চরাচর- আলতাফ মাহমুদ : চিরঋণী তাঁর কাছে by তামান্না ইসলাম অলি
১৯৭১ সাল। ৩০ আগস্ট। ভোরবেলা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের উল্টোদিকের একটি বাড়ি। ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোড। পাকিস্তানি বাহিনী ঘিরে রেখেছে বাড়িটি। দলনেতা বাসার ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, 'আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়?' আলতাফ মাহমুদ বাসায়ই ছিলেন। সামনে এসে নির্ভয়ে বললেন, 'আমি।'
এই বাসাটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানা। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে নিয়ে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদ ও অস্ত্রের দুটি বড় বাঙ্ উদ্ধার করল। ধরে নিয়ে গেল আলতাফ মাহমুদকে। যাওয়ার সময় হাতের আংটিটি তাঁর শ্যালককে দিয়ে বললেন, 'এটা ঝিনু ও শাওনকে দিয়ো। ওদের জন্য তো কিছু রেখে যেতে পারলাম না। দেশের মানুষ আছে ওদের জন্য।' এই শেষ কথা। এরপর আলতাফ মাহমুদের কথা আর কোনো বাঙালি শোনেনি। তিনি নিখোঁজ হলেন চিরদিনের মতো। আলতাফ মাহমুদ। একজন সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও ভাষাসৈনিক। আলতাফ মাহমুদ ১৯৩৩ সালে বরিশালের মুলাদী উপজেলার পাতারচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মা-বাবা নাম রেখেছিলেন এ এন এম আলতাফ আলী। ডাকনাম ঝিলু। বাবা নাজেম আলী হাওলাদার ও মা কদ বানুর একমাত্র ছেলে আলতাফ। বাবা ছিলেন আদালতের পেশকার এবং পরবর্তী সময়ে জেলা বোর্ডের সেক্রেটারি। বাবার খুব ইচ্ছা ছিল, ছেলে হবে জেলা বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু ছেলে মনে মনে সারাক্ষণই খেলত সুর নিয়ে। আলতাফ মাহমুদ তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়েন। একদিন কাঁঠালগাছ খোদাই করে লিখলেন, 'ঝিলু দি গ্রেট।' আজ বাংলাদেশের কোটি মানুষ এক বাক্যে স্বীকার করবে, 'আলতাফ মাহমুদ দি গ্রেট'। একবার বরিশালে এক জনসভায় 'ম্যায় ভুখাহু' গানটি গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। ১৯৪৮ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ভর্তি হন বি এম কলেজে। এখানে পড়া শেষ না করেই ভর্তি হন কলকাতার আর্ট স্কুলে। এ সময় তিনি বিখ্যাত বেহালা বাদক সুরেন রায়ের কাছে শেখেন পদ্ধতিগত সুরের চর্চা। ১৯৫০ সালে আসেন ঢাকায়। যোগ দেন 'ধূমকেতু শিল্পী সংঘে'। ১৯৫০ সাল থেকেই তিনি ভাষার জন্য গণসংগীত গাইতেন। ১৯৫২ সালে যোগ দেন ভাষা আন্দোলনে। ১৯৫৪ সালে 'ভিয়েনা শান্তি সম্মেলনে' আমন্ত্রিত হন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার করাচিতে তাঁর পাসপোর্ট আটকে দেয়। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচিতেই ছিলেন। এ সময় তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতের পাঠ নেন ওস্তাদ আবদুল কাদের খাঁর কাছে। করাচিতে বসবাসরত বাংলাদেশি শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তোলেন ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসোসিয়েশন' ও করাচির 'নজরুল একাডেমী।' ১৯৬৬ সালের মধ্যেই সংগীত জগতে বড় একটা জায়গা করে নেন আলতাফ মাহমুদ। প্রতিষ্ঠা পান কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক হিসেবে। ঢাকায় ফিরে কাজ শুরু করেন চলচ্চিত্রে। একে একে ২৬টি চলচ্চিত্রে সুরকার অথবা সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এর মধ্যে 'জীবন থেকে নেয়া', 'ক্যায়ামে কহু', 'কার বউতানহা' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৬ সালে বিলাহ পরিবারের সারা আরা বিনুকে বিয়ে করেন তিনি। তাঁদের একমাত্র সন্তান শাওন মাহমুদ। ১৯৬৭ সালে পল্টনে 'জ্বলছে আগুন ক্ষেত খামারে' শীর্ষক গীতিনাট্যের আয়োজন করেন তিনি। এই গীতিনাট্য লাখ লাখ মানুষকে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনে বেগবান করেছিল। ১৯৭১-এ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। তাঁর বাসায় বানিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানা। আর এই অপরাধেই ১৯৭১-এর ৩০ আগস্ট তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। আজও কেউ জানে না কী নির্মমতা ঘটেছিল তাঁর ভাগ্যে। আমরা বাঙালিরা চিরঋণী আলতাফ মাহমুদের কাছে। দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ ও মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে দেওয়া হয় স্বাধীনতা পুরস্কার। কোটি ভক্তের ভালোবাসায় বেঁচে আছেন তিনি। 'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?' এ গানের সুরস্রষ্টা তিনি। তাঁর অমর এই সৃষ্টির মতো তাঁকেও আমরা কখনো ভুলব না।
-তামান্না ইসলাম অলি
No comments