ঈদের উৎস by মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
এই কথাটাই ভাবছি-সময় গড়িয়ে যায় পলে পলে আর ক্রমেই বিস্তার হয়ে যাওয়া কালো একটা চাদরে ঢেকে দেয় আমাদের অনেক কিছু-কোন ঘন অন্ধকারের অতলে। তাহলে এই ক্ষণের বর্তমান? ব্যতিক্রমের ব্যাপারটা বাদ থাক, বাকি সবাই তো আমরা বিক্ষত সমকালীন বর্তমানের প্রহারে। স্বভাবতই নিঃশ্বাস নিতে চাই।
একটা কোনো অবলম্বনকে আশ্রয় করে জীবনের স্বাদ নিতে চাই। সেই তখন হৃদয় খুঁড়ে জাগাতে ইচ্ছা করে অতীত স্মৃতি। সুখদ কোনো কোনো স্মৃতি। পালিয়ে গিয়ে নিরাপদ আলয়ের সন্ধান বার করব সে হেতু নয়, কিংবা নস্টালজিয়ার টানেও নয়। বর্তমান প্রসঙ্গে নির্বাচিত করে নেওয়া গেছে উৎসবের স্মৃতি।
অনুসন্ধিৎসা যে আদতেই কী পাওয়া আমাদের উৎসব থেকে? বাইরের দিকটায় আনুষ্ঠানিকতার বিষয়বাধ্যকতা থাকে বটে, আর তা যখন বিশেষ কোনো ধর্মজাত হয়, কিংবা তাতে ধর্মের মিশেল, সেসব ক্ষেত্রে বিশ্বাস অবশ্যই অনেকটা কাজ করে এবং তৎসহ তাবৎ আচারাদির পালন। তবে বলবার যে, তদতিরিক্ত পাওয়া আরো বেশ খানিক ঘটে যায়। এই যে আরো, সেখানেই তো উৎসবের আসল ভূমিকা-মানুষে মানুষে মিলিয়ে দেওয়া, হৃদয়ে হৃদয়ে বেঁধে দিয়ে অন্তরঙ্গ ঐকতানের সৃজন করা। শৈশব, বাল্যকালে আমাদের কি শেখানো হয়েছিল, অথবা কেমন করে যেন আপনা থেকেই বুঝে নেওয়া গিয়েছিল। সেই তো ঈদ। হায় রে কবে সরে গেছে ওই মতো ঈদোৎসবের দিনগুলো! বলছিলাম স্মৃতিকে হৃদয় খুঁড়ে জাগানোর কথা। তাই থেকে অতি দূর অতীতের ছবিটা দেখতে পাই। এখনো তেমন ধূসর হয়ে যায়নি। মস্ত একটা ময়দান। এ মাথা ও মাথা সীমানা নেই, হারিয়ে গেছে মানুষে মানুষে। তখন আমরা কলকাতায়, হাতেখড়ির বয়স হয়নি সেই সময়টায়। ঈদের দিনে আব্বা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ওই ময়দানে, সর্বজন জানা নাম-গড়ের মাঠ। অমন বিপুলতায়ন ঈদের জামাত অভিজ্ঞতায় দ্বিতীয়টি আর পাইনি। এখনো বেশ স্পষ্ট দেখি অনেক অনেক মানুষ বুকে জড়িয়ে বুক মেলাচ্ছে, মুখে অনাবিল স্মিত হাসি। যেন এই প্রকারেই নজরুল ইসলাম যে তাঁর গানে তুলে ধরেছিলেন, 'তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে', 'আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত-দুশমন/হাত মেলাও হাতে'। ঈদ বলতে এখনো সেই শৈশবস্মৃতি বিশাল এক ভূমির ওপরে অগুনতি মেলা মানুষের জমায়েত। আর মানুষে মানুষে অমন করে বুকে জড়িয়ে মেশামেশি।
২. স্মৃতির কথাই যখন আরো খানি বলি। এই প্রজন্মের যারা বিশেষ তাদের জন্য। বারো মাসে তেরো পার্বণ-এই নিয়েই তো আবহমান বাংলা। তবে পার্বণ বলতে যদি বাঙালি মুসলমানের তাদের বেলায় কিন্তু তেমন অনেক নয়। ইংরাজ প্রশাসনের আমলে ইশকুল-কলেজে থাকত সামারের দীর্ঘ ছুটি; দুর্গাপূজার/অটামের মাসখানেক আরেকটা; তেমনি কিয়দংশে ছিল বড়দিন, ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার্স ডে-সব মিলিয়ে উইন্টারের অবকাশ। আমাদের বেলায় ধর্মোৎসবের নামে দু-চার দিন করে দুই ঈদের ছুটি, মহররমের আশুরার দিন, আর ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম উপলক্ষে এক দিন। ছুটি বলতে নেই তেমন, তা ঈদের উৎসবও তেমনি যার যার বাড়িতে বাড়িতে এবং আরেকটু ছড়িয়ে এ মহল্লায় ও মহল্লায়। ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা। আমরা বলতাম একটাকে সেমাইয়ের ঈদ; আকেটা কোরবানির, গোশত খাওয়ার ঈদ। তা আনন্দ-উৎসব অবশ্যই হতো। ছোটদেরই বেশি মাতামাতি। বোনেরা, ছোট খালা, ছোট ফুফু তাঁরা বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যেতেন। মায়েরা রান্নাঘরে। আর বড়রা, মুুরবি্বজন তাঁরা দহলিজে বসে লম্বা নল লাগানো ফুরসি হুঁকো টনতেন, ঘনিষ্ঠ মগ্নতায় গল্পগুজবে মেতে থাকতেন।
বালক বয়সের ওই দিনগুলো যেন হেঁটে হেঁটে সামনে আসছে। রাত জেগে আমরা কয়েক ভাই কাঁচি দিয়ে রনি কাগজ কাটছি, ময়দার আটা দিয়ে জুড়ে জুড়ে শেকলের মালা বানাচ্ছি, তেকোনা নিশান বানাচ্ছি। তারপর আঁধার তখনো কাটেনি, নিষুত ভোর রাতে ঝুলিয়ে দেব সারা বাড়িতে। সকাল হবে, গোসল সেরে ঘরে ঘরে লোবান জ্বালানো হতো। বৈঠকখানায় টেবিল সাজিয়ে তশতরির ওপর আতরদানে হরেক কিসিমের আতর, পাশে নরম তুলো। বাড়িতে একটা গ্রামোফোন ছিল, হ্যান্ডেলঅলা ঢাউস মাইকের চোঙা লাগানো। এ রকম দিনভরই টুইন কম্পানির রেকর্ড বাজানো হতো-'ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ', 'সাহারাতে ফুটল রে', 'ইসলামের ওই সওদা লয়ে', 'ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ' এসব গান। বেলা যত বাড়ত পাড়ার ছেলেমেয়েরা ভিড় জমিয়ে আসত। বলেইছি তো সেমাইয়ের ঈদ। তার যে কত রকমের-দুধ সেমাই, জর্দা সেমাই, নারকেল সেমাই, ঝাল সেমাই, নিম-নোনতা সেমাই, আরো আরো, এ্যাদ্দিনে সব নাম ভুলে গেছি। আর হতো ফিরনি, পায়েস, ঘি জবজব মোহনভোগ, ক্ষীর, তক্তি সন্দেশ, নাড়ু। দুপুরে, রাতে অবশ্য কোরমা-পোলাও। তবে বৈচিত্র্য তেমন নয়। তা তোলা থাকত পরের ঈদ কোরবানির ঈদের জন্য। খাঞ্চা সাজিয়ে নানা খাবার, ওপরে কারুকাজ করা কাপড়ের কি বাঁশ-বেতের ঢাকনা, আমরা ঘরের ছেলেরা পেঁৗছে দিতাম এ বাড়ি ও বাড়িতে।
৩. এখন? ঈদ যদি উৎসবই তবে চেহারা দেখা যাক এখনকার এই বর্তমানের। সংগত জিজ্ঞাসা আসতেই পারে কার জন্য উৎসব, কাদের উৎসব। সবাই যে মেতে উঠেছি, ঘরের বাইরের পরিবেশটাকে যে প্রকার হুড়মুড়িয়ে তাতিয়ে তোলা হয়েছে চোখের সামনেই তো দেখছি। গত মাসখানেক ধরে কেমন এক উৎসব হৈ রৈ কাণ্ড। মেট্রোপলিটন সিটি ঢাকায়, ঢাকার বাইরে নানা শহরে-বন্দরে-চট্টগ্রামে, খুলনায়, রাজশাহীতে, বগুড়ায়, সিলেটে কোথায় নয়। রোজকার খবরের কাগজে রপোর্ট পাঠ করি, ছবি দেখি। রঙিন সাজে বিপণিবিতান, ইংরেজি শব্দের নতুন আভরণে আরো জাতে উঠেছে শপিং সেন্টার, শপিং কমপ্লেঙ্ ইত্যাকার নাম পরিচিতিতে সন্ধ্যের সঙ্গে বিচিত্র আলোকমালায় রমণীয় আকর্ষণের বিভ্রম ছড়া। আর রাজপথে তো বটেই; ফাঁকফোকরের গলিপথেও অনড়, নিশ্ছিদ্র যানজট, পথে-ঘাটে, ফুটপাতে বাজারে হঠাৎ করেই কোথা থেকে বিস্ফোরণ মানুষের ভিড়ের। কী? না ঈদ। ঈদোৎসবের মাতামাতি। তা উৎসবের একদিকে তো উত্তেজনা থেকেই থাকে। তবে সেই উত্তেজনাকে গ্রাস করে ফেলছে উৎসবের সামগ্রিকতা।
আবারও বলি, আমরা সমকালের চেহারাটা দেখার প্রয়াস পাচ্ছি। বুঝতে মোটে অসুবিধা নেই-ফ্রি ইকোনমি, মুক্তবাজারের মুক্তাঙ্গনে এখন আমাদের বসবাস। বাজারাধিপতিরা অনিবার্য লোভাতুর করে তুলবেন তাঁদের চাঁদেরহাট-এটাই স্বাভাবিক। অতএব পশরা আসছে ব্যাংকক-হংকং থেকে, পাশের দেশের কলকাতা-মাদ্রাজ থেকে। যথার্থ বটে খবরের কাগজের শিরোনাম; 'ঈদের বাজার জমজমাট বিদেশি দ্রব্য আসছে দেদার।' আরেক শিরোনাম : 'কেনাকাটার ধুম পোশাকের বাজারে আগুন বিদেশি জিনিসপত্রে বাজার সয়লাব।' এই রকমে সব। আরেক চেহারা। ভাগ্যবানই বলব, তাঁরা মাঝারি মাপের, খানিক খাটো মাপের চাকরিজীবী, তাঁরা ঈদ বোনাস, ঈদ অ্যাডভান্স পেয়েছেন। ফলত ঈদের নামে উৎসবের মাতন নয়ই বা কেন তাঁদের। সেই 'শপিং'-এর হুল্লোড় তাদের হকার্স মার্কেটে ফুটপাতের পশরায়। প্রাণান্তকর ঘোরাঘুরি হেথায় হোথায়, নাভিশ্বাস দরদাম, শেষ পর্যন্ত যা থাকে কপালে, কিনেই ফেলা সংগতিতে কুলোয় যদ্দুর। কিন্তু মোটের হিসেবে সংখ্যানুপাতিক কত জনই বা এঁরা?
প্রসঙ্গত, ওই জিজ্ঞাসাটি পুনরায় এভাবে আনা যাক-ঈদ যদি উৎসব, সর্বজনীন উৎসব, যথার্থই কি তাই? পথের মানুষ যাদের দিনাতিপাতের অবলম্বন ষোলো আনা শ্রমনির্ভর, আর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বিরাট গ্রামটির কোটি কোটি চাষি জনমানুষ, বলবার প্রয়োজন নেই যে উৎসব সেই সমস্ত ঘরে পরিহাসের আরেক নাম। মিল্লাত-ই-কওম ধর্মভ্রাতা তাঁরা পেট্রোডলারের মালিক সৌদিরা, ইরানিরা, বাহরাইনি, কুয়েতি, কাতারিয়া, রাখঢাকের বালাই না রেখে খোলাখুলি নামকরণই করে দিয়েছে আমাদের 'মিসকিন' অভিধায়। কটুবাক্য বটে, তবে প্রকৃত সত্য এই যে তেমন করে প্রতিবাদ জানাবার সম্বল নেই বটে। অপরদিকে প্রাচ্যের জাপান থেকে প্রতীচ্যের মার্কিন দেশ অবধি তারা দাতা; বাংলাদেশের আমরা তাদের উচ্ছিষ্ট দান-অনুদান-ঋণের প্রার্থনায় নতজানু কৃপাপ্রার্থী। উন্নয়নের জোয়ার সত্ত্বেও প্রাকৃত সাধারণের জন্য নিত্য দুবেলা ডাল-ভাতের জোগান অনতিক্রম্য সংকট সমস্যা-কে না জানে এইটেই বাস্তব। সেই কবে লিখেছিলেন নজরুল-'জীবনে যাদের হররোজ রোজা', তারপর সত্তর বছরের মতো কাল অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, তাদের ঘরে উৎসব-'এল খুশির ঈদ'?
লেখক : শিক্ষাবিদ
অনুসন্ধিৎসা যে আদতেই কী পাওয়া আমাদের উৎসব থেকে? বাইরের দিকটায় আনুষ্ঠানিকতার বিষয়বাধ্যকতা থাকে বটে, আর তা যখন বিশেষ কোনো ধর্মজাত হয়, কিংবা তাতে ধর্মের মিশেল, সেসব ক্ষেত্রে বিশ্বাস অবশ্যই অনেকটা কাজ করে এবং তৎসহ তাবৎ আচারাদির পালন। তবে বলবার যে, তদতিরিক্ত পাওয়া আরো বেশ খানিক ঘটে যায়। এই যে আরো, সেখানেই তো উৎসবের আসল ভূমিকা-মানুষে মানুষে মিলিয়ে দেওয়া, হৃদয়ে হৃদয়ে বেঁধে দিয়ে অন্তরঙ্গ ঐকতানের সৃজন করা। শৈশব, বাল্যকালে আমাদের কি শেখানো হয়েছিল, অথবা কেমন করে যেন আপনা থেকেই বুঝে নেওয়া গিয়েছিল। সেই তো ঈদ। হায় রে কবে সরে গেছে ওই মতো ঈদোৎসবের দিনগুলো! বলছিলাম স্মৃতিকে হৃদয় খুঁড়ে জাগানোর কথা। তাই থেকে অতি দূর অতীতের ছবিটা দেখতে পাই। এখনো তেমন ধূসর হয়ে যায়নি। মস্ত একটা ময়দান। এ মাথা ও মাথা সীমানা নেই, হারিয়ে গেছে মানুষে মানুষে। তখন আমরা কলকাতায়, হাতেখড়ির বয়স হয়নি সেই সময়টায়। ঈদের দিনে আব্বা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ওই ময়দানে, সর্বজন জানা নাম-গড়ের মাঠ। অমন বিপুলতায়ন ঈদের জামাত অভিজ্ঞতায় দ্বিতীয়টি আর পাইনি। এখনো বেশ স্পষ্ট দেখি অনেক অনেক মানুষ বুকে জড়িয়ে বুক মেলাচ্ছে, মুখে অনাবিল স্মিত হাসি। যেন এই প্রকারেই নজরুল ইসলাম যে তাঁর গানে তুলে ধরেছিলেন, 'তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে', 'আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত-দুশমন/হাত মেলাও হাতে'। ঈদ বলতে এখনো সেই শৈশবস্মৃতি বিশাল এক ভূমির ওপরে অগুনতি মেলা মানুষের জমায়েত। আর মানুষে মানুষে অমন করে বুকে জড়িয়ে মেশামেশি।
২. স্মৃতির কথাই যখন আরো খানি বলি। এই প্রজন্মের যারা বিশেষ তাদের জন্য। বারো মাসে তেরো পার্বণ-এই নিয়েই তো আবহমান বাংলা। তবে পার্বণ বলতে যদি বাঙালি মুসলমানের তাদের বেলায় কিন্তু তেমন অনেক নয়। ইংরাজ প্রশাসনের আমলে ইশকুল-কলেজে থাকত সামারের দীর্ঘ ছুটি; দুর্গাপূজার/অটামের মাসখানেক আরেকটা; তেমনি কিয়দংশে ছিল বড়দিন, ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার্স ডে-সব মিলিয়ে উইন্টারের অবকাশ। আমাদের বেলায় ধর্মোৎসবের নামে দু-চার দিন করে দুই ঈদের ছুটি, মহররমের আশুরার দিন, আর ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম উপলক্ষে এক দিন। ছুটি বলতে নেই তেমন, তা ঈদের উৎসবও তেমনি যার যার বাড়িতে বাড়িতে এবং আরেকটু ছড়িয়ে এ মহল্লায় ও মহল্লায়। ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা। আমরা বলতাম একটাকে সেমাইয়ের ঈদ; আকেটা কোরবানির, গোশত খাওয়ার ঈদ। তা আনন্দ-উৎসব অবশ্যই হতো। ছোটদেরই বেশি মাতামাতি। বোনেরা, ছোট খালা, ছোট ফুফু তাঁরা বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যেতেন। মায়েরা রান্নাঘরে। আর বড়রা, মুুরবি্বজন তাঁরা দহলিজে বসে লম্বা নল লাগানো ফুরসি হুঁকো টনতেন, ঘনিষ্ঠ মগ্নতায় গল্পগুজবে মেতে থাকতেন।
বালক বয়সের ওই দিনগুলো যেন হেঁটে হেঁটে সামনে আসছে। রাত জেগে আমরা কয়েক ভাই কাঁচি দিয়ে রনি কাগজ কাটছি, ময়দার আটা দিয়ে জুড়ে জুড়ে শেকলের মালা বানাচ্ছি, তেকোনা নিশান বানাচ্ছি। তারপর আঁধার তখনো কাটেনি, নিষুত ভোর রাতে ঝুলিয়ে দেব সারা বাড়িতে। সকাল হবে, গোসল সেরে ঘরে ঘরে লোবান জ্বালানো হতো। বৈঠকখানায় টেবিল সাজিয়ে তশতরির ওপর আতরদানে হরেক কিসিমের আতর, পাশে নরম তুলো। বাড়িতে একটা গ্রামোফোন ছিল, হ্যান্ডেলঅলা ঢাউস মাইকের চোঙা লাগানো। এ রকম দিনভরই টুইন কম্পানির রেকর্ড বাজানো হতো-'ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ', 'সাহারাতে ফুটল রে', 'ইসলামের ওই সওদা লয়ে', 'ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ' এসব গান। বেলা যত বাড়ত পাড়ার ছেলেমেয়েরা ভিড় জমিয়ে আসত। বলেইছি তো সেমাইয়ের ঈদ। তার যে কত রকমের-দুধ সেমাই, জর্দা সেমাই, নারকেল সেমাই, ঝাল সেমাই, নিম-নোনতা সেমাই, আরো আরো, এ্যাদ্দিনে সব নাম ভুলে গেছি। আর হতো ফিরনি, পায়েস, ঘি জবজব মোহনভোগ, ক্ষীর, তক্তি সন্দেশ, নাড়ু। দুপুরে, রাতে অবশ্য কোরমা-পোলাও। তবে বৈচিত্র্য তেমন নয়। তা তোলা থাকত পরের ঈদ কোরবানির ঈদের জন্য। খাঞ্চা সাজিয়ে নানা খাবার, ওপরে কারুকাজ করা কাপড়ের কি বাঁশ-বেতের ঢাকনা, আমরা ঘরের ছেলেরা পেঁৗছে দিতাম এ বাড়ি ও বাড়িতে।
৩. এখন? ঈদ যদি উৎসবই তবে চেহারা দেখা যাক এখনকার এই বর্তমানের। সংগত জিজ্ঞাসা আসতেই পারে কার জন্য উৎসব, কাদের উৎসব। সবাই যে মেতে উঠেছি, ঘরের বাইরের পরিবেশটাকে যে প্রকার হুড়মুড়িয়ে তাতিয়ে তোলা হয়েছে চোখের সামনেই তো দেখছি। গত মাসখানেক ধরে কেমন এক উৎসব হৈ রৈ কাণ্ড। মেট্রোপলিটন সিটি ঢাকায়, ঢাকার বাইরে নানা শহরে-বন্দরে-চট্টগ্রামে, খুলনায়, রাজশাহীতে, বগুড়ায়, সিলেটে কোথায় নয়। রোজকার খবরের কাগজে রপোর্ট পাঠ করি, ছবি দেখি। রঙিন সাজে বিপণিবিতান, ইংরেজি শব্দের নতুন আভরণে আরো জাতে উঠেছে শপিং সেন্টার, শপিং কমপ্লেঙ্ ইত্যাকার নাম পরিচিতিতে সন্ধ্যের সঙ্গে বিচিত্র আলোকমালায় রমণীয় আকর্ষণের বিভ্রম ছড়া। আর রাজপথে তো বটেই; ফাঁকফোকরের গলিপথেও অনড়, নিশ্ছিদ্র যানজট, পথে-ঘাটে, ফুটপাতে বাজারে হঠাৎ করেই কোথা থেকে বিস্ফোরণ মানুষের ভিড়ের। কী? না ঈদ। ঈদোৎসবের মাতামাতি। তা উৎসবের একদিকে তো উত্তেজনা থেকেই থাকে। তবে সেই উত্তেজনাকে গ্রাস করে ফেলছে উৎসবের সামগ্রিকতা।
আবারও বলি, আমরা সমকালের চেহারাটা দেখার প্রয়াস পাচ্ছি। বুঝতে মোটে অসুবিধা নেই-ফ্রি ইকোনমি, মুক্তবাজারের মুক্তাঙ্গনে এখন আমাদের বসবাস। বাজারাধিপতিরা অনিবার্য লোভাতুর করে তুলবেন তাঁদের চাঁদেরহাট-এটাই স্বাভাবিক। অতএব পশরা আসছে ব্যাংকক-হংকং থেকে, পাশের দেশের কলকাতা-মাদ্রাজ থেকে। যথার্থ বটে খবরের কাগজের শিরোনাম; 'ঈদের বাজার জমজমাট বিদেশি দ্রব্য আসছে দেদার।' আরেক শিরোনাম : 'কেনাকাটার ধুম পোশাকের বাজারে আগুন বিদেশি জিনিসপত্রে বাজার সয়লাব।' এই রকমে সব। আরেক চেহারা। ভাগ্যবানই বলব, তাঁরা মাঝারি মাপের, খানিক খাটো মাপের চাকরিজীবী, তাঁরা ঈদ বোনাস, ঈদ অ্যাডভান্স পেয়েছেন। ফলত ঈদের নামে উৎসবের মাতন নয়ই বা কেন তাঁদের। সেই 'শপিং'-এর হুল্লোড় তাদের হকার্স মার্কেটে ফুটপাতের পশরায়। প্রাণান্তকর ঘোরাঘুরি হেথায় হোথায়, নাভিশ্বাস দরদাম, শেষ পর্যন্ত যা থাকে কপালে, কিনেই ফেলা সংগতিতে কুলোয় যদ্দুর। কিন্তু মোটের হিসেবে সংখ্যানুপাতিক কত জনই বা এঁরা?
প্রসঙ্গত, ওই জিজ্ঞাসাটি পুনরায় এভাবে আনা যাক-ঈদ যদি উৎসব, সর্বজনীন উৎসব, যথার্থই কি তাই? পথের মানুষ যাদের দিনাতিপাতের অবলম্বন ষোলো আনা শ্রমনির্ভর, আর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বিরাট গ্রামটির কোটি কোটি চাষি জনমানুষ, বলবার প্রয়োজন নেই যে উৎসব সেই সমস্ত ঘরে পরিহাসের আরেক নাম। মিল্লাত-ই-কওম ধর্মভ্রাতা তাঁরা পেট্রোডলারের মালিক সৌদিরা, ইরানিরা, বাহরাইনি, কুয়েতি, কাতারিয়া, রাখঢাকের বালাই না রেখে খোলাখুলি নামকরণই করে দিয়েছে আমাদের 'মিসকিন' অভিধায়। কটুবাক্য বটে, তবে প্রকৃত সত্য এই যে তেমন করে প্রতিবাদ জানাবার সম্বল নেই বটে। অপরদিকে প্রাচ্যের জাপান থেকে প্রতীচ্যের মার্কিন দেশ অবধি তারা দাতা; বাংলাদেশের আমরা তাদের উচ্ছিষ্ট দান-অনুদান-ঋণের প্রার্থনায় নতজানু কৃপাপ্রার্থী। উন্নয়নের জোয়ার সত্ত্বেও প্রাকৃত সাধারণের জন্য নিত্য দুবেলা ডাল-ভাতের জোগান অনতিক্রম্য সংকট সমস্যা-কে না জানে এইটেই বাস্তব। সেই কবে লিখেছিলেন নজরুল-'জীবনে যাদের হররোজ রোজা', তারপর সত্তর বছরের মতো কাল অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, তাদের ঘরে উৎসব-'এল খুশির ঈদ'?
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments