জলবায়ু পরিবর্তন-কীভাবে আমরা এই বিপদ মোকাবিলা করব? by মহিউদ্দিন আহমদ
প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র ভানোয়াতু। জনসংখ্যা দুই লাখের কিছু বেশি। দেশটি হারিয়ে যেতে বসেছে। ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে জেনেভায় জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্যানেলের (আইপিসিসি) ওয়ার্কিং গ্রুপের একটি সভায় ভানোয়াতুর প্রতিনিধি আর্নেস্ট বেনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই বলে আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন, ‘২০ লাখ বছর ধরে এই মহাসমুদ্র আমাদের দেখভাল করেছে, অনেক দিয়েছে আমাদের।
আমাদের দেশ থেকে অনেক অনেক দূরের কিছু কিছু রাষ্ট্রের, কিছু কিছু কাজের ফলে আজ আমরা ডুবতে বসেছি। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার মানুষ আগামী শতকে একটি বিলীয়মান প্রজাতিতে রূপান্তরিত হতে পারে। কার পাপে আমাদের এই শাস্তি?’
গত বছর কোপেনহেগেনে মন্ত্রী পর্যায়ের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের সভার কয়েক দিন আগে মালদ্বীপের তরুণ রাষ্ট্রপতি মো. নাশিদ স্কুবা ডাইভিংয়ের পোশাক পরে ভারত মহাসাগরের ৩০ মিটার পানির নিচে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছিলেন। এটাও ছিল একটা প্রতীকী প্রতিবাদ। একই সপ্তাহে নেপালের প্রধানমন্ত্রী মাধব নেপাল হিমালয়ের ১৮ হাজার ফুট উচ্চতায় মন্ত্রিসভার একটা বৈঠক করেন আধা ঘণ্টার জন্য। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে হিমালয়ের গ্লেসিয়ার যেভাবে দ্রুত গলে যাচ্ছে, সে বিষয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ছিল এই আয়োজন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন কোনো আয়োজন হয়েছিল বলে জানা নেই। ঢাকার প্রেসক্লাবের সামনে কয়েকটি এনজিও মানববন্ধন করে মিডিয়ার দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা করেছিল।
বাংলাদেশের সরকার এবং সুযোগসন্ধানী কিছু এনজিও অবশ্য নড়েচড়ে বসেছে গ্লোবাল ক্লাইমেট ফান্ডের টাকা পাওয়ার জন্য। পেয়েছেও কিছু। তার পরই শুরু হয়ে যায় ‘হরির লুট।’ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে আনাচকানাচে অনেক প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ আছে, নেপথ্যে কুশীলব মন্ত্রী, সাংসদ, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, কিছু মার্সেনারি এনজিও এবং তাদের আশীর্বাদপুষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান ভাগাভাগি করে নিচ্ছে এই ফান্ডের টাকা। এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে আমাদের গণমাধ্যমে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণা একসময় অনুমাননির্ভর ছিল। এখন তা একটি ভয়াবহ বাস্তবতা। এর অভিঘাত দেখা যাচ্ছে নানাভাবে, নানা রূপে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। স্বল্পোন্নত ৪৮টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্যোগপ্রবণ হলো ১০টি দেশ। এর মধ্যে আছে বাংলাদেশ, হাইতি, ইথিওপিয়া, মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক, নেপাল, তাঞ্জানিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও মালাবি। ইন্টারন্যাশনাল ডিজাস্টার ডেটাবেইজ ব্যবহার করে আংকটাড একটা হিসাব করেছে, ১৯৮০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই ১০টি দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে ৬৯২ বার। এর মধ্যে ২৪৬টি দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। এসব দুর্যোগের মধ্যে আছে বন্যা, ঝড়, খরা ও মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা। খরা ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ আছে শীর্ষে। আমরা এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কী উদ্যোগ নিয়েছি বা নিচ্ছি?
অর্থনীতির নিজস্ব একটি ক্ষুধা আছে। অনিয়ন্ত্রিত শিল্প বিকাশের জন্য কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়ছে দিন দিন। বাড়ছে তাপমাত্রা, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে পর্বতশৃঙ্গে এবং মেরু অঞ্চলে বরফ গলছে দ্রুত হারে। ফলে পানির উচ্চতা আরও বাড়ছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক মিটারের চেয়ে কম উঁচু। অর্থাৎ সাগরের পানির উচ্চতা যদি এক মিটার বেড়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে যাবে। ফলে উদ্বাস্তু হবে প্রায় তিন কোটি মানুষ। এগুলো সবই জানা কথা, পুরোনো কথা। এসব নিয়ে দেনদরবার হচ্ছে অনেক দিন ধরে। রিও, জোহানেসবার্গ, কিয়োটো, কানকুন, কোপেনহেগেন হয়ে এখন জলবায়ু বিশারদেরা সবাই ধাবমান ডারবানের দিকে। ২৮ নভেম্বর সেখানে বিশ্ব জলবায়ূ সম্মেলন শুরু হচ্ছে। কী ফর্মুলা দেবেন নেতারা , যা থেকে এই পৃথিবীর মানুষ তাঁদের ঝুঁকি থেকে পরিত্রাণ পাবে?
সার্ক অঞ্চলের শীর্ষ বৈঠক হলো সম্প্রতি মালদ্বীপে। অথচ ঝুঁকির মধ্যে থাকা এ অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জন্য তাঁরা ডারবান সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য একটি বাক্য উচ্চারণের ব্যাপারে একমত হতে পারলেন না। তাঁরা একমত হলেন এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাটখারার সমন্বয় করতে। মানুষ বাঁচলে তো বাণিজ্য?
বাংলাদেশে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ খুবই কম, মাথাপিছু বছরে ২৭০ কিলোগ্রাম। ভারতে এর পরিমাণ মাথাপিছু ১৩০১ কিলোগ্রাম। কার্বন নিঃসরণে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে মাথাপিছু বার্ষিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয় ১৯ টন। তারপরই আছে কানাডা (১৭ টন), রাশিয়া (১১ টন) এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান (১০ টন)। ওই সব দেশের মানুষের ভোগবাদী জীবন যাপন এবং অপচয়ের অর্থনীতির জন্য চড়া দাম দিতে হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষকে। তার পরও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো একত্রে আওয়াজ তুলতে পারছে না। তাদের অনেকেই নিজ নিজ দেশের ‘উন্নয়ন’ উন্মাদনায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ধরিত্রী। এসব দেশের মধ্যে আছে গুটিকয়েক উঠতি শক্তিধর রাষ্ট্র। যেমন—চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। তাই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো দুর্বল শক্তির দেশগুলোর তেমন কিছু করার নেই, অনুকম্পা ভিক্ষা করা ছাড়া। তবে একটি জিনিস আমরা পারি। আর তা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে যথাসম্ভব মুক্ত থাকা অথবা এর ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনার জন্য নিজেদের কিছুটা প্রস্তুত রাখা। আমরা এটাও ঠিকমতো করছি না। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আঘাত হেনেছিল। দুই বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো আইলা-উদ্বাস্তুরা ঘরে ফিরে যেতে পারেনি। যে বাঁধগুলো ভেঙে গিয়েছিল, সেগুলো মেরামত এবং পুনর্নির্মাণ করলেই কয়েক লাখ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের পথ সহজ হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড চার-চারবার টেন্ডার আহ্বান করেও কার্যাদেশ দিতে পারেনি শুধু টেন্ডারবাজির দৌরাত্ম্যের জন্য। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কারা টেন্ডারবাজি করে, ক্ষমতার বলয়ে থেকে কারা এদের মদদ দেয়, এটা আমাদের একেবারে অজানা নয়।
অর্থ সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশ দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। আমরা কখনোসখনো নিজেদের ‘উদীয়মান বাঘ,’ কখনো ‘মধ্যআয়ের দেশ প্রায় হয়ে যাচ্ছি,’ এসব ছেলেভোলানো গল্প বলে মানুষকে প্রতারিত করছি। ২০১০ সালের জুন মাসে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটর অনুযায়ী বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা (মাথাপিছু দৈনিক আয় ২ ডলারের কম) ৭৩ শতাংশ, আর অতিদরিদ্রের সংখ্যা (মাথাপিছু দৈনিক আয় সোয়া এক ডলারের কম) ৪১ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১০-এ দেখানো হয়েছে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়ে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের ফলে জীবন যাত্রার মানের যে অবনতি ঘটেছে, তাতে করে পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া এই তথ্য বিশ্বাসযোগ্য না-ও মনে হতে পারে।
বাংলাদেশের এই দারিদ্র্য প্রকটতর হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হচ্ছে, নদী গ্রাস করছে মানুষের জমাজমি-বসতবাড়ি, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্ত হচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকা। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নিমজ্জিত হচ্ছে। উন্নয়নের জোয়ারের জলে খুব কমসংখ্যক মানুষই দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে ওপরের দিকে উঠতে পারছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এখন প্রায় সর্বত্র। পৃথিবীতে সব দেশই এখন এ ব্যাপারে একমত যে, জলবায়ু পরিবর্তনের যে নেতিবাচক প্রভাব, তার প্রধানতম শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। আমরা কীভাবে এই অবস্থার মোকাবিলা করব?
এখানে কৌশল হতে হবে দুটো। প্রথমত, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দায়ী দেশগুলোর দিকে আঙুল উঁচিয়ে প্রতিবাদ জানানোর ভাষা অর্জন করতে হবে এবং এ জন্য চাই দরকষাকষির সক্ষমতা। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া এবং আমরা একা এটা করতে পারব না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের সহযাত্রী হতে হবে অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে, যারা একই রকমভাবে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত। দ্বিতীয় কৌশলটি প্রয়োগ করতে হবে সমান্তরালভাবে।
আমাদের প্রতিটি পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনের দিকটি অনুষঙ্গ হিসেবে রেখে উন্নয়ন নীতি ও কৌশল তৈরি করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম অগ্রাধিকার ও সততা থাকতে হবে। আইলায় বিপর্যস্ত বাঁধ পুনর্নির্মাণ করে আমরা আমাদের সদিচ্ছা প্রমাণের ইঙ্গিত দিতে পারি। এবং তা এই মুহূর্তেই। আমরা যদি আন্তরিক হই, তাহলে পৃথিবীতে আমাদের বন্ধুর অভাব হবে না। চোর-বাটপারদের কেউ পছন্দ করেন না। দেশেও না, বিদেশেও না।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
গত বছর কোপেনহেগেনে মন্ত্রী পর্যায়ের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের সভার কয়েক দিন আগে মালদ্বীপের তরুণ রাষ্ট্রপতি মো. নাশিদ স্কুবা ডাইভিংয়ের পোশাক পরে ভারত মহাসাগরের ৩০ মিটার পানির নিচে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছিলেন। এটাও ছিল একটা প্রতীকী প্রতিবাদ। একই সপ্তাহে নেপালের প্রধানমন্ত্রী মাধব নেপাল হিমালয়ের ১৮ হাজার ফুট উচ্চতায় মন্ত্রিসভার একটা বৈঠক করেন আধা ঘণ্টার জন্য। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে হিমালয়ের গ্লেসিয়ার যেভাবে দ্রুত গলে যাচ্ছে, সে বিষয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ছিল এই আয়োজন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন কোনো আয়োজন হয়েছিল বলে জানা নেই। ঢাকার প্রেসক্লাবের সামনে কয়েকটি এনজিও মানববন্ধন করে মিডিয়ার দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা করেছিল।
বাংলাদেশের সরকার এবং সুযোগসন্ধানী কিছু এনজিও অবশ্য নড়েচড়ে বসেছে গ্লোবাল ক্লাইমেট ফান্ডের টাকা পাওয়ার জন্য। পেয়েছেও কিছু। তার পরই শুরু হয়ে যায় ‘হরির লুট।’ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে আনাচকানাচে অনেক প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ আছে, নেপথ্যে কুশীলব মন্ত্রী, সাংসদ, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, কিছু মার্সেনারি এনজিও এবং তাদের আশীর্বাদপুষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান ভাগাভাগি করে নিচ্ছে এই ফান্ডের টাকা। এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে আমাদের গণমাধ্যমে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণা একসময় অনুমাননির্ভর ছিল। এখন তা একটি ভয়াবহ বাস্তবতা। এর অভিঘাত দেখা যাচ্ছে নানাভাবে, নানা রূপে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। স্বল্পোন্নত ৪৮টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্যোগপ্রবণ হলো ১০টি দেশ। এর মধ্যে আছে বাংলাদেশ, হাইতি, ইথিওপিয়া, মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক, নেপাল, তাঞ্জানিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও মালাবি। ইন্টারন্যাশনাল ডিজাস্টার ডেটাবেইজ ব্যবহার করে আংকটাড একটা হিসাব করেছে, ১৯৮০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই ১০টি দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে ৬৯২ বার। এর মধ্যে ২৪৬টি দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। এসব দুর্যোগের মধ্যে আছে বন্যা, ঝড়, খরা ও মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা। খরা ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ আছে শীর্ষে। আমরা এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কী উদ্যোগ নিয়েছি বা নিচ্ছি?
অর্থনীতির নিজস্ব একটি ক্ষুধা আছে। অনিয়ন্ত্রিত শিল্প বিকাশের জন্য কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়ছে দিন দিন। বাড়ছে তাপমাত্রা, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে পর্বতশৃঙ্গে এবং মেরু অঞ্চলে বরফ গলছে দ্রুত হারে। ফলে পানির উচ্চতা আরও বাড়ছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক মিটারের চেয়ে কম উঁচু। অর্থাৎ সাগরের পানির উচ্চতা যদি এক মিটার বেড়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে যাবে। ফলে উদ্বাস্তু হবে প্রায় তিন কোটি মানুষ। এগুলো সবই জানা কথা, পুরোনো কথা। এসব নিয়ে দেনদরবার হচ্ছে অনেক দিন ধরে। রিও, জোহানেসবার্গ, কিয়োটো, কানকুন, কোপেনহেগেন হয়ে এখন জলবায়ু বিশারদেরা সবাই ধাবমান ডারবানের দিকে। ২৮ নভেম্বর সেখানে বিশ্ব জলবায়ূ সম্মেলন শুরু হচ্ছে। কী ফর্মুলা দেবেন নেতারা , যা থেকে এই পৃথিবীর মানুষ তাঁদের ঝুঁকি থেকে পরিত্রাণ পাবে?
সার্ক অঞ্চলের শীর্ষ বৈঠক হলো সম্প্রতি মালদ্বীপে। অথচ ঝুঁকির মধ্যে থাকা এ অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জন্য তাঁরা ডারবান সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য একটি বাক্য উচ্চারণের ব্যাপারে একমত হতে পারলেন না। তাঁরা একমত হলেন এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাটখারার সমন্বয় করতে। মানুষ বাঁচলে তো বাণিজ্য?
বাংলাদেশে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ খুবই কম, মাথাপিছু বছরে ২৭০ কিলোগ্রাম। ভারতে এর পরিমাণ মাথাপিছু ১৩০১ কিলোগ্রাম। কার্বন নিঃসরণে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে মাথাপিছু বার্ষিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয় ১৯ টন। তারপরই আছে কানাডা (১৭ টন), রাশিয়া (১১ টন) এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান (১০ টন)। ওই সব দেশের মানুষের ভোগবাদী জীবন যাপন এবং অপচয়ের অর্থনীতির জন্য চড়া দাম দিতে হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষকে। তার পরও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো একত্রে আওয়াজ তুলতে পারছে না। তাদের অনেকেই নিজ নিজ দেশের ‘উন্নয়ন’ উন্মাদনায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ধরিত্রী। এসব দেশের মধ্যে আছে গুটিকয়েক উঠতি শক্তিধর রাষ্ট্র। যেমন—চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। তাই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো দুর্বল শক্তির দেশগুলোর তেমন কিছু করার নেই, অনুকম্পা ভিক্ষা করা ছাড়া। তবে একটি জিনিস আমরা পারি। আর তা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে যথাসম্ভব মুক্ত থাকা অথবা এর ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনার জন্য নিজেদের কিছুটা প্রস্তুত রাখা। আমরা এটাও ঠিকমতো করছি না। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আঘাত হেনেছিল। দুই বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো আইলা-উদ্বাস্তুরা ঘরে ফিরে যেতে পারেনি। যে বাঁধগুলো ভেঙে গিয়েছিল, সেগুলো মেরামত এবং পুনর্নির্মাণ করলেই কয়েক লাখ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের পথ সহজ হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড চার-চারবার টেন্ডার আহ্বান করেও কার্যাদেশ দিতে পারেনি শুধু টেন্ডারবাজির দৌরাত্ম্যের জন্য। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কারা টেন্ডারবাজি করে, ক্ষমতার বলয়ে থেকে কারা এদের মদদ দেয়, এটা আমাদের একেবারে অজানা নয়।
অর্থ সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশ দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। আমরা কখনোসখনো নিজেদের ‘উদীয়মান বাঘ,’ কখনো ‘মধ্যআয়ের দেশ প্রায় হয়ে যাচ্ছি,’ এসব ছেলেভোলানো গল্প বলে মানুষকে প্রতারিত করছি। ২০১০ সালের জুন মাসে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটর অনুযায়ী বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা (মাথাপিছু দৈনিক আয় ২ ডলারের কম) ৭৩ শতাংশ, আর অতিদরিদ্রের সংখ্যা (মাথাপিছু দৈনিক আয় সোয়া এক ডলারের কম) ৪১ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১০-এ দেখানো হয়েছে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়ে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের ফলে জীবন যাত্রার মানের যে অবনতি ঘটেছে, তাতে করে পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া এই তথ্য বিশ্বাসযোগ্য না-ও মনে হতে পারে।
বাংলাদেশের এই দারিদ্র্য প্রকটতর হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হচ্ছে, নদী গ্রাস করছে মানুষের জমাজমি-বসতবাড়ি, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্ত হচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকা। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নিমজ্জিত হচ্ছে। উন্নয়নের জোয়ারের জলে খুব কমসংখ্যক মানুষই দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে ওপরের দিকে উঠতে পারছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এখন প্রায় সর্বত্র। পৃথিবীতে সব দেশই এখন এ ব্যাপারে একমত যে, জলবায়ু পরিবর্তনের যে নেতিবাচক প্রভাব, তার প্রধানতম শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। আমরা কীভাবে এই অবস্থার মোকাবিলা করব?
এখানে কৌশল হতে হবে দুটো। প্রথমত, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দায়ী দেশগুলোর দিকে আঙুল উঁচিয়ে প্রতিবাদ জানানোর ভাষা অর্জন করতে হবে এবং এ জন্য চাই দরকষাকষির সক্ষমতা। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া এবং আমরা একা এটা করতে পারব না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের সহযাত্রী হতে হবে অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে, যারা একই রকমভাবে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত। দ্বিতীয় কৌশলটি প্রয়োগ করতে হবে সমান্তরালভাবে।
আমাদের প্রতিটি পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনের দিকটি অনুষঙ্গ হিসেবে রেখে উন্নয়ন নীতি ও কৌশল তৈরি করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম অগ্রাধিকার ও সততা থাকতে হবে। আইলায় বিপর্যস্ত বাঁধ পুনর্নির্মাণ করে আমরা আমাদের সদিচ্ছা প্রমাণের ইঙ্গিত দিতে পারি। এবং তা এই মুহূর্তেই। আমরা যদি আন্তরিক হই, তাহলে পৃথিবীতে আমাদের বন্ধুর অভাব হবে না। চোর-বাটপারদের কেউ পছন্দ করেন না। দেশেও না, বিদেশেও না।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
No comments