দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়

বর্তমান ব্যবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠুভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তবে কিছু শর্ত মানলে তা সম্ভব। এ মন্তব্য করেছেন বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ টি এম শামসুল হুদা। সিইসি ও দুই কমিশনারের বিদায় উপলক্ষে গতকাল শনিবার দুপুরে আগারগাঁওয়ের জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল মিলনায়তনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শামসুল হুদা এ কথা বলেন।


সিইসি বলেন, ‘কতিপয় লোক নির্বাচন সুষ্ঠু করতে চান। কিন্তু বেশির ভাগ লোক তা ভণ্ডুল করতে চান। শুভ আর অশুভর দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে গেলে দলের লোকজন ঝামেলা করবে। তবে আল্লাহর দুনিয়ায় কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। এ জন্য কিছু শর্ত মানতে হবে। এক দিনে না করে কয়েক ধাপে মাসব্যাপী নির্বাচন করতে পারলে ভোট সুষ্ঠু হবে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের সুযোগও থাকতে হবে।’
সিইসির বক্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিইসি যথার্থ বলেছেন। শর্ত সাপেক্ষে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। আমি আগেও বলেছি, তত্ত্বাবধায়কের বিকল্প হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি রূপরেখা তৈরি করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সেটিকে আইনে পরিণত করা সম্ভব।’
একই বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিইসি আগে বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এখন বলছেন শর্ত সাপেক্ষে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে। মূলত সরকারকে খুশি করতে কথা বলতে হয় বলে তিনি একেক সময় একেক কথা বলছেন। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। এই কমিশন ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশে বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য যা যা করার প্রয়োজন ছিল, তার সবই করেছে।’
নির্বাচনী আইন সংস্কার প্রস্তাবে সিইসি সরকারের চারটি বিভাগকে নির্বাচন চলাকালে ইসির পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার কথা বলেন। বিভাগগুলো হচ্ছে মন্ত্রিসভা, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
শামসুল হুদা ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে গতকাল বলেন, ‘প্রায় নির্ভুল একটি ভোটার তালিকা বর্তমান কমিশনের বিরাট অর্জন। এই আমানত রক্ষার দায়িত্ব ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের। আমি বিশ্বাস করি, পরিশ্রম ও আল্লাহর রহমতে এত কাজ করে যেতে পারলাম। আমরা যে অর্জনগুলো রেখে যাচ্ছি, আল্লাহর ওয়াস্তে তা দেখভাল করে রাখবেন।’
সিইসি আরও বলেন, এ কমিশনের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে, তা নিয়ে বড় ধরনের কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। সুতরাং কমিশনের এই অর্জন ধরে রাখতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে কমিশনের কাজ। তাই সব ধরনের কাজে দলগুলোর পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে। স্বাধীন হয়ে গেছি ভেবে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে মহা বিপদে পড়তে হবে।
মেয়াদের শেষের দিকের কয়েকটি নির্বাচন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে করতে হয়েছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, এসব নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার পেছনে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
সিইসির এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, সিইসি অভিজ্ঞতা থেকে কথা বলেছেন। তাই তাঁর কথায় যুক্তি আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে যে সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সে সরকারের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকা কঠিন। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী তারা দলীয় স্বার্থে কাজ করবে।
তবে সিইসির বক্তব্য সম্পর্কে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, সে বিষয়ে সিইসির সঙ্গে আমি একমত। তবে তিনি চারটি মন্ত্রণালয়ের ওপর কমিশনের কর্তৃত্ব বাড়ানোর যে সুপারিশ করেছেন, সেটা অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক। কমিশনের কাজ নির্বাচন করা, সেটা সংবিধানে বলা আছে। নির্বাহী বিভাগের ওপর তাদের কর্তৃত্ব সংবিধান অনুমোদন করে না।’
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, ‘বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনটি কারণে দেশ অস্থির ছিল। প্রথমত, ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকা; দ্বিতীয়ত, কালোটাকার ব্যবহার; তৃতীয়ত, পেশিশক্তির প্রয়োগ। আমরা এই তিনটি সমস্যা দূর করার চেষ্টা করেছি। যে কারণে সংসদ নির্বাচনসহ পরের সব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’
অপর কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বর্তমান কমিশন যা করেছে, তাতে ভবিষ্যতে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা অসম্ভব হবে না। জোর করে ভোট দেওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে।
ইসি সচিবালয়ের সচিব মোহাম্মদ সাদিকের সভাপতিত্বে ‘পঞ্চবার্ষিক কৌশলগত পরিকল্পনা ও দ্বিবার্ষিক কর্মপরিকল্পনায় বিদায়ী ইসির দিকনির্দেশনা’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে আঞ্চলিক, জেলা ও কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ইসি গঠনের প্রক্রিয়া: সিইসি শাসমুল হুদা ও কমিশনার ছহুল হোসাইনের পাঁচ বছরের মেয়াদ আজ রোববার শেষ হচ্ছে। অপর কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনের মেয়াদ শেষ হবে ১৪ ফেব্রুয়ারি।
এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনে ২৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে রাষ্ট্রপতি একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছেন। কমিটি দলগুলোর কাছে যোগ্য ব্যক্তিদের নামের তালিকা চেয়েছে। আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জাতীয় পার্টি (জেপি), গণতন্ত্রী পার্টি ও তরিকত ফেডারেশন নামের তালিকা দিয়েছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ অন্য ১৭টি দল তালিকা দেয়নি।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, অনুসন্ধান কমিটি ৭ ফেব্রুয়ারি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে প্রতিটি পদের জন্য দুজনের নাম সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে।

No comments

Powered by Blogger.