শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগসংক্রান্ত নাটকীয় ঘটনা by এ এম এম শওকত আলী
১৬ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকারি কর্মচারীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্তে দেখা যায়, বিদ্যমান আচরণবিধির অধিকতর প্রচার করতে হবে। হঠাৎ করে এ বিষয়টি কেন উত্থাপিত হলো, তার কোনো বিস্তারিত বিবরণ জানা যায়নি। অনুমান করা হচ্ছে যে শেয়ারবাজারে সরকারি কর্মচারীরা বিনিয়োগ করছেন।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের কিছু দেশে এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ওই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের বিষয়টি যে ঝুঁকিপূর্ণ এ কথা স্পষ্ট করে মিডিয়ায় প্রচার করে। বাংলাদেশে এটা করা হয় না। এ বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হলে ভালো হবে। যেকোনো বিনিয়োগকারী জানতে পারবে যে বিনিয়োগটি হবে ঝুঁকিপূর্ণ। অর্থাৎ বিনিয়োগে লাভও হতে পারে, লোকসানও হতে পারে। ১৭ জানুয়ারি প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায় যে এ বিষয়টি সম্পর্কেই প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন যে বিনিয়োগকারীকে লাভ করলে ক্ষতিরও দায়ভার নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের বিনিয়োগে বিধিনিষেধ সম্পর্কেও জানতে চান। তিনি জানতে পারেন যে ১৯৭৯ সালে প্রণীত সরকারি কর্মচারীদের আচরণবিধিতে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল, বিধিটি নতুন করে প্রচার করতে হবে। প্রাসঙ্গিক যে আচরণবিধির প্রেক্ষাপট বহু পুরনো। ব্রিটিশ আমল থেকেই পর্যায়ক্রমে এ ধরনের আচরণবিধি সময় সময় প্রণীত হয়। পদমর্যাদা নির্বিশেষে সব সরকারি কর্মচারীর আচরণবিধি জানা বাধ্যতামূলক। এর ব্যত্যয় ঘটলে ক্ষেত্রভেদে শাস্তিও প্রদান করা হয়। আচরণবিধির কয়েকটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো : ক. সততা ও সুনাম নিশ্চিত করা, খ. সিদ্ধান্ত গ্রহণে বস্তুনিষ্ঠতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা, গ. সরকারের ভাবমূর্তি ও ক্ষমতার সুরক্ষা এবং ঘ. সার্ভিসে উচ্চমান ও ন্যায়নিষ্ঠতা বজায় রাখা। বলা বাহুল্য যে শৃঙ্খলামূলক নিয়ন্ত্রণ শাসনব্যবস্থার জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। এ কারণে আচরণবিধি করা হয়েছে। এ বিধি কোনো আইনের আওতায় করা হয়নি। এ বিধির ভিত্তি হলো সংবিধান।
পাকিস্তান আমলেও এ বিধির অস্তিত্ব দেখা যায়। ১৯৭৯ সালে প্রণীত বিধিতেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই বিধিতে বলা আছে, ১৯৬৪ সালে প্রণীত বিধি রদ করা হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। ১৯৬৬ সালেও পূর্ববর্তী বিধির সংশোধন করা হয়। ১৯৭৯-এর বিধি মূলত পূর্ববর্তী বিধিগুলোর ওপর ভিত্তি করেই প্রণীত হয়। এ বিধি যেকোনো কর্মরত অথবা দুটি ভোগকারী কর্মচারীর জন্য প্রযোজ্য। বিধিতে বহু ধরনের নিষেধ রয়েছে। এসব বিধিনিষেধ মূলত দুই ধরনের। এক. কিছু বিধিনিষেধ সরকারের পূর্বানুমোদনসাপেক্ষে প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের পূর্ব অনুমোদন নিয়ে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা বাধ্যতামূলক হবে না। দুই. কিছু বিধিনিষেধ অবশ্যই বাধ্যতামূলক। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ এ ধরনের একটি নিষেধাজ্ঞা, যা বাধ্যতামূলক।
১৫ নম্বর বিধিতে এর স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, যেকোনো সরকারি কর্মচারী লাভের উদ্দেশ্যে কোনো বিনিয়োগ করতে পারবে না। এ ধারায় সরকারের কোনো পূর্বানুমতির উল্লেখ নেই। বিধিতে এ ধরনের বিনিয়োগের সংজ্ঞাও রয়েছে। সংজ্ঞায় দেখা যায়, যেসব বিনিয়োগের মূল্যমান দারুণভাবে অস্থিতিশীল, তাতে কোনো বিনিয়োগই করা যাবে না। ইংরেজিতে �Securities� শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে যেকোনো সরকারি কর্মচারীর পরিবারের কোনো সদস্যও এ ধরনের বিনিয়োগ করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে আরো দুটি উপবিধির উল্লেখ করা যায়। এক. কোনো সরকারি কর্মচারী যদি পূর্বাহ্নেই জানতে পারে যে বিনিয়োগ করে সে লাভবান হবেই, সে ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ করতে পারবে না। দুই. কোন ধরনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা যাবে না সে বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।
উপর্যুক্ত বিষয়টি অন্য একটি বিধির সঙ্গে যুক্ত। সংশ্লিষ্ট বিধিতে ধার দেওয়া বা ধার নেওয়া, দুটোই নিষিদ্ধ। শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় কেউ হয়তো লাভবান হওয়ার আশায় ক্রয়ের জন্য অর্থ ধার নিতে পারে অথবা কিছু লাভের আশায় অন্যকে ধার দিতে পারে। বলা বাহুল্য যে এ বিষয়টি নিষিদ্ধ করার কারণ এ ধরনের অভ্যাসের জন্য কোনো কর্মচারী যেন দেনাগ্রস্ত না হয়। অন্য একটি প্রাসঙ্গিক বিধি হলো, যেকোনো কর্মচারীর জীবনযাপনের মান তাঁর আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিধি রয়েছে। তা হলো, উপহার গ্রহণ করা। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক।
বিভিন্ন সময় আচরণবিধির পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৯৮৫ থেকে শুরু করে ২০০২ সাল পর্যন্ত। আগের এক আচরণবিধি অনুযায়ী ১০ হাজার টাকার উর্ধ্বে মূল্যসংক্রান্ত গহনার বিষয়ে সরকারকে অবহিত করার উল্লেখ ছিল। ডিসেম্বর ২০০২ সালে মূল্যের উচ্চসীমা করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া মহিলা সহকর্মীদের সঙ্গে মার্জিত আচরণ করার বিষয়ও সংশোধনীতে নতুনভাবে বিধিভুক্ত করা হয়েছে। অন্য একটি অন্যতম সংশোধনী হলো, Conflict of Interest--সংক্রান্ত। এ বিষয়টিই সরকারি কর্মচারীদের ওপর শেয়ারবাজারে লেনদেনসংক্রান্ত বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞার অন্যতম একটি কারণ। তবে এ ক্ষেত্রে বলা যায়, যেসব মন্ত্রণালয়ের বা দপ্তরের কর্মচারীদের পক্ষে কোন শেয়ারে বিনিয়োগ করলে লাভবান হওয়া যাবে এবং কোনটায় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে, তা অল্প কিছু মন্ত্রণালয় ব্যতীত অন্য কারো পূর্বাহ্নে জানার সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে যেকোনো আইন বা বিধি সবার জন্য প্রযোজ্য হওয়াই নিয়ম।
১৭ জানুয়ারি সংবাদে দেখা যায় যে অস্থিরতার জন্য শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এক. ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ লি. সরকারি কর্মচারীদের বিনিয়োগের সুযোগ দাবি করেছে। দুই. কালো টাকাসংক্রান্ত এনবিআরের প্রজ্ঞাপনও রদ করার দাবি করেছে। সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বলা সম্ভব যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের অধিকার ক্ষুণ্ন করার জন্য শেয়ারবাজারে কোনো প্রভাব থাকার কথা নয়। প্রায় ১০ লাখ সরকারি কর্মচারীর সিংহভাগই চতুর্থ, তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণীর। তাঁদের বিনিয়োগের জন্য সঞ্চয় না থাকাই স্বাভাবিক। প্রথম শ্রেণীর সিংহভাগই কনিষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁদের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য।
প্রকাশিত সংবাদে আচরণবিধির নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত কর্মচারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সংবাদও পাওয়া গেছে। তাঁদের সিংহভাগই নিষেধাজ্ঞার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। অন্যদিকে মধ্যম কাতারের কর্মচারীরা এর বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের যুক্তির ভিত্তি হলো, কিছু কর্মচারী প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা উঠিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। এতে দোষের কিছু নেই। এ ফান্ডের সুদের হার ১১ কি ১২ শতাংশ। অন্যদিকে কিছু শেয়ারের বার্ষিক মুনাফা প্রায় দ্বিগুণ। তবে এ মুনাফা যে প্রতিবছর একই বা তার অধিক হবে, এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। এ ছাড়া রয়েছে সঠিক শেয়ার কেনার প্রশ্ন। সার্বিকভাবে বলা যায় যে ধ্রুব সত্যটি হলো, শেয়ারবাজারে লেনদেন সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। যাদের অঢেল উদ্বৃত্ত টাকা রয়েছে, তারাই এ ঝুঁকি নিতে পারে। সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এ কথা বলা যাবে না।
বিনিয়োগের সপক্ষে আরো যুক্তি দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে যে সরকারি কর্মচারীরা এখন আয়কর দেয়। তাদের মোট আয়-ব্যয়সহ সম্পদের হিসাব আয়কর বিভাগকে দেওয়া হয়। এ কথা সত্যি হলেও বলা যায় যে আরোপযোগ্য আয়করের পরিমাণ হবে নগণ্য। আয়করসীমার মধ্যে নিম্ন বেতনের কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য না থাকাই স্বাভাবিক। অপেক্ষাকৃত উচ্চ বেতনক্রমের কর্মচারীদের জন্যও উদ্বৃত্ত আয় খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। এর সঙ্গে যোগ করা যায় আয়কর আইনের বিধান। এ বিধান অনুযায়ী মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশ বিনিয়োগযোগ্য। এর পরিমাণ কম হওয়ারই কথা। ১৮ জানুয়ারি এ-সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহে এক নাটকীয় পরিবর্তন দেখা দেয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সিকিউরিটি এঙ্চেঞ্জের চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের জানান যে প্রকাশিত সংবাদ সঠিক নয়। তিনি দাবি করেন, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত ওই বৈঠকে গ্রহণ করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে সরকার এ-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে। এ পদক্ষেপের কিছু পরেই আবার প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মিডিয়ার জন্য এটা ছিল একটি দারুণ খবর। যে কর্মচারীরা ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের জন্য এটা ছিল সুখবর। জানা যায়, সেনাবাহিনী ও পুলিশের কিছু সদস্য এ ধরনের বিনিয়োগ করেছিলেন। বিনিয়োগকৃত অর্থের উৎস জাতিসংঘের শান্তিমিশন-সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন। এ সত্ত্বেও বলা যায় যে নিষেধাজ্ঞার বিধান এখনো আচরণবিধিতে রয়েছে। ভবিষ্যতে সরকার হয়তো বাস্তবতার নিরিখে সংশ্লিষ্ট বিধানে কিছু পরিবর্তন আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের বিনিয়োগে বিধিনিষেধ সম্পর্কেও জানতে চান। তিনি জানতে পারেন যে ১৯৭৯ সালে প্রণীত সরকারি কর্মচারীদের আচরণবিধিতে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল, বিধিটি নতুন করে প্রচার করতে হবে। প্রাসঙ্গিক যে আচরণবিধির প্রেক্ষাপট বহু পুরনো। ব্রিটিশ আমল থেকেই পর্যায়ক্রমে এ ধরনের আচরণবিধি সময় সময় প্রণীত হয়। পদমর্যাদা নির্বিশেষে সব সরকারি কর্মচারীর আচরণবিধি জানা বাধ্যতামূলক। এর ব্যত্যয় ঘটলে ক্ষেত্রভেদে শাস্তিও প্রদান করা হয়। আচরণবিধির কয়েকটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো : ক. সততা ও সুনাম নিশ্চিত করা, খ. সিদ্ধান্ত গ্রহণে বস্তুনিষ্ঠতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা, গ. সরকারের ভাবমূর্তি ও ক্ষমতার সুরক্ষা এবং ঘ. সার্ভিসে উচ্চমান ও ন্যায়নিষ্ঠতা বজায় রাখা। বলা বাহুল্য যে শৃঙ্খলামূলক নিয়ন্ত্রণ শাসনব্যবস্থার জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। এ কারণে আচরণবিধি করা হয়েছে। এ বিধি কোনো আইনের আওতায় করা হয়নি। এ বিধির ভিত্তি হলো সংবিধান।
পাকিস্তান আমলেও এ বিধির অস্তিত্ব দেখা যায়। ১৯৭৯ সালে প্রণীত বিধিতেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই বিধিতে বলা আছে, ১৯৬৪ সালে প্রণীত বিধি রদ করা হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। ১৯৬৬ সালেও পূর্ববর্তী বিধির সংশোধন করা হয়। ১৯৭৯-এর বিধি মূলত পূর্ববর্তী বিধিগুলোর ওপর ভিত্তি করেই প্রণীত হয়। এ বিধি যেকোনো কর্মরত অথবা দুটি ভোগকারী কর্মচারীর জন্য প্রযোজ্য। বিধিতে বহু ধরনের নিষেধ রয়েছে। এসব বিধিনিষেধ মূলত দুই ধরনের। এক. কিছু বিধিনিষেধ সরকারের পূর্বানুমোদনসাপেক্ষে প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের পূর্ব অনুমোদন নিয়ে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা বাধ্যতামূলক হবে না। দুই. কিছু বিধিনিষেধ অবশ্যই বাধ্যতামূলক। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ এ ধরনের একটি নিষেধাজ্ঞা, যা বাধ্যতামূলক।
১৫ নম্বর বিধিতে এর স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, যেকোনো সরকারি কর্মচারী লাভের উদ্দেশ্যে কোনো বিনিয়োগ করতে পারবে না। এ ধারায় সরকারের কোনো পূর্বানুমতির উল্লেখ নেই। বিধিতে এ ধরনের বিনিয়োগের সংজ্ঞাও রয়েছে। সংজ্ঞায় দেখা যায়, যেসব বিনিয়োগের মূল্যমান দারুণভাবে অস্থিতিশীল, তাতে কোনো বিনিয়োগই করা যাবে না। ইংরেজিতে �Securities� শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে যেকোনো সরকারি কর্মচারীর পরিবারের কোনো সদস্যও এ ধরনের বিনিয়োগ করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে আরো দুটি উপবিধির উল্লেখ করা যায়। এক. কোনো সরকারি কর্মচারী যদি পূর্বাহ্নেই জানতে পারে যে বিনিয়োগ করে সে লাভবান হবেই, সে ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ করতে পারবে না। দুই. কোন ধরনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা যাবে না সে বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে।
উপর্যুক্ত বিষয়টি অন্য একটি বিধির সঙ্গে যুক্ত। সংশ্লিষ্ট বিধিতে ধার দেওয়া বা ধার নেওয়া, দুটোই নিষিদ্ধ। শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় কেউ হয়তো লাভবান হওয়ার আশায় ক্রয়ের জন্য অর্থ ধার নিতে পারে অথবা কিছু লাভের আশায় অন্যকে ধার দিতে পারে। বলা বাহুল্য যে এ বিষয়টি নিষিদ্ধ করার কারণ এ ধরনের অভ্যাসের জন্য কোনো কর্মচারী যেন দেনাগ্রস্ত না হয়। অন্য একটি প্রাসঙ্গিক বিধি হলো, যেকোনো কর্মচারীর জীবনযাপনের মান তাঁর আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিধি রয়েছে। তা হলো, উপহার গ্রহণ করা। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক।
বিভিন্ন সময় আচরণবিধির পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৯৮৫ থেকে শুরু করে ২০০২ সাল পর্যন্ত। আগের এক আচরণবিধি অনুযায়ী ১০ হাজার টাকার উর্ধ্বে মূল্যসংক্রান্ত গহনার বিষয়ে সরকারকে অবহিত করার উল্লেখ ছিল। ডিসেম্বর ২০০২ সালে মূল্যের উচ্চসীমা করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া মহিলা সহকর্মীদের সঙ্গে মার্জিত আচরণ করার বিষয়ও সংশোধনীতে নতুনভাবে বিধিভুক্ত করা হয়েছে। অন্য একটি অন্যতম সংশোধনী হলো, Conflict of Interest--সংক্রান্ত। এ বিষয়টিই সরকারি কর্মচারীদের ওপর শেয়ারবাজারে লেনদেনসংক্রান্ত বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞার অন্যতম একটি কারণ। তবে এ ক্ষেত্রে বলা যায়, যেসব মন্ত্রণালয়ের বা দপ্তরের কর্মচারীদের পক্ষে কোন শেয়ারে বিনিয়োগ করলে লাভবান হওয়া যাবে এবং কোনটায় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে, তা অল্প কিছু মন্ত্রণালয় ব্যতীত অন্য কারো পূর্বাহ্নে জানার সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে যেকোনো আইন বা বিধি সবার জন্য প্রযোজ্য হওয়াই নিয়ম।
১৭ জানুয়ারি সংবাদে দেখা যায় যে অস্থিরতার জন্য শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এক. ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ লি. সরকারি কর্মচারীদের বিনিয়োগের সুযোগ দাবি করেছে। দুই. কালো টাকাসংক্রান্ত এনবিআরের প্রজ্ঞাপনও রদ করার দাবি করেছে। সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বলা সম্ভব যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের অধিকার ক্ষুণ্ন করার জন্য শেয়ারবাজারে কোনো প্রভাব থাকার কথা নয়। প্রায় ১০ লাখ সরকারি কর্মচারীর সিংহভাগই চতুর্থ, তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণীর। তাঁদের বিনিয়োগের জন্য সঞ্চয় না থাকাই স্বাভাবিক। প্রথম শ্রেণীর সিংহভাগই কনিষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁদের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য।
প্রকাশিত সংবাদে আচরণবিধির নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত কর্মচারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সংবাদও পাওয়া গেছে। তাঁদের সিংহভাগই নিষেধাজ্ঞার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। অন্যদিকে মধ্যম কাতারের কর্মচারীরা এর বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের যুক্তির ভিত্তি হলো, কিছু কর্মচারী প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা উঠিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। এতে দোষের কিছু নেই। এ ফান্ডের সুদের হার ১১ কি ১২ শতাংশ। অন্যদিকে কিছু শেয়ারের বার্ষিক মুনাফা প্রায় দ্বিগুণ। তবে এ মুনাফা যে প্রতিবছর একই বা তার অধিক হবে, এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। এ ছাড়া রয়েছে সঠিক শেয়ার কেনার প্রশ্ন। সার্বিকভাবে বলা যায় যে ধ্রুব সত্যটি হলো, শেয়ারবাজারে লেনদেন সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। যাদের অঢেল উদ্বৃত্ত টাকা রয়েছে, তারাই এ ঝুঁকি নিতে পারে। সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এ কথা বলা যাবে না।
বিনিয়োগের সপক্ষে আরো যুক্তি দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে যে সরকারি কর্মচারীরা এখন আয়কর দেয়। তাদের মোট আয়-ব্যয়সহ সম্পদের হিসাব আয়কর বিভাগকে দেওয়া হয়। এ কথা সত্যি হলেও বলা যায় যে আরোপযোগ্য আয়করের পরিমাণ হবে নগণ্য। আয়করসীমার মধ্যে নিম্ন বেতনের কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য না থাকাই স্বাভাবিক। অপেক্ষাকৃত উচ্চ বেতনক্রমের কর্মচারীদের জন্যও উদ্বৃত্ত আয় খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। এর সঙ্গে যোগ করা যায় আয়কর আইনের বিধান। এ বিধান অনুযায়ী মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশ বিনিয়োগযোগ্য। এর পরিমাণ কম হওয়ারই কথা। ১৮ জানুয়ারি এ-সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহে এক নাটকীয় পরিবর্তন দেখা দেয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সিকিউরিটি এঙ্চেঞ্জের চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের জানান যে প্রকাশিত সংবাদ সঠিক নয়। তিনি দাবি করেন, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত ওই বৈঠকে গ্রহণ করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে সরকার এ-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে। এ পদক্ষেপের কিছু পরেই আবার প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মিডিয়ার জন্য এটা ছিল একটি দারুণ খবর। যে কর্মচারীরা ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের জন্য এটা ছিল সুখবর। জানা যায়, সেনাবাহিনী ও পুলিশের কিছু সদস্য এ ধরনের বিনিয়োগ করেছিলেন। বিনিয়োগকৃত অর্থের উৎস জাতিসংঘের শান্তিমিশন-সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন। এ সত্ত্বেও বলা যায় যে নিষেধাজ্ঞার বিধান এখনো আচরণবিধিতে রয়েছে। ভবিষ্যতে সরকার হয়তো বাস্তবতার নিরিখে সংশ্লিষ্ট বিধানে কিছু পরিবর্তন আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
No comments