চরাচর-তাঁতিদের একাল-সেকাল by আজিজুর রহমান

বাংলার তাঁতিদের উৎপাদিত সুনিপুণ সৃষ্টিশীল বস্ত্র একসময় বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং তা সুপ্রাচীনকাল থেকে শুরু করে মধ্যযুগের শেষ ১৮ শতক পর্যন্ত বিশ্বের বস্ত্র-বাণিজ্য একচেটিয়া দখলে রাখে। বাংলার বস্ত্রের অসাধারণ বুনন, সৌন্দর্য, রঙের শৈল্পিক ব্যবহার, কারুকাজ, নমনীয়তা ও স্থায়িত্বের বিবেচনায় তা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।


চিরায়ত বাংলার রূপ-মাধুর্য আর নান্দনিক সৌকর্যের সমন্বয়ে অপূর্ব সৃষ্টি এই তাঁতবস্ত্র শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্বকে সম্মোহিত করে রেখেছিল। বাংলার তাঁতশিল্পের বস্ত্র আজও বিদেশে এবং দেশের ঘরে ঘরে বিপুলভাবে জনপ্রিয়। এলাকাভিত্তিক তাঁতিদের উৎপাদিত বিপুল চাহিদাসম্পন্ন কাপড় হচ্ছে-টাঙ্গাইল : সুতি, সিল্ক, হাফ সিল্ক, রোসিল্ক ও শাড়ি। বিভিন্ন ধরনের শাড়ি থানসহ উন্নতমানের কাপড় কোটেজ পদ্ধতিতে এখানে উৎপাদিত হয়। পাবনা : সাধারণ কাপড় ছোট ছোট কারখানায় তৈরি হয়। এর উৎপাদনের হার টাঙ্গাইলের তুলনায় অনেক বেশি। পাবনায় বেশির ভাগ চিত্তরঞ্জন হুক জ্যাকার্ড ও খটখটি তাঁত ব্যবহার করা হয়। পাবনা ও টাঙ্গাইল জেলা দুটি পাশাপাশি হলেও কাপড়ের শৈল্পিক গুণ আর শাড়ি দুই ঘরানার। চাঁপাইনবাবগঞ্জ : এ জেলা হচ্ছে শিল্পের আদি নিবাস। এখানে বর্তমানে সিল্কের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। আমদানি করা এবং স্থায়ীভাবে উৎপাদিত সুতা দিয়ে মাত্র কয়েক হাজার তাঁত উৎপাদনে রয়েছে। রাজশাহী : এখানে মূলত শাড়ি গ্রে, পাঞ্জাবির কাপড়, শার্টিং ইত্যাদি তৈরি হয়। তাঁতের ওপর নির্ভর করে কয়েক হাজার ছাপাখানা এখানে চালু রয়েছে। খটখটি ও ডগির লস্কর তাঁত রাজশাহীতে বেশি ব্যবহার হয়। নারায়ণগঞ্জ : রূপগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, তারাবো, রূপসী, দক্ষিণ রূপসী, সোনারগাঁ এবং ঢাকার ডেমরার তাঁতিরা উৎপাদন করেন বিশ্বখ্যাত জামদানি। নরসিংদী : এখানকার তাঁতিরা শাড়ি, লুঙ্গি, শার্টিং, বিছানার চাদরসহ সব ধরনের প্রচলিত কাপড় তৈরি করেন। জনপ্রিয় চেক কাপড় তৈরি হয় নরসিংদী ও পাবনায়। সিরাজগঞ্জ : এখানে শাড়ি, লুঙ্গিসহ সব ধরনের কাপড় তৈরি হয়। কুমিল্লা : এ জেলার মুরাদনগর ও চান্দিনায় তৈরি হয় বিখ্যাত খাদি কাপড়। পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে তৈরি হয় উপজাতিদের নিজস্ব ঘরানার কাপড়। সিলেট ও পার্বত্য জেলার তাঁতিরা সাধারণত কোমর তাঁত ব্যবহার করেন। এলাকাভিত্তিক তাঁতিদের বুনন পদ্ধতির সঙ্গে তৈরি কাপড়েরও ভিন্নতা রয়েছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মেধা, দক্ষতা আর শ্রম দিয়ে তাঁতিরা তাঁদের পেশা তথা ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প হাজার বছর ধরে বাঁচিয়ে রেখেছেন। উৎপাদন চালু রেখে দেশের বস্ত্র অর্থনীতিতে শক্তি জোগাচ্ছেন। সেই সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতি লালনে তাঁতিদের বস্ত্রশিল্পের গুরুত্ব ও অবদান অপরিসীম।
আজিজুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.