চারদিক-মুকুন্দপুরে আসছেন তো?
আমরা যারা ষাটের কোঠার আশপাশে অর্থাৎ হয় ষাট ছুঁই ছুঁই বা ষাট পার হচ্ছি বা হয়েছি—তারা একদিকে বড় ভাগ্যবান। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতিটি স্মৃতি তাদের মনে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। যারা চল্লিশের বা পঞ্চাশের কোঠায় হয় তাদের তেমন কোনো স্মৃতি নেই, থাকলেও খুব ম্লান। আবার যাঁরা সত্তর বা আশির কোঠায় চলে গেছেন, তাঁরা আবার এখন ওই সব স্মৃতি খুব একটা মনে করতে পারেন না।
তৎকালীন বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ছিলেন বিশাল মনের অধিকারী সাধারণত কলুষতার অনেক ঊর্ধ্বে। তিনি কিছুটা বিপদের আশঙ্কা করলেও তা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের উপায় খুঁজছিলেন। দ্বিতীয়ত, বিশ্বাসঘাতকেরা যে কতটুকু নিচে নামতে পারে, উঁচুমনের মানুষটা বুঝতে পারলেও তা বীরের মতো মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। কাপুরুষেরা বাঙালির পিঠে ছুরির আঘাত হেনে রক্তের হলিখেলায় মেতে উঠে দেশটা রক্তে ভাসিয়ে দিয়ে ভেবেছিল এর সঙ্গে বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা বুঝি ভাসিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু বাঙালিকে তারা চিনতে ভুল করেছিল। অপ্রস্তুত বাঙালি তখনকার মতো মাটিতে পড়ে গেলেও উঠে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় নেয়নি। জানা-অজানা অসংখ্য তরুণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আমাদের ইপিআর, সামরিক বাহিনী, বাঙালি পুলিশ ও অন্যরা। তাঁদের কজনকেই বা আমরা চিনি, কজনই বা পেয়েছেন তাঁদের কাজের প্রাপ্য সম্মান বা স্বীকৃতি?
আসুন, পাঠক, এঁদের একজনের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। তাঁর নাম সায়ীদ আহমেদ। তখন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। সামনে ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সবকিছু হেলায় ফেলে দিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে কী করেছিলেন তা জেনে নিই। আপনারা কিন্তু সায়ীদ আহমেদকে শুধু একজন ব্যক্তি বা একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নেবেন না বরং তাঁর ভেতর দিয়ে তখনকার সমগ্র তরুণ সমাজকে চেনার চেষ্টা করবেন।
আমাদের নায়ক সায়ীদ আহমেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ইতিহাসের ছাত্র। ছয়টা পরীক্ষা হয়ে গেছে আর মাত্র দুটো পরীক্ষা হয়ে গেলেই ছাত্রজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন, কিন্তু ২৫ মার্চের তাণ্ডব ওলটপালট করেছিল সবকিছু। মাতৃভূমির এই অপমান দেখে সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। যাতায়াতব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে টেম্পো-রিকশা, এমনকি অনেকটা পথ হেঁটে দেশের বাড়ি সোনাপুরে চলে যান। সেখানে গিয়ে ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন গোলাম মাওলার নেতৃত্বে গঠিত বাহিনীতে যোগ দেন। ক্যাপ্টেন গোলাম মাওলা ও স্থানীয় নেতাদের সাহায্যে গ্রামের ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিকদের সংগঠিত করেন। এঁদেরই সাহায্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের রাস্তায় বড় বড় গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। কাঠের সেতুগুলো পুড়িয়ে দিয়ে ও পাকা সেতুগুলো হাতুিড়, শাবল দিয়ে ভেঙে হানাদার বাহিনীর জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চলাচলের অযোগ্য করে তোলেন। তখন হানাদার বাহিনী বিমান ও হেলিকপ্টার দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। সায়ীদ বুঝতে পারেন যে মামুলি ট্রেনিংয়ের জ্ঞান দিয়ে একটি দেশের সামরিক বাহিনীর মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই আরও উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য আগরতলা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সায়ীদের ভাগ্য ভালো ছিল। কারণ, আমাদের রাজনীতিবিদেরা তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে হানাদার বাহিনীকে হয়তো ব্যস্ত রাখা যাবে, কিন্তু কার্যসিদ্ধি করতে হলে বাংলাদেশের শিক্ষিত ছেলেদের নিয়ে সুসংগঠিত সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন।
ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সহায়তায় বিভিন্ন সেক্টর থেকে ৬১ জন ক্যাডেটকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়। সায়ীদ ছিলেন তাঁদেরই একজন। ভারতের সামরিক বাহিনীর অধীনে তাঁদের কঠোর প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি চৌকস সামরিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর প্রবাসী বাংলাদেশি সরকার ৬১ জন ক্যাডেটকে সামরিক সনদ প্রদান করে। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী। আর এ অনুষ্ঠানেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন সায়ীদ আহমেদ।
সায়ীদ তাঁর এই বাহিনী, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর লে. কর্নেল অশোক ভার্মার বাহিনীর সঙ্গে নভেম্বরের প্রথমদিকে তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার মুকুন্দপুরে প্রবেশ করেন এবং সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯ নভেম্বর মুকুন্দপুরে হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেন তাঁরা। মুকুন্দপুর মুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার সায়ীদ আহমেদকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করেন।
দীর্ঘদিন সামরিক বাহিনীতে চাকরি করার পর ২০০৬ সালে সায়ীদ আহমেদ মেজর জেনারেল হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। সেদিনের সেই অসংখ্য সায়ীদ শুধু দেশপ্রেমের কারণে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে অসংখ্য ছোট-বড় যুদ্ধের ভেতর দিয়ে আমাদের এ দেশটা স্বাধীন করেছিলেন। আর তাঁদের এই অসামান্য অবদানকে স্মরণ করার জন্য মেজর জেনারেল সায়ীদ (অব.) এবার সেই মুকুন্দপুরে এক আনন্দ পুনর্মিলনীর আয়োজন করেছেন। সেই মুকুন্দপুর, সেই ১৯ নভেম্বর। যাঁরা তাতে যোগদান করতে চান, তাঁরা যোগাযোগ করতে পারেন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিচের মোবাইল নম্বরগুলোতে: মেজর জেনারেল (অব.) সায়ীদ আহমেদ-০১৬১২১২৯৫৭৯, মেজর (অব.) জহির-০১৭৩০১৮৩৫৭৫, জহিরুল ইসলাম-০১৭১৬২৪২৫৫৫।
সে সময়কার সূর্যসন্তানেরা মুকুন্দপুরে আসছেন তো?
ইবনে মুস্তাফা
আসুন, পাঠক, এঁদের একজনের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। তাঁর নাম সায়ীদ আহমেদ। তখন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। সামনে ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সবকিছু হেলায় ফেলে দিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে কী করেছিলেন তা জেনে নিই। আপনারা কিন্তু সায়ীদ আহমেদকে শুধু একজন ব্যক্তি বা একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নেবেন না বরং তাঁর ভেতর দিয়ে তখনকার সমগ্র তরুণ সমাজকে চেনার চেষ্টা করবেন।
আমাদের নায়ক সায়ীদ আহমেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ইতিহাসের ছাত্র। ছয়টা পরীক্ষা হয়ে গেছে আর মাত্র দুটো পরীক্ষা হয়ে গেলেই ছাত্রজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন, কিন্তু ২৫ মার্চের তাণ্ডব ওলটপালট করেছিল সবকিছু। মাতৃভূমির এই অপমান দেখে সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। যাতায়াতব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে টেম্পো-রিকশা, এমনকি অনেকটা পথ হেঁটে দেশের বাড়ি সোনাপুরে চলে যান। সেখানে গিয়ে ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন গোলাম মাওলার নেতৃত্বে গঠিত বাহিনীতে যোগ দেন। ক্যাপ্টেন গোলাম মাওলা ও স্থানীয় নেতাদের সাহায্যে গ্রামের ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিকদের সংগঠিত করেন। এঁদেরই সাহায্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের রাস্তায় বড় বড় গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। কাঠের সেতুগুলো পুড়িয়ে দিয়ে ও পাকা সেতুগুলো হাতুিড়, শাবল দিয়ে ভেঙে হানাদার বাহিনীর জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চলাচলের অযোগ্য করে তোলেন। তখন হানাদার বাহিনী বিমান ও হেলিকপ্টার দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। সায়ীদ বুঝতে পারেন যে মামুলি ট্রেনিংয়ের জ্ঞান দিয়ে একটি দেশের সামরিক বাহিনীর মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই আরও উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য আগরতলা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সায়ীদের ভাগ্য ভালো ছিল। কারণ, আমাদের রাজনীতিবিদেরা তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে হানাদার বাহিনীকে হয়তো ব্যস্ত রাখা যাবে, কিন্তু কার্যসিদ্ধি করতে হলে বাংলাদেশের শিক্ষিত ছেলেদের নিয়ে সুসংগঠিত সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন।
ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সহায়তায় বিভিন্ন সেক্টর থেকে ৬১ জন ক্যাডেটকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়। সায়ীদ ছিলেন তাঁদেরই একজন। ভারতের সামরিক বাহিনীর অধীনে তাঁদের কঠোর প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি চৌকস সামরিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর প্রবাসী বাংলাদেশি সরকার ৬১ জন ক্যাডেটকে সামরিক সনদ প্রদান করে। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী। আর এ অনুষ্ঠানেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন সায়ীদ আহমেদ।
সায়ীদ তাঁর এই বাহিনী, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর লে. কর্নেল অশোক ভার্মার বাহিনীর সঙ্গে নভেম্বরের প্রথমদিকে তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার মুকুন্দপুরে প্রবেশ করেন এবং সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯ নভেম্বর মুকুন্দপুরে হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেন তাঁরা। মুকুন্দপুর মুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার সায়ীদ আহমেদকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করেন।
দীর্ঘদিন সামরিক বাহিনীতে চাকরি করার পর ২০০৬ সালে সায়ীদ আহমেদ মেজর জেনারেল হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। সেদিনের সেই অসংখ্য সায়ীদ শুধু দেশপ্রেমের কারণে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে অসংখ্য ছোট-বড় যুদ্ধের ভেতর দিয়ে আমাদের এ দেশটা স্বাধীন করেছিলেন। আর তাঁদের এই অসামান্য অবদানকে স্মরণ করার জন্য মেজর জেনারেল সায়ীদ (অব.) এবার সেই মুকুন্দপুরে এক আনন্দ পুনর্মিলনীর আয়োজন করেছেন। সেই মুকুন্দপুর, সেই ১৯ নভেম্বর। যাঁরা তাতে যোগদান করতে চান, তাঁরা যোগাযোগ করতে পারেন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিচের মোবাইল নম্বরগুলোতে: মেজর জেনারেল (অব.) সায়ীদ আহমেদ-০১৬১২১২৯৫৭৯, মেজর (অব.) জহির-০১৭৩০১৮৩৫৭৫, জহিরুল ইসলাম-০১৭১৬২৪২৫৫৫।
সে সময়কার সূর্যসন্তানেরা মুকুন্দপুরে আসছেন তো?
ইবনে মুস্তাফা
No comments