সীমার অনেক নিচে ব্যাংকের বিনিয়োগ by জাকির হোসেন

শেয়ারবাজারে ব্যাংকিং খাতের বিনিয়োগ সীমার অনেক নিচে এখন। তিন বছরের মধ্যে তা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী একটি ব্যাংক তার মোট দায়ের ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারলেও বর্তমানে বেশিরভাগ ব্যাংকের বিনিয়োগ তাদের মোট দায়ের ১ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে। ১০টি ব্যাংকের বিনিয়োগ ৫ শতাংশের ওপরে। এ অবস্থায় বর্তমানে পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতন ঠেকাতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগকে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে এক ধরনের নৈতিক চাপও ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে।


পাশাপাশি বাজারে শেয়ারের দর অনেক কম থাকায় ব্যাংকগুলো নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়ানোসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের
সংগঠন এবিবি আজ জরুরি বৈঠক ডেকেছে। এ উদ্যোগ পুঁজিবাজারের বর্তমান তারল্য সংকট এমনকি আস্থার সংকট কাটাতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকও পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল বলেছে, আইনের সীমার মধ্যে থেকে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। এ ছাড়া মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো বিধিনিষেধ নেই। এমনকি ব্যাংক অথবা তার সাবসিডিয়ারির মার্জিন ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিলের প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা বিবেচনা করবে।
২০০৯ ও ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলো ব্যাপক বিনিয়োগ করে বড় অঙ্কের মুনাফা করে। কেউ কেউ আইনের সীমা লঙ্ঘন করেও বিনিয়োগ করেছিল। গত বছরের এ সময়ে মোট ১২টি ব্যাংকের বিনিয়োগ আইনি সীমার ঊধর্ে্ব ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনি সীমা মানার এবং মুনাফা তুলে নেওয়ার চাপে ২০১০ সালের শেষদিকে বাজার ধসের আগেই অনেকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ তুলে নেয়। বাজার দ্রুত পতনের পেছনে এটি একটি বড় কারণ বলে শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন। পুঁজিবাজার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও এরকম অভিমত দেওয়া হয়। এ প্রেক্ষাপটে ২০১০ সালে বেশ ক'টি ব্যাংকের শেয়ারবাজার থেকে আসা মুনাফা বিতরণ করতে দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শেয়ারবাজার থেকে আসা গত বছরের মুনাফা সঞ্চিত আয় হিসেবে ব্যাংকগুলোর মূলধনের মধ্যে আছে। ওই মুনাফা থেকে নতুন করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের কথাবার্তা চলছে।
পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাব করা হয় দুটি পদ্ধতিতে। প্রথমটি হলো শেয়ার ধারণ, দ্বিতীয়টি হলো মোট সম্পৃক্ততা বা এক্সপোজার। ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের শেয়ার ধারণ এবং এক্সপোজার তার মোট দায়ের (আমানত ও অন্যান্য দায়) ১০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। দুটি পদ্ধতিতেই শেয়ারের বাজারমূল্য ধরে হিসাব করা হয়। শেয়ার ধারণ বলতে বোঝায় ব্যাংকগুলোর নিজস্ব পোর্টফোলিও এবং লিয়েন ও কাস্টডিতে রাখা শেয়ার। মোট এক্সপোজার বলতে বোঝায় নিজস্ব পোর্টফোলিও, নিজস্ব ও অন্যান্য সাবসিডিয়ারিকে দেওয়া ঋণ, এসব ঋণের বিপরীতে গ্যারান্টি এবং স্টক ডিলারকে দেওয়া ঋণ।
বর্তমানে দেশের ৪৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৪৩টি ব্যাংকের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দুটি ব্যাংকের বিনিয়োগ আইনি সীমার ওপরে আছে। বাকি ৪১টি ব্যাংকের বিনিয়োগ ওই সীমার নিচে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসভিত্তিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, পুঁজিবাজারে ব্যাংকিং খাতের শেয়ার ধারণ মোট দায়ের ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যার পরিমাণ ১৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। অন্যদিকে এক্সপোজার রয়েছে তাদের দায়ের ৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এর পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পুঁজিবাজারে এক্সপোজার তাদের মোট দায়ের ৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। তাদের মোট শেয়ার ধারণ মোট দায়ের ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সেপ্টেম্বর শেষে শেয়ার ধারণ দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং এক্সপোজার ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকগুলোর শেয়ার ধারণ ও এক্সপোজার যথাক্রমে ১ দশমিক ৩৮ এবং ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। তাদের সম্মিলিত বিনিয়োগ ১ শতাংশের নিচে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান সমকালকে বলেন, ব্যাংকগুলো সীমার মধ্যে থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলে তাতে অসুবিধার কিছু নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের নতুন করে বিনিয়োগের পর্যাপ্ত অবকাশ রয়েছে। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ব্যাংকগুলোর মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ তারা স্বীয় বিবেচনায় করতে পারবে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান এবং দি সিটি ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী মাহমুদ সাত্তার সমকালকে বলেন, পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক ব্যাংকই নতুন করে বিনিয়োগ করার চিন্তা-ভাবনা করছে। কেউ কেউ গত দু'একদিনে নতুন বিনিয়োগ করেছে। এতে পুঁজিবাজারে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ বাড়ালে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের চেষ্টা থাকবে। শেয়ারবাজার ইস্যুতে এবিবি বৃহস্পতিবার (আজ) বৈঠক করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবৃতি : গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিবৃতিতে বলেছে, আইনি সীমার মধ্যে থেকে কোনো ব্যাংক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বা মার্চেন্ট ব্যাংকের সুদ মওকুফ করলে কিছু বলবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া নীতিমালা অনুসরণপূর্বক ব্যাংক নিজেই সাবসিডিয়ারি কর্তৃক প্রদত্ত মার্জিন ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারে। এক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিলের প্রয়োজনে কোনো ব্যাংক আবেদন করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা বিবেচনা করবে। ১২ অক্টোবর এসইসির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল বলে প্রদত্ত বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ব্যাংক বা তার সাবসিডিয়ারি কর্তৃক প্রদত্ত মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বিধিনিষেধ নেই। ব্যাংক নিজস্ব বিবেচনায় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদ মওকুফ করতে পারে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে বর্ণিত নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। যেসব ব্যাংক নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে তাদের বিনিয়োগ নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনার সময়সীমা এরই মধ্যে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তারা আজ সকালে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম এ বিষয়ে সমকালকে বলেন, নীতিমালা অনুসরণ করে ব্যাংকগুলো তাদের মার্জিন ঋণ পুনঃতফসিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিল করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে। এ ছাড়া মার্চেন্ট ব্যাংকের সুদ মওকুফ বা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানো ব্যাংকের নিজস্ব বিষয়। তারপরও ব্যাংকগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। নিজেদের ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করে ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাবে বলে তিনি আশা করেন।
 

No comments

Powered by Blogger.