সহজ-সরল-প্রথম জীবন তারপর ভ্রমণ by কনকচাঁপা
শাহরিয়ার আবিদ-সারা দেশ থেকে ছেঁকে তোলা একটি শিল্পীর নাম। শক্তি, সাহস, ভদ্রতা, শিক্ষা, সৌন্দর্য ও পরিশীলিত কণ্ঠ-সব কিছুর সমন্বয়েই তৈরি ছিল আবিদের অবয়ব। ওকে খুব কাছে থেকে দেখলাম দিগন্ত টিভির সরাসরি অনুষ্ঠানে। ওর চোখ দুটো চঞ্চল, কিন্তু গভীর। বার বার মনে হচ্ছিল, এ রকম আরেকটা ছেলে আমাদের থাকলে ভালো হতো।
গানের অনুষ্ঠানেই আমি স্বরচিত কবিতা পাঠ করলাম-ও আকাশ থেকে পড়ল। বলল, আর তো ম্যাডাম বলা যায় না, বস বলতে হবে! ভদ্রতা ও চঞ্চলতা যে একসঙ্গে কিভাবে মেশানো থাকে, ওকে না দেখলে তা বোঝা যায় না। যেমন লালের সঙ্গে নীল মেলানো। আমার কাছে ও ছিল বেগুনি আবিদ। আর গান-যেমন দরদ ও তার স্থানে ওর কণ্ঠ ছিল আট-দশ বছরে ও একদম রবীন্দ্রসংগীতের শীর্ষস্থানে পায়ের ওপর পা তুলে রবিসুধা ঝরাত, এতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু কেন? কেন এই চলে যাওয়া? কেন এই বোকামি-বোকামিই তো বলব, অমন ভাটার সময়ে পানিতে নামলে কেন বাবা? আমাদের কি কোনো নিরাপত্তা আছে কোথাও? সেখানে অত বুদ্ধিমান ছেলে হয়ে কেন যে নামতে গেলে বাবা-আনন্দ করতে গিয়ে জীবনটাই তো খোয়ালে!
সবাই হয়তো অবাক হচ্ছেন যে ছেলেটা নেই, তাকে কী সব বলছি! বলব না-ওর ওপরই যে অভিমান। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে বলব? তাঁরা কোথায় থাকেন-কেমন দেখতে-তাঁদের হাত-পা কয়টা কেউ বলতে পারবেন? আজ কতটা বছর ধরে ইলিয়াস কাঞ্চন 'নিরাপদ সড়ক চাই' বলে সংগ্রাম করছেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষ তার কী করেছে! আমাদের সন্তানের জন্য তাঁর বাবার কোলও নিরাপদ নয়! আর তো সড়ক! কিন্তু 'এক মাঘেই তো শীত যায় না।' যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো দায় আছে কি না জানি না, পৃথিবীর এই ভয়ংকর সৌন্দর্যমণ্ডিত দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে ব্যক্তিমালিকানায় পর্যটন ব্যবসা কিন্তু রমরমাই চলছে। যত পর্যটক ভাটার টানে বা চোরাখালে পড়ে প্রাণ হারায়, এই হিসাবটা জনসমক্ষে এলে এই রমরমা ব্যবসার কী অবস্থা দাঁড়াবে বলা যায়? কতগুলো হোটেল আছে ওই সৈকত এলাকায়? তারা সবাই মিলে বিপৎসংকুল স্থানগুলো তারের বেড়া দিয়ে, লাল সংকেত দিয়ে, বাঁধ দিয়ে উদ্ধার-কর্মীদের সংখ্যা বাড়িয়ে, এই বিপজ্জনক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় নাকি? দুই বছর আগে আমি আমার ছেলেমেয়ে ও জামাতা নিয়ে গেলাম সেখানে। আমরা সবাই একটু ভীতু প্রকৃতির। হাঁটুজলেই ঝাঁপাঝাঁপি। আর হোটেলের সুইমিং পুলেই বেশি সময় কাটে। কারণ ওই গুপ্তখালের ও ভাটার টানের ভয়। ভাটার সময় একটা অনুজ্জ্বল লাল ন্যাকড়া কঞ্চির আগায় দোলে বটে; কিন্তু গুপ্তখাল ও তো বড়ই ভয়ংকর। যা হোক তিন দিনের দিন জামাতার ঘাড়ের রগে টান পড়ে ফ্রিজিশোল্ডার হয়ে গেল। হোটেল থেকে অনেক কষ্টে হাসপাতালের নম্বর নিয়ে ফোন করলাম। না কোনো উত্তর, না কোনো সেবা-কিছুই পেলাম না। সেখানে আবিদ! ওফ-ভাবতেও চাই না ওর কষ্টটা। যতই চিন্তা করি ততই ওদের তিনজনের ওপর অভিমানে মরে যাই। আবার চিন্তা করি, শুধু ওর মৃত্যু কেন, সারা দেশে প্রতিদিনই যে মৃত্যুগুলো আমরা দেখছি, এই কষ্টগুলো কত আর বয়ে নিয়ে বেড়ানো যায়। দুঃখের ভারে আমরা সবাই কুঁজো নটর ডেমের হ্যাঞ্চব্যাক হয়ে যাচ্ছি। তাতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের ঋজুতা তো কমছে না! সোজা শিরদাঁড়ার সামনে মেদভুঁড়ি জমছে। হবে না? তাদের দুঃখবোধও নেই, দায়বদ্ধতা নেই, লাজলজ্জার বালাইও নেই। তাই এ দেশে বার্ড ফ্লু হয়ে যত মুরগি, অ্যানথ্রাঙ্ হয়ে যত গবাদিপশু বা গুলি খেয়ে যত অতিথি পাখি মারা যায়, তার চেয়ে মানুষ মরে অনেক বেশি। এই এক যমুনা সড়ক, নরসিংদী ও চিটাগাং সড়কে রোজ কত মানুষ প্রাণ দেয়, তা কি যথাযথ কর্তৃপক্ষ বলতে পারে? আগে ভাবতাম ট্রেন অনেক নিরাপদ, এখন আর তা-ও ভাবার অবকাশ নেই। হায়রে জীবন! হায় দেশ? সবাইকে শুধু এটুকুই বলতে চাই, যথাযথ কর্তৃপক্ষ কী করবে জানি না-আমাদের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে এবং মনে রাখতে হবে, জীবনের জন্য প্রথমে নিরাপত্তা-তারপর সব কিছু। জীবন তো একটাই, তাই তার মূল্যও অনেক। আর বলতে চাই আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়-এ কথা নয়, বলতে চাই যতক্ষণ না উপযুক্ত নিরাপত্তা ও চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না হবে, তত দিন যেন কোনো মা তাঁর সন্তানকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে না পাঠান। খালি পড়ে থাক পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতের ভয়ংকর সুন্দর বেলাভূমি।
লেখক : সংগীতশিল্পী
সবাই হয়তো অবাক হচ্ছেন যে ছেলেটা নেই, তাকে কী সব বলছি! বলব না-ওর ওপরই যে অভিমান। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে বলব? তাঁরা কোথায় থাকেন-কেমন দেখতে-তাঁদের হাত-পা কয়টা কেউ বলতে পারবেন? আজ কতটা বছর ধরে ইলিয়াস কাঞ্চন 'নিরাপদ সড়ক চাই' বলে সংগ্রাম করছেন। যথাযথ কর্তৃপক্ষ তার কী করেছে! আমাদের সন্তানের জন্য তাঁর বাবার কোলও নিরাপদ নয়! আর তো সড়ক! কিন্তু 'এক মাঘেই তো শীত যায় না।' যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো দায় আছে কি না জানি না, পৃথিবীর এই ভয়ংকর সৌন্দর্যমণ্ডিত দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে ব্যক্তিমালিকানায় পর্যটন ব্যবসা কিন্তু রমরমাই চলছে। যত পর্যটক ভাটার টানে বা চোরাখালে পড়ে প্রাণ হারায়, এই হিসাবটা জনসমক্ষে এলে এই রমরমা ব্যবসার কী অবস্থা দাঁড়াবে বলা যায়? কতগুলো হোটেল আছে ওই সৈকত এলাকায়? তারা সবাই মিলে বিপৎসংকুল স্থানগুলো তারের বেড়া দিয়ে, লাল সংকেত দিয়ে, বাঁধ দিয়ে উদ্ধার-কর্মীদের সংখ্যা বাড়িয়ে, এই বিপজ্জনক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় নাকি? দুই বছর আগে আমি আমার ছেলেমেয়ে ও জামাতা নিয়ে গেলাম সেখানে। আমরা সবাই একটু ভীতু প্রকৃতির। হাঁটুজলেই ঝাঁপাঝাঁপি। আর হোটেলের সুইমিং পুলেই বেশি সময় কাটে। কারণ ওই গুপ্তখালের ও ভাটার টানের ভয়। ভাটার সময় একটা অনুজ্জ্বল লাল ন্যাকড়া কঞ্চির আগায় দোলে বটে; কিন্তু গুপ্তখাল ও তো বড়ই ভয়ংকর। যা হোক তিন দিনের দিন জামাতার ঘাড়ের রগে টান পড়ে ফ্রিজিশোল্ডার হয়ে গেল। হোটেল থেকে অনেক কষ্টে হাসপাতালের নম্বর নিয়ে ফোন করলাম। না কোনো উত্তর, না কোনো সেবা-কিছুই পেলাম না। সেখানে আবিদ! ওফ-ভাবতেও চাই না ওর কষ্টটা। যতই চিন্তা করি ততই ওদের তিনজনের ওপর অভিমানে মরে যাই। আবার চিন্তা করি, শুধু ওর মৃত্যু কেন, সারা দেশে প্রতিদিনই যে মৃত্যুগুলো আমরা দেখছি, এই কষ্টগুলো কত আর বয়ে নিয়ে বেড়ানো যায়। দুঃখের ভারে আমরা সবাই কুঁজো নটর ডেমের হ্যাঞ্চব্যাক হয়ে যাচ্ছি। তাতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের ঋজুতা তো কমছে না! সোজা শিরদাঁড়ার সামনে মেদভুঁড়ি জমছে। হবে না? তাদের দুঃখবোধও নেই, দায়বদ্ধতা নেই, লাজলজ্জার বালাইও নেই। তাই এ দেশে বার্ড ফ্লু হয়ে যত মুরগি, অ্যানথ্রাঙ্ হয়ে যত গবাদিপশু বা গুলি খেয়ে যত অতিথি পাখি মারা যায়, তার চেয়ে মানুষ মরে অনেক বেশি। এই এক যমুনা সড়ক, নরসিংদী ও চিটাগাং সড়কে রোজ কত মানুষ প্রাণ দেয়, তা কি যথাযথ কর্তৃপক্ষ বলতে পারে? আগে ভাবতাম ট্রেন অনেক নিরাপদ, এখন আর তা-ও ভাবার অবকাশ নেই। হায়রে জীবন! হায় দেশ? সবাইকে শুধু এটুকুই বলতে চাই, যথাযথ কর্তৃপক্ষ কী করবে জানি না-আমাদের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে এবং মনে রাখতে হবে, জীবনের জন্য প্রথমে নিরাপত্তা-তারপর সব কিছু। জীবন তো একটাই, তাই তার মূল্যও অনেক। আর বলতে চাই আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়-এ কথা নয়, বলতে চাই যতক্ষণ না উপযুক্ত নিরাপত্তা ও চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না হবে, তত দিন যেন কোনো মা তাঁর সন্তানকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে না পাঠান। খালি পড়ে থাক পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতের ভয়ংকর সুন্দর বেলাভূমি।
লেখক : সংগীতশিল্পী
No comments