বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-কিবরিয়া হত্যা মামলা : শুধু তদন্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে! by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি নিজ জেলা হবিগঞ্জের বৈদ্যেরবাজারে এক রাজনৈতিক জনসভা শেষে গাড়িতে ওঠার সময় দুর্বৃত্তদের বোমা হামলায় বাংলাদেশের ক্ষণজন্মা মানুষ শাহ এ এম এস কিবরিয়া রক্তাক্ত হন। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইরত শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে বাঁচানোর জন্য এর পর পরই ঢাকায় নিয়ে আসা হলেও সব ধরনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। তিনি চিরবিদায় নেন বৈরী সময়ের হিংস্র ছোবলে, ওই দিনই রাত প্রায় ১২টায়।
অভিযোগ আছে, কিবরিয়া রক্তাক্ত অবস্থায় যখন হবিগঞ্জের জেলা সদর হাসপাতালে কাতরাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে ঢাকায় আনতে বা পাঠাতে স্থানীয় এবং ঊর্ধ্বতন প্রশাসন অনেক কালক্ষেপণ করে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তখনই তিনি প্রায় চলে যান জীবনের শেষ প্রান্তে। তৎকালীন (২০০১-২০০৬) সরকারের শাসনামলে বিরোধীদলীয় অসংখ্য নেতা-কর্মী অপশক্তির নির্যাতন-হামলার শিকার হন। সেসব নির্যাতন-হামলার পেছনে তৎকালীন শাসক জোটের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগসাজশ ছিল বলে অভিযোগ আছে। শুধু নির্যাতন-হামলাই নয়, প্রাণও কেড়ে নেওয়া হয় অনেকেরই। শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং আহসানউল্লাহ মাস্টারের হত্যাকাণ্ড তারই সাক্ষ্য বহন করছে। এর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানীর জনবহুল এলাকায় এক জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়, যে জনসভায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা করছিলেন। শেখ হাসিনা তখন অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও ওই হামলায় আইভী রহমানসহ ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। এখনো বহু মানুষ ওই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। এ সবই জানা কথা, পুরনো কথা। মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বৃত্তবন্দি থেকে তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের যে ক্ষতি করে গেছে, যেসব ক্ষত সৃষ্টি করে গেছে, তা কবে পূরণ হবে, বলা দুষ্কর। এককালের মেধাবী ছাত্র, পেশাগত জীবনে দক্ষ কূটনীতিক ও অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের অন্যতম সফল অর্থমন্ত্রী হিসেবে শাহ এ এম এস কিবরিয়ার অবদানের কথা বলে শেষ করা কি সম্ভব? যে দেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে স্বাধীনতার স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, জাতীয় নেতাদের রাষ্ট্রের সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান কারাগারে ঢুকেও হত্যা করা হয়, যে দেশের মানুষ প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রগতির অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করে, তাদেরই আক্রমণ করা হয় এবং পঙ্গু ও হত্যা করা হয়, সেই দেশের মানবাধিকারের চিত্র সম্পর্কে কথা বলাও নিষ্প্রয়োজন। আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের দুরবস্থার চিত্র এ থেকেই তো প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে। আজ যখন তৎকালীন শাসকদল এবং তাদের সমমনারা আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে বড় বড় বুলি কপচান, তখন মনে হয়, সত্যিই রক্তস্নাত বাংলাদেশে বড় অদ্ভুত রকমভাবে স্ববিরোধিতা জিইয়ে রাখা হয়েছে। বিগত সাত বছরে কিবরিয়া হত্যার বিচার সম্পন্ন তো হয়ইনি, উপরন্তু ওই মর্মন্তুদ ঘটনাকে কত বাঁকে আমরা পাক খেতে দেখলাম। চারদলীয় জোট শাসকগোষ্ঠী রীতিমতো এ নিয়ে প্রহসনে মেতে উঠেছিল। কিন্তু বিপুল গণরায়ে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার ইতিমধ্যে তিন বছর অতিক্রম করেছে। এখনো কেন কিবরিয়াসহ ওই শাসনামলে মানুষ হত্যার বিচার বিলম্বিত হচ্ছে? কেন সভ্যতা-মানবতাবিরোধী অপশক্তির উৎস সন্ধান সম্ভব হচ্ছে না- এসব প্রশ্ন চাপা দিয়ে রাখা যাবে না।
বিলম্বিত বিচার ন্যায়বিচারকে পরাহত করে- এই বাক্যের পক্ষে দৃষ্টান্ত রয়েছে অনেক। বিচার তো দূরের কথা, সাত বছর ধরে তদন্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলা। এত বড় স্পর্শকাতর একটি মামলার ক্ষেত্রে যদি এই চিত্র পরিলক্ষিত হয়, তাহলে অন্য সব মামলা নিয়ে অধিকতর শঙ্কা থেকে যায় সংগত কারণেই। কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের পর হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং বর্তমানে হবিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হবিগঞ্জ থানায় দুটি মামলা করেন। ২০০৫ সালের ১৯ মার্চ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ১০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করলে কিবরিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য আবেদন জানানো হয়। এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে কেটে যায় সাতটি বছর। এর মধ্যে এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র গায়েব হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। মামলার তদন্ত সম্পর্কে বারবারই বাদীপক্ষ থেকে নারাজি জানানো হয়। এভাবে নিম্ন আদালত-উচ্চ আদালতে মামলাটি ঘুরপাক খাচ্ছে; এবং তদন্তই এখন পর্যন্ত শেষ হলো না! সর্বশেষ গত ৩০ জানুয়ারি আদালতের নির্দেশে হত্যাকাণ্ড তদন্তে সিআইডির নতুন আইও নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু এই নিয়োগের ব্যাপারেও কিবরিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। তাদের এসব প্রতিক্রিয়া যুক্তিযুক্ত কারণে সংগতও বটে। আবারও মামলাটির সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। লক্ষ করার বিষয় হলো, শুরু থেকেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু কেন? যে চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, সেই মামলাটি মহাজোট সরকারের তিন বছরেও তদন্তের বৃত্তবন্দি অবস্থা থেকে কেন মুক্ত হতে পারল না? আশা করা গিয়েছিল, মহাজোট সরকারের শাসনামলে মামলার তদন্তপ্রক্রিয়া গতি পাবে এবং যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। কিন্তু না, আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাঁটা রয়েই গেল। একটি কথা মনে রাখা খুবই দরকার, কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার শুধু ব্যক্তির বিচারপ্রাপ্তির বিষয় নয়, এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা তো বটেই, সামাজিক স্থিতিশীলতার বিষয়টিও জড়িত।
আইনের যথাযথ প্রয়োগে, বিশেষ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর যেহেতু কোনো দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল না, সেহেতু সব অপরাধের যথাসম্ভব দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে- এটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু সেই প্রত্যাশাও মাঠে মারা যায়। অতীতে নিম্ন আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার বাদীর আবেদন উপেক্ষিত হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালতে এবং অধিকতর তদন্তে বাদীপক্ষের আবেদনের যৌক্তিকতাই প্রমাণিত হয়েছে। শুধু হবিগঞ্জেই নয়, প্রায় সর্বত্রই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অনেক রাঘববোয়ালের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে বারবার অভিযোগ উঠলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। এত কিছুর পরও মামলাটির নথি গায়েব হয় কী করে? গুরুত্বপূর্ণ নথি সরানোর কাজে কারা জড়িত ছিল, এর সন্ধান করা কি রাষ্ট্রের জন্য খুবই কঠিন কাজ? কেন তা করা হয়নি? ওই গায়েবকারীদের চিহ্নিত করা গেলে স্পর্শকাতর এই মামলার ব্যাপারে আরো তথ্য উদ্ঘাটন হয়তো সহজ হতে পারে। তা ছাড়া এত গুরুত্বপূর্ণ একটি নথির অনুলিপি কোথাও রক্ষিত হলো না কেন? প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের এই যুগে ওই তদন্ত প্রতিবেদনের 'সফট কপি' রাখাও তো কঠিন ছিল না। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে যে মহাজোট সরকার গঠিত হয়েছে, এসব প্রশ্নের ব্যাপারে তাদের ভাবা এবং এখন থেকে এসব অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতাকে ভবিষ্যতের জন্য সাবধানতা হিসেবে আমলে নেওয়া জরুরি।
স্বাধীন-সার্বভৌম রক্তস্নাত এই বাংলাদেশে অনেক কলঙ্কজনক অধ্যায় রয়েছে। এগুলোর কালিমা জাতিকে বহন করতে হচ্ছে। ফ্যাসিবাদী চক্র, মৌলবাদীগোষ্ঠী আর মুখোশধারীরা যদি বারবার পার পেয়ে যায়, তাহলে সভ্যতা-মানবতা আর ন্যায়বিচার নামক শব্দগুলো হারিয়ে যাবে। আর যদি তা-ই হয়, তাহলে সমাজ ক্রমেই হয়ে পড়বে মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী। যুক্তি, মননশীল চিন্তা আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ কিংবা শুধুই উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি কোনোকালেই কল্যাণ বয়ে আনেনি, আনতে পারে না। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির ধারায় শাহ এ এম এস কিবরিয়া নতুন মাত্রা যোগ করতে চেয়েছিলেন; এবং তা তিনি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কর্মকাণ্ডে সাফল্যের সঙ্গে সংযোজিতও করতে পেরেছিলেন। এমন একজন মানুষের প্রাণ যারা কেড়ে নিয়েছিল, তারা কতটা ক্ষমতাধর যে তারা সব কিছুর ঊধর্ে্ব! আজ পর্যন্ত তাদের সেভাবে শনাক্তও করা যায়নি? প্রশাসনযন্ত্রের কাছে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষ এসব প্রশ্নের জবাব আশা করে। রাষ্ট্রশক্তি এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় এড়াতে পারে না। রাষ্ট্রের দায় যদি রাষ্ট্র পরিচালকরা ভুলে যান, তাহলে এর পরিণাম কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তার দৃষ্টান্তও আছে অজস্র, যা অশুভের দাপাদাপিকেই বেপরোয়া করে দেয়। এমনটি কারোরই কাম্য নয়।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
বিলম্বিত বিচার ন্যায়বিচারকে পরাহত করে- এই বাক্যের পক্ষে দৃষ্টান্ত রয়েছে অনেক। বিচার তো দূরের কথা, সাত বছর ধরে তদন্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলা। এত বড় স্পর্শকাতর একটি মামলার ক্ষেত্রে যদি এই চিত্র পরিলক্ষিত হয়, তাহলে অন্য সব মামলা নিয়ে অধিকতর শঙ্কা থেকে যায় সংগত কারণেই। কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের পর হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং বর্তমানে হবিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হবিগঞ্জ থানায় দুটি মামলা করেন। ২০০৫ সালের ১৯ মার্চ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ১০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করলে কিবরিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য আবেদন জানানো হয়। এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে কেটে যায় সাতটি বছর। এর মধ্যে এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র গায়েব হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। মামলার তদন্ত সম্পর্কে বারবারই বাদীপক্ষ থেকে নারাজি জানানো হয়। এভাবে নিম্ন আদালত-উচ্চ আদালতে মামলাটি ঘুরপাক খাচ্ছে; এবং তদন্তই এখন পর্যন্ত শেষ হলো না! সর্বশেষ গত ৩০ জানুয়ারি আদালতের নির্দেশে হত্যাকাণ্ড তদন্তে সিআইডির নতুন আইও নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু এই নিয়োগের ব্যাপারেও কিবরিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। তাদের এসব প্রতিক্রিয়া যুক্তিযুক্ত কারণে সংগতও বটে। আবারও মামলাটির সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। লক্ষ করার বিষয় হলো, শুরু থেকেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু কেন? যে চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, সেই মামলাটি মহাজোট সরকারের তিন বছরেও তদন্তের বৃত্তবন্দি অবস্থা থেকে কেন মুক্ত হতে পারল না? আশা করা গিয়েছিল, মহাজোট সরকারের শাসনামলে মামলার তদন্তপ্রক্রিয়া গতি পাবে এবং যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। কিন্তু না, আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাঁটা রয়েই গেল। একটি কথা মনে রাখা খুবই দরকার, কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার শুধু ব্যক্তির বিচারপ্রাপ্তির বিষয় নয়, এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা তো বটেই, সামাজিক স্থিতিশীলতার বিষয়টিও জড়িত।
আইনের যথাযথ প্রয়োগে, বিশেষ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর যেহেতু কোনো দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল না, সেহেতু সব অপরাধের যথাসম্ভব দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে- এটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু সেই প্রত্যাশাও মাঠে মারা যায়। অতীতে নিম্ন আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার বাদীর আবেদন উপেক্ষিত হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালতে এবং অধিকতর তদন্তে বাদীপক্ষের আবেদনের যৌক্তিকতাই প্রমাণিত হয়েছে। শুধু হবিগঞ্জেই নয়, প্রায় সর্বত্রই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অনেক রাঘববোয়ালের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে বারবার অভিযোগ উঠলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। এত কিছুর পরও মামলাটির নথি গায়েব হয় কী করে? গুরুত্বপূর্ণ নথি সরানোর কাজে কারা জড়িত ছিল, এর সন্ধান করা কি রাষ্ট্রের জন্য খুবই কঠিন কাজ? কেন তা করা হয়নি? ওই গায়েবকারীদের চিহ্নিত করা গেলে স্পর্শকাতর এই মামলার ব্যাপারে আরো তথ্য উদ্ঘাটন হয়তো সহজ হতে পারে। তা ছাড়া এত গুরুত্বপূর্ণ একটি নথির অনুলিপি কোথাও রক্ষিত হলো না কেন? প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের এই যুগে ওই তদন্ত প্রতিবেদনের 'সফট কপি' রাখাও তো কঠিন ছিল না। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে যে মহাজোট সরকার গঠিত হয়েছে, এসব প্রশ্নের ব্যাপারে তাদের ভাবা এবং এখন থেকে এসব অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতাকে ভবিষ্যতের জন্য সাবধানতা হিসেবে আমলে নেওয়া জরুরি।
স্বাধীন-সার্বভৌম রক্তস্নাত এই বাংলাদেশে অনেক কলঙ্কজনক অধ্যায় রয়েছে। এগুলোর কালিমা জাতিকে বহন করতে হচ্ছে। ফ্যাসিবাদী চক্র, মৌলবাদীগোষ্ঠী আর মুখোশধারীরা যদি বারবার পার পেয়ে যায়, তাহলে সভ্যতা-মানবতা আর ন্যায়বিচার নামক শব্দগুলো হারিয়ে যাবে। আর যদি তা-ই হয়, তাহলে সমাজ ক্রমেই হয়ে পড়বে মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী। যুক্তি, মননশীল চিন্তা আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ কিংবা শুধুই উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি কোনোকালেই কল্যাণ বয়ে আনেনি, আনতে পারে না। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির ধারায় শাহ এ এম এস কিবরিয়া নতুন মাত্রা যোগ করতে চেয়েছিলেন; এবং তা তিনি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কর্মকাণ্ডে সাফল্যের সঙ্গে সংযোজিতও করতে পেরেছিলেন। এমন একজন মানুষের প্রাণ যারা কেড়ে নিয়েছিল, তারা কতটা ক্ষমতাধর যে তারা সব কিছুর ঊধর্ে্ব! আজ পর্যন্ত তাদের সেভাবে শনাক্তও করা যায়নি? প্রশাসনযন্ত্রের কাছে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষ এসব প্রশ্নের জবাব আশা করে। রাষ্ট্রশক্তি এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় এড়াতে পারে না। রাষ্ট্রের দায় যদি রাষ্ট্র পরিচালকরা ভুলে যান, তাহলে এর পরিণাম কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তার দৃষ্টান্তও আছে অজস্র, যা অশুভের দাপাদাপিকেই বেপরোয়া করে দেয়। এমনটি কারোরই কাম্য নয়।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments