শোকই নিয়তি নয় by ড. মুহাম্মদ আশকার ইবনে শাইখ

গত ১৩ আগস্ট লন্ডনে একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার প্রাক্কালে যখন তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের মর্মন্তুদ সংবাদটি পাই, তখন শুধু একটি প্রশ্নই তাড়া করেছে, বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কের বাঁকে বাঁকে যেসব মৃত্যুফাঁদ রয়েছে, সেগুলো আর কত অমূল্য প্রাণ কেড়ে নেবে? প্রথমেই বলতে চাই, মৃত্যু অমোঘ, অনিবার্য বটে; কিন্তু কোনোভাবেই এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।


বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দুঃসময়ে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের কারিগর অসীম প্রতিভাবান তারেক মাসুদ যে পথের সন্ধান দিয়েছিলেন, এ জন্য তাঁর কাছে প্রগতিবাদী বাঙালিদের কৃতজ্ঞ থাকতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধকে ধ্যানে-জ্ঞানে লালন করে তারেক মাসুদ প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনায়। আর মিশুক মুনীর? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে, উৎসর্গ করে দিয়ে, এর বিকাশে যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন, এর মূল্যায়ন করার সাধ্য আমার নেই। এই দুজনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার পাশাপাশি তাঁদের সঙ্গে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসে এখনো বাঁচার জন্য যাঁরা যুদ্ধ করে চলেছেন, তাঁদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। তারেক মাসুদের সহধর্মিণী ক্যাথরিন মাসুদের কাছেও আমাদের ঋণের শেষ নেই। প্রার্থনা একটাই, তিনি যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং তাঁদের আত্মজ বিষাদকে নিয়ে তারেক মাসুদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে শোককে শক্তিতে পরিণত করে কাজ করতে পারেন। একই সঙ্গে গভীর শ্রদ্ধায় তাঁদেরও স্মরণ করি, যাঁরা ওই মর্মান্তিক ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। ঢালী আল মামুন শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই নন, বহুমুখী প্রতিভাধরও। তাঁর স্ত্রী দিলারা বেগম জলিসহ সবার দ্রুত সুস্থতাই কাম্য।
আমাদের ক্ষতির দিকটা ক্রমেই স্ফীত হয়ে চলেছে। এসব ক্ষতি কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়ার নয়। এ দেশে প্রতিভার লালনচিত্র এমনিতেই খুব বিবর্ণ, এর মধ্যে যেভাবে প্রতিভা ঝরে যায় অত্যন্ত অস্বাভাবিকভাবে, তা আরো উদ্বেগজনক, যুগপৎ প্রশ্নবোধক। তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের শূন্যতা আমরা কোনোভাবেই পূরণ করতে পারব না। এ-জাতীয় ক্ষতি আমাদের বড় বেশি ধাক্কা দিল। আমি তাঁদের কৃতকর্মের ফিরিস্তি দেব না, সচেতন মানুষমাত্রই তা জানেন, শুধু একটি প্রশ্নই রাখব, তাঁরা যেভাবে প্রাণ হারালেন এবং অব্যাহতভাবে যে মানুষের প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, তা কি রোধ করা দুরূহ? না, মোটেই না। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং ক্রমেই তা এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যা চরম উদ্বেগজনক। একই সঙ্গে বিস্ময়কর হলো, এই মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রীর সড়ক ব্যবস্থাপনা এবং চালকদের উন্মাদনা নিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য। তাঁদের বোধোদয় কবে ঘটবে আমরা জানি না। আর কত প্রাণ ঝরে গেলে তাঁদের টনক নড়বে, তাও আমরা জানি না। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা যেভাবে ঘটছে একে শুধু দুর্ঘটনা না বলে বলা উচিত হত্যাকাণ্ড। কী কী কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে, এর কারণ জানা সত্ত্বেও সরকার ও প্রশাসন কেন কোনো প্রতিকার করতে পারছে না_এর জবাব দেওয়ার দায় তারা এড়াতে পারে না। শুধু সড়কপথ কেন, নৌপথেও চলছে মানুষরূপী কিছু অমানুষের চরম উন্মাদনা, যার বলি অহরহ হচ্ছে মানুষ। তবে সড়কপথের চিত্র ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এবং এ জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে বাধ্য করা উচিত। যন্ত্রদানবের যারা নিয়ন্ত্রক, তাদের বেশির ভাগই অযোগ্য, অদক্ষ, স্বেচ্ছাচারী, মূর্খ আর অর্থপিপাসায় লালায়িত। সম্প্রতি এ রকম আরো কয়েক হাজার লাইসেন্স প্রদানের সুপারিশ করেছেন একজন মন্ত্রী! সত্যি, বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ।
এভাবে মানুষ মরবে, তারপর কিছুদিন মিডিয়ায় হৈচৈ হবে, দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা অঙ্গীকার আর প্রতিশ্রুতির বন্যায় সব ভাসিয়ে দেবেন_এভাবেই তো চলছে। সড়ক-মহাসড়কের বাঁকে বাঁকে যেসব মৃত্যুফাঁদ বিদ্যমান, এসব তাঁদের চোখে পড়ে না, ড্রাইভার নামক অদক্ষ-অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে সনদ তুলে দিতে তাঁদের বিবেকে বাধে না! লাইসেন্স দেওয়ার নামে চলাচলের অযোগ্য যানবাহনের গায়ে ফিটনেসের সিল মেরে দিতে তাঁদের হাত কাঁপে না! কারণ একটাই। এই সব কিছুর পেছনেই রয়েছে হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের উদগ্র লালসা, যা কোনো সভ্য-সুস্থ সমাজে চিন্তা করা যায় না। এসব নিয়ে কথা হয়েছে বিস্তর; কিন্তু কোনো কাজের কাজ হয় না! কোনো রাষ্ট্রে, কোনো সমাজে অন্যায়, অপরাধ, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম_যার দুর্নীতির এমন মহোৎসব যদি চলতেই থাকে, তাহলে সে রাষ্ট্র, সে সমাজচিত্র কত বেশি বিবর্ণ হতে বাধ্য, তা আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রকরা না বুঝলেও দেশের সচেতন সাধারণ মানুষ ঠিকই বোঝেন এবং এ জন্যই তাঁদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার দাগটা এত মোটা।
আমরা আর শোক করব না। আমরা প্রতিবাদ জানাই। আসুন সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে রুখে দাঁড়াই সবাই। আমরা এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। আমরা চাই এই হত্যাকাণ্ড বন্ধে অনতিবিলম্বে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন। শুধু ক্ষমতাবানদের কাছে একটাই অনুরোধ, আপনারা শুধু এ পথের কাঁটা হবেন না। আপনারা আপনাদের স্ববিরোধিতা বন্ধ করুন, দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিন; তা না হলে দয়া করে সরে দাঁড়ান; তবু মানুষকে স্বাভাবিকভাবে মরতে দিন। বাংলাদেশে যেসব কারণে যত্রতত্র, যখন-তখন মানুষ মরে যাচ্ছে আর এর বিপরীতে আপনাদের উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার আর প্রতিশ্রুতি ভিন্ন কিছুই করার থাকবে না, তা তো হতে পারে না। এভাবে চলতে পারে না। মানুষের জীবনযাত্রার সব পথ নির্বিঘ্ন করার দায় যাঁদের, তাঁদের কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য পরিস্থিতিকে আরো দুর্বিষহ করে তুলছে। এর দায় তাঁরা এড়াতে পারেন না। আমরা মনে করি, নিজ নিজ ক্ষেত্রে যাঁরাই ব্যর্থতার পরিচয় দেবেন, স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শন করবেন, দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা দেখাবেন, সর্বাগ্রে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনা উন্নত দেশেও ঘটে; কিন্তু চিত্র এত উৎকট নয়, একই সঙ্গে নয় প্রতিকারহীনও। প্রতিকার হয় বিধায়ই সংখ্যা অনুল্লেখযোগ্য। নিয়মশৃঙ্খলা ও আইনকানুন মেনে চলার প্রবণতা যে সমাজে যত বেশি, সে সমাজই তত বেশি আলোকিত।
তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ কয়েকজনের মর্মন্তুদ ঘটনার পর যথারীতি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, হয়তো প্রতিবেদনও পাওয়া যাবে; কিন্তু প্রতিকার কতটা কী হবে, তা নিয়ে সংশয় তো থেকেই যাচ্ছে। কারণ আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা চরম তিক্ত। দেশের সড়ক-মহাসড়কে যে নৈরাজ্য চলছে, যে উদ্বেগজনক চিত্র ধারণ করে আছে, এর সমাধানসূত্র যদি রাষ্ট্রশক্তির কাছে না থাকে, তাহলে বলতে হবে, আমরা যে সমাজে বাস করছি, তা মনুষ্য বসবাসের সত্যিকার অর্থেই অযোগ্য হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র পরিচালকরা যদি দায়বদ্ধতার, জবাবদিহির পাট চুকিয়ে ফেলেন, তাহলে এমনটিই হতে বাধ্য। বর্তমান মহাজোট বিপুল জনরায় নিয়ে ক্ষমতায় বসেছে। এই সরকারের কাছে সংগত কারণেই মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। বলতে কষ্ট হয়, তবু বলতে হয়, প্রত্যাশা করেই হোঁচট খেয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, জননেত্রী শেখ হাসিনা যেসব মন্ত্রী নিয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই কর্মকাণ্ড ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁদের দক্ষতা, যোগ্যতা, দূরদর্শিতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। সড়ক-মহাসড়কের যে চিত্র ক্রমেই বিবর্ণ হচ্ছে, তাও এরই কুফল এবং এটি একটিমাত্র দৃষ্টান্ত। কাজেই সরকারের নীতিনির্ধারকদের যত দ্রুত ঘুম ভাঙবে, ততই মঙ্গল।
আমরা নিরাপদ সড়ক চাই, নৌপথ চাই, রেলপথ চাই। সীমাবদ্ধতা আছে, থাকবেই; কিন্তু নিয়মনীতি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে এবং স্বেচ্ছাচারিতা-দুর্নীতির মূলোৎপাটনে কোনো রকম সীমাবদ্ধতার কথা, অজুহাতের কথা আমরা আর শুনতে চাই না। আমরা অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসতে চাই না। বাংলাদেশে যখন-তখন যেভাবে মানুষের জীবন ধসে যাচ্ছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এর জন্য আর শোকালোচনা নয়, শোকসভা নয়; দাবি একটাই_অপরাধীর বিচার চাই। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য কোনো শোকসভা আর যেন করতে না হয়, তা নিশ্চিত করার দায় সরকারের। শোকের দরজায় খিল এঁটে দিতে হবে এবং সরকার ও প্রশাসনকে এ জন্য আর যাতে ব্যর্থতা প্রদর্শন করতে না হয়, সে রকম ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে। শোকই নিয়তি হতে পারে না। ব্যবস্থা ভালো হলে অবস্থা এমনিতেই ভালো হতে বাধ্য।

লেখক : লন্ডনপ্রবাসী গবেষক

No comments

Powered by Blogger.