্রথম প্রকাশ্যে অভিনীত হয়েছিল। কিন্তু পরিবেশ অনেক সময়ই প্রতিকূল ছিল। নেতাকে শেরওয়ানি ও জিন্নাহ্ টুপি পরিহিত অবস্থায় দেখানো নিয়ে কয়েক জায়গায় হইচই হয়েছে। তবে ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শহীদ দিবস উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কবর নাটক অভিনীত হতে থাকে। এখনো কবর আমাদের চেতনাকে নাড়া দেয়, ভাষা আন্দোলনকে ছাড়িয়ে বৃহত্তর প্রতিবাদের ইঙ্গিত দেয়। সংলাপ রচনায় মুনীর চৌধুরীর অসামান্য পারঙ্গমতা, এ নাটকেও আমাদের মুগ্ধ করে। নাটকের সমাপ্তি যেভাবে হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। অনেক নির্দেশক মুর্দা ফকিরের মিছিলের আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে নাটকটি শেষ করেন। নাট্যকার অবশ্য নির্দেশককে সে স্বাধীনতা দিয়েছেন।
মাত্র ৪৬ বছর বয়সে বিজয়ের উষালগ্নে স্বাধীনতাবিরোধী আল-বদর আল-শামসদের হাতে নাট্যকার মুনীর চৌধুরী অন্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নির্মমভাবে শহীদ হন। নিয়তির কী পরিহাস। যে কবর নাটক মুনীর চৌধুরীকে অমর করে রেখেছে, সেই মুনীর চৌধুরীর কোনো কবর নেই। কারণ তাঁর মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটি কবরে শায়িত না থেকে তিনি ছড়িয়ে আছেন গোটা বাংলাদেশের মৃত্তিকায়। মুনীর চৌধুরীর মতো বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের যারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, সেসব মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের এটাই কি উপযুক্ত সময় নয়?
নাট্যকারের যখন মঞ্চের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে, মঞ্চায়নের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকে, তখন মঞ্চসফল নাটক লেখা সহজ হয়। কবর তার উজ্জ্বল উদাহরণ। মুনীর চৌধুরী ভাবলেন সেট ও আলোর ব্যবস্থা থাকবে না, তাই সেই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগাতে হবে। তিনি নাটকের ঘটনাস্থল হিসেবে বেছে নিলেন গোরস্থানকে, যেখানে সেটের প্রয়োজন নেই। সময় শেষ রাত। নাটকের শুরুতেই নাট্যকারের নির্দেশ: ‘মঞ্চে কোনোরূপ উজ্জ্বল আলো ব্যবহূত হইবে না। হারিকেন, প্রদীপ ও দিয়াশলাইয়ের কারসাজিতে নাটকের প্রয়োজনীয় ভয়াবহ, রহস্যময়, অশরীরী পরিবেশকে সৃষ্টি করিতে হইবে।’ জেলখানায় নারী চরিত্রের অভিনেত্রী পাওয়া যাবে না বলে কবর নাটকে নাট্যকার কোনো নারী চরিত্র রাখেননি। কেবল নাটকীয় মুহূর্তে ইন্সপেক্টর হাফিজ মাথায় চাদর টেনে নারীর অভিনয় করেন।
নাটকটি মুনীর চৌধুরী লেখা শেষ করেছিলেন ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি আর জেলখানায় অভিনীত হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। ফণী চক্রবর্তীর নির্দেশনায় নাটকটির অভিনয় নাকি বেশ ভালো হয়েছিল। মুনীর চৌধুরী অন্য কক্ষে ছিলেন বলে কবর নাটকের প্রথম অভিনয় দেখতে পারেননি। জেলখানায় যখন অদূরেই অন্য কক্ষে নাটকটি অভিনীত হচ্ছিল, তখন তাঁর মনে কী অনুভূতি হয়েছিল প্রশ্ন করলে মুনীর চৌধুরী জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি নির্লিপ্ত ছিলাম। কেননা জেল এমন জায়গা যেখানে সব রকমের মানসিক উৎকণ্ঠাকে আয়ত্তে আনতে হয়।’
১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় প্রথমবার ও ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে দ্বিতীয়বার মুনীর চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর তিনি মাস দুয়েকের জন্য মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ৯২(ক) ধারা জারি করার পর তৃতীয়বার কারাবরণ করতে হয়েছিল তাঁকে।
১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে সংবাদ পত্রিকার আজাদী সংখ্যায় কবর প্রথম প্রকাশিত হয়। এর ১০ বছর পর হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনের দ্বিতীয় সংস্করণে নাটকটি পুনর্মুদ্রিত হয় এবং ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের শাহীন বুক ক্লাব থেকে অপর দুটি নাটিকা ‘মানুষ’ ও ‘নষ্টছেলে’র সঙ্গে কবর শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
আমাদের বিবেচনায় ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় আজ পর্যন্ত যত নাটক রচিত হয়েছে তার কোনোটিই মুনীর চৌধুরীর কবর নাটককে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। কবর প্রসঙ্গে মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘শুধু কবর নাটকটিতে একুশের তাৎপর্য খোঁজা হলে খানিকটা ভুলই বরং করা হবে। হয়তো আরও বেশি কিছু বলার চেষ্টা করেছি আমি, আরও বেশি কিছু। নিঃসন্দেহে এটি আমার দৃষ্টি উন্মোচনকারী শ্রেষ্ঠ লেখা।’
কবর কেবল মুনীর চৌধুরীর নয়, আমাদের জন্যও দৃষ্টি উন্মোচনকারী শিল্পসৃষ্টি। বাংলাদেশের প্রথম প্রতিবাদী রাজনৈতিক নাটক কবর। কবর-এর হাত ধরেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর রচিত ও প্রযোজিত হয়েছে অনেক প্রতিবাদী নাটক। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের এসব নাটক বাংলাদেশে নাট্যরচনার একটি নতুন ধারার বিকাশ ঘটিয়েছে। এসব রচনা আমাদের নাট্যকর্মীদের সামাজিক দায়বদ্ধতাকে শাণিত করেছে।
১৯৫৬ সালে কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে কবর প্রথম প্রকাশ্যে অভিনীত হয়েছিল। কিন্তু পরিবেশ অনেক সময়ই প্রতিকূল ছিল। নেতাকে শেরওয়ানি ও জিন্নাহ্ টুপি পরিহিত অবস্থায় দেখানো নিয়ে কয়েক জায়গায় হইচই হয়েছে। তবে ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শহীদ দিবস উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কবর নাটক অভিনীত হতে থাকে। এখনো কবর আমাদের চেতনাকে নাড়া দেয়, ভাষা আন্দোলনকে ছাড়িয়ে বৃহত্তর প্রতিবাদের ইঙ্গিত দেয়। সংলাপ রচনায় মুনীর চৌধুরীর অসামান্য পারঙ্গমতা, এ নাটকেও আমাদের মুগ্ধ করে। নাটকের সমাপ্তি যেভাবে হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। অনেক নির্দেশক মুর্দা ফকিরের মিছিলের আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে নাটকটি শেষ করেন। নাট্যকার অবশ্য নির্দেশককে সে স্বাধীনতা দিয়েছেন।
মাত্র ৪৬ বছর বয়সে বিজয়ের উষালগ্নে স্বাধীনতাবিরোধী আল-বদর আল-শামসদের হাতে নাট্যকার মুনীর চৌধুরী অন্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নির্মমভাবে শহীদ হন। নিয়তির কী পরিহাস। যে কবর নাটক মুনীর চৌধুরীকে অমর করে রেখেছে, সেই মুনীর চৌধুরীর কোনো কবর নেই। কারণ তাঁর মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটি কবরে শায়িত না থেকে তিনি ছড়িয়ে আছেন গোটা বাংলাদেশের মৃত্তিকায়। মুনীর চৌধুরীর মতো বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের যারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, সেসব মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের এটাই কি উপযুক্ত সময় নয়?
No comments