স্থাপত্য শিক্ষার সুযোগ ও সম্ভাবনা-শিক্ষা by মীর মোবাশ্বের আলী

স্থাপত্য বিভাগও একটা পরিবারের মতো। স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হওয়া মানে এই পরিবারের সদস্য হওয়া। সফলভাবে পড়াশোনা শেষ হলে পেশায় যোগ দেওয়াও একটা অর্জন ও মর্যাদার বিষয়। আজকে স্থাপত্য বিভাগে পড়তে আসা মানে ভবিষ্যতে সফলভাবে স্থাপত্য পেশা অনুশীলনের পথে প্রথম পদক্ষেপ রাখা


বাংলাদেশে স্থাপত্য পেশার অগ্রগতির কথা আলোচনা করতে গেলে পেশাজীবীদের অনেক অর্জনের কথা বলতে হয়, যার অনেকটাই অর্জিত হয়েছে পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। আজ ঢাকা শহরে যে কোনো ভবন তৈরির অনুমোদন পেতে হলে সে ভবনটির ডিজাইন করার সময় একজন স্থপতির পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে। এদেশে একটা খুবই সুবিন্যস্ত ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড পার্লামেন্টে পাস ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ নিয়মনীতি কার্যকর করা হয়েছে। অর্থাৎ স্থপতির ডিজাইন করা ছাড়া কোনো স্থাপনাই নির্মাণ করা যাবে না। কারণ স্থপতি নিশ্চিত করবেন যাতে ভবনটি খুব স্বাস্থ্যসম্মত, নিরাপদ এবং বসবাসের উপযুক্ত হয়। শুধু তাই নয়, ভবনটি দেখতে সুন্দর ও অভ্যন্তরে আরামদায়ক এবং আনন্দময় হতে হবে। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সব বিধির প্রয়োগ মেনে ভবনটি তৈরি হবে এবং ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা খালি জায়গার পরিমাণ পরীক্ষিতভাবে সঠিক মাপমতো হতে হবে।
তা ছাড়া একটি স্থাপনার কাঠামো (Structure ) ও গঠন প্রণালি যথেষ্ট মজবুত হয়েছে কি-না তা দেখতে হবে। তাতে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ইত্যাদি ঠিকমতো, নিখুঁত, নিরাপদ ও সুন্দরভাবে বসানো হয়েছে কি-না সেদিকে শুধু লক্ষ্য রাখবে তা নয়, বরং সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে।
স্থাপত্য শিক্ষার বিবরণ দিতে গেলে প্রশ্ন রাখতে হয়, একজন স্থপতিকে কী জানতে হয়? এর উত্তর বোধহয় এভাবেই ভালো দেওয়া যায়, তার কী না জানলে চলে। পৃথিবীতে হেন জিনিস নেই যা না জানলে চলে। পাঠ্য বিষয়, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি ছাড়াও তার জ্ঞান থাকতে হয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, আচার-ব্যবহার, দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড ও জীবন ধারণের পদ্ধতি সম্বন্ধে। উদাহরণস্বরূপ দেখা যাক_ একটা বাড়ি ডিজাইন করতে হলে স্থপতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানতে হয় একটা বাড়িতে কী হবে। প্রথমত, বাড়ি বিশ্রামের স্থল, সারাদিনের সব কাজ ও পরিশ্রমের পর প্রয়োজন শান্তি এবং বিশ্রাম, অর্থাৎ শোয়া, বসা ও ঘুম। বাড়ি কর্মস্থানও বটে, যেমন_ রান্না করা, গোসল করা, পড়াশোনা করা, ছোটখাটো কাজ করার জিনিস (Tool ) দিয়ে কাজ করা, বাগান করা, গাছ লাগানো ইত্যাদি। বাড়ি বিনোদনের স্থলও; টিভি দেখা, রেডিও ও গান-বাজনা শোনা, খেলাধুলা করা (তাস, দাবা), আড্ডা দেওয়া, অতিথি আপ্যায়ন করা, বিয়ে-শাদি, মিলাদ ইত্যাদি অনুষ্ঠান করা; মোট কথা, একটা বাড়িতে যা কিছু ঘটতে পারে তার সবকিছু চিন্তা করে তার স্থান নির্ণয় করা। শুধু তাই নয়, বসবাস করা যে সুখময় ও আনন্দদায়ক হয়, তার ব্যবস্থা করা। আর পথচারী যেন বাড়িটি দেখে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে বলে_ বাহ্! স্থপতির কাজকে সংজ্ঞায়িত করতে হলে বলতে হয়, তা হচ্ছে উন্নত জীবনযাত্রার পরিবেশ সৃষ্টি করা সব মানুষের তৈরি কর্মকাণ্ডেই রয়েছে স্থপতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
এখানেই শেষ নয়, ভবনটি নির্মাণ করতে হবে। সে জন্য লোহা, ইট, সিমেন্ট, কাঠ ইত্যাদির ব্যবহার সম্বন্ধে জানতে হবে। ভবনটি যাতে মজবুত হয় তার ব্যবস্থাও করতে হবে। ঝড়, বাতাস, বৃষ্টি, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি থেকে নিরাপদ হতে হবে। আলো-বাতাস পরিমাণমতো পাওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। এ ছাড়া পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদি কীভাবে প্রতিস্থাপন করতে হবে তাও স্থির করতে হবে। সবার ওপরে নন্দনতত্ত্ব ও সৃজনশীলতার সম্পূর্ণ প্রয়োগ বা বিকাশ ঘটাতে হবে। এ নন্দনতত্ত্ব শেখা ও সৃজনশীলতার অনুশীলনই স্থাপত্য শিক্ষাকে করেছে অন্যান্য শিক্ষার চেয়ে ভিন্ন; এটা ঠিক ব্যাকরণ বা অঙ্ক শেখার মতো নয়। নন্দনতত্ত্ব বা সৌন্দর্যবোধের মূল হচ্ছে মানুষ ও তার ভাব বা দর্শন। প্রাচ্য দর্শনে বলা হয়, সত্যম শিবম সুন্দরম, যা সত্য তাই সুন্দর। অন্যভাবে বলতে গেলে, যা বাহুল্যবর্জিত স্বাভাবিক, তা-ই সুন্দর। সৃষ্টির সুন্দরতম নিদর্শন হচ্ছে মানুষ, যা উত্তম উপকরণে সৃষ্ট। প্রাচ্যের চর্যা কবি চণ্ডীদাস বলেন, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। স্থাপত্য শিক্ষার একটা দিক হচ্ছে, মানুষকে জানা, তার মহত্ত্বকে উপলব্ধি করা। বাস্তব সৃষ্টির মাধ্যমে মানবতার বিকাশ ঘটানো।
স্থপতির প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি হওয়ার কারণে অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগ খোলা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়েও দুই টার্ম ধরে অর্থাৎ ঝঢ়ৎরহম ২০১১ থেকে স্থাপত্য বিভাগ খোলা হয়েছে। শুরুতে অল্প কয়েকজন নিয়ে শুরু হলেও দ্বিতীয় টার্মে ভালো সাড়া পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনুমোদিত একটি আধুনিক সিলেবাস অনুযায়ী পাঠ্যক্রম ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। যেহেতু স্থাপত্যে ব্যবহারিক শিক্ষার প্রয়োজন অনেক বেশি, তাই শুধু ক্লাসরুমনির্ভর শিক্ষা ছাড়াও ইন্টার্নশিপ, সাইট দেখা, কাজ পরিদর্শন করা, উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কর্ম পরিদর্শন ও পর্যালোচনা করা এবং নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, স্থাপত্য শিক্ষা অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে একটু ভিন্নতর। থিওরিটিক্যাল প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস ছাড়া স্থাপত্য শিক্ষায় স্টুডিও ক্লাসের প্রাধান্য বেশি। এ ক্লাসে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক দাঁড়ায় অনেকটা গুরু-শিষ্যের মতো। হেন বিষয় নেই যা নিয়ে আলোচনা হয় না। প্রতিটি পর্যায়ে কাজের অগ্রগতি শিক্ষকের নজর এড়ায় না, বরং উৎসাহদানের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা কনফিডেন্স পায় ও অর্থবহ সমাধান বা ডিজাইন করতে সক্ষম হয়। স্থাপত্য শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীকে যথেষ্ট মনোযোগী ও পরিশ্রমী হতে হয়। যেহেতু কাজটা খুবই সন্তুষ্টিদায়ক, সে জন্য পরিশ্রমটা ক্লান্তিময় মনে না হয়ে বরং আনন্দদায়ক মনে হয়। আমরাও পরিবেশটা সে রকম রাখার চেষ্টা করি।
স্থাপত্য শিক্ষায় পরিবেশটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা সৃজনশীল পরিবেশেই শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশ লাভ ও প্রশংসনীয় ডিজাইন বেরিয়ে আসতে পারে।
স্থপতিরা শুধু যে ডিজাইন করেন তা নয়, তারা সমাজে রুচিবোধ সৃষ্টিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কোনো সময় একটা বিশেষ স্টাইল প্রাধান্য লাভ করে। এর নাম, ধরন ও রুচি বৈশিষ্ট্যও স্থাপত্যকর্মের মাধ্যমে আসে। ইতিহাসের বিভিন্ন স্টাইলও সেই সময়ের স্থাপত্য ও শিল্পের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই নামে পরিচিত হয়। যেমন Classical, Roman, Mediaval, Gothic, Reniscience, Baroque Modern, Post-Modern ইত্যাদি। সব Art Movement -এর প্রতিফলন স্থপতিদের ওপর পড়ে, এমনকি স্থপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
স্থাপত্য বিভাগ অন্যান্য সুকুমার শিল্প সম্বন্ধে সচেতন ও উৎসাহী। সব জনগোষ্ঠীরই কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য বা বিশেষ গুণাগুণ থাকে, যাতে তারা সুপারদর্শী হয়। জাপানে মেয়েরা হাতের সূক্ষ্ম কাজে একটা বিশেষ দক্ষতা রাখে। সে জন্য একসময় তারা ইলেকট্রনিক জিনিস তৈরিতে জাপানকে একটা বিশেষ স্থানে নিয়ে যায়। তেমনি বাঙালিদের যদি কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা দক্ষতা আবিষ্কার করতে হয় তবে তা হবে সুকুমার শিল্পের ক্ষেত্রে। সব বাঙালিই কবিতা লিখতে পারে। তেমনি বাঙালিদের স্থাপত্য বা ডিজাইনের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ প্রতিভা ও দক্ষতা আছে বলে মনে হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাঙালি স্থপতিরা বিদেশে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিতে আমাদের অঙ্গীকার যে, এখানকার স্নাতক বা সদ্য ডিগ্রিপ্রাপ্ত স্থপতিদের শিক্ষা ও যোগ্যতার মান পৃথিবীর যে কোনো দেশের স্নাতকদের সমমানের হবে। আমাদের যোগ্যতা, প্রচেষ্টা ও কর্মোদ্দীপনা এমনটাই হবে বলে মনে করি। যেসব ছাত্র ভর্তি হয়েছে তাদের মানও বেশ ভালো এবং তারা আমাদের অঙ্গীকার বাস্তবে পরিণত করতে সক্ষম হবে বলে আশা রাখি। স্থপতিরা তাদের পেশার প্রতি একটা বিশেষ দরদ রাখেন ও তারা এর প্রতি নিবেদিত। স্থাপত্য বিভাগও একটা পরিবারের মতো। স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হওয়া মানে এই পরিবারের সদস্য হওয়া। সফলভাবে পড়াশোনা শেষ হলে পেশায় যোগ দেওয়াও একটা অর্জন ও মর্যাদার বিষয়। আজকে স্থাপত্য বিভাগে পড়তে আসা মানে ভবিষ্যতে সফলভাবে স্থাপত্য পেশা অনুশীলনের পথে প্রথম পদক্ষেপ রাখা।

মীর মোবাশ্বের আলী :অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, স্থাপত্য বিভাগ, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি

No comments

Powered by Blogger.