স্মরণ-ইতিহাসের মহানায়ক মওলানা ভাসানী by রাশেদ খান মেনন
প্রথম আলো একবার তার বিশেষ সংখ্যা সাজিয়েছিল এ দেশের ইতিহাসের নায়কদের নিয়ে। সে প্রসঙ্গে আমার ওপর এসে পড়েছিল মওলানা ভাসানী সম্পর্কে কিছু লেখার। সেই লেখা লিখতে গিয়ে লিখেছিলাম, ‘সত্যি মওলানা ভাসানীর মতো কে আমাদের জীবনকে এভাবে প্রভাবিত করেছে—সেই ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান পেরিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা নিয়ন্ত্রণ করেছেন, যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের দাবির প্রথম প্রকাশ ঘটেছে,
যিনি এ দেশে পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ইতি ঘটিয়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির গোড়াপত্তন করেছেন, স্বৈরশাসকেরা যাঁকে ভয় পেয়েছেন, যাঁর আহ্বানে গরিব মজলুম মানুষগুলো মেরুদণ্ড সোজা করে সংগ্রামের মাঠে দাঁড়িয়েছে, সেই মওলানা ভাসানী আমাদের ইতিহাসের নায়ক তো বটেই, মহানায়ক। আমার এবং এ দেশের মানুষেরও।’
কিন্তু ইতিহাস বিকৃতির যে ধারা এ দেশে এখনো বিদ্যমান, তখন আমাদের ইতিহাসের এই নায়কদের খলনায়ক বানিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মহান নায়কেরা এর থেকে বাদ পড়েননি। সে কারণে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যখন বঙ্গবন্ধু বা মওলানা ভাসানী সম্পর্কে জানে, তখন তাঁদের খণ্ডিতভাবে জানে, বিপরীতভাবেও জানে।
ইতিহাসের এই মহানায়কদের সম্পর্কে বিপরীতভাবে জানার ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি সবচেয়ে দুর্ভাগা তিনি হলেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। তাঁর এই দুর্ভাগ্যের পেছনে তিনি যে রাজনীতি করতেন সেই রাজনীতি ধারণকারী সংগঠন রেখে না যেতে পারাটা অন্যতম কারণ। মওলানা ভাসানীর জীবদ্দশাতেই তাঁর হাতে গড়া সংগঠনের প্রায় বিলুপ্তি ঘটেছিল। মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর তাঁর ওই বিলুপ্তপ্রায় সংগঠনে যাঁরা অবশিষ্ট ছিলেন, তাঁরা মওলানা ভাসানীর রাজনীতিকে পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে এ দেশে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির যে পুনরুত্থান ঘটে, ক্ষমতার লোভে তার কাছে ইজারা দিয়ে দিয়েছিল। এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসের ছাত্রদের স্মরণ আছে পঁচাত্তর-পরবর্তী মওলানা ভাসানীর অনুসারী দাবিদার ভাসানী ন্যাপকে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল সামরিক নায়ক জিয়াউর রহমানের প্রথমে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ও পরে জাতীয়তাবাদী দলে। আর সেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপির কল্যাণে মওলানা ভাসানী এখন পরিচিত জনতার রাজনীতির ঠিক উল্টোভাবে। বিএনপির বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ যখন মওলানা ভাসানীর রাজনীতির উত্তরাধিকারের দাবি করে, তখন মওলানা ভাসানীর সারা জীবনের সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার রাজনীতি মিথ্যা হয়ে যায়।
কিন্তু এটাই হয়ে আসছে সাম্প্রতিক বছরগুলোয়। বিএনপি তার সাম্প্রদায়িকতার মিশেল দেওয়া বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে মওলানা ভাসানীর অনুসরণ বলে এমনভাবে দাবি করে যে অনেকের মনে হতে পারে ঘটনাটা সত্যিই তা-ই। এই মিথ্যাকে খণ্ডন করা এ জন্যই প্রয়োজন যে বিএনপির রাজনীতি এখন আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদেই থেমে নেই, জামায়াতের হাত ধরে সেটা ইসলামি জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়েছে। আর বিএনপি-জামায়াতের এই ইসলামি জাতীয়তাবাদের স্বরূপ আমরা দেখেছি ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত তাদের শাসনামলে, যখন তাদের এই ধর্মবাদী রাজনীতি ইসলামি জঙ্গিবাদে রূপ নিয়ে বাংলাদেশের সমাজ-সভ্যতার মূলে গিয়ে আঘাত করেছিল। জনগণের প্রতিরোধের মুখে বিএনপি-জামায়াতের মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতি গুটিয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি সেটাই আবার ফণা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আর এখানেই মওলানা ভাসানীর রাজনীতির স্বরূপটা আরেকবার বিবৃত করা অত্যন্ত জরুরি। নইলে এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের মতো স্বাধীনতার মহানায়কদের ইতিহাস আত্মসাৎ করে নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল চেহারাটা ঢাকার অপচেষ্টাকে প্রতিরোধ করা যাবে না।
মওলানা ভাসানী কে ছিলেন? ইতিহাসের কয়েক যুগ পেছনে গিয়ে যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখতে পাই, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত স্বাধীন পাকিস্তানের অসম্প্রদায়িক রাজনীতির যিনি সূচনা করেছিলেন, তিনি—মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের ধর্মের রাজনীতিকে তাঁর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি দিয়ে তীব্রভাবে আঘাত হেনেছিলেন, যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম, তাকে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একজন ধর্মতত্ত্ববিদ হিসেবে ধর্মকে তিনি ব্যবহার করেছেন জনগণের কাজে, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কাজে। তিনি বলেন, ‘আমার ধর্ম বিপ্লবের ধর্ম এবং আমি নিজে ধর্মানুসারী। সুতরাং ধার্মিক হিসেবে আমার কর্তব্য হচ্ছে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো—জিহাদ করা’ (টাইম ১৮ এপ্রিল ১৯৬৯)। মওলানা ভাসানী ধর্মকে দেখেছেন শোষণমুক্তির হাতিয়ার হিসেবে। বাংলার অগণিত গ্রামের কৃষকের পীর মওলানা ভাসানী তাঁর মুরিদদের বয়াত করাতেন সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-সাম্প্রদায়িকতা-শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার শপথে।
মওলানা ভাসানীই সেই ব্যক্তি, যিনি পাকিস্তানের প্রথম যুগে আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘মুসলিম’ শব্দ বর্জন করে তাতে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে রূপ দিয়েছিলেন। শেষ জীবনে এসে মওলানা ভাসানী অবশ্য ‘হুকুমতে রব্বানী’ তথা ‘রুব্বুবিয়ত’-এর রাজনীতিতে নিজেকে নিবিষ্ট করেছিলেন, কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন।
মওলানা ভাসানীর জীবনসায়াহ্নের সময়ের কথা। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের পথ থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই সময় ১৯৭৬ সালের কথা। মওলানা ভাসানী রোগাক্রান্ত অবস্থায় পিজি হাসপাতালে ভর্তি। একাত্তরের পরাজিত ধর্মবাদী গোষ্ঠীরা রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টায় পঁচাত্তরের পরিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে একটু একটু করে মাথা তুলছে। তাদেরই উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সিরাত মজলিশের আয়োজন করা হয়েছে। প্রধান অতিথি উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার মার্শাল তোয়াব। ওই রোগাক্রান্ত অবস্থায় সেই ষড়যন্ত্র মওলানা ভাসানীর চোখ এড়ায়নি। তিনি ওই সিরাত সম্মেলনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাই ওই রোগশয্যা থেকেই এক কঠিন বিবৃতিতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে হুঁশিয়ারি জানালেন যে তিনি এই ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করবেন না। মওলানার এক হুঙ্কারেই ওই সিরাত সম্মেলন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একাত্তরের পরাজিত ধর্মবাদী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র আর বিশেষ এগোতে পারেনি। সেই মওলানার মৃত্যুর পর একে যখন ধর্মবাদী রাজনীতির স্বার্থে—তার নামকে ব্যবহার করা হয়, তখন সেটা গ্রহণ করা যায় না, কেবল তার স্বরূপ উন্মোচন করে তাকে প্রতিরোধ করা মওলানা ভাসানীর অনুসারীসহ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মীদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।
কেবল ধর্মবাদী রাজনীতির প্রশ্নই নয়, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা মওলানা ভাসানীর রাজনীতির মুখ্য বিষয় ছিল। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নের সঙ্গে এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্ন তাঁকে তাঁর নিজ সংগঠন আওয়ামী লীগ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করে। সিয়েটো-সেন্টো পদক মার্কিন সামরিক চুক্তি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন—প্রতিটি ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানী তাঁর বিরোধিতা অব্যাহত রেখেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ যখন নতুন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে, তখন তিনি বঙ্গবন্ধুকে যেমন, তেমনি সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে বারবার হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার শত্রুর প্রয়োজন পড়ে না।
মওলানা ভাসানীর এই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্র তাঁকে অনন্য করেছিল। আবার এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা থেকে তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনেক সময় এমন সব ব্যাখ্যাতীত ভূমিকা নিয়েছেন, যা তাঁকে বিতর্কিত করেছিল। সামরিক শাসক আইয়ুবের পররাষ্ট্রনীতির প্রতি তাঁর দুর্বলতা এর একটি উদাহরণ।
কিন্তু মওলানা ভাসানী মওলানা ভাসানীই। তাই আইয়ুবের শাসনের বিরুদ্ধে উত্তাল গণ-আন্দোলনের তিনিই রূপকার। আইয়ুবের পতনে তাঁর ভূমিকার জন্য টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে নিয়ে যে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিল, তাতে লেখা হয়েছিল, ‘একজন মানুষ, শুধু একজন মানুষই গত মাসে (মার্চ ১৯৬৯) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং ‘লৌহমানব’ নামে খ্যাত আইয়ুব খানকে গদিচ্যুত করতে বাধ্য করেছেন। এই মুহূর্তে ভাসানীই একমাত্র ব্যক্তি, ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত গোলযোগপূর্ণ দেশে সামরিক আইন দিয়ে ভঙ্গুর শান্তি ফিরিয়ে আনলেও তিনিই এখন সেই সামরিক আইনের একমাত্র একক আতঙ্কস্বরূপ। ভাসানীর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী চরমপন্থী শেখ মুজিবুর রহমানসহ পাকিস্তানের অন্য রাজনৈতিক নেতারা একটি ভীতির কারণে নিশ্চুপ। কিন্তু ভাসানী অকুতোভয়। তাঁর বাঁশের বেড়া দেওয়া ক্ষুদ্র কুঁড়েঘরে তাঁর অনুসারী ও সাংবাদিকদের এখনো অবারিত দ্বার। ‘ভয়, আমার আবার ভয় পাওয়ার কী আছে?’ বেতের টুপিটা মাথায় আঁটতে আঁটতে এবং সবুজ সোয়েটারটা শরীরে গলাতে গলাতে টাইম পত্রিকার সাংবাদদাতা ডন কেগিনকে মওলানা বলেন, ‘আমি আমার দেশবাসীর জন্য ফাঁসিতে ঝুলতেও প্রস্তুত।’
আজ ১৭ নভেম্বর মওলানার পঁয়ত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশবাসীকে কিছুটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য এই লেখা। মৃত্যুর পর তাঁকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেওয়ার যেমন একটা চেষ্টা আছে, তেমনি তাঁর রাজনীতিকে আত্মসাৎ করে প্রতিক্রিয়াশীল ঘৃণ্য রাজনীতিকে মওলানার নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও আছে। কিন্তু ইতিহাসের মহানায়কেরা নিজেদের গুণেই ভাস্কর থাকেন। মওলানা ভাসানীও তাঁর নিজ মহিমায় ভাস্কর। মওলানা ভাসানী তাঁর রাজনীতির পরিচয়েই এ দেশের মানুষের মধ্যে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন।
রাশেদ খান মেনন: সংসদ সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি।
কিন্তু ইতিহাস বিকৃতির যে ধারা এ দেশে এখনো বিদ্যমান, তখন আমাদের ইতিহাসের এই নায়কদের খলনায়ক বানিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মহান নায়কেরা এর থেকে বাদ পড়েননি। সে কারণে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যখন বঙ্গবন্ধু বা মওলানা ভাসানী সম্পর্কে জানে, তখন তাঁদের খণ্ডিতভাবে জানে, বিপরীতভাবেও জানে।
ইতিহাসের এই মহানায়কদের সম্পর্কে বিপরীতভাবে জানার ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি সবচেয়ে দুর্ভাগা তিনি হলেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। তাঁর এই দুর্ভাগ্যের পেছনে তিনি যে রাজনীতি করতেন সেই রাজনীতি ধারণকারী সংগঠন রেখে না যেতে পারাটা অন্যতম কারণ। মওলানা ভাসানীর জীবদ্দশাতেই তাঁর হাতে গড়া সংগঠনের প্রায় বিলুপ্তি ঘটেছিল। মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর তাঁর ওই বিলুপ্তপ্রায় সংগঠনে যাঁরা অবশিষ্ট ছিলেন, তাঁরা মওলানা ভাসানীর রাজনীতিকে পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে এ দেশে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির যে পুনরুত্থান ঘটে, ক্ষমতার লোভে তার কাছে ইজারা দিয়ে দিয়েছিল। এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসের ছাত্রদের স্মরণ আছে পঁচাত্তর-পরবর্তী মওলানা ভাসানীর অনুসারী দাবিদার ভাসানী ন্যাপকে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল সামরিক নায়ক জিয়াউর রহমানের প্রথমে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ও পরে জাতীয়তাবাদী দলে। আর সেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপির কল্যাণে মওলানা ভাসানী এখন পরিচিত জনতার রাজনীতির ঠিক উল্টোভাবে। বিএনপির বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ যখন মওলানা ভাসানীর রাজনীতির উত্তরাধিকারের দাবি করে, তখন মওলানা ভাসানীর সারা জীবনের সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার রাজনীতি মিথ্যা হয়ে যায়।
কিন্তু এটাই হয়ে আসছে সাম্প্রতিক বছরগুলোয়। বিএনপি তার সাম্প্রদায়িকতার মিশেল দেওয়া বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে মওলানা ভাসানীর অনুসরণ বলে এমনভাবে দাবি করে যে অনেকের মনে হতে পারে ঘটনাটা সত্যিই তা-ই। এই মিথ্যাকে খণ্ডন করা এ জন্যই প্রয়োজন যে বিএনপির রাজনীতি এখন আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদেই থেমে নেই, জামায়াতের হাত ধরে সেটা ইসলামি জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়েছে। আর বিএনপি-জামায়াতের এই ইসলামি জাতীয়তাবাদের স্বরূপ আমরা দেখেছি ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত তাদের শাসনামলে, যখন তাদের এই ধর্মবাদী রাজনীতি ইসলামি জঙ্গিবাদে রূপ নিয়ে বাংলাদেশের সমাজ-সভ্যতার মূলে গিয়ে আঘাত করেছিল। জনগণের প্রতিরোধের মুখে বিএনপি-জামায়াতের মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতি গুটিয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি সেটাই আবার ফণা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আর এখানেই মওলানা ভাসানীর রাজনীতির স্বরূপটা আরেকবার বিবৃত করা অত্যন্ত জরুরি। নইলে এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের মতো স্বাধীনতার মহানায়কদের ইতিহাস আত্মসাৎ করে নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল চেহারাটা ঢাকার অপচেষ্টাকে প্রতিরোধ করা যাবে না।
মওলানা ভাসানী কে ছিলেন? ইতিহাসের কয়েক যুগ পেছনে গিয়ে যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখতে পাই, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত স্বাধীন পাকিস্তানের অসম্প্রদায়িক রাজনীতির যিনি সূচনা করেছিলেন, তিনি—মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের ধর্মের রাজনীতিকে তাঁর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি দিয়ে তীব্রভাবে আঘাত হেনেছিলেন, যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম, তাকে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একজন ধর্মতত্ত্ববিদ হিসেবে ধর্মকে তিনি ব্যবহার করেছেন জনগণের কাজে, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কাজে। তিনি বলেন, ‘আমার ধর্ম বিপ্লবের ধর্ম এবং আমি নিজে ধর্মানুসারী। সুতরাং ধার্মিক হিসেবে আমার কর্তব্য হচ্ছে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো—জিহাদ করা’ (টাইম ১৮ এপ্রিল ১৯৬৯)। মওলানা ভাসানী ধর্মকে দেখেছেন শোষণমুক্তির হাতিয়ার হিসেবে। বাংলার অগণিত গ্রামের কৃষকের পীর মওলানা ভাসানী তাঁর মুরিদদের বয়াত করাতেন সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-সাম্প্রদায়িকতা-শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার শপথে।
মওলানা ভাসানীই সেই ব্যক্তি, যিনি পাকিস্তানের প্রথম যুগে আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘মুসলিম’ শব্দ বর্জন করে তাতে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে রূপ দিয়েছিলেন। শেষ জীবনে এসে মওলানা ভাসানী অবশ্য ‘হুকুমতে রব্বানী’ তথা ‘রুব্বুবিয়ত’-এর রাজনীতিতে নিজেকে নিবিষ্ট করেছিলেন, কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন।
মওলানা ভাসানীর জীবনসায়াহ্নের সময়ের কথা। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের পথ থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই সময় ১৯৭৬ সালের কথা। মওলানা ভাসানী রোগাক্রান্ত অবস্থায় পিজি হাসপাতালে ভর্তি। একাত্তরের পরাজিত ধর্মবাদী গোষ্ঠীরা রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টায় পঁচাত্তরের পরিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে একটু একটু করে মাথা তুলছে। তাদেরই উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সিরাত মজলিশের আয়োজন করা হয়েছে। প্রধান অতিথি উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার মার্শাল তোয়াব। ওই রোগাক্রান্ত অবস্থায় সেই ষড়যন্ত্র মওলানা ভাসানীর চোখ এড়ায়নি। তিনি ওই সিরাত সম্মেলনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাই ওই রোগশয্যা থেকেই এক কঠিন বিবৃতিতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে হুঁশিয়ারি জানালেন যে তিনি এই ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করবেন না। মওলানার এক হুঙ্কারেই ওই সিরাত সম্মেলন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একাত্তরের পরাজিত ধর্মবাদী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র আর বিশেষ এগোতে পারেনি। সেই মওলানার মৃত্যুর পর একে যখন ধর্মবাদী রাজনীতির স্বার্থে—তার নামকে ব্যবহার করা হয়, তখন সেটা গ্রহণ করা যায় না, কেবল তার স্বরূপ উন্মোচন করে তাকে প্রতিরোধ করা মওলানা ভাসানীর অনুসারীসহ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মীদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।
কেবল ধর্মবাদী রাজনীতির প্রশ্নই নয়, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা মওলানা ভাসানীর রাজনীতির মুখ্য বিষয় ছিল। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নের সঙ্গে এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্ন তাঁকে তাঁর নিজ সংগঠন আওয়ামী লীগ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করে। সিয়েটো-সেন্টো পদক মার্কিন সামরিক চুক্তি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন—প্রতিটি ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানী তাঁর বিরোধিতা অব্যাহত রেখেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ যখন নতুন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে, তখন তিনি বঙ্গবন্ধুকে যেমন, তেমনি সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে বারবার হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার শত্রুর প্রয়োজন পড়ে না।
মওলানা ভাসানীর এই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্র তাঁকে অনন্য করেছিল। আবার এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা থেকে তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনেক সময় এমন সব ব্যাখ্যাতীত ভূমিকা নিয়েছেন, যা তাঁকে বিতর্কিত করেছিল। সামরিক শাসক আইয়ুবের পররাষ্ট্রনীতির প্রতি তাঁর দুর্বলতা এর একটি উদাহরণ।
কিন্তু মওলানা ভাসানী মওলানা ভাসানীই। তাই আইয়ুবের শাসনের বিরুদ্ধে উত্তাল গণ-আন্দোলনের তিনিই রূপকার। আইয়ুবের পতনে তাঁর ভূমিকার জন্য টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে নিয়ে যে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিল, তাতে লেখা হয়েছিল, ‘একজন মানুষ, শুধু একজন মানুষই গত মাসে (মার্চ ১৯৬৯) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং ‘লৌহমানব’ নামে খ্যাত আইয়ুব খানকে গদিচ্যুত করতে বাধ্য করেছেন। এই মুহূর্তে ভাসানীই একমাত্র ব্যক্তি, ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত গোলযোগপূর্ণ দেশে সামরিক আইন দিয়ে ভঙ্গুর শান্তি ফিরিয়ে আনলেও তিনিই এখন সেই সামরিক আইনের একমাত্র একক আতঙ্কস্বরূপ। ভাসানীর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী চরমপন্থী শেখ মুজিবুর রহমানসহ পাকিস্তানের অন্য রাজনৈতিক নেতারা একটি ভীতির কারণে নিশ্চুপ। কিন্তু ভাসানী অকুতোভয়। তাঁর বাঁশের বেড়া দেওয়া ক্ষুদ্র কুঁড়েঘরে তাঁর অনুসারী ও সাংবাদিকদের এখনো অবারিত দ্বার। ‘ভয়, আমার আবার ভয় পাওয়ার কী আছে?’ বেতের টুপিটা মাথায় আঁটতে আঁটতে এবং সবুজ সোয়েটারটা শরীরে গলাতে গলাতে টাইম পত্রিকার সাংবাদদাতা ডন কেগিনকে মওলানা বলেন, ‘আমি আমার দেশবাসীর জন্য ফাঁসিতে ঝুলতেও প্রস্তুত।’
আজ ১৭ নভেম্বর মওলানার পঁয়ত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশবাসীকে কিছুটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য এই লেখা। মৃত্যুর পর তাঁকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেওয়ার যেমন একটা চেষ্টা আছে, তেমনি তাঁর রাজনীতিকে আত্মসাৎ করে প্রতিক্রিয়াশীল ঘৃণ্য রাজনীতিকে মওলানার নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও আছে। কিন্তু ইতিহাসের মহানায়কেরা নিজেদের গুণেই ভাস্কর থাকেন। মওলানা ভাসানীও তাঁর নিজ মহিমায় ভাস্কর। মওলানা ভাসানী তাঁর রাজনীতির পরিচয়েই এ দেশের মানুষের মধ্যে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন।
রাশেদ খান মেনন: সংসদ সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি।
No comments