সংবাদ বিশ্লেষণঃ বিচারক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন by মিজানুর রহমান খান
হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক বাছাই ও নিয়োগে আবারও সুপ্রিম কোর্টের নীতিমালা লঙ্ঘিত হয়েছে। আদালতে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জযোগ্য। এ ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার চেয়ে স্বজনপ্রীতি ও বিচারবহির্ভূত চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। নতুন নিয়োগ হওয়াদের মধ্যে এমন একজন আছেন, যিনি গতবছর এ মাসেই দেড় শতাধিক বিচারককে ডিঙিয়ে ঢাকার জেলা জজ হন। এ নিয়ে সংসদীয় কমিটির সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল। সে বিষয়টি অনিষ্পন্ন থাকতে একই ব্যক্তিকে হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগ করা হলো।
এ ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মন্তব্য চাইলে তিনি বলেন, ‘মন্তব্য নেই।’ দুই দফায় নিয়োগ পাওয়া ১০ জন গতকাল বৃহস্পতিবার শপথ নেন। বুধবার নিয়োগ পান আইনজীবী এ কে এম শহীদুল হক ও আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান এবং আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব সহিদুল করিম ও ঢাকার জেলা জজ মো. জাহাংগীর হোসেন। ৪ অক্টোবর নিয়োগ পান ছয় আইনজীবী। এ নিয়ে হাইকোর্টের বিচারক সংখ্যা দাঁড়াল ৯৮।
হাইকোর্টে কতজন বিচারক থাকবেন, তা সুনির্দিষ্ট করে কোনো আইন নেই। মামলাজটের কথা বলে বিচারকের সংখ্যা বাড়ালেও মামলা কমে না। বছরে গড়ে ৫০ হাজার মামলা হয়। কিন্তু অর্ধেকের বেশি অনিষ্পন্ন থাকে। ২০০৯ সালে ৭৮ জন বিচারক গড়ে মাথাপিছু মাত্র ২৭৫টি মামলা নিষ্পত্তি করেন। অথচ ১৯৯৬-২০০০ পর্বেও এক বিচারক গড়ে ৩২৯টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন।
সরকারি দল স্পষ্টতই সংখ্যা বাড়িয়ে বিএনপিপন্থী বিচারকদের সংখ্যালঘু করতে চায়। তাই আরও বিচারক নিয়োগ দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগের এ আমলে গতকাল পর্যন্ত ৫২ জন নিয়োগ পেয়েছেন।
এর আগে ছয় আইনজীবীকে বিচারক নিয়োগের ঘোষণার পর সরকার-সমর্থক আইনজীবীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। আমীর-উল ইসলাম, আবদুল মতিন খসরু প্রমুখ আইনজীবী ছয়জনের নিয়োগ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়নি বলে অভিযোগ করেছিলেন।
তখন প্রথমবারের মতো জেলা জজ পুরোপুরি বাদ দিয়ে শুধু আইনজীবীদের নেওয়া হচ্ছিল। এ নিয়ে নিম্ন আদালতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে জেলা জজ অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু দুই জেলা জজের মধ্যে বিচারক সহিদুল করিম জেলা জজ পদে ১১ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। জাহাঙ্গীর বাদল মাত্র এক বছরের। ২০০১ সালে তৈরি সর্বশেষ প্রকাশিত জ্যেষ্ঠতা তালিকামতে জনাব করিমের ক্রমিক ১০০। তিনি ১৯৮৩-এর ব্যাচের মেধাতালিকায় দ্বিতীয়। যদিও তার আগে দুটি ব্যাচের প্রায় ১০ জন জ্যেষ্ঠ জেলা জজ বর্তমানে কর্মরত আছেন। এমনকি জ্যেষ্ঠতম জজ আবদুল গফুরকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন বিচারক পদের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু তা ক্রমাগতভাবে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। তবু জনাব করিমের নিয়োগ গ্রহণযোগ্য। কিন্তু জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ১৯৮৪-এর ব্যাচের জাহাংগীর হোসেন সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছেন। ওই জ্যেষ্ঠতা তালিকায় তাঁর ক্রমিক ৩৩২। ১৯৮৪-এর মেধাতালিকায় তাঁর অবস্থান ৫৯। অধস্তন আদালতে বলাবলি হচ্ছে, এভাবেই যদি বাছাই হবে তাহলে জেলা জজ কোটা বাদ থাকাই তো উত্তম ছিল! কারণ, এ ঘটনা তাঁদের মনোবলে প্রলয় নয়, সুনামি নামাবে। নবীন বিচারকেরা উৎকৃষ্ট রায় লেখার পরিবর্তে তদবিরে মনোযোগী হবেন। এটা তদবিরবাজির এক ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত।
জ্যেষ্ঠতাই পদোন্নতির মাপকাঠি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু এর উত্তর মিলছে না যে, প্রধান বিচারপতি তাহলে বাছাই সূচকের কোন মানদণ্ডে প্রায় দেড় শ জেলা জজের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিলেন! অন্তত ১০ বছরের জেলা জজগিরি করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রায় অর্ধশত জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে ডিঙিয়ে শুধু এক বছরের জেলা জজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিচারক বনে গেলেন জাহাংগীর হোসেন? এক বছরের ব্যবধানে তাঁর দুই রেকর্ড। জ্যেষ্ঠ প্রায় দেড় শ জেলা জজকে ডিঙিয়ে গত অক্টোবরে তাঁকে ঢাকার জেলা জজ করা হলে বিচার বিভাগে হতাশা নেমে আসে।
১৯৭২-এর মূল সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ গত ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে পুনর্মুদ্রিত হয়। এতে ৯৫ অনুচ্ছেদের ২ দফার খ উপ-অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ‘কমপক্ষে তিন বছর জেলা বিচারকের ক্ষমতা নির্বাহ না করে থাকলে কেউ হাইকোর্টে বিচারক পদে নিয়োগ লাভে যোগ্য হবেন না।’ ওই শর্তটি পঞ্চদশ সংশোধনীতে রহস্যজনকভাবে বাদ পড়ে।
২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের তৈরি করা নীতিমালার শর্ত হচ্ছে, বিচারক বাছাই-প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ। প্রধান বিচারপতি নিজে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন না। তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ সহকর্মী ও বারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলবেন। আর এসবের মাধ্যমে কী করে একজনকে সর্বাপেক্ষা যোগ্য বিবেচনায় বেছে নেওয়া হলো, তার বিবরণ লিখে সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু এই শর্ত পূরণ হয়নি। যদিও ১৫তম সংশোধনীতে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে নির্দিষ্টভাবে শুধু প্রধান বিচারপতির পরামর্শের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে প্রধান বিচারপতির অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে প্রধান বিচারপতির একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সৃষ্টি হয়নি। ১১ অক্টোবর চলতি নিয়োগ নিয়ে সরকারি দল-সমর্থক আইনজীবীদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটেনি।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সর্বশেষ নিয়োগ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে তিনি গতকাল এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি কী করে তাঁর মতামত তৈরি করবেন, সে বিষয়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় আছে। সেখানে বাছাই থেকে নিয়োগ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ধাপ আছে। প্রতিটি ধাপে লিখিত শর্ত আছে। স্বচ্ছতার সঙ্গে এসব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পাঠান।’
নীতিমালায় বিচারক নিয়োগ ও বিচারক বাছাই-প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা হয়, বিচারক বাছাইয়ে প্রার্থীর আইনগত সূক্ষ্ম বিচারশক্তির বিষয়ে তথ্য দেবেন প্রধান বিচারপতি এবং সেটাই প্রাধান্য পাবে। ‘সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে’ খুঁজে বের করতে হবে। প্রক্রিয়াটি হতে হবে স্বচ্ছ। বিচারক বাছাই থেকে নিয়োগ-সংক্রান্ত পুরো প্রক্রিয়া হতে হবে লিখিত। কিন্তু বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় বাছাই ও নিয়োগ ঘটেছে, তাতে এর ব্যত্যয় ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নীতিমালায় বলা আছে, কাগজে-কলমে আইনজীবী হিসেবে ১০ বছর নাম লিখিয়ে রাখলেই ‘সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট’ হওয়া যাবে না। গতকাল শপথ গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্তত দুজনের পেশায় সক্রিয়তা ১০ বছরের অনেক কম। তাঁদের একজন ছাত্র ইউনিয়ন করার সুবাদে আইনমন্ত্রীর এবং অন্যজন আওয়ামী লীগের সাংসদ ফজলে রাব্বীর জামাতা হিসেবে আনুকূল্য পান বলে মনে করা হয়। নীতিমালা বলছে, খাতায় নাম লেখালেই হবে না। দেখতে হবে ১০ বছর প্রকৃতপক্ষে তিনি কী করেছেন। আর জেলা জজের ক্ষেত্রে দেখতে হবে, তিনি কোনো নির্বাহী পদে প্রেষণে কতটা সময় কাটিয়েছেন।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক নিয়োগ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ওই নীতিমালা আদৌ পড়ে দেখেছেন কি না সে বিষয়ে গতকাল প্রতিবেদকের কাছে সংশয় প্রকাশ করেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু সম্প্রতি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘যার এলডি ক্লার্ক হওয়ার যোগ্যতা নেই, তাকেও বিচারক করা হচ্ছে।’ জানা যায়, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের শ্যালক অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড এ কে এম শহিদুল হকের দিকে ইঙ্গিত করেই ওই মন্তব্য করা হয়েছিল।
খায়রুল হক যাঁদের নাম সুপারিশ করেছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে চারজনকে অজ্ঞাত কারণে বিচারক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সার্বিকভাবে তাই বলা চলে, বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়াটি আগের মতোই অস্বচ্ছ রয়ে গেছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা একমত যে অস্বচ্ছতা মানেই বেআইনি।
এ বিষয়ে ১১ অক্টোবর সমন্বয় পরিষদের বৈঠকে প্রতিবাদ করা হয়। এর আগের দিন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আমীর-উল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করে। তাঁরা তাঁকে বলেন, সততা, যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রশ্নে কোনো আপস করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে উল্টোটা ঘটছে।
হাইকোর্টে কতজন বিচারক থাকবেন, তা সুনির্দিষ্ট করে কোনো আইন নেই। মামলাজটের কথা বলে বিচারকের সংখ্যা বাড়ালেও মামলা কমে না। বছরে গড়ে ৫০ হাজার মামলা হয়। কিন্তু অর্ধেকের বেশি অনিষ্পন্ন থাকে। ২০০৯ সালে ৭৮ জন বিচারক গড়ে মাথাপিছু মাত্র ২৭৫টি মামলা নিষ্পত্তি করেন। অথচ ১৯৯৬-২০০০ পর্বেও এক বিচারক গড়ে ৩২৯টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন।
সরকারি দল স্পষ্টতই সংখ্যা বাড়িয়ে বিএনপিপন্থী বিচারকদের সংখ্যালঘু করতে চায়। তাই আরও বিচারক নিয়োগ দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগের এ আমলে গতকাল পর্যন্ত ৫২ জন নিয়োগ পেয়েছেন।
এর আগে ছয় আইনজীবীকে বিচারক নিয়োগের ঘোষণার পর সরকার-সমর্থক আইনজীবীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। আমীর-উল ইসলাম, আবদুল মতিন খসরু প্রমুখ আইনজীবী ছয়জনের নিয়োগ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়নি বলে অভিযোগ করেছিলেন।
তখন প্রথমবারের মতো জেলা জজ পুরোপুরি বাদ দিয়ে শুধু আইনজীবীদের নেওয়া হচ্ছিল। এ নিয়ে নিম্ন আদালতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে জেলা জজ অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু দুই জেলা জজের মধ্যে বিচারক সহিদুল করিম জেলা জজ পদে ১১ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। জাহাঙ্গীর বাদল মাত্র এক বছরের। ২০০১ সালে তৈরি সর্বশেষ প্রকাশিত জ্যেষ্ঠতা তালিকামতে জনাব করিমের ক্রমিক ১০০। তিনি ১৯৮৩-এর ব্যাচের মেধাতালিকায় দ্বিতীয়। যদিও তার আগে দুটি ব্যাচের প্রায় ১০ জন জ্যেষ্ঠ জেলা জজ বর্তমানে কর্মরত আছেন। এমনকি জ্যেষ্ঠতম জজ আবদুল গফুরকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন বিচারক পদের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু তা ক্রমাগতভাবে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। তবু জনাব করিমের নিয়োগ গ্রহণযোগ্য। কিন্তু জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ১৯৮৪-এর ব্যাচের জাহাংগীর হোসেন সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছেন। ওই জ্যেষ্ঠতা তালিকায় তাঁর ক্রমিক ৩৩২। ১৯৮৪-এর মেধাতালিকায় তাঁর অবস্থান ৫৯। অধস্তন আদালতে বলাবলি হচ্ছে, এভাবেই যদি বাছাই হবে তাহলে জেলা জজ কোটা বাদ থাকাই তো উত্তম ছিল! কারণ, এ ঘটনা তাঁদের মনোবলে প্রলয় নয়, সুনামি নামাবে। নবীন বিচারকেরা উৎকৃষ্ট রায় লেখার পরিবর্তে তদবিরে মনোযোগী হবেন। এটা তদবিরবাজির এক ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত।
জ্যেষ্ঠতাই পদোন্নতির মাপকাঠি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু এর উত্তর মিলছে না যে, প্রধান বিচারপতি তাহলে বাছাই সূচকের কোন মানদণ্ডে প্রায় দেড় শ জেলা জজের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিলেন! অন্তত ১০ বছরের জেলা জজগিরি করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রায় অর্ধশত জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে ডিঙিয়ে শুধু এক বছরের জেলা জজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিচারক বনে গেলেন জাহাংগীর হোসেন? এক বছরের ব্যবধানে তাঁর দুই রেকর্ড। জ্যেষ্ঠ প্রায় দেড় শ জেলা জজকে ডিঙিয়ে গত অক্টোবরে তাঁকে ঢাকার জেলা জজ করা হলে বিচার বিভাগে হতাশা নেমে আসে।
১৯৭২-এর মূল সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ গত ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে পুনর্মুদ্রিত হয়। এতে ৯৫ অনুচ্ছেদের ২ দফার খ উপ-অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ‘কমপক্ষে তিন বছর জেলা বিচারকের ক্ষমতা নির্বাহ না করে থাকলে কেউ হাইকোর্টে বিচারক পদে নিয়োগ লাভে যোগ্য হবেন না।’ ওই শর্তটি পঞ্চদশ সংশোধনীতে রহস্যজনকভাবে বাদ পড়ে।
২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের তৈরি করা নীতিমালার শর্ত হচ্ছে, বিচারক বাছাই-প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ। প্রধান বিচারপতি নিজে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন না। তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ সহকর্মী ও বারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলবেন। আর এসবের মাধ্যমে কী করে একজনকে সর্বাপেক্ষা যোগ্য বিবেচনায় বেছে নেওয়া হলো, তার বিবরণ লিখে সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু এই শর্ত পূরণ হয়নি। যদিও ১৫তম সংশোধনীতে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে নির্দিষ্টভাবে শুধু প্রধান বিচারপতির পরামর্শের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে প্রধান বিচারপতির অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে প্রধান বিচারপতির একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সৃষ্টি হয়নি। ১১ অক্টোবর চলতি নিয়োগ নিয়ে সরকারি দল-সমর্থক আইনজীবীদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটেনি।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সর্বশেষ নিয়োগ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে তিনি গতকাল এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি কী করে তাঁর মতামত তৈরি করবেন, সে বিষয়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় আছে। সেখানে বাছাই থেকে নিয়োগ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ধাপ আছে। প্রতিটি ধাপে লিখিত শর্ত আছে। স্বচ্ছতার সঙ্গে এসব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পাঠান।’
নীতিমালায় বিচারক নিয়োগ ও বিচারক বাছাই-প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা হয়, বিচারক বাছাইয়ে প্রার্থীর আইনগত সূক্ষ্ম বিচারশক্তির বিষয়ে তথ্য দেবেন প্রধান বিচারপতি এবং সেটাই প্রাধান্য পাবে। ‘সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে’ খুঁজে বের করতে হবে। প্রক্রিয়াটি হতে হবে স্বচ্ছ। বিচারক বাছাই থেকে নিয়োগ-সংক্রান্ত পুরো প্রক্রিয়া হতে হবে লিখিত। কিন্তু বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় বাছাই ও নিয়োগ ঘটেছে, তাতে এর ব্যত্যয় ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নীতিমালায় বলা আছে, কাগজে-কলমে আইনজীবী হিসেবে ১০ বছর নাম লিখিয়ে রাখলেই ‘সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট’ হওয়া যাবে না। গতকাল শপথ গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্তত দুজনের পেশায় সক্রিয়তা ১০ বছরের অনেক কম। তাঁদের একজন ছাত্র ইউনিয়ন করার সুবাদে আইনমন্ত্রীর এবং অন্যজন আওয়ামী লীগের সাংসদ ফজলে রাব্বীর জামাতা হিসেবে আনুকূল্য পান বলে মনে করা হয়। নীতিমালা বলছে, খাতায় নাম লেখালেই হবে না। দেখতে হবে ১০ বছর প্রকৃতপক্ষে তিনি কী করেছেন। আর জেলা জজের ক্ষেত্রে দেখতে হবে, তিনি কোনো নির্বাহী পদে প্রেষণে কতটা সময় কাটিয়েছেন।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক নিয়োগ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ওই নীতিমালা আদৌ পড়ে দেখেছেন কি না সে বিষয়ে গতকাল প্রতিবেদকের কাছে সংশয় প্রকাশ করেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু সম্প্রতি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘যার এলডি ক্লার্ক হওয়ার যোগ্যতা নেই, তাকেও বিচারক করা হচ্ছে।’ জানা যায়, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের শ্যালক অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড এ কে এম শহিদুল হকের দিকে ইঙ্গিত করেই ওই মন্তব্য করা হয়েছিল।
খায়রুল হক যাঁদের নাম সুপারিশ করেছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে চারজনকে অজ্ঞাত কারণে বিচারক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সার্বিকভাবে তাই বলা চলে, বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়াটি আগের মতোই অস্বচ্ছ রয়ে গেছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা একমত যে অস্বচ্ছতা মানেই বেআইনি।
এ বিষয়ে ১১ অক্টোবর সমন্বয় পরিষদের বৈঠকে প্রতিবাদ করা হয়। এর আগের দিন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আমীর-উল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করে। তাঁরা তাঁকে বলেন, সততা, যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রশ্নে কোনো আপস করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে উল্টোটা ঘটছে।
No comments