কল্পকথার গল্প-নাথিং বাট সামথিং ঝক্কিঝামেলা by আলী হাবিব
শোনেন শোনেন বন্ধুগণ, শোনেন দিয়া মন পুরাতন কিস্সা কিছু করিব বর্ণন পুরনো গল্প কেন ব্রাদার? স্টক শেষ? না, এটা হচ্ছে স্টক ধরে রাখার একটা কায়দা। এর ফায়দা কী, সেটা পরে জানা যাবে। আপাতত অন্যদিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, 'দৃষ্টিতে আর হয় না সৃষ্টি আগের মতো গোলাপ ফুল।'
কেন? কারণ, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে। দৃষ্টির সঙ্গে দৃষ্টিশক্তিরও একটা যোগ আছে। দেখতে হয়, জানতে হয়। দৃষ্টিশক্তির রকমফের যেমন থাকে, তেমনি একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা আলাদা। আমরা সবাই দেখতে পাই। কিন্তু কে কিভাবে দেখছি, সেটাই হচ্ছে মুখ্য বিষয়। এর পরও অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে, সবাই কি দেখতে পায়? তাহলে ওই গানটা এল কেমন করে, 'হায়রে কপাল মন্দ/চোখ থাকিতে অন্ধ।' অন্ধত্ব এক ধরনের রোগ। কেউ জেগে ঘুমান, চোখে কিছু দেখতে পান না। কেউ কেউ ঘুমিয়ে থাকলেও তাঁদের দৃষ্টির আড়ালে কোনো কিছুই যায় না। তাঁদের আর গানের সুরে বলা লাগে না, 'দেখো রে নয়ন মেলে।' তাঁরা নয়ন মেলেই থাকেন। মহাদেবের তৃতীয় নয়নের মতো তাঁদের চোখ সব সময় খোলাই থাকে। এসবের পাশাপাশি দেখাশোনা বলে একটা ব্যাপার আছে। শুধু দেখলে চলবে না, শুনতে হবে। শুধু শুনলেও চলবে না, দেখতে হবে। সবাই সব কিছু দেখতে ও শুনতে পান না। কেউ কেউ দেখতে পান, শুনতে পান না। একালের গায়ককে তাই চিৎকার করে গাইতে হয়, 'ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও!' কে শোনে কার কথা! যাকগে, ওই দেখাশোনার বিষয়েই আবার ফেরা যাক। কেউ কেউ আবার শুনলে দেখতে পান না। কেউ কেউ ইচ্ছে করেই দেখেন না, অথবা শোনেন না। লেখাপড়ায় ফাঁকি দেওয়া ছাত্রদের মতো কারো কারো মধ্যে এমন প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তো দৃষ্টিশক্তি কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরে কথা হবে। একটা মহাজন বাক্য বলে নেওয়া যাক। কে যেন বলেছিলেন, ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ ও বধির করে দেয়। ক্ষমতা পেলে নাকি দেয়ালের লিখন ও মানুুষের মুখের কথা বুঝে ওঠার শক্তি লোপ পায়। আমাদের সে ভয় নেই। কারণ আমরা ক্ষমতাবান নই। কাছে গিয়ে ক্ষমতার আঁচ গায়ে লাগানোও আমাদের পক্ষে অসম্ভব। কাজেই গল্পে দৃষ্টি দেওয়া যাক। গল্প হোক। পুরনো গল্প।
দেখার গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ছিলেন ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী। প্রথমে কৃপাচার্য ও পরে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেছিলেন অর্জুন। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় চক্রের মাঝখানে মাছ লক্ষ্যবিদ্ধ করে তিনি দ্রৌপদীকে লাভ করেছিলেন। এ নিয়ে একটা গল্প আছে। গল্পটি এ রকম_কুয়ার মধ্যে মাছটি ছিল। কথা ছিল তীর ছুড়ে মাছটির চোখের মণি তুলে আনতে হবে। এ অবস্থায় স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত কেউই লক্ষ্যভেদ করতে পারেননি। গেলেন অর্জুন। ধনুকে তীর লাগিয়ে লক্ষ্য স্থির করলেন। পাশে তাঁর গুরু দ্রোণাচার্য। গুরু ওস্তাদের কাছে জানতে চাইলেন, 'কী দেখতে পাচ্ছ?' শিষ্য অর্জুনের জবাব_একটা মাছ। 'দৃষ্টি আরো কাছে নিয়ে যাও। এবার কী দেখতে পাচ্ছ?' গুরুর প্রশ্নে অর্জুনের উত্তর, 'মাছের মাথা।' দৃষ্টি আরো নিবিষ্ট করতে বললেন গুরু। ওস্তাদের নির্দেশে শিষ্যের দৃষ্টি আরো নিবিষ্ট হলো। 'কী দেখতে পাচ্ছ?'_জানতে চাইলেন গুরু। 'মাছের চোখ।' শিষ্যের এই জবাবে গুরু দ্রোণাচার্য বললেন, 'আরো নিবিষ্ট করো দৃষ্টি। কী দেখতে পাচ্ছো?' 'চোখের মণি।' শিষ্যের জবাব শুনে গুরুর নির্দেশ, 'এবার তীর ছোড়।' তীর ছুড়ে মাছের চোখের মণি তুলে আনলেন অর্জুন। অর্জন করলেন দ্রৌপদীকে। পরে তো ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে অন্য গল্প। সে যাকগে!
অর্জুন ছিলেন রাজপুত্র। সে আমলে তো আর এখনকার মতো ভোট ছিল না, তত্ত্বাবধায়কও ছিল না, ছিল না সংসদ কিংবা বিরোধী দল। রাজা-বাদশাহ-সম্রাটদের রাজত্ব ছিল। তাঁদের ইচ্ছাই ছিল শেষ কথা। তো, ওই রাজ-রাজড়াদের পেছনে তখন একদল তাঁবেদার ঘুর ঘুর করতে দেখা যেত। অনেকে আবার তাঁবেদার পুষতে পছন্দ করতেন। সে আমলের রাজাদের মন্ত্রী-উজির-নাজির কিংবা রাজসভার পাত্র-মিত্র হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হতো, তাঁরাও এক অর্থে ছিলেন রাজার তাঁবেদার। রাজা যখন রাজদরবারে ঢুকতেন, তখন সবাই কুর্ণিশ করে বলতেন, 'মহারাজার জয় হোক' কিংবা 'জয়, বাদশাহ নামদারের জয়।' তাঁদের কাজই ছিল রাজা-বাদশাহদের তোয়াজ করা। তোয়াজ করা নিয়ে প্রতিযোগিতাও হতো। রাজা-বাদশাহদের চোখের সামনে তোয়াজের একটা পর্দাও টাঙিয়ে দিতেন তাঁরা। ফলে রাজা-বাদশাহরা অনেক সময় আসলটা দেখতে পেতেন না। তেমনই এক রাজার গল্প। রাজাদের নানা ধরনের শখ ছিল। কোনো এক শীতের রাতে এক রাজা বেরিয়েছেন রাতের দৃশ্য দেখতে। হঠাৎ কাছের বনে একদল শিয়াল 'হুক্কা-হুয়া হুক্কা-হুয়া' রবে ডেকে উঠল। তিনি জানতে চাইলেন, শিয়াল ডাকছে কেন? সঙ্গে থাকা অমাত্যরা বললেন, 'এটা তো শীতের সময়, ওদের শীত লাগছে। সেই কষ্টে ওরা কাঁদছে।' মহারাজ বললেন, রাজকোষ থেকে টাকা নিয়ে ওদের কম্বল কিনে দাও।
কয়েক দিন পর ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় আবার শিয়ালের ডাক শুনতে পেলেন রাজা। তিনি জানতে চাইলেন, 'আজ আবার শিয়ালগুলো ডাকছে কেন? ওদের তো সেদিন কম্বল কিনে দেওয়া হয়েছে।' সঙ্গে থাকা তাঁবেদারদের জবাব, 'আজ ওরা মহারাজার জয়গান গাইছে।'
এই গল্পটাই আবার অন্যভাবেও শোনা যায়। রাজা রাজবাড়ির ঝুল বারান্দায় খোশ মেজাজে বসে ছিলেন। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এল শিয়ালের ডাক। তিনি কারণ জানতে চাইলেন। তাঁকে জানানো হলো, শিয়ালগুলো ক্ষুধার্ত। রাজার কাছে খাবার চাইছে। তিনি রাজকোষ থেকে টাকা নিয়ে শিয়ালগুলোকে খাবার কিনে দিতে বললেন। কিছুদিন পর আবার শিয়ালের ডাক। 'ওরা আবার কী চাইছে?' জানতে চাইলেন রাজা। 'ভরপেট খেয়ে ওরা এখন মহারাজার গুণগান গাইছে'_তাঁবেদারদের জবাব।
পুরনো আরেক গল্প সেই ন্যাংটো রাজার। যাকে অদৃশ্য কাপড় পরিয়েছিল কিছু প্রতারক। রাজা সেই অদৃশ্য কাপড় পরে বেরিয়েছিলেন রাস্তায়। তাঁবেদাররা কেউ কিছু বলেনি। সবাই ধন্য ধন্য করেছে। শেষে এক শিশু দূর থেকে চিৎকার করে জানিয়ে দেয়, রাজার পরনে কাপড় নেই। নিজের চোখে তাকালেন রাজা। এর আগে দেখছিলেন অন্যের চোখে। নিজের পরনে কাপড় নেই, এটা তিনি দেখতেই পাননি।
রাজ-রাজড়াদের দিন আজ নেই। কিন্তু এখনো কি আমরা দেখতে পাই? রাস্তা থেকে বিটুমিন উঠে যায়। রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়, আমরা দেখতে পাই না। রাস্তার দাবিতে মানুষ মানববন্ধন করে। বাস মালিকরা ধর্মঘটে গেলেও আমাদের চোখ ফোটে না। ঈদের সময় বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়। আমরা দেখি না। নৌপথে লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা লঞ্চ চলে, আমরা দেখেও দেখি না। ওসব আমাদের চোখে পড়ে না। শুধু রাস্তার বেহাল দশার জন্য বাধাগ্রস্ত হয় আমাদের চলার পথের গতি। আমাদের চোখে পড়ে না মানুষের দুর্গতি। আমাদের দৃষ্টি থাকে বাণিজ্যের দিকে। 'বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী'_সে লক্ষ্মী ঠাকুর কবির না হলেও আমাদের কারো কিছু আসে-যায় না। আমরা সেই লক্ষ্মীকে অস্বীকার করি কেমন করে! আমাদের বাণিজ্যলক্ষ্মীকে সব সময় আমাদের সঙ্গে রাখতে চাই। এর পরও আমরা ভালো আছি। আমরা আমাদের ওপরওয়ালাদের বুঝিয়ে দিতে পেরেছি, আমাদের বিকল্প নেই। এবার ঈদের ছুটি অনেক লম্বা। সেই ছুটিতে প্রিয়জনদের কাছে যেতে চাই আমরা। কেমন করে যাব? আমাদের রেলের বগি আছে, ইঞ্জিন নেই। ইঞ্জিন যদি না থাকে, তাহলে ওই খালি বগি টেনে নিয়ে যাওয়ার উপায় কী? আবার ওই খালি বগিতে উঠে বসে থাকলে তো আর চলবে না! বগিতে উঠব যে আমাদের টিকিট কই? পপশিল্পীর গাওয়া গানটি আমরা সবাই শুনেছি, 'লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ি।' এখন দেখছি, ইঞ্জিন ছাড়া আমাদের রেলগাড়ি চলছে না। আমাদের তবে উপায় কী? আমরা কি নন্দলাল হয়ে যাব! সেই যে নন্দলাল, যে নাকি একটা দেশের জন্য বিরাট এক কিছু করার প্ল্যান করেছিল_'নন্দলাল তো একদা একটি করিল ভীষণ পণ/ স্বদেশের তরে যে করেই হোক রাখিবেই সে জীবন।' প্ল্যান করে ঘরে ঢুকে বসে ছিল। কেন? কারণ যেখানেই সে যেতে চায়, যেতে ভয় পায়। কেমন করে যাবে? বাস উল্টে খাদে পড়ে, লঞ্চডুবি হয়, রেল দুর্ঘটনা হয়। তার চেয়ে ঘরে বসে থাকাটাই তো মঙ্গল! নন্দ ঘরে বসে থাকে। কবি ডি এল রায় লিখছেন, "নন্দ বাড়ির হতো না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি;/চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি;/নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে 'কলিশন' হয়;/হাঁটিতে সর্প, কুক্কুর আর গাড়ি-চাপা-পড়া ভয়;/তাই শুয়ে শুয়ে কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল।/সকলে বলিল 'ভ্যালারে নন্দ বেঁচে থাক চিরকাল'।" তা সে যে যা বলে বলুক, আমরা যে কী করি! আমাদের পদে পদে বিপদ। আমাদের তো ঘর থেকে বের না হয়ে উপায় নেই। বেঁচে থাকার জন্যই রোজ আমাদের ঘর থেকে বের হতে হয়। আমাদের মনে মধ্যবিত্তসুলভ আবেগ। আমরা নাড়ির টান এড়াতে পারি না। ওদিকে ভয় আমাদের পিছু ছাড়ে না।
তার পরও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা ভয় পেয়ে পিছিয়ে থাকব না। আমাদের চলার পথ আমরা মসৃণ করবই। আমাদের সামনে কেউ বাধা হয়ে আসতে পারবে না। ষড়যন্ত্রকারীরা ষড়যন্ত্র করবে। আমরা ভালো কাজ করছি এবং করব। আমাদের কোনো ভয় নেই। রবার্ট ব্রুস নামের এক রাজা আমাদের আদর্শ। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, 'একবার না পারিলে দেখ শতবার'। যুদ্ধে সাতবার পরাজিত হয়েও ক্ষান্ত হননি। আমরা কেন রণে ভঙ্গ দেব। এবার যদি না পারি তো আগামীবার। এবার দুর্ভোগ হয়তো হয়েছে। ওটা কিন্তু নাথিং। চলার পথে সামথিং ঝক্কিঝামেলা তো থাকবেই। আগামীবার আর এই ঝামেলা থাকবে না। আগামীবার আমাদের রাস্তা হয়ে যাবে মসৃণ। খানাখন্দ থাকবে না। রাস্তা হবে যানজটমুক্ত, থাকবে না গর্ত। এবার যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি, আসুন তাঁরা এই আশায় বুক বাঁধি, সামনের ঈদে আমাদের রাস্তা ঝকঝকে-তকতকে হবে।
এবার ঈদে এই ভাঙা রাস্তায় নড়বড়ে বাসে নাচতে নাচতে বাড়িতে যাব। 'মায়ের-ভায়ের এতো স্নেহ/কোথায় গেলে পাবে কেহ!' যাব মায়ের কাছে। 'পথের ক্লান্তি ভুলে, মায়ের স্নেহমাখা কোলে শীতল হব।'
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
দেখার গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ছিলেন ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী। প্রথমে কৃপাচার্য ও পরে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেছিলেন অর্জুন। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় চক্রের মাঝখানে মাছ লক্ষ্যবিদ্ধ করে তিনি দ্রৌপদীকে লাভ করেছিলেন। এ নিয়ে একটা গল্প আছে। গল্পটি এ রকম_কুয়ার মধ্যে মাছটি ছিল। কথা ছিল তীর ছুড়ে মাছটির চোখের মণি তুলে আনতে হবে। এ অবস্থায় স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত কেউই লক্ষ্যভেদ করতে পারেননি। গেলেন অর্জুন। ধনুকে তীর লাগিয়ে লক্ষ্য স্থির করলেন। পাশে তাঁর গুরু দ্রোণাচার্য। গুরু ওস্তাদের কাছে জানতে চাইলেন, 'কী দেখতে পাচ্ছ?' শিষ্য অর্জুনের জবাব_একটা মাছ। 'দৃষ্টি আরো কাছে নিয়ে যাও। এবার কী দেখতে পাচ্ছ?' গুরুর প্রশ্নে অর্জুনের উত্তর, 'মাছের মাথা।' দৃষ্টি আরো নিবিষ্ট করতে বললেন গুরু। ওস্তাদের নির্দেশে শিষ্যের দৃষ্টি আরো নিবিষ্ট হলো। 'কী দেখতে পাচ্ছ?'_জানতে চাইলেন গুরু। 'মাছের চোখ।' শিষ্যের এই জবাবে গুরু দ্রোণাচার্য বললেন, 'আরো নিবিষ্ট করো দৃষ্টি। কী দেখতে পাচ্ছো?' 'চোখের মণি।' শিষ্যের জবাব শুনে গুরুর নির্দেশ, 'এবার তীর ছোড়।' তীর ছুড়ে মাছের চোখের মণি তুলে আনলেন অর্জুন। অর্জন করলেন দ্রৌপদীকে। পরে তো ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে অন্য গল্প। সে যাকগে!
অর্জুন ছিলেন রাজপুত্র। সে আমলে তো আর এখনকার মতো ভোট ছিল না, তত্ত্বাবধায়কও ছিল না, ছিল না সংসদ কিংবা বিরোধী দল। রাজা-বাদশাহ-সম্রাটদের রাজত্ব ছিল। তাঁদের ইচ্ছাই ছিল শেষ কথা। তো, ওই রাজ-রাজড়াদের পেছনে তখন একদল তাঁবেদার ঘুর ঘুর করতে দেখা যেত। অনেকে আবার তাঁবেদার পুষতে পছন্দ করতেন। সে আমলের রাজাদের মন্ত্রী-উজির-নাজির কিংবা রাজসভার পাত্র-মিত্র হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হতো, তাঁরাও এক অর্থে ছিলেন রাজার তাঁবেদার। রাজা যখন রাজদরবারে ঢুকতেন, তখন সবাই কুর্ণিশ করে বলতেন, 'মহারাজার জয় হোক' কিংবা 'জয়, বাদশাহ নামদারের জয়।' তাঁদের কাজই ছিল রাজা-বাদশাহদের তোয়াজ করা। তোয়াজ করা নিয়ে প্রতিযোগিতাও হতো। রাজা-বাদশাহদের চোখের সামনে তোয়াজের একটা পর্দাও টাঙিয়ে দিতেন তাঁরা। ফলে রাজা-বাদশাহরা অনেক সময় আসলটা দেখতে পেতেন না। তেমনই এক রাজার গল্প। রাজাদের নানা ধরনের শখ ছিল। কোনো এক শীতের রাতে এক রাজা বেরিয়েছেন রাতের দৃশ্য দেখতে। হঠাৎ কাছের বনে একদল শিয়াল 'হুক্কা-হুয়া হুক্কা-হুয়া' রবে ডেকে উঠল। তিনি জানতে চাইলেন, শিয়াল ডাকছে কেন? সঙ্গে থাকা অমাত্যরা বললেন, 'এটা তো শীতের সময়, ওদের শীত লাগছে। সেই কষ্টে ওরা কাঁদছে।' মহারাজ বললেন, রাজকোষ থেকে টাকা নিয়ে ওদের কম্বল কিনে দাও।
কয়েক দিন পর ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় আবার শিয়ালের ডাক শুনতে পেলেন রাজা। তিনি জানতে চাইলেন, 'আজ আবার শিয়ালগুলো ডাকছে কেন? ওদের তো সেদিন কম্বল কিনে দেওয়া হয়েছে।' সঙ্গে থাকা তাঁবেদারদের জবাব, 'আজ ওরা মহারাজার জয়গান গাইছে।'
এই গল্পটাই আবার অন্যভাবেও শোনা যায়। রাজা রাজবাড়ির ঝুল বারান্দায় খোশ মেজাজে বসে ছিলেন। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এল শিয়ালের ডাক। তিনি কারণ জানতে চাইলেন। তাঁকে জানানো হলো, শিয়ালগুলো ক্ষুধার্ত। রাজার কাছে খাবার চাইছে। তিনি রাজকোষ থেকে টাকা নিয়ে শিয়ালগুলোকে খাবার কিনে দিতে বললেন। কিছুদিন পর আবার শিয়ালের ডাক। 'ওরা আবার কী চাইছে?' জানতে চাইলেন রাজা। 'ভরপেট খেয়ে ওরা এখন মহারাজার গুণগান গাইছে'_তাঁবেদারদের জবাব।
পুরনো আরেক গল্প সেই ন্যাংটো রাজার। যাকে অদৃশ্য কাপড় পরিয়েছিল কিছু প্রতারক। রাজা সেই অদৃশ্য কাপড় পরে বেরিয়েছিলেন রাস্তায়। তাঁবেদাররা কেউ কিছু বলেনি। সবাই ধন্য ধন্য করেছে। শেষে এক শিশু দূর থেকে চিৎকার করে জানিয়ে দেয়, রাজার পরনে কাপড় নেই। নিজের চোখে তাকালেন রাজা। এর আগে দেখছিলেন অন্যের চোখে। নিজের পরনে কাপড় নেই, এটা তিনি দেখতেই পাননি।
রাজ-রাজড়াদের দিন আজ নেই। কিন্তু এখনো কি আমরা দেখতে পাই? রাস্তা থেকে বিটুমিন উঠে যায়। রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়, আমরা দেখতে পাই না। রাস্তার দাবিতে মানুষ মানববন্ধন করে। বাস মালিকরা ধর্মঘটে গেলেও আমাদের চোখ ফোটে না। ঈদের সময় বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়। আমরা দেখি না। নৌপথে লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা লঞ্চ চলে, আমরা দেখেও দেখি না। ওসব আমাদের চোখে পড়ে না। শুধু রাস্তার বেহাল দশার জন্য বাধাগ্রস্ত হয় আমাদের চলার পথের গতি। আমাদের চোখে পড়ে না মানুষের দুর্গতি। আমাদের দৃষ্টি থাকে বাণিজ্যের দিকে। 'বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী'_সে লক্ষ্মী ঠাকুর কবির না হলেও আমাদের কারো কিছু আসে-যায় না। আমরা সেই লক্ষ্মীকে অস্বীকার করি কেমন করে! আমাদের বাণিজ্যলক্ষ্মীকে সব সময় আমাদের সঙ্গে রাখতে চাই। এর পরও আমরা ভালো আছি। আমরা আমাদের ওপরওয়ালাদের বুঝিয়ে দিতে পেরেছি, আমাদের বিকল্প নেই। এবার ঈদের ছুটি অনেক লম্বা। সেই ছুটিতে প্রিয়জনদের কাছে যেতে চাই আমরা। কেমন করে যাব? আমাদের রেলের বগি আছে, ইঞ্জিন নেই। ইঞ্জিন যদি না থাকে, তাহলে ওই খালি বগি টেনে নিয়ে যাওয়ার উপায় কী? আবার ওই খালি বগিতে উঠে বসে থাকলে তো আর চলবে না! বগিতে উঠব যে আমাদের টিকিট কই? পপশিল্পীর গাওয়া গানটি আমরা সবাই শুনেছি, 'লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ি।' এখন দেখছি, ইঞ্জিন ছাড়া আমাদের রেলগাড়ি চলছে না। আমাদের তবে উপায় কী? আমরা কি নন্দলাল হয়ে যাব! সেই যে নন্দলাল, যে নাকি একটা দেশের জন্য বিরাট এক কিছু করার প্ল্যান করেছিল_'নন্দলাল তো একদা একটি করিল ভীষণ পণ/ স্বদেশের তরে যে করেই হোক রাখিবেই সে জীবন।' প্ল্যান করে ঘরে ঢুকে বসে ছিল। কেন? কারণ যেখানেই সে যেতে চায়, যেতে ভয় পায়। কেমন করে যাবে? বাস উল্টে খাদে পড়ে, লঞ্চডুবি হয়, রেল দুর্ঘটনা হয়। তার চেয়ে ঘরে বসে থাকাটাই তো মঙ্গল! নন্দ ঘরে বসে থাকে। কবি ডি এল রায় লিখছেন, "নন্দ বাড়ির হতো না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি;/চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি;/নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে 'কলিশন' হয়;/হাঁটিতে সর্প, কুক্কুর আর গাড়ি-চাপা-পড়া ভয়;/তাই শুয়ে শুয়ে কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল।/সকলে বলিল 'ভ্যালারে নন্দ বেঁচে থাক চিরকাল'।" তা সে যে যা বলে বলুক, আমরা যে কী করি! আমাদের পদে পদে বিপদ। আমাদের তো ঘর থেকে বের না হয়ে উপায় নেই। বেঁচে থাকার জন্যই রোজ আমাদের ঘর থেকে বের হতে হয়। আমাদের মনে মধ্যবিত্তসুলভ আবেগ। আমরা নাড়ির টান এড়াতে পারি না। ওদিকে ভয় আমাদের পিছু ছাড়ে না।
তার পরও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা ভয় পেয়ে পিছিয়ে থাকব না। আমাদের চলার পথ আমরা মসৃণ করবই। আমাদের সামনে কেউ বাধা হয়ে আসতে পারবে না। ষড়যন্ত্রকারীরা ষড়যন্ত্র করবে। আমরা ভালো কাজ করছি এবং করব। আমাদের কোনো ভয় নেই। রবার্ট ব্রুস নামের এক রাজা আমাদের আদর্শ। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, 'একবার না পারিলে দেখ শতবার'। যুদ্ধে সাতবার পরাজিত হয়েও ক্ষান্ত হননি। আমরা কেন রণে ভঙ্গ দেব। এবার যদি না পারি তো আগামীবার। এবার দুর্ভোগ হয়তো হয়েছে। ওটা কিন্তু নাথিং। চলার পথে সামথিং ঝক্কিঝামেলা তো থাকবেই। আগামীবার আর এই ঝামেলা থাকবে না। আগামীবার আমাদের রাস্তা হয়ে যাবে মসৃণ। খানাখন্দ থাকবে না। রাস্তা হবে যানজটমুক্ত, থাকবে না গর্ত। এবার যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি, আসুন তাঁরা এই আশায় বুক বাঁধি, সামনের ঈদে আমাদের রাস্তা ঝকঝকে-তকতকে হবে।
এবার ঈদে এই ভাঙা রাস্তায় নড়বড়ে বাসে নাচতে নাচতে বাড়িতে যাব। 'মায়ের-ভায়ের এতো স্নেহ/কোথায় গেলে পাবে কেহ!' যাব মায়ের কাছে। 'পথের ক্লান্তি ভুলে, মায়ের স্নেহমাখা কোলে শীতল হব।'
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments