বছর শেষে কেমন আছেন গাজাবাসী

বছর শেষে ১৬তম মাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে গাজা যুদ্ধ। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির আন্তর্জাতিক আহ্বান সত্ত্বেও এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের কাছে আশার আলো দেখা দেয়নি। ১১ই ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ দু’টি গুরুত্বপূর্ণ রেজ্যুলেশন অনুমোদন করে। তাতে অবিলম্বে, নিঃশর্ত এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি আহ্বান করা হয় গাজায়। পাশাপাশি অবিলম্বে এবং শর্তহীনভাবে হামাসের হাতে আটক সব জিম্মির মুক্তি দাবি করা হয়। পরিষদ থেকে নিয়ার ইস্টে ফিলিস্তিনের শরণার্থী বিষয়ক ত্রাণ ও ওয়ার্ক বিষয়ক এজেন্সিকে (ইউএনআরডব্লিউএ) তাদের ম্যান্ডেটের জন্য পূর্ণাঙ্গ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা হয়। ধারণা করা হয় এটা হলো কয়েক লাখ মানুষের লাইফলাইন। এ ছাড়া এই এজেন্সির ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেট একটি প্রস্তাব পাস করে। জাতিসংঘ তার বিরুদ্ধে নিন্দা জানায়। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর হামাস আকস্মিক ইসরাইলের দক্ষিণে দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালায়। তাতে নিহত হয় প্রায় ১২০০ মানুষ। হামাস জিম্মি করে প্রায় ২৪০ জনকে। এরপর থেকেই গাজার ওপর সীমাহীন ও বাধাহীন বোমা হামলা শুরু করে ইসরাইল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, এসব হামলায় নিহত হয়েছেন প্রায় ৪৫ হাজার ফিলিস্তিনি। ধ্বংস হয়েছে বাড়িঘর, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পয়ঃনিষ্কাশন সেবা, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ। বহু বাড়িঘরে একাধিকবার বোমা হামলা হয়েছে। গাজায় শতকরা কমপক্ষে ৮৩ ভাগ মানবিক ত্রাণ প্রবেশে বাধা দেয় ইসরাইল। গাজাবাসীর জন্য যথেষ্ট নয় এমন ত্রাণ বহনকারী গাড়িবহরে লুটপাট হয়। এর ফলে গাজায় অকল্পনীয় খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়। খাদ্য সংকট এবং অন্যান্য সংকটের ফলে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ অনাহারে বা অন্যান্য দুর্বিপাকে ভুগছেন। ডিসেম্বরের শুরুতে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করেছে যে, গাজার খাদ্য ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সেখানে প্রতিটি অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের উচ্চ ঝুঁকি আছে। গাজার উত্তরাঞ্চলে প্রায় তিন মাস কোনো সহায়তা, ত্রাণ পৌঁছেনি। সেখানে ৬৫ হাজার ফিলিস্তিনি দুর্ভিক্ষের অত্যাসন্ন হুমকিতে। নভেম্বরে নিরপেক্ষ ফেমিন রিভিউ কমিটি সতর্ক করে বলেছে, গাজার এই অংশে দুর্ভিক্ষাবস্থা অনেক আগেই অতিক্রম করেছে অথবা নিকট ভবিষ্যতে তা অতিক্রম করবে। ১লা এপ্রিল গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রিপোর্ট করেছে যে, উত্তরাঞ্চলে অপুষ্টিতে এবং পানিশূন্যতায় ভুগে হাসপাতালে মারা গেছে ২৮ শিশুসহ ৩২ জন। কামাল আদোয়ান এবং আল আওদা হাসপাতালে শিশুরা অনাহারে মারা যাচ্ছে- এমন ঘটনা মার্টে প্রামাণ্য আকারে তুলে ধরেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলে ত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ এজেন্সিগুলো রিপোর্ট করেছে যে, শতকরা ৫ ভাগ শিশু, যাদের বয়স দুই বছরের নিচে, তারা মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এসব কারণে এবং গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)। রায়ে বলা হয়েছে, যদি তারা এই আদালতের সদস্য ১২৪টি দেশের কোনোটিতে সফর করেন, তাহলে তাকে বা তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। নভেম্বরের শেষের দিকে নেতানিয়াহু, ইয়োভ গ্যালান্ট এবং হামাসের কমান্ডার মোহাম্মদ দিয়েফের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তবে ইসরাইলের দাবি জুলাইয়ে তারা মোহাম্মদ দিয়েফকে হত্যা করেছে। তবে তাকে হত্যা করা হয়েছে নাকি তিনি জীবিত আছেন- এ বিষয়ে আইসিসি কোনো মন্তব্য করেনি। আইসিসি তার রায়ে বলেছেন, নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে মানুষকে অনাহারে রাখার কৌশল ব্যবহার করেছে। এর মধ্যদিয়ে তারা যুদ্ধাপরাধ করেছে। হত্যা, নিষ্পেষণ ও অন্যান্য অমানবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। এই ফৌজদারি অপরাধের দায় নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের। আইসিসি’র যৌক্তিক কারণ রয়েছে যে, মোহাম্মদ দিয়েফও হত্যা, নির্যাতন, অন্যান্য যৌন নির্যাতন, জিম্মি আটকসহ বিভিন্ন অপরাধের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ করেছে।
কিছু সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন আরও একটু অগ্রসর হয়েছে। সম্প্রতি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক রিপোর্টে বলেছে, দখলিকৃত গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে ইসরাইল এবং তা অব্যাহত আছে। গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার জন্য ইসরাইলকে প্রথম দায়ী করে যেসব দেশ তার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা অন্যতম। এমনকি তারা জানুয়ারিতে আইসিসিতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলা করে। দাবি করা হয়, ইসরাইল জোনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার এই মামলায় যোগ দেয় বা স্বাক্ষর করে বিশ্বের কমপক্ষে ১৪টি দেশ। এরমধ্যে আছে স্পেন, বেলজিয়াম, তুরস্ক, মিশর এবং চিলি।
২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে যে হামলা হয় ইসরাইলে তাতে ইউএনআরডব্লিউএ’র বেশ কিছু কর্মী জড়িত বলে জানুয়ারিতে অভিযোগ করে ইসরাইল। এমন অভিযোগে ওই এজেন্সি তদন্ত শুরু করে। এ সময়ে ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করে রাখে অনেক পশ্চিমা দাতা। তদন্ত শেষে ৯জন কর্মীকে দায়ী দেখিয়ে তাদের বরখাস্ত করে ইউএনআরডব্লিউএ। যুক্তরাষ্ট্র বাদে সব দাতা তাদের অর্থ আবার দেয়া শুরু করে। রিপোর্টে দেখা যায়, গাজায় ইউএনআরডব্লিউএ পরিচালিত স্কুলগুলোর মধ্যে শতকরা কমপক্ষে ৭০ ভাগ স্কুল ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরাইলের বোমা হামলায়। এসব স্কুলের শতকরা ৯৫ ভাগই ব্যবহার করা হতো ইসরাইলের হামলায় বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়স্থল হিসেবে। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা আশ্রয় নিয়েছিলেন গাজার দক্ষিণে আল মাওয়াসি ক্যাম্পে। এটাকে মানবিক নিরাপদ জোন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল ইসরাইল। কিন্তু ৪ঠা ডিসেম্বর সেখানেও হামলা চালায় তারা। যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই আল মাওয়াসি ক্যাম্প কয়েক লাখ বাস্তুচ্যুত গাজাবাসীর আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল। গাজায় এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে ইসরাইল হামলা চালায়নি, আর সেখানে রক্তপাত হয়নি। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.