কালান্তরের কড়চা-এ বছর সবাইকে ঈদ মোবারক জানানোর সঙ্গে সবার জন্যই পড়েছি 'ফি আমানিল্লাহ্' by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
সামনে ঈদ। রমজানের ঈদ। কিছুদিনের জন্য ঢাকা শহর প্রায় শূন্য হয়ে যাবে। নারী-পুরুষ-শিশু সবাই ছুটবে তাদের গ্রাম বা মফস্বল শহরের বাড়ির দিকে। বাস-ট্রেন থেকে শুরু করে স্থলপথের কোনো যানবাহনে এবং নদীপথে স্টিমার, লঞ্চ, যাত্রীবাহী গয়নার নৌকায় তিলধারণের স্থান থাকবে না।
রাস্তাঘাট, নৌপথের বেহাল অবস্থায় এবং সৈয়দ আবুল হোসেন এবং শাজাহান খান এখনো মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকায় এ বছরও যান দুর্ঘটনা এড়াতে না পেরে কতজন যাত্রী প্রাণ নিয়ে বাড়িতে পেঁৗছতে পারবেন না এবং কতজন ঢাকায় ফিরে আসতে সক্ষম হবেন না, তা শুধু আল্লাহ তায়ালা জানেন। আমি শুধু সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা জানাই, যাঁরা এই ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাচ্ছেন, তাঁরা যেন সবাই নিরাপদে যান এবং নিরাপদে ঢাকায় ফিরে আসেন। হে আল্লাহ, আর যেন আবুল হোসেনের ভাঙা রাস্তায় মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনায় এবং শাজাহান খানের নিযুক্ত গাড়ি চালনায় অদক্ষ ড্রাইভার বা লঞ্চচালকের অযোগ্যতায় ও ভুলে লঞ্চডুবিতে নারী-পুরুষ-শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর শুনতে না হয়। আমার পাঠকরাও যেন নিরাপদে বাড়ি যান এবং নিরাপদে ঢাকায় ফিরে আসেন। তাঁদের সবার জন্য রইল আমার ঈদ মোবারক এবং সবার জন্যই পাঠ করছি 'ফি আমানিল্লাহ্'।
জানি না, আল্লাহ আমার মোনাজাত কবুল করবেন কি না! আমার বিশ্বাস, করবেন। দৈবদুর্ঘটনা ছাড়া তিনি আর মন্ত্রীদের দায়িত্বহীনতা ও অযোগ্যতায় এবার অসহায় মানুষকে প্রাণ হারাতে দেবেন না। কোনো কোনো সময় বাংলাদেশে একেকটি দুর্ঘটনায় গোটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার খবর হচ্ছে। বুকের ভেতর আত্মীয়বিয়োগের শোক গুমরে ওঠে। মনে মনে ভাবি, এই শোক, এই ব্যথা কি মন্ত্রীদের বুকে বাজে না? তাঁদের কি হৃদয় নেই? কী করে দুই মন্ত্রী ১৩ আগস্টের এত বড় মর্মান্তিক ঘটনার পর নিজেদের সাফাই গাইতে পারেন? একবার বৃষ্টির ওপর, একবার গাড়ির নিহত ড্রাইভারের ওপর, একবার অর্থমন্ত্রীর ওপর দোষ চাপাতে পারেন? এখনো চরম বেহায়ার মতো মন্ত্রীপদ আঁকড়ে থাকতে পারেন?
এখন তো জানা গেছে, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের নিহত হওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত বাসচালক মো. জামির হোসেনের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। এ সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা বিভাগের আশরাফুল আলম জানিয়েছেন, জামির হোসেনের ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কুষ্টিয়া বিআরটিএ অফিসে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে 'না' সূচক উত্তর পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বাসচালক জামির ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে কুষ্টিয়া বিআরটিএ অফিস থেকে দুই বছর মেয়াদের ভারী যানবাহন চালনার লাইসেন্স গ্রহণ করে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর সে পুলিশকে বলেছে, ওই লাইসেন্স নবায়নের জন্য কুষ্টিয়া অফিসে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তদন্তে দেখা গেছে, তার দেওয়া লাইসেন্স জমা দেওয়ার রসিদটিও ভুয়া।
এই তথ্যটি জানার পর শিহরিত হয়ে ভাবছি, এ রকম কত মানুষ হত্যার লাইসেন্স বাংলাদেশে বিএনপি ও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইস্যু করা হয়েছে এবং জামির হোসেনের মতো কত শত গাড়িচালকের হাতে রয়েছে ভুয়া অথবা ঘুষ দিয়ে পাওয়া লাইসেন্স? বিভাগীয় মন্ত্রী কি এ সম্পর্কে দায়িত্ব এড়াতে পারেন? যদি না পারেন, তাহলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পরিষ্কারভাবে জড়িত থাকার অথবা প্রশ্রয় দেওয়ার অপরাধে কি মন্ত্রী থেকে শুরু করে লাইসেন্স প্রদানকারী বিভাগীয় সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি সংশ্লিষ্ট শ্রমিকসংগঠনের এক শ্রেণীর নেতারও বিচার হওয়া উচিত নয়?
বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই বিচার হওয়া দূরের কথা, যোগাযোগ ও নৌপরিবহনের যে দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে, তাঁদের অপসারণেও প্রধানমন্ত্রী অনিচ্ছুক। উল্টো তিনি তাঁদের ভালো কাজের সার্টিফিকেট দিয়েছেন এবং যাঁরা মন্ত্রীদের সমালোচনা করেন তাঁরা শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন। একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে শুধু দায়িত্বশীল সরকার বলা হয় না, জবাবদিহিতার সরকারও বলা হয়। রেসপনসিবল এবং রেসপনসিভ_এ দুটো কথাই গণতান্ত্রিক সরকারের অভিধা। এ ব্যবস্থায় সমালোচনা সরকারকে সহ্য করতেই হবে। ভোটদাতারা বিক্ষুব্ধ হলে তাদের কাছে জবাবদিহিতা করতেই হবে। তা না করে উষ্মা প্রকাশ করা, সমালোচনাকারীদের ধমক মেরে ঠাণ্ডা করতে গেলে সরকারের গণতান্ত্রিক চরিত্র আর থাকে না।
দেশে যানদুর্ঘটনার এই হিড়িক এবং দুর্ঘটনায় প্রায় প্রত্যহ নিহত ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজনের শোক ও দেশবাসীর মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কথা জেনেও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন তাঁর অভিযুক্ত এবং অদক্ষ মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চান না, তখন অসহায় মানুষ কার কাছে বিচার চেয়ে গিয়ে দাঁড়াবে? একমাত্র আল্লাহ ছাড়া বাংলার মানুষের এখন আর কে আছে? সরকার জনগণের দাবি ও অভিযোগে কান না দিলে তারা বিরোধী দলের দিকে তাকায়। বাংলাদেশে প্রকৃত বিরোধী দল আছে কি? যে দলটি আছে, তারা তো দলনেত্রীর দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত দুই পুত্রকে রক্ষা করা এবং '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য ইস্যু তৈরি করে সেই ইস্যুতে মাঠে নামা ছাড়া দেশের মানুষের কোনো সমস্যায় আন্দোলনে নামতে বা আন্দোলন গড়ে তুলতে রাজি নয়।
এবার দুই অযোগ্য মন্ত্রীর দায়িত্বহীন উক্তি, দায়িত্বহীন কাজকারবার এবং সড়ক ও নদীপথের প্রায় প্রাত্যহিক দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যুকে ইস্যু করে বিএনপি সারা দেশে শান্তিপূর্ণ ও অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলতে পারত এবং জনগণকে পাশে পেত। বিএনপি সে আন্দোলনে যায়নি এবং যাবে না। এবার রমজানের পর তারা আন্দোলনে যাবে বলে তর্জন-গর্জন করছে। কিন্তু ইস্যু কী হবে? সেই তারেক-কোকো উদ্ধার এবং নিজামী-সাঈদীদের যুদ্ধাপরাধের বিচার থেকে মুক্ত করার ইস্যুটাই হবে মুখ্য। সেই সঙ্গে লোক দেখানোভাবে জনগণের দু-একটি দাবি জুড়ে দেওয়া হবে। তাতে আন্দোলন হবে কি? আন্দোলনের নামে রাজপথে কিছু দোকানপাট, গাড়ি ভাঙচুর এবং জনগণের জীবনে দুর্ভোগ বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমার ধারণা, বিএনপি এবার এ ধরনের আন্দোলনে নামলে জনগণই তাদের তাড়া করবে।
সড়ক দুর্ঘটনা, নৌ দুর্ঘটনা সব দেশেই হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যা হয় তা তো দুর্ঘটনা নয়, তা হচ্ছে সড়কে ও নৌপথে অবাধ হত্যা। আর যে দেশে পরীক্ষা ছাড়া এক লাখ ৮৯ হাজার অদক্ষ গাড়িচালককে দেওয়া হয় ড্রাইভিং লাইসেন্স, সে দেশ মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হওয়া ছাড়া আর কী হতে পারে? এই ঘাতক গাড়িচালকরা দুর্ঘটনা ঘটানোর তিন মাসের মধ্যে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। তার লাইসেন্স বাতিল করা হয় না। সে আবারও শুরু করে বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং হত্যাকাণ্ড। তা ছাড়া অধিকাংশ বাস-লরি-ট্রাকের অবস্থা রাস্তায় চলাচলের উপযোগী নয়। তা যান্ত্রিক ত্রুটিপূর্ণ। এগুলো অবাধে ভাঙা রাস্তায় চলাচল করে। পুলিশ কিছুই করতে পারে না। অভিযোগ, এসব গাড়ির মালিকরা অধিকাংশই হয় সরকারি দলের কেউকেটা, এমনকি মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যও।
এই অবস্থার প্রতিকার করবে কে? আওয়ামী লীগ? বিএনপি? নৈবচ নৈবচ! আমার একটা আশা ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মাতৃহৃদয় আছে, তা আবার দায়িত্ব সচেতন ও কর্তব্যে কঠোর। ১৩ আগস্টের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর তিনি গত দুই-আড়াই বছরের দায়িত্বহীনতা, অযোগ্যতা এবং দায়িত্বহীন কথাবার্তার জন্য অন্তত যোগাযোগ ও নৌ পরিবহন মন্ত্রীদের পদত্যাগের নির্দেশ দেবেন এবং এই দুই মন্ত্রীর পদে দুইজন যোগ্য মন্ত্রী বসিয়ে এই ঈদের আগে ঢাকা থেকে যে লাখ লাখ নর-নারী ছুটি কাটাতে বাড়ি ছুটবেন, তাঁদের মনে এই আস্থাটুকু অন্তত ফিরিয়ে আনবেন যে সরকার তাঁদের মৃত্যু সম্পর্কে উদাসীন নয়। তারা কিছু একটা করার উদ্যোগ নিয়েছে।
এ কথা সত্য, বাংলাদেশে সড়ক ও নৌ পরিবহনের এখন যা অবস্থা, তাতে কেবল মন্ত্রী বদল করে রাতারাতি অবস্থার উন্নতি ঘটানো যাবে না। কিন্তু এই মন্ত্রী বদল দরকার অবস্থার রাতারাতি উন্নতি ঘটানোর জন্য নয়, অবিলম্বে মন্ত্রী বদল দরকার হতাশ, ভীত ও ক্ষুব্ধ মানুষের মধ্যে সড়ক ও নৌপথে চলাচলে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য। এই আস্থা ফেরানোর পরই দ্রুত যোগ্য মন্ত্রীদের পরিচালনায় যোগাযোগব্যবস্থার বর্তমান ত্রুটিগুলো দূর করার লক্ষ্যযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহতদের পরিবারের মনে সান্ত্বনা এবং দেশের মানুষের মনে আস্থা ও সাহস সৃষ্টির জন্য এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতেন। তাঁর কোনো কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অযোগ্যতা ও দায়িত্বহীনতার অভিযোগ যে তাঁর মন্ত্রিসভার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ নয়_এ কথাটা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝতে হবে। তিনি বলেছেন, মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটানো একটি রুটিন ওয়ার্ক। এটি মোটেই রুটিন ওয়ার্ক বা প্রথাগত কাজ নয়। এটি একটি নেসেসিটি বা প্রয়োজন। মোটর গাড়ির কোনো একটি পার্টস অকেজো হয়ে গেলে যেমন পাল্টাতে হয়, তেমনি মন্ত্রিসভারও কোনো একটি অংশ অকেজো বা অযোগ্য প্রমাণিত হলে তা সঙ্গে সঙ্গে বর্জন করতে হয়। এটা চার্চিল থেকে বঙ্গবন্ধু_সবাই করেছেন, সব গণতান্ত্রিক দেশেই এখনো করা হচ্ছে। না করা হলে অযোগ্যদের সংস্পর্শে যোগ্যরাও যোগ্যতা হারাতে শুরু করেন।
অযোগ্য ও বাকসর্বস্ব মন্ত্রীদের অপসারণের গণদাবিতে যদি প্রধানমন্ত্রী কান না দেন, বিরোধী দল যদি এটিকে প্রধান ইস্যু করে আন্দোলনে নামতে না চায়, ক্যাথেরিন মাসুদ আর মঞ্জুলী কাজীর অকাল বৈধব্য যদি ক্ষমতাসীনদের কারো মনেই হাহাকার না জাগায়, তাহলে জনগণের শোক ও ক্ষোভ তো আর বাষ্প হয়ে উড়ে যেতে পারে না, তার ছোট-বড় একটা প্রকাশ ঘটবেই। কেউ না কেউ প্রতিবাদ জানাবেই। সম্ভবত তারই প্রমাণ সৈয়দ আবুল মকসুদ, এক রাজনৈতিক কলামিস্টের ঢাকায় শহীদ মিনারে ঈদের দিন জনসমাবেশ ডাকা। তাঁর আসল উদ্দেশ্যটি কী আমার জানা নেই। উদ্দেশ্য শুভ হলে, বর্তমান অবস্থায় প্রতিকার দাবি করা হলে আমি তাঁকে সমর্থন জানাই।
মকসুদ সাহেবের ডাকে শহীদ মিনারে কত লোক আসবে তা আমি জানি না। কিন্তু মাত্র একজন বা কয়েকজন মানুষের এই উদ্যোগেই সরকার মনে হয় ভয় পেয়ে গেছে। একজন মন্ত্রী অথবা প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, 'গেরুয়া কাপড় পরিধান করলেই আন্না হাজারে হওয়া যায় না।' সৈয়দ আবুল মকসুদ যে ধরনের কাপড় পরেন, তা নিয়েই মন্ত্রীর এই কটাক্ষ। এটা কটাক্ষ নয়, মনের আসল ভয়, যদি এই সাধারণ মানুষটিই আন্না হাজারের মতো হয়ে ওঠেন!
যদি সরকার গণদাবি মানতে অনীহা দেখায়, বিরোধী দল প্রকৃত গণদাবি নিয়ে আন্দোলনে নামতে ব্যর্থ হয় এবং ব্যর্থ মন্ত্রীরা জনগণের কাঁধে দিনের পর দিন সিন্দবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসে থাকেন, তাহলে মানুষের মনের শোক, ক্ষোভ ও অসন্তোষ একদিন পুঞ্জীভূত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাবেই। সে জন্য একজন আন্না হাজারের দরকার হবে না। সৈয়দ আবুল মকসুদের উদ্যোগ একটি সামান্য স্ফুলিঙ্গ হতে পারে, কিন্তু স্ফুলিঙ্গ থেকেই অনেক সময় দাবানল তৈরি হয়। আমি বর্তমান সরকারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বলেই এই আগাম হুঁশিয়ারি তাদের জানিয়ে রাখলাম। আমি আবারও সবাইকে জানাচ্ছি ঈদ মোবারক। সেই সঙ্গে সবার জন্যই পড়ছি 'ফি আমানিল্লাহ্'।
লন্ডন, ২৯ আগস্ট, সোমবার, ২০১১
« পূর্ববর্তী সংবাদ
পরবর্তী সংবাদ »
এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনার মতামত দিতে এখানে ক্লি
জানি না, আল্লাহ আমার মোনাজাত কবুল করবেন কি না! আমার বিশ্বাস, করবেন। দৈবদুর্ঘটনা ছাড়া তিনি আর মন্ত্রীদের দায়িত্বহীনতা ও অযোগ্যতায় এবার অসহায় মানুষকে প্রাণ হারাতে দেবেন না। কোনো কোনো সময় বাংলাদেশে একেকটি দুর্ঘটনায় গোটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার খবর হচ্ছে। বুকের ভেতর আত্মীয়বিয়োগের শোক গুমরে ওঠে। মনে মনে ভাবি, এই শোক, এই ব্যথা কি মন্ত্রীদের বুকে বাজে না? তাঁদের কি হৃদয় নেই? কী করে দুই মন্ত্রী ১৩ আগস্টের এত বড় মর্মান্তিক ঘটনার পর নিজেদের সাফাই গাইতে পারেন? একবার বৃষ্টির ওপর, একবার গাড়ির নিহত ড্রাইভারের ওপর, একবার অর্থমন্ত্রীর ওপর দোষ চাপাতে পারেন? এখনো চরম বেহায়ার মতো মন্ত্রীপদ আঁকড়ে থাকতে পারেন?
এখন তো জানা গেছে, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের নিহত হওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত বাসচালক মো. জামির হোসেনের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। এ সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা বিভাগের আশরাফুল আলম জানিয়েছেন, জামির হোসেনের ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কুষ্টিয়া বিআরটিএ অফিসে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে 'না' সূচক উত্তর পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বাসচালক জামির ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে কুষ্টিয়া বিআরটিএ অফিস থেকে দুই বছর মেয়াদের ভারী যানবাহন চালনার লাইসেন্স গ্রহণ করে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর সে পুলিশকে বলেছে, ওই লাইসেন্স নবায়নের জন্য কুষ্টিয়া অফিসে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তদন্তে দেখা গেছে, তার দেওয়া লাইসেন্স জমা দেওয়ার রসিদটিও ভুয়া।
এই তথ্যটি জানার পর শিহরিত হয়ে ভাবছি, এ রকম কত মানুষ হত্যার লাইসেন্স বাংলাদেশে বিএনপি ও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইস্যু করা হয়েছে এবং জামির হোসেনের মতো কত শত গাড়িচালকের হাতে রয়েছে ভুয়া অথবা ঘুষ দিয়ে পাওয়া লাইসেন্স? বিভাগীয় মন্ত্রী কি এ সম্পর্কে দায়িত্ব এড়াতে পারেন? যদি না পারেন, তাহলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পরিষ্কারভাবে জড়িত থাকার অথবা প্রশ্রয় দেওয়ার অপরাধে কি মন্ত্রী থেকে শুরু করে লাইসেন্স প্রদানকারী বিভাগীয় সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি সংশ্লিষ্ট শ্রমিকসংগঠনের এক শ্রেণীর নেতারও বিচার হওয়া উচিত নয়?
বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই বিচার হওয়া দূরের কথা, যোগাযোগ ও নৌপরিবহনের যে দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে, তাঁদের অপসারণেও প্রধানমন্ত্রী অনিচ্ছুক। উল্টো তিনি তাঁদের ভালো কাজের সার্টিফিকেট দিয়েছেন এবং যাঁরা মন্ত্রীদের সমালোচনা করেন তাঁরা শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন। একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে শুধু দায়িত্বশীল সরকার বলা হয় না, জবাবদিহিতার সরকারও বলা হয়। রেসপনসিবল এবং রেসপনসিভ_এ দুটো কথাই গণতান্ত্রিক সরকারের অভিধা। এ ব্যবস্থায় সমালোচনা সরকারকে সহ্য করতেই হবে। ভোটদাতারা বিক্ষুব্ধ হলে তাদের কাছে জবাবদিহিতা করতেই হবে। তা না করে উষ্মা প্রকাশ করা, সমালোচনাকারীদের ধমক মেরে ঠাণ্ডা করতে গেলে সরকারের গণতান্ত্রিক চরিত্র আর থাকে না।
দেশে যানদুর্ঘটনার এই হিড়িক এবং দুর্ঘটনায় প্রায় প্রত্যহ নিহত ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজনের শোক ও দেশবাসীর মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কথা জেনেও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন তাঁর অভিযুক্ত এবং অদক্ষ মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চান না, তখন অসহায় মানুষ কার কাছে বিচার চেয়ে গিয়ে দাঁড়াবে? একমাত্র আল্লাহ ছাড়া বাংলার মানুষের এখন আর কে আছে? সরকার জনগণের দাবি ও অভিযোগে কান না দিলে তারা বিরোধী দলের দিকে তাকায়। বাংলাদেশে প্রকৃত বিরোধী দল আছে কি? যে দলটি আছে, তারা তো দলনেত্রীর দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত দুই পুত্রকে রক্ষা করা এবং '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য ইস্যু তৈরি করে সেই ইস্যুতে মাঠে নামা ছাড়া দেশের মানুষের কোনো সমস্যায় আন্দোলনে নামতে বা আন্দোলন গড়ে তুলতে রাজি নয়।
এবার দুই অযোগ্য মন্ত্রীর দায়িত্বহীন উক্তি, দায়িত্বহীন কাজকারবার এবং সড়ক ও নদীপথের প্রায় প্রাত্যহিক দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যুকে ইস্যু করে বিএনপি সারা দেশে শান্তিপূর্ণ ও অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলতে পারত এবং জনগণকে পাশে পেত। বিএনপি সে আন্দোলনে যায়নি এবং যাবে না। এবার রমজানের পর তারা আন্দোলনে যাবে বলে তর্জন-গর্জন করছে। কিন্তু ইস্যু কী হবে? সেই তারেক-কোকো উদ্ধার এবং নিজামী-সাঈদীদের যুদ্ধাপরাধের বিচার থেকে মুক্ত করার ইস্যুটাই হবে মুখ্য। সেই সঙ্গে লোক দেখানোভাবে জনগণের দু-একটি দাবি জুড়ে দেওয়া হবে। তাতে আন্দোলন হবে কি? আন্দোলনের নামে রাজপথে কিছু দোকানপাট, গাড়ি ভাঙচুর এবং জনগণের জীবনে দুর্ভোগ বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমার ধারণা, বিএনপি এবার এ ধরনের আন্দোলনে নামলে জনগণই তাদের তাড়া করবে।
সড়ক দুর্ঘটনা, নৌ দুর্ঘটনা সব দেশেই হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যা হয় তা তো দুর্ঘটনা নয়, তা হচ্ছে সড়কে ও নৌপথে অবাধ হত্যা। আর যে দেশে পরীক্ষা ছাড়া এক লাখ ৮৯ হাজার অদক্ষ গাড়িচালককে দেওয়া হয় ড্রাইভিং লাইসেন্স, সে দেশ মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হওয়া ছাড়া আর কী হতে পারে? এই ঘাতক গাড়িচালকরা দুর্ঘটনা ঘটানোর তিন মাসের মধ্যে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। তার লাইসেন্স বাতিল করা হয় না। সে আবারও শুরু করে বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং হত্যাকাণ্ড। তা ছাড়া অধিকাংশ বাস-লরি-ট্রাকের অবস্থা রাস্তায় চলাচলের উপযোগী নয়। তা যান্ত্রিক ত্রুটিপূর্ণ। এগুলো অবাধে ভাঙা রাস্তায় চলাচল করে। পুলিশ কিছুই করতে পারে না। অভিযোগ, এসব গাড়ির মালিকরা অধিকাংশই হয় সরকারি দলের কেউকেটা, এমনকি মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যও।
এই অবস্থার প্রতিকার করবে কে? আওয়ামী লীগ? বিএনপি? নৈবচ নৈবচ! আমার একটা আশা ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মাতৃহৃদয় আছে, তা আবার দায়িত্ব সচেতন ও কর্তব্যে কঠোর। ১৩ আগস্টের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর তিনি গত দুই-আড়াই বছরের দায়িত্বহীনতা, অযোগ্যতা এবং দায়িত্বহীন কথাবার্তার জন্য অন্তত যোগাযোগ ও নৌ পরিবহন মন্ত্রীদের পদত্যাগের নির্দেশ দেবেন এবং এই দুই মন্ত্রীর পদে দুইজন যোগ্য মন্ত্রী বসিয়ে এই ঈদের আগে ঢাকা থেকে যে লাখ লাখ নর-নারী ছুটি কাটাতে বাড়ি ছুটবেন, তাঁদের মনে এই আস্থাটুকু অন্তত ফিরিয়ে আনবেন যে সরকার তাঁদের মৃত্যু সম্পর্কে উদাসীন নয়। তারা কিছু একটা করার উদ্যোগ নিয়েছে।
এ কথা সত্য, বাংলাদেশে সড়ক ও নৌ পরিবহনের এখন যা অবস্থা, তাতে কেবল মন্ত্রী বদল করে রাতারাতি অবস্থার উন্নতি ঘটানো যাবে না। কিন্তু এই মন্ত্রী বদল দরকার অবস্থার রাতারাতি উন্নতি ঘটানোর জন্য নয়, অবিলম্বে মন্ত্রী বদল দরকার হতাশ, ভীত ও ক্ষুব্ধ মানুষের মধ্যে সড়ক ও নৌপথে চলাচলে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য। এই আস্থা ফেরানোর পরই দ্রুত যোগ্য মন্ত্রীদের পরিচালনায় যোগাযোগব্যবস্থার বর্তমান ত্রুটিগুলো দূর করার লক্ষ্যযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহতদের পরিবারের মনে সান্ত্বনা এবং দেশের মানুষের মনে আস্থা ও সাহস সৃষ্টির জন্য এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতেন। তাঁর কোনো কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অযোগ্যতা ও দায়িত্বহীনতার অভিযোগ যে তাঁর মন্ত্রিসভার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ নয়_এ কথাটা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝতে হবে। তিনি বলেছেন, মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটানো একটি রুটিন ওয়ার্ক। এটি মোটেই রুটিন ওয়ার্ক বা প্রথাগত কাজ নয়। এটি একটি নেসেসিটি বা প্রয়োজন। মোটর গাড়ির কোনো একটি পার্টস অকেজো হয়ে গেলে যেমন পাল্টাতে হয়, তেমনি মন্ত্রিসভারও কোনো একটি অংশ অকেজো বা অযোগ্য প্রমাণিত হলে তা সঙ্গে সঙ্গে বর্জন করতে হয়। এটা চার্চিল থেকে বঙ্গবন্ধু_সবাই করেছেন, সব গণতান্ত্রিক দেশেই এখনো করা হচ্ছে। না করা হলে অযোগ্যদের সংস্পর্শে যোগ্যরাও যোগ্যতা হারাতে শুরু করেন।
অযোগ্য ও বাকসর্বস্ব মন্ত্রীদের অপসারণের গণদাবিতে যদি প্রধানমন্ত্রী কান না দেন, বিরোধী দল যদি এটিকে প্রধান ইস্যু করে আন্দোলনে নামতে না চায়, ক্যাথেরিন মাসুদ আর মঞ্জুলী কাজীর অকাল বৈধব্য যদি ক্ষমতাসীনদের কারো মনেই হাহাকার না জাগায়, তাহলে জনগণের শোক ও ক্ষোভ তো আর বাষ্প হয়ে উড়ে যেতে পারে না, তার ছোট-বড় একটা প্রকাশ ঘটবেই। কেউ না কেউ প্রতিবাদ জানাবেই। সম্ভবত তারই প্রমাণ সৈয়দ আবুল মকসুদ, এক রাজনৈতিক কলামিস্টের ঢাকায় শহীদ মিনারে ঈদের দিন জনসমাবেশ ডাকা। তাঁর আসল উদ্দেশ্যটি কী আমার জানা নেই। উদ্দেশ্য শুভ হলে, বর্তমান অবস্থায় প্রতিকার দাবি করা হলে আমি তাঁকে সমর্থন জানাই।
মকসুদ সাহেবের ডাকে শহীদ মিনারে কত লোক আসবে তা আমি জানি না। কিন্তু মাত্র একজন বা কয়েকজন মানুষের এই উদ্যোগেই সরকার মনে হয় ভয় পেয়ে গেছে। একজন মন্ত্রী অথবা প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, 'গেরুয়া কাপড় পরিধান করলেই আন্না হাজারে হওয়া যায় না।' সৈয়দ আবুল মকসুদ যে ধরনের কাপড় পরেন, তা নিয়েই মন্ত্রীর এই কটাক্ষ। এটা কটাক্ষ নয়, মনের আসল ভয়, যদি এই সাধারণ মানুষটিই আন্না হাজারের মতো হয়ে ওঠেন!
যদি সরকার গণদাবি মানতে অনীহা দেখায়, বিরোধী দল প্রকৃত গণদাবি নিয়ে আন্দোলনে নামতে ব্যর্থ হয় এবং ব্যর্থ মন্ত্রীরা জনগণের কাঁধে দিনের পর দিন সিন্দবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসে থাকেন, তাহলে মানুষের মনের শোক, ক্ষোভ ও অসন্তোষ একদিন পুঞ্জীভূত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাবেই। সে জন্য একজন আন্না হাজারের দরকার হবে না। সৈয়দ আবুল মকসুদের উদ্যোগ একটি সামান্য স্ফুলিঙ্গ হতে পারে, কিন্তু স্ফুলিঙ্গ থেকেই অনেক সময় দাবানল তৈরি হয়। আমি বর্তমান সরকারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বলেই এই আগাম হুঁশিয়ারি তাদের জানিয়ে রাখলাম। আমি আবারও সবাইকে জানাচ্ছি ঈদ মোবারক। সেই সঙ্গে সবার জন্যই পড়ছি 'ফি আমানিল্লাহ্'।
লন্ডন, ২৯ আগস্ট, সোমবার, ২০১১
« পূর্ববর্তী সংবাদ
পরবর্তী সংবাদ »
এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনার মতামত দিতে এখানে ক্লি
No comments