তহবিল সংকটে সরকারি ব্যাংক-কলমানি মার্কেটে দৈনিক লেনদেনের প্রায় অর্ধেকই নিচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংক by ওবায়দুল্লাহ রনি

ধারের ওপর ভর করে চলছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার বাণিজ্যিক ব্যাংক। গ্রাহকের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে এসব ব্যাংক দ্বারস্থ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও কলমানি মার্কেটে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বন্ডের বিপরীতে জ্বালানি তেলের আমদানি ও সরকারের ব্যাংক ঋণের চাপ সামলাতে তহবিল সংকটের মুখে পড়েছে তারা। আশানুরূপ আমানত না আসায় নতুন করে বড় কোনো ঋণ অনুমোদন করছে না ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।


সূত্র জানিয়েছে, কলমানি মার্কেটে দৈনিক লেনদেনের প্রায় অর্ধেকই নিচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংক। চলতি সপ্তাহের শুরুর কার্যদিবস রোববারে কলমানি মার্কেটে ৪ হাজার ৮৮৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। যার মধ্যে ২ হাজার ১৪১ কোটি টাকাই নিয়েছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। এদিন ৩৬টি ব্যাংক ও ১৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ১৬টি ব্যাংক ও ৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধার দিয়েছে। ধার নিয়েছে ২০টি ব্যাংক ও ১৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। গত বৃহস্পতিবারও ছিল একই চিত্র। মোট ৫৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫ হাজার ১৫৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার লেনদেন হয়। যার মধ্যে শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংক নিয়েছে ২ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। আর গত বুধবারে ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকার মধ্যে চার ব্যাংক নেয় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। প্রতিদিনই এভাবে ধার নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে দৈনন্দিন লেনদেন মেটাতে হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও স্বল্প সময়ের জন্য ধার (রেপো) নিয়ে এসব ব্যাংকে চলতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমকালকে জানান, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই যেহেতু বিপিসির আমদানি হয়, তাই ব্যয় মেটাতে ডলারের ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাপোর্টের ফলে সেটি সামলে নেওয়া কঠিন হচ্ছে না। দৈনন্দিন হিসাব মেটাতে না পারার বিষয়টি সঠিক নয় বলে তিনি মনে করে। শিগগিরই এ চাপ কমে আসবে বলে তিনি আশা করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, বিপিসি আমদানি করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংকের মাধ্যমে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) মোট আমদানি হয়েছে ৪০ হাজার ৮০৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ৬৯.৪৮ টাকা হিসেবে)। এর মধ্যে শুধু জ্বালানি ও জ্বালানি পণ্য আমদানি হয়েছে ৬ হাজার ৭১ কোটি ৩৯ লাখ টাকার। গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৫৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। সে হিসেবে চলতি অর্থবছর এ খাতে ৩ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা বা ১৪৭ শতাংশ আমদানি বেড়েছে। দুই মাসের মোট আমদানির মধ্যে জ্বালানি খাতেই সর্বোচ্চ আমদানি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বিপিসির আমদানি দায় মেটাতে গিয়ে অন্য বড় কোনো ঋণপত্র খুলতে পারছে না। বাধ্য হয়ে এসব ব্যাংকের গ্রাহক অন্যান্য ব্যাংকে ভিড় করছেন। এতে করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয়ও ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। যোগাযোগ করা হলে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারম্যান ও বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন জানান, গত বছরের তুলনায় এবার জ্বালানি তেল ও জ্বালানি পণ্য আমদানি অনেক বেড়েছে। এতে করে টাকা ও ডলারের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। তবে রেমিট্যান্স, রফতানি, বিদেশি বিনিয়োগ বা ঋণ বাড়ানো গেলে এ চাপ থাকবে না বলে তিনি মনে করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ডলারের ওপর সৃষ্ট চাপ সামলাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাড়ে ৩ মাসে সরাসরি বিক্রি ও ধারের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে ৩৮ কোটি ডলার সরবরাহ করা হয়েছে। এ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ডলার ধার দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে এখনও ২৩ কোটি ২০ লাখ ডলার অপরিশোধিত রয়েছে। এ ছাড়া আইডিবি থেকে বিপিসির নেওয়া ঋণের প্রায় ৩০ কোটি ডলার চলতি মাসে পরিশোধ করতে হবে। এতে করে চলতি মাসেও চাপ থাকবে। তবে বড় ধরনের কোনো বৈদেশিক ঋণ পেলে সেটি কেটে যাবে বলে তিনি জানান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে ৮ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। এসব ঋণের মধ্যে ৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার মোট ৩ হাজার ৩৬৫ টাকা নিয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের বড় অংশই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংকে জোগান দিতে হয়েছে বলে জানা গেছে।
 

No comments

Powered by Blogger.