কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-কবে হব উন্মাদ চিৎকারে হুংকারে by রণজিৎ বিশ্বাস
মাটির ঘরে স্বামীকে শুইয়ে দেওয়ার পর শহীদ মুনীর চৌধুরী পুত্রভার্যা, সাংবাদিকতার শিক্ষক ও ক্যামেরার পেছনের এক প্রতিভাময় শিল্পী মিশুক মুনীরের স্ত্রী খুব সাংঘাতিক একটি কাজ করেছেন। খুব সাহসেরও কাজ। তিনি সেখানে উপস্থিত ঢাকার মেয়রকে প্রচণ্ড ভাষায় ধিক্কার দিয়েছেন। বারবার বলেছেন_ধিক আপনাদের, আপনাদের ধিক। যাদের নেতৃত্বে সড়কের মেরামত-সংস্কারের কাজগুলো হয়, তাদের উদ্দেশে এটি এক প্রতীকী অসন্তোষ।
অকালে-অসময়ে সড়কে প্রাণ হারানো তারেক মাসুদের বন্ধু মিশুক মুনীর তাঁর সহমরণের সঙ্গীর সঙ্গে হিমঘরে ছিলেন পাশাপাশি। বন্ধুর এক দিন আগেই তিনি শেষ ঠিকানায় চলে গেলেন।
এই যাওয়া হতো আরো দুদিন আগে। সুদানে থাকা যে বড় ভাইটির অন্তিম চুম্বনের অপেক্ষাই বিলম্ব হওয়া, তিনিও বললেন_এমন হয় না, এমন হতে পারে না, এমন হতে দেওয়া যায় না। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। ছোট ভাইটিও বলেছেন এমন কথা, পিতৃপ্রতিম নিকটাত্মীয় রামেন্দু মজুমদারও বললেন প্রায় একই কথা। যোগ করলেন, আমরা বড় ক্ষুব্ধ।
ঢাকার মেয়র যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো বকা খাচ্ছিলেন, আমার মনে এক ধরনের অন্যায়তুষ্টির বোধ জেগেছিল। জেগেছিল অন্য কারণে। কয়েক দিন ধরে অনেকেই বলছিলেন, সড়কের বেহালদশা ও অপরিপক্ব চালকের হাতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের নামে মানব হত্যার লাইসেন্স তুলে দেওয়া_এসবে তাঁদেরও দায়দায়িত্ব আছে। কারণ এসব আসলে জের বওয়া।
হতেই পারে। আমি তেমন বিশ্লেষণে যাইনি। মনে মনে আমি দুটি বিষয় ভাবছিলাম। একটি ঘটনসংশ্লিষ্ট, অন্যটি ঘটনবিযুক্ত। ঘটনসংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে আবার দুটো পার্ট আছে। প্রথম পার্ট হচ্ছে, যাঁর বাবা দেশের একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী, তিনি নিজেও একরকম শাহাদাতই বরণ করলেন। জীবনের যাপন তিনিই পুরোটা শেষ করতে পারলেন না। এমন করে ভাবতে গেলে আফসোস তো হবেই! কান্না তো পাবেই।
দ্বিতীয় পার্ট হচ্ছে, কর্মসূত্র যে দুজন প্রতিভাধরকে বেঁধেছিল, যাঁদের যুগল সৃষ্টির সরণি সারণিতে সর্বশেষ সংযুক্তি হতে যাচ্ছিল 'কাগজের ফুল', তাঁরা মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সিক্ত ফুলের শোভায় ডুবতে ডুবতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় কেউ কাউকে বলে যেতে পারল না_বন্ধু তুই থেকে যা, আমি একটু আগে গেলাম।
যেন তাঁরা যাওয়ার সময় একে অন্যকে প্রবোধ দিয়ে গেলেন_যেতে তো হতোই একদিন। হলো না হয় সেই দিনটা আজই, ক্ষণটা না হয় এল অকালে, এল অসময়ে ও মানবসৃষ্ট কারণে; মানুষ তবু বুঝুক_আমাদের প্রস্থানে কারা গেল, কোন জায়গা শূন্য হলো।
ঘটনাবিযুক্ত ব্যাপারটি আমার একটি স্মৃতি উসকে দিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের এক মেধাবী ছাত্র, রাজনীতিনিরপেক্ষ আরিফ আহমেদ এস এম হলে সিঙ্গল রুমে নিবাসী থাকতে থাকতে ছাত্ররাজনীতির শিকার হয়ে এক সন্ধ্যায় এক গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। হয়ে তো গেল বেশ কয়েক বছর। এখন বছরের সংখ্যাও মনে নেই।
স্নেহসিক্ত সেই অনুজপ্রতিমের নিথর দেহ দেখার জন্য মালিবাগে এক ডিপার্চার লাউঞ্জে আমি দেখতে গিয়েছিলাম। দুই দলের দুজন নেতা সেদিন সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন শোক জানাতে। একজন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আরেকজন আসাদুজ্জামান রিপন। তাঁদের সামনে পেয়ে আমি আমার অবস্থান ও স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে সেদিন প্রচণ্ড চিৎকার করেছিলাম। মিশুক মুনীরের স্ত্রীর মতোই। ছাত্র নেতৃত্বের অক্ষম্য অপরাধ ও বিশাল ব্যর্থতার জন্য আমি কঠিন কঠিন শব্দ প্রয়োগ করেছিলাম। তাঁরা আমাকে থামাননি। তাতে উপযুক্ত একটি দায়িত্ব পালন হয়ে গিয়েছিল ভাবছি না। ভাবছি, একটি কালছবির ফিরে ফিরে আসা ও মানুষ কাড়ার দৃশ্য রোখার জন্য কবে আমরা সবাই একসঙ্গে চিৎকার করব। কবে, কখন আমরা সবাই চিৎকারে চিৎকারে উন্মাদ হব! কবে আমরা একটি দাবির সম্মেলকে উচ্চকিত হব!
কেউ জানে না। বিধাতাও না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
এই যাওয়া হতো আরো দুদিন আগে। সুদানে থাকা যে বড় ভাইটির অন্তিম চুম্বনের অপেক্ষাই বিলম্ব হওয়া, তিনিও বললেন_এমন হয় না, এমন হতে পারে না, এমন হতে দেওয়া যায় না। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। ছোট ভাইটিও বলেছেন এমন কথা, পিতৃপ্রতিম নিকটাত্মীয় রামেন্দু মজুমদারও বললেন প্রায় একই কথা। যোগ করলেন, আমরা বড় ক্ষুব্ধ।
ঢাকার মেয়র যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো বকা খাচ্ছিলেন, আমার মনে এক ধরনের অন্যায়তুষ্টির বোধ জেগেছিল। জেগেছিল অন্য কারণে। কয়েক দিন ধরে অনেকেই বলছিলেন, সড়কের বেহালদশা ও অপরিপক্ব চালকের হাতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের নামে মানব হত্যার লাইসেন্স তুলে দেওয়া_এসবে তাঁদেরও দায়দায়িত্ব আছে। কারণ এসব আসলে জের বওয়া।
হতেই পারে। আমি তেমন বিশ্লেষণে যাইনি। মনে মনে আমি দুটি বিষয় ভাবছিলাম। একটি ঘটনসংশ্লিষ্ট, অন্যটি ঘটনবিযুক্ত। ঘটনসংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে আবার দুটো পার্ট আছে। প্রথম পার্ট হচ্ছে, যাঁর বাবা দেশের একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী, তিনি নিজেও একরকম শাহাদাতই বরণ করলেন। জীবনের যাপন তিনিই পুরোটা শেষ করতে পারলেন না। এমন করে ভাবতে গেলে আফসোস তো হবেই! কান্না তো পাবেই।
দ্বিতীয় পার্ট হচ্ছে, কর্মসূত্র যে দুজন প্রতিভাধরকে বেঁধেছিল, যাঁদের যুগল সৃষ্টির সরণি সারণিতে সর্বশেষ সংযুক্তি হতে যাচ্ছিল 'কাগজের ফুল', তাঁরা মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সিক্ত ফুলের শোভায় ডুবতে ডুবতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় কেউ কাউকে বলে যেতে পারল না_বন্ধু তুই থেকে যা, আমি একটু আগে গেলাম।
যেন তাঁরা যাওয়ার সময় একে অন্যকে প্রবোধ দিয়ে গেলেন_যেতে তো হতোই একদিন। হলো না হয় সেই দিনটা আজই, ক্ষণটা না হয় এল অকালে, এল অসময়ে ও মানবসৃষ্ট কারণে; মানুষ তবু বুঝুক_আমাদের প্রস্থানে কারা গেল, কোন জায়গা শূন্য হলো।
ঘটনাবিযুক্ত ব্যাপারটি আমার একটি স্মৃতি উসকে দিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের এক মেধাবী ছাত্র, রাজনীতিনিরপেক্ষ আরিফ আহমেদ এস এম হলে সিঙ্গল রুমে নিবাসী থাকতে থাকতে ছাত্ররাজনীতির শিকার হয়ে এক সন্ধ্যায় এক গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। হয়ে তো গেল বেশ কয়েক বছর। এখন বছরের সংখ্যাও মনে নেই।
স্নেহসিক্ত সেই অনুজপ্রতিমের নিথর দেহ দেখার জন্য মালিবাগে এক ডিপার্চার লাউঞ্জে আমি দেখতে গিয়েছিলাম। দুই দলের দুজন নেতা সেদিন সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন শোক জানাতে। একজন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আরেকজন আসাদুজ্জামান রিপন। তাঁদের সামনে পেয়ে আমি আমার অবস্থান ও স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে সেদিন প্রচণ্ড চিৎকার করেছিলাম। মিশুক মুনীরের স্ত্রীর মতোই। ছাত্র নেতৃত্বের অক্ষম্য অপরাধ ও বিশাল ব্যর্থতার জন্য আমি কঠিন কঠিন শব্দ প্রয়োগ করেছিলাম। তাঁরা আমাকে থামাননি। তাতে উপযুক্ত একটি দায়িত্ব পালন হয়ে গিয়েছিল ভাবছি না। ভাবছি, একটি কালছবির ফিরে ফিরে আসা ও মানুষ কাড়ার দৃশ্য রোখার জন্য কবে আমরা সবাই একসঙ্গে চিৎকার করব। কবে, কখন আমরা সবাই চিৎকারে চিৎকারে উন্মাদ হব! কবে আমরা একটি দাবির সম্মেলকে উচ্চকিত হব!
কেউ জানে না। বিধাতাও না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
No comments