কমলাপুর স্টেশন: মানুষ বেচা কেনার হাট by শাহীন কাওসার ও ফাহিমা আক্তার সুমি

কমলাপুর রেলস্টেশন। রেলপথের পুরো দেশের কেন্দ্রস্থল। ট্রেনের হুইসেল আর লাখো যাত্রীর পদভারে রাতদিন একাকার হয়ে যায় এখানে। দিনে কতো মানুষ আসে, কতো মানুষ যায় এই স্টেশন হয়ে। এই যাত্রীদের ঘিরে জীবন-জীবিকার সংস্থান হয় অনেক মানুষের। তাদের কারও কারও আবার ঘরবাড়ি মানে এই স্টেশন। এদের কেউ ঘাম ঝরিয়ে রোজগার করে আবার কেউ ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িত। এই অপরাধ চক্রের সদস্যরা মানুষ বিক্রির মতো জঘন্য কাজ করে এই স্টেশনে বসেই। অবুঝ শিশু, কিশোরী এমনকি নারীদেরও বিক্রি করে দেয় এই চক্র। সরজমিন কয়েক দিন কমলাপুর স্টেশনে অবস্থান করে মানবজমিন মানুুষ কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত এই চক্রের বিষয়ে বিস্তর তথ্য পেয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে অসহায় অবস্থায় কমলাপুর এসে অনেকে আশ্রয় নেয়। এই অসহায় মানুষদেরই টার্গেট করে গড়ে উঠেছে এই চক্র। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিশু চুরির সঙ্গেও যোগসাজশ আছে তাদের। এই চক্রটি মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে চুরি করে আনা শিশু তুলে দেয় কোনো পরিবারের হাতে। আবার এই শিশুদের বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তির কাজে ব্যবহারেরও অভিযোগ আছে। এ ছাড়া কিশোরী বা নারীদেরও নানা পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেয় তারা। এই কিশোরী বা নারীরাও নানাভাবে পরবর্তীতে পাচার বা সহিংসতার শিকার হন।

কমলাপুরে মানুষ কেনাবেচার এই চক্রটিতে ১০ থেকে ১২ জন। সোমবার কমলাপুর রেলস্টেশনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় চক্রটির মূলহোতা রুবেলের সঙ্গে। এক ব্যক্তিকে ক্রেতা সাজিয়ে তার কাছে একটি শিশুর চাহিদার কথা জানানো হয়। শুরুতে সে এড়িয়ে যেতে চাইলেও তার এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আনে। একপর্যায়ে চাহিদামতো শিশু এনে দিতে পারবে বলে জানায়, দাবি করে  মোটা অঙ্কের অর্থ। শুধু শিশু নয় কিশোরী ও তরুণীদেরও বিক্রি করে দেয়ার তথ্য দেয়। তরুণীদের গর্ভে অবৈধভাবে ধারণ করা সন্তান বিক্রিরও প্রস্তাব দেয়। একটি পাঁচ মাসের ছেলে সন্তান বিক্রির জন্য দরদামও হাঁকায়।

শিশু-কিশোরীদের পাচারের কথা জানিয়ে রুবেল বলে, ছোট-বড় যে বয়সী শিশু দরকার সেটি দিতে পারবো। শিশু সংগ্রহের কৌশলের বিষয়ে সে বলে, দেশের বিভিন্ন স্থানে তার নির্ধারিত লোক শিশু চুরি করে নিয়ে আসে। এই শিশুদের পরে বিক্রি করে দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এই চক্রের সদস্যদের ধরা পড়ার তথ্যও জানায় এই যুবক।  

চক্রের ৬ সদস্য শিশু চুরির কাজ করে জানিয়ে রুবেল বলে, এখান থেকে খরচ দিয়ে আমি তিনটি মেয়েকে পাঠিয়ে দিবো। তারা যাবে ময়মনসিংহ, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া এবং জয়দেবপুর এবং অন্য কয়েকটি জেলায় যাবে বাকিরা। মোট আমাদের ছয়টি মেয়ে যাবে, তারা সঙ্গে করে দুইটা বাচ্চা নিয়ে আসবে। তারা নিয়ে এসে আমাকে খবর পাঠাবে আমরা আবার সেখান থেকে নিয়ে আসবো।

ক্রেতা সেজে একজন শিশুর চাহিদা জানালে রুবেল টাকা দাবি করে বলে, রাতে তার চক্রের ৬ সদস্যকে ঢাকার বাইরে পাঠানোর জন্য গাড়ি ভাড়ার খরচ বাবদ দুই হাজার টাকা দিতে হবে।
ঘণ্টাখানেক পর একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল করে শিশুটিকে হাতে পাওয়ার পর ১ লাখ টাকা দাবি করে রুবেল। সে বলে, কমলাপুরে এসে বাচ্চাটিকে নিতে হবে।
অন্য একজন একটি কিশোরীর চাহিদা জানালে রুবেল বলে, মারিয়া নামের একটি মেয়ে আছে। তার জন্য আমাকে ২০ হাজার টাকা দিলে হবে। মেয়েটিকে কোনো টাকা দেয়া লাগবে না। তাকে একেবারে বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।

রুবেল কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছে একটি পানির পাম্পে কাজ করার কথা দাবি করেন।
এসময় তিনি নিজের বাড়ি নোয়াখালী দাবি করেন। ওদিকে স্টেশনে দীর্ঘ সময় অবস্থান করে চক্রের কিছু কাজের আলামতও মিলে। শুধু শিশু না, ভবঘুরে ছিন্নমূল কিশোরী, তরুণীদেরও নানা কাজে ব্যবহার করে রুবেলসহ একাধিক চক্র। তাদের ভয় ও লোভ দেখিয়ে নানা অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হয়। এমন একজন কিশোরীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, রুবেল ভাই আমাকে যেতে বলেছে। আর বলেছে আমি যেন গিয়ে ঠিকমতো কথা শুনি, যদি কথা না শুনি তাহলে কমলাপুরে দেখলে খারাপ হবে। এরচেয়ে আর বেশি কিছু বলেনি। কিশোরীটি বলে, আমার সৎমা ধরে আমাকে মারতো। নিজের মা আরেক জনকে বিয়ে করেছে। কিছু চাইলে ঠিকমতো দিতে চাইতো না। স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে পারতাম না। বই-খাতা কিনতে চাইলে কিনে দিতো না। এরপর অল্প বয়সে বাড়ি থেকে ট্রেনে করে চলে আসি কমলাপুরে। এখানে এসে থাকা শুরু করি। নিজের বলতে এখানে কেউ নেই। যখন আমার ৭ থেকে ৮ বছর বয়স তখন আসি। আমার বাড়ি রংপুর। সাত বছর ধরে থাকি। বাড়ি থেকেও কখনো কেউ খোঁজ নেয়নি। কিশোরীটির শরীরের বিভিন্ন স্থানে কাটা ও সুঁচের চিহ্ন দেখা যায়। এসব কী জানতে চাইলে সে বলে এখানে থাকা প্রায় সবাই মাদক গ্রহণ করে, নেশা করে।

আরেক কিশোরী বলে, একেবারে ছোটবেলায় চলে আসি। রাজশাহী আমাদের গ্রামের বাড়ি। এই জগতটা আর ভালো লাগে না। অনেক ঘটনা ঘটে এই কমলাপুরে। নতুন বা পুরাতন যেই আসুক মানুষের মোবাইল ছিনতাই হয়। যাত্রীদের ব্যাগ ছিনতাই হয়। অনেকে অনেকভাবে খারাপ কথা বলে। ব্লেড দিয়ে হাত-পা কাটি। শরীরে ড্রাগ নেই, এতে নেশা হয় সব ভুলে থাকি। কখনো কখনো কষ্টে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাই। এখানে আসার পর মানুষ আর ভালো থাকতে দেয়নি। এই কিশোরীও রুবেলের কথামতো কাজ করে বলে জানায়।

২৩ বছরের আরেক তরুণ বলেন, আমার জন্মই কমলাপুর। বাবা-মা গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় চলে আসে। এখন তাদের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ তেমন নেই।
আমার কোনো বাড়িঘর নেই এই কমলাপুরই সব। আমি বাইরে কোথাও ভিক্ষা করতে গেলেও কমলাপুরের কথা আমার চোখে ভাসে। এই রেলস্টেশন আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। আমার অনেক কষ্ট আছে সেজন্য আমি এলাকায় যাই না। আমি আমার মা-বাবা ছাড়া কাউকে চিনি না। করোনার সময় মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছে আর হয়নি। বাবা-মায়ের কথা মনে পড়লে এক জায়গায় বসে কান্নাকাটি করে নিজের দুঃখ নিজের কাছে বলি। এই কমলাপুরই আমার ভালোবাসা। এখানে ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়াও বিভিন্ন কাজ করি, তাতে প্রায় ৭-৮ শত টাকা আয় হয়।

স্টেশনে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি বলেন, এখানে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায়ই অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা ট্রেনে চড়ে ঢাকায় আসে। শুধু তাই নয় ছোট ছোট শিশুরাও আসে। আবার বিভিন্ন ছেলেদের প্রেমের ফাঁদে পড়ে মেয়েরা এখানে আসে। পরে মেয়েটাকে ফেলে রেখে চলে যায়। এসব মেয়েরা আর ফিরে যায় না পরিবারের কাছে। অনেক ছেলে-মেয়ে আবার বাবা-মায়ের সঙ্গে রাগ করে আসে। কেউ সৎমায়ের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে চলে আসে। এখানে অনেকে অভাবের কারণে নিজের বাচ্চা বিক্রি করে দিতে শুনেছি। যাদের বাচ্চার প্রয়োজন হয় তারা মোবাইল নাম্বার দিয়ে যায়।
বারবার নাম জানতে চাইলেও নিজের নামটি বলতে চাননি এ তরুণ। তিনি বলেন, এখানে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করে লাভ নেই। আমার মতো যারা থাকে তাদের কেউ ভালো, কেউ খারাপ। তবে কমলাপুর সবারই ঠিকানা।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.