হাসিনারে ফেলায় দেয়ার আন্দোলন বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান না কি জনঅভ্যুত্থান? by আর রাজী
‘প্লাবন’ শব্দটা আমাদের বেশ চেনা। ‘প্লব’-ও চেনা কিন্তু যখন তার আগে ‘বি’ থাকে তখন আরও ভালোভাবে চিনতে পারি তাকে (বি-+প্লব= বিপ্লব)। সরল শব্দার্থ কোষ বলছে: ‘প্লব’ হচ্ছে প্ল-তে বাহিত হয় যে। ‘প্ল’ হচ্ছে- ধারা, জলধারা। তাতে যে বা যা বাহিত হয় সে বা তা ‘প্লব’। যেমন হাঁস। আর ‘বিশেষ প্রকারের প্লব যাহাতে তাহাই বিপ্লব’। সমাজ-রাষ্ট্রেও ধারা থাকে- কর্মধারা যেমন। সেখানে যে ধারায় জন বা আমলারা ভেসে বেড়াচ্ছে তা বদলে গেলে, তখন তাকে বলা হয় ‘বিপ্লব’। ‘বিপ্লব’ এমন কিছু যা ধারাটা বদলে দেয় বা জলধারায় যা কিছু ভেসে বেড়াচ্ছিল তাদের ভেসে বেড়ানোটা বিশেষভাবে বদলে দেয়। এটা দৃশ্যমান কিছু। আপনি দেখতে পাবেন যে সমাজে ভেসে বেড়ানোর ধরন বদলে গেছে। ভালো বা খারাপ সেটা আলোচ্য না, বদলে চলা দৃশ্যমান হলে তা ‘বিপ্লব’। এটা ফল দেখে শনাক্ত করার বিষয়। খুঁজে বলতে হয় না যে সমাজ বা রাষ্ট্রে ‘বিপ্লব’ হয়েছে কি না?
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মধারা-রীতি-পদ্ধতি কিছুই বদলে যায়নি, কিছু লোকের বদল হওয়া ছাড়া। গত দশ বছর আগে যেমন ছিল এখনো তেমনি সবাই ভাসছেন। সমাজ-রাষ্ট্রের যে স্রোতধারা তা যেমন বদলে যায়নি, তাতে ভেসে বেড়ানো মানুষদের ভেসে বেড়েনোর প্রক্রিয়া-পদ্ধতিও বদলে যায়নি। সমাজ বা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ধারা বদল মানে ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্ক বদল। তেমন বদল কি হয়েছে? কেবল কিছু মানুষের বদলে নতুন অন্য কিছু মানুষ এসেছেন। সমাজে ক্ষমতালব্ধ ও ক্ষমতা-প্রলুব্ধ অংশের মধ্যে যে লড়াই সর্বক্ষণ চলে তাতে এক পক্ষকে সরিয়ে আর এক পক্ষ ক্ষমতা নিয়েছেন। আর নতুন যারা ক্ষমতা পেয়েছেন তারা একইভাবে ভেসে বেড়াচ্ছেন। এ বিবেচনায় ৫ই আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রে বিপ্লব হয়েছে সে কথা মান্যতা পায় না। অনেকেই একে ‘অভ্যুত্থান’ বলছেন। একে কি ‘অভ্যুত্থান’ বলা যায়? ‘অভ্যুত্থান’ কাকে বলে? মানে, আমাদের বাংলাভাষায় ‘অভ্যুত্থান’ বলতে কী বুঝায়?
‘অভ্যুত্থান’ হচ্ছে- ‘অভির কারণে উত্থান যাহাতে’। ‘অভি’ বুঝায় উপরে স্থিত থাকা। অভিভাবক শব্দটা তো আমরা জানি। উপরে থেকে যিনি ‘ভাবক’ হিসেবে থাকেন- আমার উপরে স্থিত থেকে যিনি আমার ভাবনাকে প্রভাবিত করেন বা করতে পারেন তিনিই আমার অভিভাবক। একইভাবে উপরিস্থিত কারণে যে উত্থান তাকে বলে ‘অভি+উত্থান= অভ্যুত্থান’। ৫ই আগস্ট ২০২৪-এ এই রাষ্ট্রে যা ঘটছে তা আমরা দেখেছি। উপরে, মানে রাষ্ট্রের মাথায় যারা ছিলেন তাদের কারণে সৃষ্ট বিরক্তিতে বা যন্ত্রণায় বা অন্য কোনো কারণে জনতার উত্থান ঘটেছে। রাষ্ট্রজন রায়ে যেখানে ছিলেন সেখান থেকে তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন, উত্থিত হয়েছেন এবং যারা ক্ষমতার আসনে বসে ছিলেন তাদের আসন থেকে উঠিয়ে দিয়েছেন। একটা দ্রোহ ছিল মানুষের মনে, বিশেষ সেই দ্রোহ অর্থাৎ বিদ্রোহের কারণে তাদের ‘উত্থান’ ঘটেছে। ফলত অন্যদের ‘পতন’ ঘটেছে। তার মানে ঘটনা যা ঘটেছে তাকে আমরা ‘অভ্যুত্থান’ বলতে পারি। কিন্তু তা কি ‘গণঅভ্যুত্থান’? না কি তাকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে, আরও যথাযথভাবে নামাঙ্কিত/বিশেষায়িত করার সুযোগ রয়েছে? কী নামে সেই অভ্যুত্থানকে অভিহিত করা অধিকতর সঙ্গত হবে? আর ৫ই আগস্টের ব্যাপারটাকে কেন একটা যথাসঙ্গত নামে অভিহিত করা অত্যাবশ্যক সে প্রশ্নেও তা ওঠার কথা, তাই খুবই স্বল্প কথায়ে লেখার শেষে আছে তার উত্তর।
২.
অভূতপূর্ব, সিনেমেটিক এক অভ্যুত্থানের মুখে পড়ে আগস্টের ৫ তারিখে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে গেলেন। এরপর থেকে আমাদের শিক্ষিত-বাঙালি গোষ্ঠী ‘ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান’- হিসেবে ওই ঘটনাকে উল্লেখ করতে শুরু করলো। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া তার প্রথম ভাষণে একে ‘ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান’ বলে উল্লেখ করলেও পরের ভাষণে একে ‘ছাত্র-শ্রমিক-গণঅভ্যুত্থান’ বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ ‘ছাত্র-জনতা-সৈনিকদের ঐক্যকে’ অভ্যুত্থানের শক্তি বলে চিহ্নিত করেছেন। এইভাবে সমাজ-রাষ্ট্রের বিভিন্ন বর্গকে স্বীকৃতি দেয়ার যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে আগামীতে এই অভ্যুত্থানকে ছাত্র-শ্রামিক-কৃষক-মজুর-সৈনিক ইত্যাদি ইত্যাদি বর্গযুক্ত ‘গণঅভ্যুত্থান’ বলার পরেও কোনো না কোনো বর্গ বাইরে থেকে যেতে পারে আর তারা নিজেদের ‘নীরবতার শিকার’ হিসেবে হীনতায় ভুগতে এবং দুঃখ পেতে পারেন। আবার এক বর্গ অন্য আর এক বর্গকে উহ্য রেখে প্রতিশোধও নিতে পারে। অবশ্য এখন পর্যন্ত মোটাদাগে ‘ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান’ হিসেবেই একে নির্দেশ করা হচ্ছে। দু’-একজন পণ্ডিত ‘ছাত্র’-এর বদলে ‘শিক্ষার্থী’ শব্দ যুক্ত করছেন ছাত্রের সাথে ছাত্রীদেরও অংশভাগ নিশ্চিত করার লৈঙ্গিক সমতা বজায় রাখার তাগাদা থেকে (যদিও ব্যাকরণ বলে- ছাত্রের স্ত্রী হচ্ছেন ছাত্রী)।
৩.
ইংরেজি ‘গ্যাং’ শব্দটা মাথায় রাখলে বাংলা ‘গণ’ প্রত্যয়টা বুঝা সহজ হতে পারে। ‘গণ’ এমন এক এক দল মানুষকে বুঝায় যারা দলপতির অধীনে একসঙ্গে জীবিকা অর্জনের কর্ম করেন। মানে একই ধরনের কাজ করে এমন দলবদ্ধ মানুষ হচ্ছে ‘গণ’। বঙ্গীয় শব্দকোষে হরিচরণ ‘গণ’-এর অর্থ দিয়েছেন সমূহ, নিচয়, সমুদয়। যেমন- পিতৃগণ, সখীগণ, নারীগণ ইত্যাদি। আর তিনি ‘গণ’ শব্দের যে বিবরণ দিয়েছেন তা হচ্ছে- ‘যাহারা মিলিতভাবে এক কার্য্যদ্বারা জীবিকা‘র্জ্জন করে (মেধাতিথি), সমবায়, সংঘ।’ খেয়াল করে দেখেলে তা, এই যে ‘আন্দোলন’ হলো- এখানে একই ধরনের কাজ করেন এমন মানুষ একসঙ্গে রাস্তায় নেমেছিলেন কি না? গার্মেন্টসের লোকজন বা পরিবহন শ্রমিক বা কৃষক, নির্মাণ শ্রমিক বা রিকশাওয়ালারা কি একসঙ্গে দলবেঁধে আন্দোলনে নেমেছিলেন, কারও নেতৃত্বে বা দলপতির অধীনে? শিক্ষকরা নেমেছিলেন, কাউকে নেতা মেনে? নামেন নাই। কিন্তু এই আন্দোলনে গার্মেন্টসের অনেক শ্রমিক ছিলেন, পরিবহন শ্রমিক ছিলেন, রিকশাওয়ালা ছিলেন। (কৃষক যদিও আমার নজরে পড়ে নাই!) এরা যে ছিলেন তারা দল, গ্যাং বা গণ হিসাবে ছিলেন না, ‘রহিমুদ্দীন গং নামছিল’- বলার উপায় নাই। তারা হাজির ছিলেন এক একজন বিচ্ছিন্ন ও একক পূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে। আমার দেখা-জানা বলছে- ছাত্রদের সবচেয়ে বড় যে অংশ হাজির ছিলেন তারাও দল বা গ্যাং হিসেবে না- যার যার অন্তর ও/বা বিবেকের তাড়নায় রাজপথে নামছিলেন। এমনও দেখছি, কুরিয়ারের ডেলিভারিম্যান, পানির ফিটিংমিস্ত্রী তার কাজ রেখে আন্দোলনে সক্রিয় আছেন, অনেক ক্ষেত্রে গলায় যে কোনো একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড ঝুলিয়ে নিয়ে, ছাত্র সেজে আন্দোলনে ছিলেন তারা। রাজনৈতিক দলগুলার কর্মীদের বিপুল অংশগ্রহণ দেখেছি কিন্তু সে ক্ষেত্রেও তারা দল না, ব্যক্তি হিসেবে হাজির ছিলেন। শেষদিকে এই হাজিরা তালিকায় অনেক অনেক ছাত্রলীগ-কর্মীও দেখেছি, সদ্য দলত্যাগীকে দেখেছি হাসিনার পতন নিশ্চিত করতে জীবন দিতেও প্রস্তুত- ১৬/১৭ই জুলাইয়ের পর তারা ভাইয়ের রক্তের বদলা নিতে চাইছিলেন এবং নিয়েই ঘরে ফিরেছেন।
এই যে, বিচ্ছিন্ন একক ব্যক্তি তিনিই ‘জন’। বঙ্গীয় শব্দকোষে বলা হয়েছে- ‘জন’ ধাতুটির অর্থ জনন, উৎপত্তি, হওয়া থেকে শুরু করে জন্মী, জীব ইত্যাদি অর্থ বহন করে। বাংলায় ‘জন’ ‘পুরুষ’ (নর না) অর্থেও ব্যবহৃত হয়- ‘জানেন যে জন (অন্তর্যামী যিনি)।’ কিন্তু মৈথিলি ভাষায় ‘জন’ শব্দের অর্থ শ্রমজীবী, মজুর। হরিচরণ আলালের ঘরে দুলাল থেকে ‘জন’ শব্দের ব্যবহারের যে উদাহরণ দিয়েছেন তা হচ্ছে- ‘জনখাটা ভরসা’। বাংলা ভাষাতেও এমন অসংখ্য ব্যবহার রয়েছে যেখানে ‘জন’ হচ্ছে একক মানুষ, ব্যক্তি মানুষ। আমরা যেমন বলি- কতজন এলো গেল/ জনে জনে কথা বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে/সে আমার আপনজন ইত্যাদি। এ সবের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘জন' একক ব্যক্তিকে, বিচ্ছিন্ন মানবসত্তাকে নির্দেশ করে।
৪.
ছাত্ররা আন্দোলনে ছিলেন, তবে সব লোক-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার পর ঢাকার ‘রাজনীতিমুক্ত’ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, যারা রাজনৈতিক দলভুক্ত বলে কখনো কেউ মানেননি, তারা বিপুলভাবে রাজপথে হাজির হয়েছিলেন। লীগ নিয়োজিত মাস্তানবাহিনীর যাচ্ছেতাই আচরণ, পথে পথে মোবাইলে চক/ কেড়ে নেয়া, সন্দেহ হলেই চড়থাপ্পড় ইত্যাদি তাদের সম্ভবত ত্যাক্তবিরক্ত করে তুলছিল। পুলিশের মাতব্বরি, শেখ হাসিনাসহ সরকারি লোকদের আহাম্মকের মতো ব্যাটাগিরি এই ছাত্রদের পথে নামতে ‘তাগাদা’ দিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু আমার চোখে- ছাত্রদের এই হাজিরা এমন মাত্রায় ছিল না যে তাতে সরকার পড়ে যেতে পারে। দেখেছি- আইডি ঝুলানো কিছু তরুণ, যারা আসলে একে-অপরকে চেনেনও না, তারা রাস্তায় দাঁড়ালেই আশপাশেরে লাকজন বিপুলভাবে তাদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে গেছেন। এই পরস্পর বিচ্ছিন্ন মানুষগুলো যেন যুগযুগান্তরের ক্ষোভকে আগুন করে ছড়িয়ে দিতে চাইছিলেন। ‘হাসিনাগংকে ফেলে দেওয়ার যুদ্ধে’ তারা শহীদ হওয়ার জন্য যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন!
এই মানুষগুলো যখন পথে নেমে এসেছেন, আন্দোলনের সামনে চলে গেছেন তখন ছাত্রদের ভূমিকা আর মুখ্য থাকেনি। তবে ছাত্রদের যদি কেউ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে চেয়েছে মানুষ তাকে বাধা দেয়নি, আহ্লাদও দেখায়নি। এই নেতৃত্ব দেয়া ছাত্ররাও একক সিদ্ধান্তে, একা সাহস করে, দল ছাড়াই ওই ঝুঁকি গ্রহণে ব্রতী হয়েছিলেন বলেই আমার পর্যবেক্ষণ।
৫.
আন্দোলনে একটা ছোট ফিচার ধরা পড়েছে আমার চোখে। ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মনে হয়েছিল আন্দোলন থমকে যেতে পারে। পরে খেয়াল করলাম- আন্দোলন যারা করছে, সোশ্যাল মিডিয়া বা নিউজ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নাই। এমন কি ইন্টারনেট থাকাকালেও সোশ্যাল মিডিয়ার ইনফ্লুয়েন্সাররা কে কী বলে চলেছেন তা শোনার ‘টাইম নাই’ তাদের। তারা যেন বুঝে গিয়েছিলেন- তারাই নিউজ-মেকার। তারা নিউজের এলিমেন্ট নন। আর যারা প্রতিদিন আন্দোলনে নেমেছেন, তারা তো স্মার্টফোনে ছেড়ে বাটন ফোন ধরেছিলেন! নাগরিকদের একটা অংশ জীবনের সবরকম মায়া ছেড়েই ‘হাসিনারে ফেলে দিতে’ পথে ছিলেন। কিন্তু তাই বলে সামাজিক মিডিয়ার ভাষ্যকার, বিশ্লেষকদের বিপুল অংশগ্রহণ ছাড়া এই আন্দোলন পরিণতি পেত বলে মনে করার কারণ নাই। অথচ ইনারা কেউ গ্যাং ধরে এসব কিছু করছেন, সমিতি বানিয়ে তা করছেন অর্থাৎ ‘গণ’ হিসেবে আন্দোলনে হাজির ছিলেন বলে সাদা চোখে ধরা পড়েনি।
৬.
মাঝেমাঝে ভাবি, যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া-রামপুরা-আব্দুল্লাহপুর যদি রুখে না দাঁড়াতো তাহলে কী হতো? যাত্রাবাড়ীর মতো অনেক অনেক জায়গায় পরস্পর অপরিচিত ব্যক্তি বিপুল সংখ্যায় এবং নেতা/নেতৃত্ব ছাড়াই একান্ত ব্যক্তিগত দায়ে বাধ থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ‘হাসিনা গংরে ফেলে দিতে’ রাস্তায় নেমেছিলেন। এই আন্দোলনে মাদ্রাসার ছাত্রদের ভূমিকা বিশাল- কিন্তু তারা ‘তালিব’ হয়ে আন্দোলনে আসেন নাই, এসেছেন রাষ্ট্রের এক একজন নাগরিক বা রাষ্ট্রজন হয়ে।
৭.
ওপরের ভাষ্য যদি সত্য হয়- তাহলে ছাত্রদের কেন ‘গণ’-এর বাইরে রাখা হচ্ছে? তারা তো গণের অংশ হিসেবেই ক্রিয়াশীল ছিলেন। একই কথা প্রযোজ্য শ্রমিক বা অন্য যে কোনো বর্গের ক্ষেত্রে। তারা কেউই দল বা গ্যাং বা গণ হিসেবে হাজির ছিলেন না। তাহলে তারা কী পরিচয়ে হাজির ছিলেন? আমার প্রস্তাব হচ্ছে, তারা হাজির ছিলেন ‘জন’ হিসেবে। যে ‘জন’ হচ্ছে ‘একক ব্যক্তিসত্তা’। মানে দল বা গণ/গ্যাং না, নিজের স্বাধীন ইচ্ছায়, নিজের অংশ উপ-অর্জন করেছেন একেক ‘জন’। একজন, দুইজন, বহুজন- যারা পৃথক কর্তা-সত্তা নিয়া সমাজে/রাষ্ট্রে ক্রিয়া করেন, সেই জনে জনে একতা গড়ে তুলে জনতায় উত্থিত হয়েছিলেন।
৮.
জুলাই-আগস্টে যে আন্দোলন হয়েছিল তাকে সবচেয়ে কম কথায় যদি নির্দেশিত করতে চাই, তাহলে তা হচ্ছে- এইটা ছিল বাংলাদেশের শহুরে ব্যক্তি-মানুষের একেবারে ব্যক্তি হিসেবে ঝুঁকি নিয়ে ‘হাসিনারে ফেলে দেওয়ার’ আন্দোলন। যাকে ‘জন’ আন্দোলন বলে নির্দেশ করা সম্ভবত সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি বলে বিবেচিত হতে পারে। এই ‘জন’ আন্দোলনই ক্রমে পরিণতি পেয়েছে একটা সফল ‘জনঅভ্যুত্থান’ হিসেবে।
৯.
এই সংজ্ঞায়নের প্রয়োজনীয়তা এই কথাটি বলার জন্য যে, যেহেতু এটি ‘গণ’ নয় ‘জন’ অভ্যুত্থান ছিল ফলত এই জনঅভ্যুত্থানের দূরপ্রসারী কোনো স্বপ্ন/চিন্তা/ভাবনা ছিল না অথবা বলা যায় সামষ্টিক একটা স্বপ্ন/কল্প ‘প্রকল্প’ আকারে গড়ে ওঠার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন ছিল তা ওই আন্দোলন পায়ইনি। ‘হাসিনারে ফেলে দেওয়া’র লক্ষ্য পর্যন্ত জনে জনে একতা গড়ে তুলে জনতায় পরিণত হয়েছিল কিন্তু তারপরে কী হবে- সে বিষয়ে জন-তার ভাবনা-চিন্তা ছিল বলে কোথাও কোনো ইঙ্গিতও ছিল না। তাদের যদি কিছু বাসনা থেকেও থাকে, তার রূপায়ণ বা আকার ৫ই আগস্টের আগে দলগতভাবে সেই জনতার মাঝে উপস্থাপিত ও চর্চিত হওয়ার উদহারণ দুর্লক্ষণীয়।
১০.
আন্দোলন যখন দ্রুত রঙ বদলাচ্ছিল এবং ক্রমশ আরও রক্তাক্ত হয়ে উঠছিল- তখনও ‘হাসিনারে ফেলে দেয়ার পর’ কী তরিকায় সরকার গঠন হবে, কী তরিকায় রাষ্ট্র পরিচালিত হবে তা আমাদের শিক্ষিত-বাঙালি সমাজ জনপরিসরে হাজির করতে পারে নাই। অথচ এখন কত কথা হচ্ছে! ‘জনগণের আকাঙ্ক্ষা/অভিপ্রায়’ হিসেবে অনেকে যেন আকাশ ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিতে চাচ্ছেন! ‘জন’ কে ‘গণ’-এ পরিণত করা, তাকে গঠিত ও পরিগঠিত করা হয় তো সম্ভব কিন্তু ৫ই আগস্ট পর্যন্ত যে আন্দোলন চলেছে এবং ৫ই আগস্ট যে অভ্যুত্থান হয়েছে তাতে ‘গণ’-এর উপস্থিতি দৃশ্যমান ছিল না। যা ছিল তা জন-এর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। ওটি আদতে ছিল জন-অভ্যুত্থান। গণপরিসরে কথাবার্তা শুরু হলেও আজতক জনপরিসরে রাষ্ট্র-প্রকল্প নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরুই হয়নি।
বিচ্ছিন্ন একক মানুষের সাময়িক সমূহ হয়ে ওঠার পরিণতি যে জন-অভ্যুত্থান তা স্বল্প দূরত্বের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কার্যকর হয়েছে মানে এই না যে তা সুদূর লক্ষ্য পর্যন্ত তার যাত্রা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে। যদি জুলাই জনঅভ্যুত্থানকে ছেদবিন্দু ধরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে গঠন করতে হয়, রাষ্ট্রসংস্কার করতে হয়, যদি তার নতুন গঠনতন্ত্র নির্মাণ করতে হয়, তবে অবশ্যই প্রতিটি বিচ্ছিন্ন একক ব্যক্তিসত্তা বা জনকে মোকাবিলা করার মাধ্যমেই তা করতে হবে।
আধুনিক রাষ্ট্রগঠন মানে প্রতিটি ব্যক্তির সেই রাষ্ট্রের সংস্কারে ও/বা গঠনতন্ত্র নির্মাণেও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অর্থাৎ প্রতিজনের মতামত প্রতিফলিত করে এমন একটি গঠনতন্ত্র ওরফে সংবিধান এবং সংস্কার-প্রস্তাব তৈরি করা। সংস্কার-প্রস্তাব ও গঠনতন্ত্রে কেবল সেটুকুই থাকতে পারে বা গঠনতন্ত্রের কেবল সেটুকুই সংস্কার হতে পারে যতটুকুতে প্রতিটি মানুষের সম্মতি রয়েছে বা থাকবে। বাংলাদেশে যদি ‘গণঅভ্যুত্থান’ সংঘটিত হতো, অর্থাৎ কোনো একক নেতার নেতৃত্বধীন গণের (দলের) বা গণসমূহের (দলসমূহের) ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বে উত্থান হতো ‘গণ’-এর তাহলে সম্ভবত ‘জন’-এর মোকাবিলা না করেও নতুন একটা গঠনতন্ত্র ও সংস্কার-প্রস্তাব পেতে পারতো বাংলাদেশ। এভাবে সংস্কার ও গঠনতন্ত্র পেয়ে যাওয়া ভালো হতো না হয়ে তা কিন্তু কাজটা সহজ হতো। এখন আর তা সম্ভব না। যেহেতু ‘গণঅভ্যুত্থান’ না হয়ে হয়েছে ‘জনঅভ্যুত্থান’, সুতরাং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠনে (প্রতি)জনকে মোকাবিলার দীর্ঘ যাত্রাপথ অতিক্রম করা এখন রাষ্ট্রজনদের জন্য আবশ্যিক শর্তে পরিণত হয়ে গেছে। এই পথে ছেঁটে ফেলে সহজে কার্যসিদ্ধি করার কথা যদি রাজনীতিকরা ভাবেন তাহলে নিশ্চিত জানবেন- জনমানুষ তা অন্তর থেকে গ্রহণ করবে না এবং ফলত সে গঠনতন্ত্র বা রাষ্ট্রসংস্কার স্থায়িত্বও পাবে না। কাঙ্ক্ষিত সংস্কার, কাঙ্ক্ষিত সংবিধান, ও কাঙ্ক্ষিত সমাজ-রাষ্ট্র পাওয়ার কোনো সহজ-সংক্ষিপ্ত পথ নাই। জনঅভ্যুত্থান তা তৈরি করে দেয় না। দীর্ঘ ও যত্নশীল চেষ্টা ও সাধনাতই তো কেবল হাসিল হতে পারে। জুলাই জনঅভ্যুত্থান সেই পথযাত্রার দুয়ার উন্মুক্ত করেছে মাত্র।
লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments