গণতন্ত্র-তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া জাতীয় নির্বাচন নয় by বদিউল আলম মজুমদার

গত ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) সম্মানিত ভোটাররা ‘হ্যাভ স্পোকেন’ বা তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। ভোটের ব্যবধান দেখে বিনা দ্বিধায় বলা যায়, তাঁদের মতামত ছিল ‘ভেরি লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার’—অত্যন্ত জোরালো ও সুস্পষ্ট। কিন্তু তাঁরা কী বার্তা প্রেরণ করেছেন? স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তিরাই বা কী শুনেছেন? আর নাসিক নির্বাচনে সত্যিকারার্থে কে বা কারা জয়ী হয়েছেন? পরাজয়ই বা কাদের ঘটেছে?


এসব জয়-পরাজয়ের তাৎপর্যই বা কী? এসব প্রশ্নের চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া আবশ্যক।
অবশ্যই নির্বাচনে সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগ সমর্থিত শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। জয়ের ব্যবধান ছিল লক্ষাধিক ভোট—আইভী পেয়েছেন এক লাখ ৮০ হাজার ৪৮ ভোট আর শামীম ওসমান ৭৮ হাজার ৭০৫ ভোট। একই সঙ্গে জয়ী হয়েছেন ২৭টি সাধারণ আসন থেকে ২৭ জন কাউন্সিলর এবং নয়টি সংরক্ষিত আসন থেকে একই সংখ্যক নারী কাউন্সিলর। আপাত দৃষ্টিতে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে মোট ৩৭ জন বিজয়ী হলেও, এর নেপথ্যে রয়েছেন আরও বেশ কিছু মানুষ।
এটি সুস্পষ্ট যে নাসিক নির্বাচনে একচ্ছত্র বিজয়ী ডা. আইভী। নিঃসন্দেহে ভোটের অঙ্কে তিনি নিরঙ্কুশ বিজয়ী। এ ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চেও তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। দলীয় সমর্থনের বাইরে গিয়ে মেয়র পদে বিপুল ভোটে শুধু নির্বাচিতই হননি, তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী কর্তৃক অভিনন্দিত ও ‘বাপের বেটি’ বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। এক কথায়, তিনি আপাতত শ্যামও রেখেছেন, কুলও রক্ষা করতে পেরেছেন, যা সচরাচর ঘটে না।
নাসিক নির্বাচন থেকে একটি সুস্পষ্ট বার্তা হলো যে ‘ভালো’ ও ‘খারাপে’র মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিলে জনগণ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে না। নাসিক নির্বাচনে ভোটারদের সামনে একটি ‘ক্লিয়ার চয়েস’ ছিল। ডা. আইভী ছিলেন একজন ‘ক্লিন ইমেজে’র প্রার্থী। দীর্ঘদিন ধরে পৌর মেয়র থাকার পরও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বদনাম নেই। অর্থাৎ আমাদের রাজনীতির বিরাজমান পঙ্কিলতা তাঁকে স্পর্শ করেনি। পক্ষান্তরে, শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও জবরদখলের অভিযোগ ছিল এবং এখনো আছে। তিনি গডফাদার হিসেবে পরিচিত। নির্বাচনের আগে ও পরে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে তাঁর এবং নির্বাচনের আগে ভাই নাসিম ওসমানের হুমকি এ ইমেজকে আরও পোক্ত করেছে।
ভোটের ফলাফল থেকে এটি সুস্পষ্ট যে নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির বিরুদ্ধে গণরায় দিয়েছেন। ভোটাররা দুর্নীতির অবসান চান। অবসান চান হুমকি ও ভয়-ভীতির রাজনীতির। তাঁরা চান স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ সরকার এবং সর্বোপরি তাঁরা চান সৎ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদদের নেতৃত্ব। এগুলোই হলো নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রেরিত বার্তা, যা আমাদের নেতা-নেত্রীদের কানে পৌঁছেছে বলে মনে হয় না। তবে নারায়ণগঞ্জের মতো ভবিষ্যৎ নির্বাচনেও ‘পিপল পাওয়ার’ প্রদর্শনের এবং ভোটারদের ভালো প্রার্থীর পক্ষে দাঁড়ানোর এমন সুযোগ থাকলে আমাদের রাজনীতির গুণগত রূপান্তর ঘটতে এবং রাজনৈতিক দলগুলোতে পরিবর্তন আসতে বাধ্য।
নির্বাচনে আরেকটি সুস্পষ্ট জয়ী পক্ষ হলো নির্বাচন কমিশন। কমিশনের অনুরোধ সত্ত্বেও সরকার নাসিক নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করতে ব্যর্থ হয়েছে, যা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমাদের সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হবে।’ সরকারের এ সিদ্ধান্ত ছিল কমিশনের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ। এ নিয়ে সরকার ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। এমনকি সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকেও এর সমালোচনা করেছেন।
কমিশন সরকারের এ হঠকারিতামূলক ও সংবিধান-পরিপন্থী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা পদত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন বলেও গণমাধ্যমে খবর এসেছে। কমিশন এমনকি নির্বাচন স্থগিতের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছিল। কমিশনের সদস্যরা যে সরকারের ‘সেকেন্ড ফিডল’ বা অজ্ঞাবহ নন এবং তাঁরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছেন—এসব প্রতিবাদ তারই প্রমাণ। মূলত কমিশনের বলিষ্ঠতা ও অনমনীয়তার কারণেই নারায়ণগঞ্জে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়েছে।
নাসিক নির্বাচনে সেনা মোতায়েনকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে তার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমত, ভবিষ্যতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার অংশ হিসেবে কমিশনে সৎ, যোগ্য, সত্যিকারের নিরপেক্ষ ও সাহসী ব্যক্তিদের, যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করবেন না, কমিশনে নিয়োগ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, এর জন্য আরও প্রয়োজন হবে সরকারের পক্ষ থেকে কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে হস্তক্ষেপ না করা। তৃতীয়ত, সরকার ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কমিশনের ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করতে হবে।
আমাদের আশঙ্কা যে নাসিক নির্বাচনে সবচেয়ে ভিলেন হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকার। রাষ্ট্রে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা সরকারের। সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের অনুরোধ অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জে সেনা মোতায়েন না করে সরকার সংবিধান অমান্য করেছে। আর সরকার আইন ও সংবিধান অমান্য করলে রাষ্ট্রে আইনের শাসন বিরাজ করছে তা কোনোভাবেই বলা যায় না।
নির্বাচনী বিধিবিধান অনুযায়ী সিটি করপোরেশন তথা সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়। কিন্তু বিধিবিধানের প্রতি তোয়াক্কা না করে আওয়ামী লীগ শামীম ওসমানকে দলীয় সমর্থন দেয়। বস্তুত এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বেশ অপরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গত ১৭ অক্টোবর আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘নির্বাচন আচরণবিধির মধ্যে থেকে যতটুকু সম্ভব দলের পক্ষ থেকে শামীম ওসমানকে ততটুকুই সমর্থন দেওয়া হয়েছে’ (প্রথম আলো, ১৮ অক্টোবর ২০১১)। এটি নির্বাচনী আচরণবিধির সঙ্গে এক ধরনের লুকোচুরি, যা আইন মানার প্রতি অনীহারই প্রতিফলন। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণভাবে ভোল পাল্টিয়ে বলছে যে দল উভয় প্রার্থীকেই সমর্থন দিয়েছে, যা জনগণের চোখে ধুলা দেওয়ারই একটি অপচেষ্টা। অর্থাৎ নাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বুদ্ধি ও নৈতিকতাভিত্তিক এবং জনকল্যাণমুখী রাজনীতি বিসর্জন দিয়েছে বলেই মনে হয়।
নির্বাচন ও নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে মনে হয় যেন নাসিক নির্বাচন ছিল আওয়ামী লীগের জন্য একটি শামীম ওসমান ‘পুনর্বাসন প্রকল্প’। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির অন্যতম কারণ ছিল দলের পক্ষ থেকে শামীম ওসমান, জয়নাল হাজারী, আবু তাহের প্রমুখের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। মনে হয় যেন আওয়ামী লীগ অতীত থেকে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেনি! এটি দুর্ভাগ্যজনক যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও, আওয়ামী লীগ যেন গডফাদারদের হাত ধরে সেই পুরোনো পিচ্ছিল পথেই হাঁটছে। মনে হয় যেন সরকার জনগণের হদয়-মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং ভবিষ্যতে জয় করার আশাও ছেড়ে দিয়েছে।
নাসিক নির্বাচন থেকে একটি শিক্ষণীয় যে ভবিষ্যতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মতো অন্যান্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অহেতুক পরাজয় এবং বর্তমানে যে ভুল পথে চলছে তা এড়াতে হলে দল পরিচালনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে সরকারের বাইরে দলের পৃথক সত্তা, বর্তমানে সরকারের মধ্যে যেন দল হারিয়ে গেছে। একই সঙ্গে আবশ্যক দল ও সরকারের নেতৃত্বকে পৃথক করা, যাতে ভুল-ত্রুটির জন্য সরকারকে দলের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। অর্থাৎ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পুরোনো গৌরব রক্ষা করতে হলে দলের আমূল সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।
আরেকটি পরাজিত পক্ষ অবশ্যই শামীম ওসমান। তিনি এবং তাঁর কর্মকাণ্ড বিপুল ভোটে জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। নির্বাচনী ফলাফল প্রথমে প্রত্যাখ্যান এবং পরে কোনো অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে বলে বক্তব্য দেওয়া তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নির্বাচন-পরবর্তী কার্যক্রম তাঁকে আরও বিতর্কিত করে ফেলেছে। শামীম ওসমান পুনর্বাসন প্রকল্পের অংশ হিসেবে তাঁকে ভবিষ্যতে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি করার কথা শোনা যাচ্ছে। তাহলেও তিনি দলের জন্য ‘লায়াবিলিটি’ বা বোঝা হয়েই থাকবেন বলে অনেকের আশঙ্কা। প্রসঙ্গত, নাসিক নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য শামীম ওসমান পুনর্বাসন প্রকল্পের অংশ না হলে, সেনাবাহিনীর অনপুস্থিতিতে নায়ায়ণগঞ্জে সহিংসতা সৃষ্ট হতো বলে অনেক পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন। শামীম ওসমান নিজেই বলেছেন, সরকারি দলের প্রার্থী হওয়ার কারণে তাঁকে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে।
বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি নাসিক নির্বাচন থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে তারা তাদের পুরোনো রেকর্ড বাজিয়েই যাচ্ছে, যার বিশ্বাসযোগ্যতা দলান্ধদের বাইরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আর যেহেতু নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে, তাই সেনাবাহিনী মোতায়েন না করার কারণে তাদের নির্বাচন বর্জন করার যৌক্তিকতাও অনেক ভোটারের কাছেই বোধগম্য হয়নি। এ ছাড়া বিএনপিও আচরণবিধি উপেক্ষা করে নাসিক নির্বাচনে তৈমুর আলম খন্দকারকে দলীয়ভাবে মনোনয়ন দিয়েছে। তবে নাসিক নির্বাচনে আমরা লক্ষ করেছি বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের হুমকির প্রথম প্রয়োগ, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি অশনিসংকেত।
পরিশেষে, নাসিক নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীনদের একটি ‘স্পিন’ বা স্বার্থপ্রণোদিত বক্তব্য হলো যে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। এ বক্তব্য আংশিক সত্য। দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে অনুষ্ঠান সম্ভব, কারণ স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয় না। পক্ষান্তরে জাতীয় নির্বাচনের ফলে ক্ষমতারই শুধু রদবদল নয়, এর মাধ্যমে রাজনীতি নামক ‘ব্যবসা’ও হাতছাড়া হয়ে যায়। আমাদের বিরাজমান দমন-পীড়নের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এর সঙ্গে অস্তিত্বের প্রশ্নও জড়িত। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব, এমন ধারণা সৃষ্টি করা নাসিক নির্বাচন থেকে ভুল শিক্ষা নেওয়ারই শামিল হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।

No comments

Powered by Blogger.