মাতৃভাষা-শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ চাই by মাহফুজুর রহমান

পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার মতোই বাংলারও দুটো রূপ আছে—ওই ভাষায় কথা বলি, ওই ভাষাতেই লিখি। বাক্যটি স্বতঃপ্রমাণিত। উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। তবুও লিখতে হলো। কারণ, বাংলার যে একটি প্রমিত বাচনিক রূপ আছে, তা বাংলাদেশের বাঙালি প্রায় ভুলতে বসেছে।


কখনো কখনো লেখ্য বাংলার বেহাল দশা দেখে অনেককে স্বভাবতই ডুকরে উঠতে দেখি। কথ্য বাংলার দুর্গতি নিয়ে মাথা ঘামানোরও যেন কেউ নেই। এমনটা কেন হয়? কথ্য বাংলার ব্যবহার লেখ্য বাংলার চেয়ে তো অযুত গুণ বেশি। সেই বাংলার এই ধূলিবসন কেন? ভাষা নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মাসে। এই গরবের পেছনে অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে নির্জলা ভণ্ডামি। অধিকাংশ (শিক্ষত) বাঙালি শুদ্ধ বাংলা লিখতে পারে না; বলতে পারে না যারা, তাদের সংখ্যা ঢের বেশি। তবু তারা বাংলা ভাষা নিয়ে গর্ব করে।
বাংলা ভাষার জন্য আমরা যে সংগ্রাম করেছিলাম, তা তো শুধু লিখিত বাংলার জন্য ছিল না। আমাদের মুখের ভাষা কাউকে কেড়ে নিতে দেব না বলেও আমরা আওয়াজ তুলেছিলাম। পঞ্চাশের দশকে আমরা পোস্টারে লিখতাম ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। বুকে ব্যাজ ধারণ করতাম ওই বাক্যেরই। আর সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুললাম ওই কথাগুলোই ধ্বনিত করে, শুদ্ধ, সোচ্চার উচ্চারণে। আজও সেই উচ্চারণের প্রতি কেন এই অবজ্ঞা?
লেখ্য বাংলার প্রমিত রূপ কী, তা নিয়ে অবশ্যই মতভেদ রয়েছে। বানান নিয়ে এখনো অরাজকতা চলছে বলে অনেকেরই অভিযোগ। এখনো ব্যাকরণের ধোপে টিকবে না এমন বাংলা অহরহই চোখে পড়ে। তবু বিদগ্ধ বাঙালি প্রমিত লেখ্য বাংলা দেখেই চিনতে পারে, সেই বাংলা অনুসরণ করে, উপভোগ করে। অর্থার‌্যা লেখ্য বাংলার একটি আদর্শ রূপ আছে, আর সেই রূপের বিকৃতি চোখে পড়লে তা তারা সহ্য করে না। কথ্য বাংলারও একটি আদর্শ বা মার্জিত রূপ আছে।
সেই আদর্শ এত অবহেলিত কেন—এই প্রশ্নে হরেক রকম সাড়া মিলবে। কেউ হয়তো বলবে, কথ্য বাংলার ওরকম কোনো আদর্শ নেই, সুতরাং ওটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কারণ নেই। কেউ হয়তো আরও আগ বাড়িয়ে জুড়বে, ‘আমি যে আদর্শ কথ্য বাংলার কথা বলছি, তা নেহাতই ওপার বাংলার, বাংলাদেশের নয়।’ এ আপত্তিগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। বাংলা বাচনের একটি আদর্শ বা প্রমিত রূপ আছে। সীমান্তের ওপারে সাধারণ বাঙালির বাংলা সেই প্রমিত বাচনের কাছাকাছি। তার অর্থ এই নয় যে প্রমিত বাংলা পশ্চিমবঙ্গেরই ভাষা। আদর্শ বাংলা উচ্চারণ উভয় বাংলার ভাষাবিদ-ধ্বনিতত্ত্ববিদদের শ্রমের ফসল। উভয় বাংলার বৈদগ্ধে তা লালিত।
বাংলাদেশেও সহজেই তার দেখা মেলে। আমি যে দুটো বাংলা উচ্চারণ অভিধান দেখেছি, তা বাংলাদেশেই রচিত ও মুদ্রিত [আনিসুজ্জামান, ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী ও নরেন বিশ্বাস সম্পাদিত ব্যবহারিক বাংলা উচ্চারণ অভিধান (জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট) এবং নরেন বিশ্বাস রচিত বাঙলা উচ্চারণ অভিধান (বাংলা একাডেমী)]।
আর সব ভাষার মতো বাংলা ভাষারও অনেকগুলো আঞ্চলিক রূপ আছে। অনেকেই হয়তো বলবে, আঞ্চলিক বাংলা উচ্চারণে দোষটা কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার। আঞ্চলিক উচ্চারণে কোনো দোষ নেই, সে উচ্চারণ নিয়ে কোনো হীনম্মন্যতারও অবকাশ নেই। বরং বলা যেতে পারে আঞ্চলিক বাংলার রূপভেদ আমাদের বাংলায় এনেছে বৈচিত্র্য। এই রূপভেদ ব্যতিরেকে ভাষা একঘেয়ে হয়ে উঠত। প্রমিত বাংলা উচ্চারণ আঞ্চলিক বাংলার তুলনায় উচ্চতর নয়, ভিন্নতর।
তবু আদর্শ বাংলা বাচন শুধু ভিন্নই নয়। সে বাচন বাঙালিকে জাতি হিসেবে ‘বন্ধনহীন গ্রন্থি’তে বেঁধে রেখেছে। তাই তো কার্যক্ষেত্রে প্রায়ই দেখি, বাংলার এক আঞ্চলের শিক্ষিত মানুষ অন্য কোনো অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তার নিজস্ব আঞ্চলিক উচ্চারণ বা টান বর্জন করার চেষ্টা করে থাকে। কেউ কেউ প্রায় অবচেতন মনে প্রমিত উচ্চারণের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে।
তবে সাধারণত সে চেষ্টা অতি অপ্রতুল। এর উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। অশুদ্ধ বাংলা বাচনের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে। আমাদের জাতীয় সংসদ অধিবেশন অশুদ্ধ, অপ্রমিত বাংলা উচ্চারণের একটি সম্মিলিত প্রদর্শনী বললে অত্যুক্তি করা হবে না। যাঁরা আমার এই মন্তব্যে আপত্তি করছেন, তাঁদের আমি সংসদের যেকোনো অধিবেশনে সাংসদদের বক্তব্য শুনতে আহ্বান করি। কোনো সাংসদ যখন জাতীয় সংসদে বক্তব্য দেন, তিনি তা তাঁর নির্বাচনী এলাকাবাসীর উদ্দেশে দেন না। সমগ্র জাতিই শুনছে তাঁর কথা। প্রমিত বাংলা হলো সেই জাতির সামগ্রিক সত্তার প্রতীক। সেই বাংলাই প্রত্যেক সাংসদের আদর্শ হওয়া উচিত। সরকারের মন্ত্রীদের অনেকেই ভালো বাংলা বলতে সক্ষম নন। কদিন আগে এক মন্ত্রী মহোদয়কে ‘মসজিদ’ শব্দটিকে ‘মরজিত’ উচ্চারণ করতে শুনলাম। অধিকাংশ সরকারি আমলা ভালো বাংলা বলতে পারেন না। তাঁরা তাঁদের আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলেন, অথচ কার্য উপলক্ষে যাঁদের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেন, তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের অঞ্চলের মানুষ নন।
বাংলা বাচনে সবাই আমাদের ছাত্রজীবনের অজিত গুহ বা মুনীর চৌধুরী হবেন, তা আশা করা উচিত নয়। তবে শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণের ক্ষেত্রে বাঙালিকে অবশ্যই সচেতন পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের সমাজে মুষ্টিমেয় শিক্ষিত বাঙালি ভালো বাংলা বলেন। রেডিও ও টেলিভিশনে যাঁরা সংবাদ পরিবেশন করেন, তাঁদের অনেকেরই বাংলা উচ্চারণ প্রশংসার যোগ্য। জাতীয় জীবনের সর্বত্র এমন বা তার চেয়েও ভালো বাংলা শুনতে চাই। ফেব্রুয়ারি মাসে এর চেয়ে ভালো চাওয়া আর কী হতে পারে?
সুললিত সংগীতের মতো শুদ্ধ কথ্য বাংলা বাঙালির একটি শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সংগীতের মতো শুদ্ধ বাংলা বচনও সাধনার ধন। বহুকাল আগে, সেই ১৯৪৯-৫০ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকা কালে শুনেছিলাম এই সাধনার কথা। আমাদের বাংলার অধ্যাপক হেশামুদ্দিন সাহেবের ক্লাস চলছে। পাঠ্য বিষয়বস্তু ছেড়ে হঠার‌্যা তিনি বলে উঠলেন, ‘জানো, আমি একটা সাধনা করছি।’ ব্যাখ্যা করেন শিক্ষক। তাঁর বাড়ি বরিশাল। ছেলেবেলা থেকে তাঁর বাংলায় বরিশাল অঞ্চলের টান। সেই টান থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ বাংলা আয়ত্ত করার সাধনার কথা বলছিলেন বাংলার অধ্যাপক। জোর দিয়েছিলেন ‘সাধনা’ শব্দটির ওপর।
আজও প্রয়োজন সেই সাধনার।
 মাহফুজুর রহমান: জাতিসংঘের সাবেক অর্থনীতিবিদ, গ্রন্থকার, প্রাবন্ধিক।

No comments

Powered by Blogger.