বিশ্বের সর্বনিকৃষ্ট এক শেয়ারবাজারের উত্থান-পতন

টাইম সাময়িকীতে ২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত নিবন্ধের ঈষৎ সংক্ষেপিত বাংলা রূপান্তর করেছেন এ টি এম ইসহাকত
হাফিজুর রহমানের পরিবারের কেউই খুব বেশি প্রশ্ন করেননি, যখন তাঁরা দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে দেশে দুই-তিনবার টাকা পাঠিয়েছিলেন। হাফিজ সম্পর্কে তাঁর ভগ্নিপতি মির্জা গোলাম সবুর বলেন, ‘সে ছিল রাজপুত্রের মতো।


’ কিন্তু গত বছরের মে মাসে যখন তাঁর ৫৫ বছর বয়সী বোনজামাই (হাফিজ) হঠাৎ হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন, তখন সবুর সাহেব বেশ ব্যথিত হন। কারণ, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকে হাফিজুর রহমানকে আত্মীয়স্বজনদের পাঠানো অর্থের বেশির ভাগই তত দিনে খোয়া গেছে বাংলাদেশের অস্থির শেয়ারবাজারে। যে টাকা দিয়ে তাঁরা অবসরের পরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরনগর খুলনায় বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন, তা খোয়া গেল হাফিজুরের শেয়ার ব্যবসায়।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ২০১১ সালের গোড়ার দিকেই প্রধান মূল্যসূচক ৫৫ শতাংশ পড়ে যাওয়ায় এবং পতনের প্রবণতা অব্যাহত থাকায় পুঁজি খোয়ানো হাফিজুরের মর্মান্তিক মৃত্যুর মতো দেশজুড়ে এমন আরও কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। এ দেশের শেয়ারবাজারের ৫৮ বছরের ইতিহাসে উত্থান-পতনের অনেক ঘটনা ঘটলেও গত ১২ মাসে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী যে ব্যাপক লোকসান দিয়েছেন, তা দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নতুন সমস্যা তৈরির হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে দ্রুত বিকাশমান তৈরি পোশাকশিল্পের বড় অবদানের সুবাদে গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৫ সালে গোল্ডম্যান স্যাকস দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের (ব্রিক) পরে ‘নেক্সট ইলেভেন’ (এন-১১) জোটে বাংলাদেশকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল। ২০০৭ সালে আবার জেপি মর্গ্যান চেজও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিবেচনায় বাংলাদেশকে ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’ (এফ-৫) শীর্ষক তালিকায় স্থান দিয়েছিল। কিন্তু এ দেশের শেয়ারবাজারে যেভাবে নাটকীয় উত্থান ও আচমকা পতন দেখা গেছে, তা উদীয়মান বাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ভুলটা কোথায় ছিল? এ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে তৈরি পোশাকশিল্প যথেষ্ট অবদান রেখে চলেছে। এই খাতে ২৫ লাখ জনবল মেহনত করছেন, যাঁদের মাসিক মজুরি গড়ে ৪০ ডলার। আর এই মজুরি চীনের দক্ষিণাঞ্চলের পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের এক-তৃতীয়াংশ। স্বল্পব্যয়ের সুবিধা থাকাতেই বাংলাদেশ বিশ্ববাজারের অন্যতম পোশাক প্রস্তুতকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে পোশাক রপ্তানি খাতে যেখানে বাংলাদেশের আয় হতো ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের কম, তা ২০১১ সালে এসে কয়েক গুণ বেড়ে এক হাজার ৭৯০ কোটি ডলারে উঠেছে।
বাংলাদেশ থেকে পোলো শার্ট ও ব্লু জিনসের রপ্তানি বেশ বেড়েছে। বাংলাদেশের ৫০ লাখ মানুষ বিদেশে কাজ করছেন। তাঁদের অনেকেই নির্মাণশ্রমিক, নাবিক, রেস্তোরাঁ মালিক হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশে কর্মরত। গত বছর এসব প্রবাসী দেশে এক হাজার ২০০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন, যার বদৌলতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নগদ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ হাজার কোটি ডলার। সেই সঙ্গে পোশাক খাতের রপ্তানি আয় যোগ হওয়ায় দেশজুড়ে তিন ডজনেরও বেশি ব্যাংকে নগদ অর্থের বন্যা বয়ে যায়। এর অনেকগুলোই নতুন লাইসেন্স পেয়েছে এবং ক্ষুদ্র পরিসরে ও অপেশাদারি উপায়ে পরিচালিত হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় ও অধিকসংখ্যক ব্যাংক বাজারে প্রবেশ করায় আমানতকারীদের জন্য উচ্চহারে আয়ের চাপ বাড়ে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারের খেলোয়াড় হিসেবে অবতীর্ণ হয়। এ সময় বাজারে তাদের মোট দায়ের ১০ শতাংশ অর্থ শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দেয়। এটাকে আন্তর্জাতিক প্রথার তুলনায় কিছুটা শিথিল বলে মনে করেন ঢাকাভিত্তিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান এ টি ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা অংশীদার ইফতি ইসলাম।
এদিকে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে নামায় শেয়ারের দর আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। ২০১০ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক ৯০ শতাংশ বাড়ে। এভাবে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো মুনাফার সম্ভাবনায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরমভাবে বিনিয়োগের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। এমনকি শেয়ারবাজার সম্পর্কে যাঁদের কোনো জ্ঞান ছিল না তাঁরাও বিনিয়োগ বা লেনদেন করতে ছুটে আসেন। এ টি ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা অংশীদার ইফতি ইসলামের মতে, বাংলাদেশে ২০১০ সালে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের হিসাবসংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখে উন্নীত হয়, যা ২০০৭ সালে মাত্র লাখ পাঁচেকের মতো ছিল।
কিন্তু অবধারিতভাবেই ফুলে-ফেঁপে ওঠা শেয়ারবাজারের স্ফীতিতে ধস নামে। ২০১০ সালের শেষদিকে এসে বাংলাদেশের খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১১ শতাংশে ওঠে। এতে বিপদের আশঙ্কা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংকোচনমূলক নীতি নিতে থাকে, যার অংশ হিসেবে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। এর ফলে বছর খানেক ধরে, অর্থাৎ ২০১০ সালে, শেয়ারবাজারে যে উত্থান দেখা যায় তা দ্রুত পতনের পথে ধাবিত হয়। আর এখন তা দেশকে অধিকতর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের দিকে নিয়ে যাওয়ার হুমকি তৈরি করছে। ইউরোপে বাংলাদেশের পোশাকপণ্যের চাহিদা কমায় এবং বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের কর্মসংস্থানে ভাটা পড়ায় দেশের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার বিনিময়হারও গত দুই বছরে এক-পঞ্চমাংশ পড়ে গেছে এবং এখনো পড়ছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক এইচএসবিসি প্রাইভেট ব্যাংকের বিনিয়োগ কৌশলপ্রধান অর্জুনা মাহেন্দ্র বলেন, ‘ভালো হওয়ার চেয়ে পরিস্থিতি খারাপই হচ্ছে।’
উদ্বেগের বিষয় হলো, বর্তমানে খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বাড়ছে। এক বছর ধরে বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা নিয়মিত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে জড়ো হয়ে টায়ার পুড়িয়ে ও বিক্ষোভ-সমাবেশ করে তাঁদের হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আসছেন। তাঁরা মনে করেন, শেয়ারবাজারের ফাটকাবাজি বন্ধ করা ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। গত বছরের এপ্রিলে খ্যাতিমান ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই কমিটির দাখিল করা প্রতিবেদনে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে ধস নামার আগে শেয়ারবাজারে ব্যাপকভাবে কারসাজি হয় বলে অভিযোগ তোলা হয়। শেয়ারবাজারের এই পরিস্থিতি আগামী ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের আগে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।
বেসরকারি তহবিল নিয়ে কাজ করা ব্রুমার অ্যান্ড পার্টনারস বাংলাদেশের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা কিরন বসু বলেন, কয়েক দশক ধরে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা শুধু শেয়ারবাজারের কারণে আটকে যেতে পারে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে বরাবরই পুঁজি বা মূলধন আহরণের জন্য শেয়ারবাজার প্রধান উৎস নয়। বিশ্লেষকদের মতে, দুই অঙ্কের সুদহারে হলেও দেশের কোম্পানি ও ব্যক্তি পর্যায়ে ঋণ প্রদান অব্যাহত রাখার মতো সচ্ছলতা বা সক্ষমতা বড় ব্যাংকগুলোর রয়েছে। এ টি ক্যাপিটালের ইফতি ইসলাম বলেন, ‘আমি এখনো দীর্ঘমেয়াদে এ দেশের সাফল্যে বিশ্বাস করি।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেনজির একটি প্রতিবেদনের উদাহরণ টেনে জানান, বাংলাদেশ যদি সড়ক ও বন্দরের উন্নয়ন ঘটাতে পারে এবং চীনের উৎপাদনব্যয় বৃদ্ধি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এ দেশের পোশাক খাতের রপ্তানি আগামী এক দশকে এখনকার দ্বিগুণ হয়ে চার হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তবে সবুরের ওই প্রয়াত ভগ্নিপতির মতো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অস্থিতিশীল শেয়ারবাজারে গিয়ে ভাগ্য গড়ার ঝুঁকি নেওয়াটা ছিল ভয়াবহ এক অগ্নিপরীক্ষার শামিল।

No comments

Powered by Blogger.