প্রযুক্তির জালে জীবন by এজি মাহমুদ
‘তবে কী তাকে ফিরিয়ে দেয়াটা ভুল ছিল! এমন করে ভেবে দেখিনি তো আগে কখনো। যদি ভুল নাইবা হবে তবে কেন দুপুরের এই নিঝুম ক্ষণে ঘুরেফিরে কেবল তাকেই মনে পরছে। কেন তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে অপলক!’ চমৎকার কোনো ডায়রির নীলচে সাদা পাতা জুড়ে গোটা গোটা অক্ষরে এমন লেখা আজকাল কেউ লিখেছে আর। অথচ একটা সময়ে ডায়রি লিখতেন অনেকেই। সেই লেখার মাঝে খুঁজে পাওয়া যেত, মনের আয়নায় দাগ কেটে যাওয়া কিছু ঘটনা আর ব্যাক্তিগত অনুভূতির অবাধ বিচরণ।
কিন্তু মলাটে বন্দী ডায়রির শুভ্র পাতায় কালির স্পর্শে আঁকা অনুভূতির প্রকাশ নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই আজ পুরানো সেন্টিমেন্ট মাত্র। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় অনুভূতির প্রকাশভঙ্গিতেও এসেছে পরিবর্তন। মনের কথা আজ আর ডায়রিতে নয়; লেখা হচ্ছে, ফেসবুক আর টুইটারের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইটের স্ট্যাটাস লাইনে। পাশাপাশি অনেকেই ব্লগিং সাইটগুলোতেও আবার তুলে ধরছেন নিজস্ব ভাবনা আর আবেগের দুরন্তপনা। এসব নেটওয়ার্কিং সাইটের ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা মানুষগুলোর ভাবনায় চাইলে আপনিও কমেন্ট করতে পারবেন। তাই কমেন্টস আর পাল্টা কমেন্টসের জোয়ারে এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছে কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রেখে। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফেসবুক অথবা টুইটারে কারও অ্যাকাউন্ট না থাকলেই বরং তাকে অসামাজিক ভাবছে অন্যরা। এভাবেই মনের অনুভূতিকে ক্রমশ স্পর্শ করে যাচ্ছে প্রযুক্তির আবেশ।
শুধুই কী আর মনের অনুভূতি, সাহিত্যের মুদ্রিত প্রকাশ যে বই তাকেও গ্রাস করেছে প্রযুক্তি। সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে শিশুদের কমিকস্ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে পিডিএফ ফরমেটের ফাইল হিসাবে। ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে বিনামূল্যে এসব বই আর পত্রিকার পিডিএফ ফাইল নামিয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে পড়ে নেয়া যাচ্ছে খুব সহজেই। নতুন বইয়ের গন্ধ, বইয়ের ভালো লেগে যাওয়া কথাগুলোর নিচে দাগ টেনে রাখা আর পাতা ওল্টানোর সেই শব্দ যেন আমাদের অজান্তেই বিস্মৃতির আড়ালে হারাতে শুরু করেছে।
জীবনটা এভাবেই জড়িয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির জালে। সকালের ঘুমটা ভাঙছে সেলফোনের ইনকামিং কলের রিংটোন অথবা অ্যালার্মের তীক্ষè শব্দে। ফ্রেশ হবার পর সকালে নাস্তা বানানোর সময় হাতে থাকে না বলেই আগে থেকে রান্না করা খাবার ফ্রিজ থেকে বের করে ঝটপট গরম করে নেওয়া হচ্ছে মাইক্রোওভেনে। জীবন এতটাই ব্যস্ততার ভীড়ে হাটছে যে, দেয়ালে ঝোলানো পুরানো ঘড়িটার দিকে তাকানোর অবসরটুকুও হয় না আর। কোনোরকমে সেলফোনের স্ক্রিনে সময় দেখেই বাসা থেকে বেড়িয়ে পরছে সবাই। যাওয়ার পথে সেলফোনের সঙ্গে হেডফোন কানেক্ট করে এফএম রেডিও স্টেশন অথবা নিজস্ব এমপিথ্রি কালেকশানের গানের মূর্ছনায় হারিয়ে যাওয়া এখন আমাদের জীবনের অতি পরিচিত দৃশ্য। কাজের ব্যাপারে যারা অনেক সিরিয়াস তাদেরকে আবার গাড়িতে বসেই ল্যাপটপ অথবা নোটপ্যাডের পর্দা খুলে বসে পড়তে দেখা যায়। ওয়্যারলেস ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির কারণে ল্যাপটপেও চলে এসেছে ইন্টারনেট। তাই সকালবেলা একগাদা পেপার কেনার ঝামেলায় না গিয়ে দৈনিক পত্রিকার ওয়েবসাইটগুলোতেই ঢুঁ মেরেই জেনে নেওয়া যাচ্ছে দিনের সব গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোতে। ল্যাপটপে শুধু কাজ আর ইন্টারনেট ব্রাউজিংই নয়। শপিংয়ে কিংবা অবসরে কোথাও যাবার মূহুর্তে গাড়িতে বসেই অনেকে দেখে নিচ্ছেন পছন্দের সব মুভিগুলো।
দিন শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডাটাও অনেকে জমিয়ে নিচ্ছেন অনলাইনের কোনো চ্যাটরুমে। এখানে আড্ডা দেবার সুবিধা হলো ভিডিও ক্লিপস অথবা মজার কোনো ছবি চট করে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা যায়। সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওয়েবসাইটের লিংক আর ইনফরমেশনেরও কমতি হয় না। অনলাইনের দুনিয়ায় কেউ কেউ আবার খুঁজে নিচ্ছেন নতুন নতুন সব বন্ধুদের। মনের ভাবনাগুলোকে মেলে ধরে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছেন মেলবন্ধন। কিন্তু সেই আড্ডায় ধূমায়িত গরম চা আর ঝালমুড়ির উচ্ছাস নেই। নেই অভিমানী হাওয়ায় বন্ধুর কন্ঠে ভেসে আসা গুনগুন করে গাওয়া কোন গান। রয়েছে শুধু, মাউসের ক্লিক ক্লিক কামড় আর কী-বোর্ডের বোতামে হাত রেখে লিখে যাওয়ার খটমটে কিছু শব্দ।
জীবনে বদলে যাওয়া আরো কিছু
১.
মনের কথামালা সাজিয়ে প্রিয়জনের কাছে পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে চিঠির বিকল্প নেই। একটা সময়ে এই চিঠি উড়ে আসতো পায়রার পায়ের বাঁধনে। তারপর এলো, পোস্টম্যানের টুং টাং সাইকেলে চড়ে। একটা সময়ে এসে বাড়তে শুরু করলো মানুষের ব্যস্ততা। আসতে দেরি হয় বলে দ্রুত সংবাদ পৌছাতে চিঠির বিকল্প জায়গাটা মাঝে মাঝেই দখল করে নিচ্ছিল সংক্ষিপ্ত শব্দের টেলিগ্রাফ। কিন্তু সময়ের দৌড়ে
ই-মেইল আজ পেছনে ফেলে গিয়েছে টেলিগ্রাফকেও। কিন্তু এই ব্যস্ত কোলাহলে প্রিয়তমার চিঠি লেখা তো দূরে কথা, ই-মেইল করারও সময় নেই। প্রয়োজনে হলে বড়জোর ঝটপট সেলফোনের শর্ট মেসেজ সর্ভিসের জানালাটা খুলে সংক্ষেপে কিছু শব্দ লিখে পাঠানো পর্যন্তই। সেই আবেগঘন চিঠির আবেদন আজ নাকচ করে দিয়েছে টুকরো টুকরো এসএমএস-এর স্যুভিনির।
২.
নিরাপত্তা আর ব্যবহারের সুবিধার কারনে ক্যাশ পেমেন্টের ঝামেলায় আজকাল আর যেতে চাচ্ছেন না অনেকেই। শপিং শেষে ডেবিট, ক্রেডিট অথবা ভিসা কার্ড পাঞ্চ করে দাম মিটিয়ে দিচ্ছেন পণ্যের। অথচ জাতীয় ঐতিহ্য আর স্থাপ্যত্য শিল্পের বিভিন্ন নিদর্শন ছাপানো হয়ে থাকে আমাদের দেশের বিভিন্ন মূল্যমানের টাকার নোটে। ই-ক্যাশ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানতে পারছেন না কত মূল্যমানের টাকার নোট আসলে দেখতে কেমন!
৩.
আগে সারি সারি ভেজা কাপড় ক্লিপ দিয়ে সাজিয়ে রৌদ্রে শুকোতে দেওয়া হতো বাড়ির বারান্দায় অথবা ছাদের আঙ্গিনায়। বৃষ্টি এলেই বাড়ির মেয়েরা ছোটাছুটি করে ক্লিপ খুলে সেই কাপড়গুলো গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এমন দৃশ্যপট আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। এয়ার কুলিং সিস্টেমের কারণে কখন বাইরে রোদ্দুর আর কখন মেঘময় আকাশ সে আর জানা হয় না। জানালার পাশে বসে দখিনা বাতাসে আর দোলে না হৃদয়। আর ভেজা কাপড় সব শুকিয়ে নেয়া হচ্ছে ইলেকট্রিক ওয়াশিং মেশিনেই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিংবা জানালার পাশে বসে দখিনা বাতাসে ভেজা চুলও আজ আর শুকানো হয় না। ইলেকট্রিক হেয়ার ড্রেসারের গরম বাতাস আজ সেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে।
৪.
আগে পকেটে কলম থাকলে অনেকে ভাবতো মানুষটি বুঝি নামীদামী কেউ। তাই ফ্যাশান করে হলেও বুক পকেটে কলম রাখতো অনেকেই। কিন্তু সেই ফ্যাশানের সাথে সাথে আজ কলম বা পেন যাই বলুন না কেন, সেটা হারিয়ে যাচ্ছে। পেন এর বদলে পকেটে চলে এসেছে পেন-ড্রাইভ। ডকুমেন্টস আর ইনফরমেশন থেকে শুরু করে মুভি পর্যন্ত ধারণ করা যাচ্ছে কলমের চেয়েও ছোট আকৃতির এই ড্রাইভে। যখন তখন যে কোনো কম্পিউটারের ইউএসবি পোর্টের মাধ্যমে কানেক্ট করে পেন-ড্রাইভে করেই নেওয়া যাচ্ছে প্রয়োজনীয় সব তথ্যাবলী। পেন-ড্রাইভের মতো এতো বিশাল ক্ষমতা তার নেই বলেই হয়তো কালি মুখো কলমকে এমন উপেক্ষা সইতে হচ্ছে।
৫.
কম্পিউটারের গেমসের দুনিয়ায় কোন কিছুরই কমতি নেই। ইনডোর গেমস ক্যারাম, দাবা আর কার্ড থেকে শুরু করে আউটডোরের ফুটবল, ক্রিকেট পর্যন্ত খেলা যাচ্ছে কম্পিউটারে পর্দায়। এছাড়াও অ্যাকশান আর রেসিং গেমসের টানাটান উত্তেজনায় সত্যিকারের খেলার দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে অনেকেই। শিখছে না আর কেমন করে সামনে এগিয়ে এসে স্পিন বলে হাঁকাতে হয় ছক্কা কিংবা ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে বলটাকে পৌছে দিতে হয় সোজা গোলপোস্টের জালে।
৬.
ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলার কারণে এখন আর আগের মতো ছবি ওয়াশ করে ফটো অ্যালবামে রাখার ঝামেলায় যেতে চায় কেউই। ক্যামেরার মেমরি কার্ড থেকে ছবি কপি করে নিয়ে রেখে দেওয়া হচ্ছে কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে কিংবা রাইট করে রাখা হচ্ছে কোনো সিডিতে। কম্পিউটারের স্ক্রিন ছাড়া সেই ছবি দেখার উপায় নেই। যান্ত্রিক পর্দায় প্রিয়জনদের ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে স্মৃতিরা আগের মতো আবেদন আর অনুভবের কতটুকুইবা ছড়িয়ে দিতে পারছে হৃদয়ে!
৭.
শব্দের সঠিক উচ্চারণ আর অর্থ উদ্ধারে অভিধানের বিকল্প নেই। আগে অভিধানে একটি শব্দ খুঁজতে গিয়ে তার কাছাকাছি উচ্চারণের আরো কয়েকটি শব্দে চোখ পড়ে যেতো। যে কারণে না চাইলেও মনের আয়নায় গেঁথে যেতো আরো কিছু অজানা শব্দ। কিন্তু কম্পিউটারের ডিকশনারি সফটওয়ার কিংবা ডিজিটাল ডিকশনারি মেশিনের কারণে এখন আর সেটি হচ্ছে না। ডিকশনারি সফটওয়ার বা মেশিনে নিদির্ষ্ট কোনো শব্দ বসিয়ে সার্চ বাটনে ক্লিক করলেই যাবতীয় তথ্যাবলী সামনে চলে আসছে। যে কারণে সহজেই বের করা যাচ্ছে অজানা সব শব্দ সম্পর্কিত তথ্য। ওল্টাতে হচ্ছে না আর ভারি অভিধানের পাতার পর পাতা। কিন্তু সত্যিকারের অভিধান কোষ থেকে কিভাবে একটি শব্দ নিয়ম অনুসারে খুঁজে বের করতে হয় সেই পদ্ধতি আর কৌশল ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে মনের অগোচরে।
সত্যিই বন্ধুরা, আমরা আবেগের জায়গাগুলো থেকে অনেক দূরে যেন সরে আসছি, কিন্তু আমাদের কর্মব্যস্ত জীবনটাকে কত সহজ করে দিয়েছে এই প্রযুক্তি এটাও কিন্তু ভাবতে হবে।
শুধুই কী আর মনের অনুভূতি, সাহিত্যের মুদ্রিত প্রকাশ যে বই তাকেও গ্রাস করেছে প্রযুক্তি। সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে শিশুদের কমিকস্ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে পিডিএফ ফরমেটের ফাইল হিসাবে। ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে বিনামূল্যে এসব বই আর পত্রিকার পিডিএফ ফাইল নামিয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে পড়ে নেয়া যাচ্ছে খুব সহজেই। নতুন বইয়ের গন্ধ, বইয়ের ভালো লেগে যাওয়া কথাগুলোর নিচে দাগ টেনে রাখা আর পাতা ওল্টানোর সেই শব্দ যেন আমাদের অজান্তেই বিস্মৃতির আড়ালে হারাতে শুরু করেছে।
জীবনটা এভাবেই জড়িয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির জালে। সকালের ঘুমটা ভাঙছে সেলফোনের ইনকামিং কলের রিংটোন অথবা অ্যালার্মের তীক্ষè শব্দে। ফ্রেশ হবার পর সকালে নাস্তা বানানোর সময় হাতে থাকে না বলেই আগে থেকে রান্না করা খাবার ফ্রিজ থেকে বের করে ঝটপট গরম করে নেওয়া হচ্ছে মাইক্রোওভেনে। জীবন এতটাই ব্যস্ততার ভীড়ে হাটছে যে, দেয়ালে ঝোলানো পুরানো ঘড়িটার দিকে তাকানোর অবসরটুকুও হয় না আর। কোনোরকমে সেলফোনের স্ক্রিনে সময় দেখেই বাসা থেকে বেড়িয়ে পরছে সবাই। যাওয়ার পথে সেলফোনের সঙ্গে হেডফোন কানেক্ট করে এফএম রেডিও স্টেশন অথবা নিজস্ব এমপিথ্রি কালেকশানের গানের মূর্ছনায় হারিয়ে যাওয়া এখন আমাদের জীবনের অতি পরিচিত দৃশ্য। কাজের ব্যাপারে যারা অনেক সিরিয়াস তাদেরকে আবার গাড়িতে বসেই ল্যাপটপ অথবা নোটপ্যাডের পর্দা খুলে বসে পড়তে দেখা যায়। ওয়্যারলেস ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির কারণে ল্যাপটপেও চলে এসেছে ইন্টারনেট। তাই সকালবেলা একগাদা পেপার কেনার ঝামেলায় না গিয়ে দৈনিক পত্রিকার ওয়েবসাইটগুলোতেই ঢুঁ মেরেই জেনে নেওয়া যাচ্ছে দিনের সব গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোতে। ল্যাপটপে শুধু কাজ আর ইন্টারনেট ব্রাউজিংই নয়। শপিংয়ে কিংবা অবসরে কোথাও যাবার মূহুর্তে গাড়িতে বসেই অনেকে দেখে নিচ্ছেন পছন্দের সব মুভিগুলো।
দিন শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডাটাও অনেকে জমিয়ে নিচ্ছেন অনলাইনের কোনো চ্যাটরুমে। এখানে আড্ডা দেবার সুবিধা হলো ভিডিও ক্লিপস অথবা মজার কোনো ছবি চট করে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা যায়। সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওয়েবসাইটের লিংক আর ইনফরমেশনেরও কমতি হয় না। অনলাইনের দুনিয়ায় কেউ কেউ আবার খুঁজে নিচ্ছেন নতুন নতুন সব বন্ধুদের। মনের ভাবনাগুলোকে মেলে ধরে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছেন মেলবন্ধন। কিন্তু সেই আড্ডায় ধূমায়িত গরম চা আর ঝালমুড়ির উচ্ছাস নেই। নেই অভিমানী হাওয়ায় বন্ধুর কন্ঠে ভেসে আসা গুনগুন করে গাওয়া কোন গান। রয়েছে শুধু, মাউসের ক্লিক ক্লিক কামড় আর কী-বোর্ডের বোতামে হাত রেখে লিখে যাওয়ার খটমটে কিছু শব্দ।
জীবনে বদলে যাওয়া আরো কিছু
১.
মনের কথামালা সাজিয়ে প্রিয়জনের কাছে পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে চিঠির বিকল্প নেই। একটা সময়ে এই চিঠি উড়ে আসতো পায়রার পায়ের বাঁধনে। তারপর এলো, পোস্টম্যানের টুং টাং সাইকেলে চড়ে। একটা সময়ে এসে বাড়তে শুরু করলো মানুষের ব্যস্ততা। আসতে দেরি হয় বলে দ্রুত সংবাদ পৌছাতে চিঠির বিকল্প জায়গাটা মাঝে মাঝেই দখল করে নিচ্ছিল সংক্ষিপ্ত শব্দের টেলিগ্রাফ। কিন্তু সময়ের দৌড়ে
ই-মেইল আজ পেছনে ফেলে গিয়েছে টেলিগ্রাফকেও। কিন্তু এই ব্যস্ত কোলাহলে প্রিয়তমার চিঠি লেখা তো দূরে কথা, ই-মেইল করারও সময় নেই। প্রয়োজনে হলে বড়জোর ঝটপট সেলফোনের শর্ট মেসেজ সর্ভিসের জানালাটা খুলে সংক্ষেপে কিছু শব্দ লিখে পাঠানো পর্যন্তই। সেই আবেগঘন চিঠির আবেদন আজ নাকচ করে দিয়েছে টুকরো টুকরো এসএমএস-এর স্যুভিনির।
২.
নিরাপত্তা আর ব্যবহারের সুবিধার কারনে ক্যাশ পেমেন্টের ঝামেলায় আজকাল আর যেতে চাচ্ছেন না অনেকেই। শপিং শেষে ডেবিট, ক্রেডিট অথবা ভিসা কার্ড পাঞ্চ করে দাম মিটিয়ে দিচ্ছেন পণ্যের। অথচ জাতীয় ঐতিহ্য আর স্থাপ্যত্য শিল্পের বিভিন্ন নিদর্শন ছাপানো হয়ে থাকে আমাদের দেশের বিভিন্ন মূল্যমানের টাকার নোটে। ই-ক্যাশ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানতে পারছেন না কত মূল্যমানের টাকার নোট আসলে দেখতে কেমন!
৩.
আগে সারি সারি ভেজা কাপড় ক্লিপ দিয়ে সাজিয়ে রৌদ্রে শুকোতে দেওয়া হতো বাড়ির বারান্দায় অথবা ছাদের আঙ্গিনায়। বৃষ্টি এলেই বাড়ির মেয়েরা ছোটাছুটি করে ক্লিপ খুলে সেই কাপড়গুলো গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এমন দৃশ্যপট আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। এয়ার কুলিং সিস্টেমের কারণে কখন বাইরে রোদ্দুর আর কখন মেঘময় আকাশ সে আর জানা হয় না। জানালার পাশে বসে দখিনা বাতাসে আর দোলে না হৃদয়। আর ভেজা কাপড় সব শুকিয়ে নেয়া হচ্ছে ইলেকট্রিক ওয়াশিং মেশিনেই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিংবা জানালার পাশে বসে দখিনা বাতাসে ভেজা চুলও আজ আর শুকানো হয় না। ইলেকট্রিক হেয়ার ড্রেসারের গরম বাতাস আজ সেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে।
৪.
আগে পকেটে কলম থাকলে অনেকে ভাবতো মানুষটি বুঝি নামীদামী কেউ। তাই ফ্যাশান করে হলেও বুক পকেটে কলম রাখতো অনেকেই। কিন্তু সেই ফ্যাশানের সাথে সাথে আজ কলম বা পেন যাই বলুন না কেন, সেটা হারিয়ে যাচ্ছে। পেন এর বদলে পকেটে চলে এসেছে পেন-ড্রাইভ। ডকুমেন্টস আর ইনফরমেশন থেকে শুরু করে মুভি পর্যন্ত ধারণ করা যাচ্ছে কলমের চেয়েও ছোট আকৃতির এই ড্রাইভে। যখন তখন যে কোনো কম্পিউটারের ইউএসবি পোর্টের মাধ্যমে কানেক্ট করে পেন-ড্রাইভে করেই নেওয়া যাচ্ছে প্রয়োজনীয় সব তথ্যাবলী। পেন-ড্রাইভের মতো এতো বিশাল ক্ষমতা তার নেই বলেই হয়তো কালি মুখো কলমকে এমন উপেক্ষা সইতে হচ্ছে।
৫.
কম্পিউটারের গেমসের দুনিয়ায় কোন কিছুরই কমতি নেই। ইনডোর গেমস ক্যারাম, দাবা আর কার্ড থেকে শুরু করে আউটডোরের ফুটবল, ক্রিকেট পর্যন্ত খেলা যাচ্ছে কম্পিউটারে পর্দায়। এছাড়াও অ্যাকশান আর রেসিং গেমসের টানাটান উত্তেজনায় সত্যিকারের খেলার দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে অনেকেই। শিখছে না আর কেমন করে সামনে এগিয়ে এসে স্পিন বলে হাঁকাতে হয় ছক্কা কিংবা ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে বলটাকে পৌছে দিতে হয় সোজা গোলপোস্টের জালে।
৬.
ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলার কারণে এখন আর আগের মতো ছবি ওয়াশ করে ফটো অ্যালবামে রাখার ঝামেলায় যেতে চায় কেউই। ক্যামেরার মেমরি কার্ড থেকে ছবি কপি করে নিয়ে রেখে দেওয়া হচ্ছে কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে কিংবা রাইট করে রাখা হচ্ছে কোনো সিডিতে। কম্পিউটারের স্ক্রিন ছাড়া সেই ছবি দেখার উপায় নেই। যান্ত্রিক পর্দায় প্রিয়জনদের ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে স্মৃতিরা আগের মতো আবেদন আর অনুভবের কতটুকুইবা ছড়িয়ে দিতে পারছে হৃদয়ে!
৭.
শব্দের সঠিক উচ্চারণ আর অর্থ উদ্ধারে অভিধানের বিকল্প নেই। আগে অভিধানে একটি শব্দ খুঁজতে গিয়ে তার কাছাকাছি উচ্চারণের আরো কয়েকটি শব্দে চোখ পড়ে যেতো। যে কারণে না চাইলেও মনের আয়নায় গেঁথে যেতো আরো কিছু অজানা শব্দ। কিন্তু কম্পিউটারের ডিকশনারি সফটওয়ার কিংবা ডিজিটাল ডিকশনারি মেশিনের কারণে এখন আর সেটি হচ্ছে না। ডিকশনারি সফটওয়ার বা মেশিনে নিদির্ষ্ট কোনো শব্দ বসিয়ে সার্চ বাটনে ক্লিক করলেই যাবতীয় তথ্যাবলী সামনে চলে আসছে। যে কারণে সহজেই বের করা যাচ্ছে অজানা সব শব্দ সম্পর্কিত তথ্য। ওল্টাতে হচ্ছে না আর ভারি অভিধানের পাতার পর পাতা। কিন্তু সত্যিকারের অভিধান কোষ থেকে কিভাবে একটি শব্দ নিয়ম অনুসারে খুঁজে বের করতে হয় সেই পদ্ধতি আর কৌশল ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে মনের অগোচরে।
সত্যিই বন্ধুরা, আমরা আবেগের জায়গাগুলো থেকে অনেক দূরে যেন সরে আসছি, কিন্তু আমাদের কর্মব্যস্ত জীবনটাকে কত সহজ করে দিয়েছে এই প্রযুক্তি এটাও কিন্তু ভাবতে হবে।
No comments