শেয়ারবাজারের অল্প স্বল্প গল্প-প্রলোভনের নাম পুঞ্জি স্কিম by শওকত হোসেন
নামটা অনেক বড়—কারলো পিয়েত্রো জিওভানি গুজলিয়েলমো টেবালদো পুঞ্জি। নামই বলে দিচ্ছে মানুষটি ইতালির। তাঁর একটা ছোট নামও আছে, আর সেই নামেই তিনি বিখ্যাত বা কুখ্যাত। চার্লস পুঞ্জির অবশ্য কয়েকটি ছদ্মনামও ছিল, যেমন—চার্লস পোনেই, চার্লস পি বিয়াঞ্চি, কার্ল এবং কার্লো। চার্লস পুুঞ্জিকে বলা হয় ‘ফিন্যান্সিয়াল জিনিয়াস’।
চার্লস পুঞ্জির জন্ম ১৮৮২ সালের ৩ মার্চ, ইতালির লুগোতে। তাঁর পরিবার নিয়ে খুব সুনির্দিষ্ট কিছু জানা যায় না। তবে তিনি নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পার্মার এক সচ্ছল পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর প্রথম চাকরি ছিল ডাক বিভাগের একজন কর্মী হিসেবে। পরে তিনি লেখাপড়া করতে চলে যান ইউনিভার্সিটি অব রোম লা সাপিয়েঞ্জায়।
চার্লস পুঞ্জি ১৯০৩ সালের ১৫ নভেম্বর এস এস ভাঙ্কুভার জাহাজে চড়ে বোস্টনে যেদিন নামলেন, তখন তাঁর পকেটে ছিল মাত্র আড়াই ডলার। বাকি অর্থ জাহাজে আসার সময় জুয়ায় খুইয়েছিলেন। বোস্টনে এসেই পুঞ্জি দ্রুত ইংরেজি শিখে ফেলেন। এ ছাড়া বাসন ধোয়ার কাজ নিয়েছিলেন রেস্তোরাঁয়। ঘুমাতেন রেস্তোরাঁর মেঝেতে। পরে তিনি ওয়েটারের পদ পান। তবে এই চাকরি চলে যায় চুরির দায়ে।
যুক্তরাষ্ট্রে সুবিধা করতে না পেরে চার্লস পুঞ্জি চলে যান কানাডার মন্ট্রিয়ালে। ১৯০৭ সালে তিনি সেখানে নতুন ব্যাংক বানকো জারোসিতে সহকারী টেলার হিসেবে যোগ দেন। জারোসি ব্যাংক আমানতে ৬ শতাংশ সুদ দিত, যা সে সময়ের অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ। এর ফলে ব্যাংকটির দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে। পুঞ্জিও দ্রুত ব্যাংকের ম্যানেজার হন। তবে শিগগির তিনি বুঝতে পারেন, ব্যাংকটি গভীর আর্থিক সংকটে পড়তে যাচ্ছে। কেননা, ব্যাংকটি আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ করছে বিনিয়োগ থেকে পাওয়া মুনাফা থেকে নয়, বরং নতুন খোলা আমানত থেকে। ব্যাংকটি একসময় দেউলিয়া হয়।
পুঞ্জি তখন আবারও কপর্দকশূন্য। একদিন তিনি চলে গেলেন জারোসি ব্যাংকের সাবেক গ্রাহক কানাডিয়ান ওয়্যারহাউসের অফিসে। অফিস ছিল শূন্য। তিনি সেখানে একটি চেকবই খুঁজে পেয়ে তাতে নিজের নামে ৪২৩ ডলার লেখেন এবং কোম্পানির পরিচালক ডেমিয়েন ফোরনিয়েরের সই জাল করেন। তবে খরচের বহর দেখে চার্লস পুঞ্জি পুলিশের কাছে ধরা পড়লে তিন বছর জেল হয়। মাকে তখন চার্লস পুঞ্জি চিঠি লিখে জানান, জেলে তাঁর একটি নতুন চাকরি হয়েছে।
১৯১১ সালে চার্লস পুঞ্জি আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে অবৈধ ইতালিয়ানদের সীমান্ত পার করার কাজ শুরু করেন। এ কাজ করতে গিয়ে আবার ধরা পড়েন এবং আটলান্টা জেলে দুই বছর এক মাস কাটান। এর পরই আর্থিক খাতে নতুন ইতিহাসের জন্ম দেন তিনি। পুঞ্জি একদিন স্পেন থেকে পাওয়া একটি চিঠি থেকে জানতে পারেন আন্তর্জাতিক রিপ্লাই কুপনের (আইআরসি) কথা। এখান থেকে তিনি আয়ের নতুন পথও বের করেন।
আইআরসি হলো এমন একটি কুপন, যা একটি দেশ থেকে কিনে অন্য দেশে আরেকজনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। ওই ব্যক্তি আবার তা ডাকমাশুল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। এই কুপন সংশ্লিষ্ট দেশের স্ট্যাম্পের সঙ্গে বিনিময় করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ইতালিতে ডলারের বিপরীতে ডাকমাশুলের হার কমে গিয়েছিল। এ কারণে সে সময় ইতালিতে সস্তায় কিনে তা বেশি দামে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করা যেত। পুঞ্জির হিসাবে এতে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করা সম্ভব। আর এই সুযোগটাই নিয়েছিলেন তিনি। এটি এমন এক পদ্ধতি, যা এক বাজার থেকে কিনে অন্য বাজারে বেশি দরে বিক্রি করা যায়।
দ্রুত এই ব্যবসা শুরু করেন চার্লস পুঞ্জি। তিনি অর্থ ধার করে ইতালিতে তাঁর আত্মীয়দের পাঠান। তাঁরা কুপন কিনে পাঠিয়ে দিতেন পুঞ্জিকে। এরপর পুঞ্জি এই ব্যবসা বাড়াতে থাকেন। ঘোষণা দেন, কেউ তাঁর ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে ৯০ দিনের মধ্যে মূলধন দ্বিগুণ হারে ফেরত দেওয়া হবে। এই ব্যবসায় বোস্টনের মানুষেরা আকৃষ্ট হয়। এ পর্যায়ে পুঞ্জি ‘সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কোম্পানি’ নামে নিজের একটি কোম্পানিও খুলে ফেলেন। তিনি অসংখ্য এজেন্ট নিয়োগ দেন। এজেন্টরা বিনিয়োগ আনতে পারলে প্রতি ডলারে আকর্ষণীয় কমিশন পেতেন। এরপর তিনি এই ব্যবসা আরও অনেক জায়গায় ছড়িয়ে দেন। তিনি হ্যানোভার ব্যাংকের শেয়ার কেনেন। এ সময় মানুষজন সর্বস্ব বিনিয়োগ করেন এবং মুনাফা না তুলে পুনর্বিনিয়োগও করেন।
পুঞ্জির এই ব্যবসা আসলে লাভজনক ছিল না। যেহেতু অর্থ আসছিল, তাই অনেকেই অর্থ ফেরত পাচ্ছিলেন। আর এসব অর্থ তুলে গাড়ি-বাড়ি কিনে রাজার হালে দিন কাটাচ্ছিলেন চার্লস পুঞ্জি। তবে কিছু মানুষের মধ্যে সন্দেহও ঢুকে পড়ে। কিছু মানুষ টাকা তুলেও নেন। তবে এ সময় বোস্টন পোস্ট পত্রিকা পুঞ্জির পক্ষে একটি লেখা ছাপালে নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। আর সর্বনাশটি করেছিল ওই বোস্টন পোস্ট পত্রিকাই। পত্রিকা পুঞ্জির ব্যবসা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সংবাদ প্রকাশ করতে শুরু করে। ক্লারেন্স ব্যারোন নামের একজন আর্থিক বিশ্লেষক প্রকাশ করে দেন, নিজের কোম্পানিতেই চার্লস পুঞ্জি বিনিয়োগ করছেন না। সরকারও তদন্ত শুরু করে। পুঞ্জি এ সময় উইলিয়াম ম্যাকমাস্টার নামে একজন পাবলিসিটি এজেন্ট নিয়োগ দেন। মজার ব্যাপার হলো, এই এজেন্টও পুঞ্জির ব্যবসা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা শুরু করেন। তিনি উল্টো বোস্টন পোস্ট পত্রিকায় এই ব্যবসা নিয়ে সিরিজ রিপোর্ট লেখা শুরু করেন। এবার শুরু হয় পুঞ্জির ব্যবসায় ধস। চার্লস পুঞ্জি গ্রেপ্তার এড়াতে এবার নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দেন। এ ঘটনায় হ্যানোভারসহ আরও পাঁচটি ব্যাংক বন্ধ হয়। বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি ছিল দুই কোটি ডলার, যা এখনকার হিসাবে সাড়ে ২২ কোটি ডলার। তবে লাভ হয়েছিল বোস্টন পোস্ট-এর, তারা ১৯২১ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পায়।
কয়েক দফা জেল খেটে চার্লস পুঞ্জি মুক্তি পান ১৯৩৪ সালে। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইতালিতে। সেখানেও নানাভাবে ব্যবসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে চাকরি নিয়ে চলে যান ব্রাজিলে। এখানে বসেই তিনি একটি আত্মজীবনী লেখেন। শেষ জীবনটি তাঁর ভালো যায়নি। দারিদ্র্য তো ছিলই, একসময় অন্ধও হয়ে যান। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে ১৯৪৯ সালের ১৮ জানুয়ারি মারা যান।
চার্লস পুঞ্জি এখন ইতিহাসের অংশ। বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে ভুয়া যেকোনো ব্যবসাকেই এখন বলা হয় ‘পুঞ্জি স্কিম’। যেমন বাংলাদেশে যুবক বা আইটিসিএল। এমএলএম ব্যবসাও আদতে তা-ই। পুঞ্জি স্কিম আছে শেয়ারবাজারেও। আবার চার্লস পুঞ্জির মতো বিপথে যাওয়া ‘ফিন্যান্সিয়াল জিনিয়াস’ও আছে বাংলাদেশে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের সাম্প্রতিক তদন্ত প্রতিবেদনেও পাওয়া যায় এ রকম দু-একজন ‘ফিনান্সিয়্যাল জিনিয়াস’-এর কথা। একসময় একের পর এক কোম্পানি খুলে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার বুদ্ধি এসেছিল এ ধরনের ‘জিনিয়াসের’ কাছ থেকেই। আবার সেই সব ছোট কোম্পানিকে একীভূত করে শেয়ারের দাম বাড়ানোর বুদ্ধিও এসেছিল একই মাথা থেকে।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারও আসলে হয়ে গেছে একধরনের পুঞ্জি স্কিম। আর এর দায় বেশি সরকারের। সরকারই নানা প্রলোভন দেখিয়ে অসংখ্য বিনিয়োগকারীকে টেনে এনেছে শেয়ারবাজারে। এর সঙ্গে ছিলেন দুই স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকার আর তালিকাভুক্ত কোম্পানির মালিকেরা। মজার ব্যাপার হলো, চার্লস পুঞ্জির কোম্পানির নাম ছিল ‘সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কোম্পানি’। এর সঙ্গে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) কোনো সম্পর্ক না থাকলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঞ্জি স্কিম থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব মূলত তারই।
No comments