ভূমিকম্প-দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রস্তুতি জরুরি
আধুনিক প্রযুক্তি ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম সংবাদ সরবরাহ করতে পারলেও ভূমিকম্প সবসময়ই আকস্মিক দুর্যোগ। আগাম সতর্কতার সুযোগ নেই বলেই এ দুর্যোগের সামনে উন্নত-অনুন্নত সকল দেশ অসহায়। ভূমিকম্প ও ভূমিকম্পজনিত জলকম্পের ভয়াবহতা উন্নত দেশ জাপানকে কতটা হতবিহ্বল করে তুলেছিল তা সাম্প্রতিক সুনামির সময়ই স্পষ্ট হয়েছে।
শুধু জাপান নয়, বিশ্বের বড় ভূমিকম্পগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে বিশেষজ্ঞরা কম্পন-পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবেলার জোর প্রস্তুতি নিতে পরামর্শ দেন। বলা হয়ে থাকে, যত দ্রুত ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা শুরু হবে তত জানমালের ক্ষতি কমানো সম্ভব। পাশাপাশি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলোর জন্য প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বিশেষ বিল্ডিং কোড মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। আমাদের দেশে বিল্ডিং কোড মানা বা দুর্যোগ মোকাবেলা প্রস্তুতি কেমন? রোববারের ভূমিকম্পে প্রকম্পিত মানুষের মনে এ প্রশ্ন এখন আগের যে কোনো সময়ের চাইতে জোরালো। 'হিমালয়ান ভূমিকম্প' বলে অভিহিত এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভারতের সিকিম রাজ্যের রাজধানী গ্যাংটক থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে সিকিম-নেপাল সীমান্তের মঙ্গনে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হিমালয়ের নিচে ভারতীয় প্লেট ও তিব্বতীয় প্লেটের ঘর্ষণের ফলেই ৬.৮ মাত্রার এই ভূকম্পের উদ্ভব। এর কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০-২০ কিলোমিটার গভীরে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সিকিমের এ কম্পন কাঁপিয়েছে পুরো উত্তর ভারত, পূর্ব ভারত, তিব্বত ও নেপালকেও। গত ষাট বছরের মধ্যে এত বড় ভূমিকম্প এ অঞ্চলে হয়নি, শুধু তাই নয় এত দীর্ঘস্থায়ী কম্পনের দেখাও মেলেনি। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সিকিমে। এ পর্যন্ত ৫০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে কিছু ভবনে ফাটল ধরেছে, কেউ কেউ আহতও হয়েছেন কিন্তু বড় ধরনের ক্ষতির সংবাদ মেলেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূকম্প কেন্দ্রটি অগভীর ছিল বলে বাংলাদেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েনি। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী কম্পনে এখানকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত। এ ভূমিকম্প আরও বড় ভূমিকম্পের আভাস দিচ্ছে, কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি কেমন। রাজধানীসহ সারাদেশে বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন তৈরির যে মচ্ছব চলছে এবং চলেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, এ বিষয়ে সতর্কতা খুব সামান্যই কাজে আসছে। এবারের কম্পনে যে ধরনের পরিস্থিতি দেখা গেল তাতে বড় কম্পনে ঢাকাসহ দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভবনধস হলে যে মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তা মনে রেখে এখনই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। নির্মীয়মাণ ভবনগুলো বিল্ডিং কোড ঠিকমতো মানছে কি-না তার উপযুক্ত তদারকিও হওয়া দরকার। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি সন্তোষজনক বলে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। এ সন্তোষ যেন দুর্যোগ এলে মানুষের কাজে আসে সে ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। ভূমিকম্পের উদ্ধার তৎপরতা অত্যন্ত জটিল, দক্ষ লোকবল না থাকলে এটি সফল করাও কঠিন। সেক্ষেত্রে শুধু উদ্ধার তৎপরতার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীই নয়, সাধারণ মানুষকেও প্রশিক্ষিত করা জরুরি। কিন্তু রোববারের দুর্যোগে প্রতীয়মান হলো, আতঙ্কে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপের কথা সাধারণ মানুষ জানেন না। ফলে এ বিষয়ে প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজনীয়তা থেকেই যাচ্ছে। দেশে ভূমিকম্প বিষয়ে গবেষণা ও তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও অপ্রতুল। গতকালের ভূমিকম্পের পর অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, বাংলাদেশে অনুভূত কম্পনের মাত্রা কত। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক বা ভারতীয় সূত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে আমাদের। বাকিটা বিশেষজ্ঞরা অনুমানের ভিত্তিতে বলেছেন। কেননা, বাংলাদেশ মেটেরিওলজিক্যাল সার্ভে দফতরে রিখটার স্কেলে কম্পন মাপার প্রযুক্তি নেই। সেক্ষেত্রে অনুমান কতটা সঠিকভাবে কম্পনের মাত্রা সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বাংলাদেশ যে ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে তাতে ভূকম্পন মাপার প্রযুক্তি না থাকা খুবই হতাশাজনক। প্রয়োজনের সময় ত্রাণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, উদ্ধার তৎপরতার ক্ষেত্রেও যদি এমন হতাশার ঘটনা ঘটে তবে তা বিপুল মানুষের প্রাণক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এবারের ভূমিকম্পের পর হতোদ্যম বসে থাকার আর সুযোগ নেই। সার্বিক প্রস্তুতির এখনই সময়।
No comments