কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
আকাশের মেঘ কাটেনি। মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছে। ভাপসা গুমোট ভাবও রয়ে গেছে। এরই মধ্যে কোন ফাঁকে নিয়মমতো চলে এসেছে শরৎ। আকাশে নীলচে রং। পেঁজা তুলোর মতো ছেঁড়া ছেঁড়া নরম হালকা মেঘের ওড়াউড়িও চোখে পড়ছে। ঢাকার বাইরে হাইওয়ে, জলপথ আর রেলপথের দুই পাশে খোলা প্রান্তরে কাশের দুলুনিও দেখা যাচ্ছে।
বাংলার শরতের রূপ আগের মতো না থাকলেও এখনো যেটুকু পাওয়া যায়, তা পৃথিবীতে আর কোথায় পাব! বাংলার রূপকে পাশ কাটিয়ে পৃথিবীর রূপ খোঁজার প্রয়োজন নেই�কবি বলেছেন। তবু প্রাণ কাঁদে। বুকের ভার কাটে না। চারদিকের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কত আশঙ্কাই না মনে উৎকণ্ঠা বাড়ায়! মিশুক-তারেকদের জন্য শোক কাটে না। মিরসরাইয়ের মৃত কচি মুখগুলো চোখে ভাসে। বিরোধী দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা বছরের পর বছর সংসদ অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকেন এবং নষ্ট রাজনীতির পুরনো পচা আবর্জনা ঘেঁটে ঘেঁটে দেশময় দুর্গন্ধ ছড়ান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ক্রমেই বিলম্বিত হয়। রাজাকারের রাজা গোলাম আযম সহিসালামতে নিজ বাড়িতে আরামে সময় কাটায়। সরকারের মন্ত্রী নির্লজ্জভাবে দিনের পর দিন বেফাঁস ও অবান্তর কথাবার্তা বলে সাধারণ মানুষের মনে বিরক্তি তৈরি করেন। ব্যর্থতাকে বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে বড় গলায় অবজ্ঞার সুরে তাঁরা একই ভাঙা রেকর্ড বাজাতেই থাকেন। সরকারি দলের লেবেল আঁটা অঙ্গসংগঠনগুলো মাঝেমধ্যেই এমন কাণ্ড করে, যা হয়তো সরকারকে নাড়া দেয় না, কিন্তু যাঁরা ভোট দিয়ে সরকার তৈরি করেছেন, তাঁদের বিব্রত করে। প্রভাবশালী মন্ত্রীর মুখ থেকে যখন খোদ প্রধানমন্ত্রীর জীবনের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার বক্তব্য শুনি, তখন তো আতঙ্কিত হতেই হয়। আর বিরোধী দলহীন সংসদে প্রবীণ-নবীন দলীয় সদস্যদের উচ্চকণ্ঠে মন্ত্রীদের সমালোচনাকে যাঁরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি হিসেবে ধরে নিয়ে খুশিতে বগল বাজান, তাঁরা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার ব্যর্থ কসরত করেন। ব্যাপারটি যে দলের ভেতরকার সমস্যা�এটা ধারণা করতে রাজনীতির পাঠশালায় নিয়মিত ক্লাস করার দরকার হয় না। অপ্রাপ্তির হতাশা, গুরুত্বহীন স্বীকৃতি এবং অন্য আরো কিছু বিষয় যে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশের কারণ, তা বোধ হয় সচেতন মানুষমাত্রই বোঝেন। তবে প্রবীণ-নবীন রাজনীতিকদের বক্তব্যে কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের কথাই প্রকাশ পায়, এটা সত্য। মহাজোটের শরিক দুই নেতার নিরপেক্ষতা নিয়েও সংশয় জাগে বৈকি! তাঁদের জোরগলার কথাবার্তা আজকাল কেউ আর তত জোরে শুনতে পায় না। তা ছাড়া সাধারণ পাজামা-পাঞ্জাবির আড়ালে তাঁদের বৈষয়িক প্রাপ্তির হিসাব নিয়েও আজকাল কানাঘুষা হয়। কেউ কেউ তাঁদের পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী কর্মকাণ্ডের কথা প্রকাশ্যেই বলে ফেলেন, যা অমূলক ও অসত্য নয় বোধ হয়। সে জন্যই বলছিলাম, বাংলার আকাশে শরতের অপরূপ নীলের আভা দেখা দিলেও মনের আকাশের কালো মেঘের ছায়া সরেই না।
যাক, থাক না হয় এসব। আর দুই রাত পেরোলেই ঈদের প্রভাত। দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসবের আনন্দে মেতে উঠবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। রমজানের রোজার শেষে আসবে খুশির ঈদ। এরই মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেছে ঢাকা। নগরের অসংখ্য নাগরিক ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন নিজ নিজ গ্রামে, মফস্বল শহরগুলোতে। সঙ্গে নিয়েছেন দুর্মূল্যের বাজার থেকে কেনা প্রিয়জনের জন্য উপহারসামগ্রী। আর নিয়ে গেছেন নাগরিক সংস্কৃতির মেলা গল্প। সেখানে সত্য-মিথ্যার মিশেল আছে। আছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির গল্প। সেখানেও সত্য-মিথ্যার মিশেলে মনগড়া গল্প আছে। রাজধানীর নগরজীবন থেকে সদ্য আসা টাটকা মানুষগুলোর মুখ থেকে গল্প শুনে মুগ্ধ হবে পরিবার এবং আশপাশের দশজন। স্থানীয় রাজনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব এক-আধটু তো পড়বেই। তবে ঢাকার মানুষরা নিজ অঞ্চলে ছুটি কাটাতে গিয়ে যা করতে পারেন, তা কিন্তু খুব একটা করেন না। তাঁরা স্থানীয় কিশোর-তরুণদের মধ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় চেতনা প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিতে পারেন। এই কাজটি রাজনীতিকদের ঘাড়ে না চাপিয়ে সামাজিকভাবেই করা যেতে পারে। স্বল্পকালীন অনুশীলনে স্থানীয় পর্যায়ে নাটক-সংগীত-আবৃত্তি মিলিয়ে সুন্দর একটি অনুষ্ঠান সমাজে অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। হতে পারে হাডুডু কিংবা অন্য লোকজ খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। পুরস্কার হিসেবে ট্রফি দেওয়া যেতে পারে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় বীরদের নামে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ স্থানীয় বীরদের নামেও পুরস্কার ঘোষিত হতে পারে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতাও হতে পারে। নিজ গ্রাম, নিজের দেশ, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় বীর, মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ইত্যাদি নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজনই বা মন্দ কী! এই ধরনের কাজগুলো শিশু-কিশোর-তরুণদের মনে যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা সুস্থ জাতি গঠনে সহায়ক হবে। কাজটি খুব কঠিন নয়। রাজধানী থেকে ঈদের ছুটিতে যাঁরা নিজ শিকড়ে ফিরে যান, তাঁদের আগ্রহটাই এখানে বড় কথা। বিশেষ করে যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়�য়া, তাঁরা এ ব্যাপারে উদ্যোগী হলেই কাজটা হবে।
বর্ষীয়ান অভিভাবকদের মুখে শুনেছি অবিভক্ত বাংলার শরতের দীর্ঘ ছুটিতে কলকাতাকেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গীয় চাকরিজীবী, ছাত্র এবং অন্যান্য পেশার সুধীজনরা দেশের বাড়িতে অবসর কাটাতে এসে এই ধরনের কাজে সময় ও শ্রম দিতেন। যার প্রভাব পড়ত সমগ্র অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষের সমাজে। বিনোদনের মাধ্যমে তাঁরা লাভ করতেন সামাজিক শিক্ষা। মানবিক দর্শনে তাঁরা হয়ে উঠতেন স্বশিক্ষিত। আলোকিত হতো গোটা অঞ্চল।
আজকের পল্লীবাংলা সেকালের মতো সহজ-সরল চরিত্রের নেই, তা জানি। নানা জটিলতায় আজ পল্লীগ্রামের সামাজিক জীবনে সৃষ্টি হয়েছে নানামুখী সংকট, তাও জানি। কালো টাকা আর ধর্মীয় কুশিক্ষায় সহজিয়া গ্রামের মানুষকে বিভ্রান্ত করছে স্বার্থান্বেষী মহল। এসবের বিরুদ্ধে কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা এবং প্রথাগত পদক্ষেপ নিয়ে কাজ হবে না। গড়তে হবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এই কাজটি রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা খুব একটা সফল হবে না। এগিয়ে আসতে হবে তাঁদের, সমাজে যাঁদের ভাবমূর্তি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। ঈদের ছুটিতে রাজধানী থেকে নিজ অঞ্চলে ফিরে যাওয়া লেখাপড়া শেখা মানুষ যদি এবার থেকেই ওপরে আলোচিত কাজ শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তাহলে আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতে সুফল পাওয়াই যাবে।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
যাক, থাক না হয় এসব। আর দুই রাত পেরোলেই ঈদের প্রভাত। দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসবের আনন্দে মেতে উঠবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। রমজানের রোজার শেষে আসবে খুশির ঈদ। এরই মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেছে ঢাকা। নগরের অসংখ্য নাগরিক ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন নিজ নিজ গ্রামে, মফস্বল শহরগুলোতে। সঙ্গে নিয়েছেন দুর্মূল্যের বাজার থেকে কেনা প্রিয়জনের জন্য উপহারসামগ্রী। আর নিয়ে গেছেন নাগরিক সংস্কৃতির মেলা গল্প। সেখানে সত্য-মিথ্যার মিশেল আছে। আছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির গল্প। সেখানেও সত্য-মিথ্যার মিশেলে মনগড়া গল্প আছে। রাজধানীর নগরজীবন থেকে সদ্য আসা টাটকা মানুষগুলোর মুখ থেকে গল্প শুনে মুগ্ধ হবে পরিবার এবং আশপাশের দশজন। স্থানীয় রাজনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব এক-আধটু তো পড়বেই। তবে ঢাকার মানুষরা নিজ অঞ্চলে ছুটি কাটাতে গিয়ে যা করতে পারেন, তা কিন্তু খুব একটা করেন না। তাঁরা স্থানীয় কিশোর-তরুণদের মধ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় চেতনা প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিতে পারেন। এই কাজটি রাজনীতিকদের ঘাড়ে না চাপিয়ে সামাজিকভাবেই করা যেতে পারে। স্বল্পকালীন অনুশীলনে স্থানীয় পর্যায়ে নাটক-সংগীত-আবৃত্তি মিলিয়ে সুন্দর একটি অনুষ্ঠান সমাজে অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। হতে পারে হাডুডু কিংবা অন্য লোকজ খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। পুরস্কার হিসেবে ট্রফি দেওয়া যেতে পারে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় বীরদের নামে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ স্থানীয় বীরদের নামেও পুরস্কার ঘোষিত হতে পারে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতাও হতে পারে। নিজ গ্রাম, নিজের দেশ, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় বীর, মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ইত্যাদি নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজনই বা মন্দ কী! এই ধরনের কাজগুলো শিশু-কিশোর-তরুণদের মনে যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা সুস্থ জাতি গঠনে সহায়ক হবে। কাজটি খুব কঠিন নয়। রাজধানী থেকে ঈদের ছুটিতে যাঁরা নিজ শিকড়ে ফিরে যান, তাঁদের আগ্রহটাই এখানে বড় কথা। বিশেষ করে যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়�য়া, তাঁরা এ ব্যাপারে উদ্যোগী হলেই কাজটা হবে।
বর্ষীয়ান অভিভাবকদের মুখে শুনেছি অবিভক্ত বাংলার শরতের দীর্ঘ ছুটিতে কলকাতাকেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গীয় চাকরিজীবী, ছাত্র এবং অন্যান্য পেশার সুধীজনরা দেশের বাড়িতে অবসর কাটাতে এসে এই ধরনের কাজে সময় ও শ্রম দিতেন। যার প্রভাব পড়ত সমগ্র অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষের সমাজে। বিনোদনের মাধ্যমে তাঁরা লাভ করতেন সামাজিক শিক্ষা। মানবিক দর্শনে তাঁরা হয়ে উঠতেন স্বশিক্ষিত। আলোকিত হতো গোটা অঞ্চল।
আজকের পল্লীবাংলা সেকালের মতো সহজ-সরল চরিত্রের নেই, তা জানি। নানা জটিলতায় আজ পল্লীগ্রামের সামাজিক জীবনে সৃষ্টি হয়েছে নানামুখী সংকট, তাও জানি। কালো টাকা আর ধর্মীয় কুশিক্ষায় সহজিয়া গ্রামের মানুষকে বিভ্রান্ত করছে স্বার্থান্বেষী মহল। এসবের বিরুদ্ধে কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা এবং প্রথাগত পদক্ষেপ নিয়ে কাজ হবে না। গড়তে হবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এই কাজটি রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা খুব একটা সফল হবে না। এগিয়ে আসতে হবে তাঁদের, সমাজে যাঁদের ভাবমূর্তি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। ঈদের ছুটিতে রাজধানী থেকে নিজ অঞ্চলে ফিরে যাওয়া লেখাপড়া শেখা মানুষ যদি এবার থেকেই ওপরে আলোচিত কাজ শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তাহলে আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতে সুফল পাওয়াই যাবে।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments