পশ্চিমবঙ্গের ভোটচিত্র
কী হয়েছে কে জানে, এল নিনো নাকি মানুষের পাপের বোঝা, পশ্চিমবঙ্গ ফুটিফাটা হয়ে রয়েছে। চৈত্র গেল, বৈশাখও নয় নয় করে কটা দিন কাটিয়ে দিল। হাওয়া অফিস নিত্যদিন কালবৈশাখীর আশা দেখিয়ে দেখিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে রয়েছে। কলকাতাসহ গোটা রাজ্যে ‘নাই রস নাই, দারুণ দাহন বেলা’। প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বেড়ে চলেছে নির্বাচনী তাপ-উত্তাপ। এরই মধ্যে দেশের পঞ্চম ও রাজ্যের প্রথম দফার ভোটটা হয়ে গেল। উত্তরবঙ্গের মাত্র চারটি আসনে এই দাবদাহেও ভোট পড়ল ৮০ শতাংশের বেশি। গ্রীষ্মের ভ্রুকুটি ভোটারদের ভয় দেখাতে ব্যর্থ।
পশ্চিমবঙ্গকে যাঁরা ভাগ হতে দেব না বলে চিল চিৎকার করেন, সেই কবে তাঁরাই কিন্তু অজান্তে রাজ্যটাকে ভাগ করে দিয়েছেন। একটি পশ্চিমবঙ্গ, অন্যটি উত্তরবঙ্গ। দক্ষিণের তুলনায় তারা ব্রাত্য, এটাই উত্তরের চিরকালীন অভিমান। সেই অভিমানে প্রলেপ আজও কেউ সেইভাবে দিতে পারেননি। উত্তরের সব কিছুই কম কম। জনসংখ্যা কম, জমি কম, বৈভব কম, প্রভাব কম, লোকসভা-বিধানসভার আসনও কম। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও দার্জিলিংয়ের চারটি আসন বাদ দিলে বাকি থাকে রায়গঞ্জ, বালুরঘাট, মালদহের দুটি আসন। উত্তর ও দক্ষিণের সেতু হিসেবে মুর্শিদাবাদ জেলার আসন আরও তিনটি। এই ১১টা আসনই ঐতিহাসিকভাবে
কংগ্রেস ও বামপন্থীদের অকাতরে দাক্ষিণ্য বিলি করে এসেছে এত দিন। এই প্রথম দিদি মমতার দাপাদাপিতে সেখানেও ঘাসফুল ফোটার প্রতীক্ষা। দক্ষিণের পাশাপাশি উত্তরেও আধিপত্য বিস্তারে তৃণমূল কংগ্রেস মুখিয়ে আছে।
মুখিয়ে রয়েছে আরও একটি দল। বিজেপি। সারা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির উচ্ছ্বাস চোখে পড়ছে। শ্যামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজ্য হলেও পশ্চিমবঙ্গ কোনো দিনই ভারতীয় জন সংঘ কিংবা ভারতীয় জনতা পার্টিকে কোল পেতে দেয়নি। বরং গোটা রাজ্যটাই আড়ে-বহরে বিভাজিত ছিল বামপন্থা ও কংগ্রেসের মধ্যে। কংগ্রেস ক্রমে দুর্বল হয়ে জন্ম দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের, বামপন্থীরাও ভাঙতে ভাঙতে দুর্বল হয়ে গত কবছরে নখদন্তহীন সিংহে পরিণত। সেই ফাঁক দিয়ে নরেন্দ্র মোদির চওড়া কাঁধে চেপে টুক করে এ রাজ্যে ঢুকে পড়ে বিজেপি প্রবল চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এতটাই প্রবল সেই চাপ যে এযাবৎ ‘আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে’র মতো হাবভাব করে আসা মমতা প্রতিদিন নিয়ম করে বিজেপির বাপবাপান্ত শুরু করেছেন। যে-দলের সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্কের কাহিনি তুলে ধরে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা এতদিন কটাক্ষ করে আসছিলেন, সেই দলকেই তুলাধোনা করতে মমতা এখন ছাড়ছেন না মুসলমান ভোট হারানোর আশঙ্কায়।
সত্যি বলতে কি, পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচনে বিজেপিই হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল আকর্ষণ। দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে জমিয়ে রাখা বাঙালি এই রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও বামপন্থাকে আঁকড়ে বাঁচার রসদ খুঁজে পেতে ভালোবাসছিল। অযোধ্যা আন্দোলনেও তাই তারা সেভাবে আন্দোলিত হয়নি। ১৯৯৮, ১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটে দমদম কেন্দ্র থেকে তপন সিকদার এবং ১৯৯৯ সালে কৃষ্ণনগর থেকে সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় জিতে কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছিলেন। ’৯৮ সালে অশোকনগর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিজেপির বাদল ভট্টাচার্য জিতে বিধানসভাতেও গিয়েছিলেন। হাবড়া পুরসভাও দখল নিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু ওই পর্যন্ত। বিজেপির পদ্ম রাজ্যে আর প্রস্ফুটিত হয়নি। সেই নিরুত্তেজ, নির্বিষ বিজেপির হঠাৎ কী হলো, এই প্রবল বিক্রমে উঠে আসার কারণগুলো কী, সেসব নিয়ে রীতিমতো শুরু হয়ে গেছে গবেষণা। প্রধান কারণ হিসেবে যা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, সেটাই এত দিন ছিল মমতার ‘ইউএসপি’। নরেন্দ্র মোদির ‘কঠোর কঠিন নেতৃত্ব’।
২০০৯ কিংবা তারও আগে থেকে বামপন্থী নেতৃত্ব যে-চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে যায়, তার নাম ছিল মমতা। আজ গোটা রাজ্যে বামপন্থীদের নেতৃত্বহীনতার জন্য দায়ীও তাঁরাই। সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সেই বিমান বসু, সেই গৌতম দেব, সেই শ্যামল চক্রবর্তী ছাড়া সিপিএম বা অন্যরা নতুন নেতা তুলে আনতে পারল না। কংগ্রেসকে খান খান করে ভেঙে মমতা তাঁর দল ভারী করার পাশাপাশি শতাব্দী-প্রাচীন দলটিকেও তিনি অনাথ করে দিয়েছেন। রাজ্যে নেতা বলতে তিনিই এক থেকে ১০ নম্বরে। এই নেতৃত্বহীনতায় হঠাৎই জাতীয় স্তরে নরেন্দ্র মোদির উত্থান এবং তাঁর ডানায় ভর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আচমকাই বেড়ে ওঠা। মমতার শরীরী ভাষার সঙ্গে মোদির শরীরী ভাষার দুর্দান্ত মিল। দুজনেই বোঝাতে সফল যে তাঁদের নেতৃত্ব পলকা নয়। তাঁরা কঠিন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ নন। তাঁরা সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা প্রথম প্রজন্মের রাজনীতিক, তাঁরা সোনা বা রুপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি। তাঁদের ‘পেডিগ্রিও’ অতি সাধারণ। বাপ-চাচার উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁরা রাজনীতিতে আসেননি। এই যে আমি তোমাদেরই লোক, আমি নির্লোভ, আমি স্বজন-পোষণ করি না (দুজনেই অবিবাহিত), আমি চোরচোট্টা নই ভাবমূর্তি, এ থেকেই তাঁরা এক অন্য ধরনের স্বপ্ন বেশ ভালোভাবেই ফেরি করতে পেরেছেন। ফলে, বর্ষায় লাউগাছের লকলকিয়ে ওঠার মতো রাতারাতিই বিজেপি এই রাজ্যে আগাপাছতলায় ছড়িয়ে পড়েছে। সেটাই হয়েছে মমতার শিরঃপীড়ার কারণ।
বিজেপি এই রাজ্যে পাঁচ-ছয় শতাংশের বেশি ভোট সাধারণত পায় না। ১৯৯১ সালের অযোধ্যা আন্দোলন এ রাজ্যে বিজেপিকে ১১ শতাংশ ভোট এনে দিলেও কোনো আসন দিতে পারেনি। কংগ্রেসের প্রায় পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হাল, তৃতীয় ফ্রন্টের অকালমৃত্যু, ফেডারেল ফ্রন্টের আঁতুড়ঘরেই শেষ হয়ে যাওয়ার কাহিনি ও মোদি-রাজত্ব কায়েম হওয়ার জনপ্রিয় ধারণা এ রাজ্যে বিজেপিকে আশাতীত স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এতটাই যে এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ৪২টি আসনেই প্রার্থী দিয়ে অন্তত ১০-১২টিতে শাসক দলকে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। বিজেপি এতটাই আশাবাদী যে অন্তত আটটি আসনে তারা নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছে। স্বপ্ন দেখছে অন্তত তিন-চারটি আসন জেতারও।
উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং ও আলিপুরদুয়ার, দক্ষিণবঙ্গের কৃষ্ণনগর, বসিরহাট, বারাসাত, দমদম, কলকাতা (উত্তর), হাওড়া, শ্রীরামপুর ও আসানসোলে বিজেপি কার পৌষ মাস ও কারই বা সর্বনাশের কারণ হবে, এই মুহূর্তে তা বলা যাচ্ছে না। বিভিন্ন জরিপে অন্তত ১৫ শতাংশ ভোট বিজেপি পাবে বলা হয়েছে। এই পরিমাণ ভোট পেয়ে জেতা যে যায় না তা ঠিক, কিন্তু এটাও ঠিক যে এবার চতুর্মুখী লড়াই। ১০ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে বিজেপি কার জমি ঝুরঝুরে করে কাকে জেতাবে, সে কথা জোর দিয়ে কেউ বলতে পারছে না। বসিরহাটে দেখলাম, সিপিএম করা একদল লোক বিজেপির প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্যকে বলে গেলেন, তাঁরা বংশপরম্পরায় বামপন্থী হলেও এবার ভোট দেবেন বিজেপিকে। আবার শ্রীরামপুরে দেখলাম তৃণমূলে ভোট দেওয়া মুসলমানরা দলে দলে কংগ্রেসের পতাকা হাতে নিয়ে আবদুল মান্নানের মিছিলে পা মিলিয়ে আগেরবারের তৃণমূলের জেতা প্রার্থী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে গালমন্দ করছেন। এই কেন্দ্রে বিজেপির বাপ্পী লাহিড়ী সকাল ও সন্ধে ছাড়া হোটেলের বাইরে পা না ফেললেও লোকজন বলাবলি করছে, শাসক দলের লড়াইটা নাকি বাপ্পীরই বিরুদ্ধে। আসানসোলে বিজেপির আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী গায়ক বাবুল সুপ্রিয়র প্রভাব এমনই যে তৃণমূলের লোকজন হিমশিম খেয়ে একটার পর একটা অভিযোগ এনে বাবুলকে হেনস্তা করতে চাইছে। বিজেপি যেন নদীর কামট। নিঃসাড়ে কার পা কেটে নিয়ে যাবে জানা নেই। কেউ টেরও পাচ্ছে না ১৫ শতাংশ ভোট টেনে নিজের নাক কেটে কার যাত্রা ভঙ্গ করবে।
বিজেপি প্রথম ‘ফ্যাক্টর’ হলে দ্বিতীয় ‘ফ্যাক্টর’ মুসলমান মন। রাজ্যের ৪২টা আসনের মধ্যে ১৬টায় মুসলমান ভোট হারা-জেতার মালিক। তাদের দল বা গোষ্ঠীবদ্ধতাই ঠিক করে দেবে কে জিতবে কে হারবে। এই ১৬ আসনের মধ্যে ছয়টিতে মুসলমানরা বরাবর কংগ্রেসকে সাথ দিয়ে আসছে। বাকিগুলোতে তৃণমূল কংগ্রেসকে। বিজেপির সঙ্গে মমতার গোপন আঁতাতের খবর প্রচার করে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা মমতাকে প্রাথমিকভাবে ব্যাকফুটে ফেলেছিল। আশঙ্কিত মমতাও শেষ পর্যন্ত রাখঢাক না রেখে মোদিকে আক্রমণ শুরু করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলমান মন অনেকটা পেন্ডুলামের মতো দুলছে। বারাসাত, বসিরহাট, হাওড়া, উলুবেরিয়া, শ্রীরামপুরের মতো কেন্দ্রে মুসলমান ভোটে টাল খেলে মমতার কপালের ভাঁজ বাড়তে পারে।
এটা ঠিক, ভোটের বাজারে ক্ষমতাসীন দল বাড়তি সুবিধা পায়। তৃণমূল কংগ্রেস তা পাচ্ছেও। আবার এটাও ঠিক, বিভিন্ন জেলায় অন্তর্দ্বন্দ্ব তাদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোণঠাসা করে রেখেছে। রাজনৈতিক লোকজনের ওপর ভরসা না রেখে মমতা এই যে বিনোদনের জগৎকে প্রাধান্য দিলেন, তারও একটা অঙ্ক রয়েছে। ঘাটাল, বাঁকুড়া বা মেদিনীপুরে গোষ্ঠীবাজি এতই তীব্র যে শেষ পর্যন্ত দেব, মুনমুন, সন্ধ্যা রায়কে বেছে মমতা দল সামলালেন। রাজনীতিটা হলো, যুযুধান শিবির এটা বুঝবে যে মুনমুন, দেব বা সন্ধ্যা রায়েরা জিতে আর সেভাবে কেন্দ্রমুখী হবেন না। গোষ্ঠীপতিরা তাঁদের রাজত্ব চালিয়ে যাবেন, যেমন চালাচ্ছেন এখন।
গতবারের ভোটে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট ছিল। এবার কংগ্রেস একার শক্তিপরীক্ষায় নেমেছে। তারা যেটুকু ভোট পাবে, সেটুকুই কাটা যাবে তৃণমূলের ভোট। বামপন্থীরা কতটা শক্তি সঞ্চয় করেছে বা আরও হীনবল হয়েছে কি না, হবে তার পরীক্ষাও। বিজেপি কার পাকা ধানে মই দেবে জানা নেই। তবু তৃণমূল কংগ্রেস গতবারের ২০টা (জয়নগর আসন পেয়েছিল জোটসঙ্গী এসইউসিআই) আসন বাড়িয়ে ২৫-২৬টা পাবেই বলে ধরে নিয়েছে। চমক সেটা অবশ্য হবে না। কেন্দ্রে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার গড়লে এবং এ রাজ্যের সমতলে বিজেপি বহু বছর পর ফের খাতা খুললে (সঙ্গে ১৫-১৬ শতাংশ ভোট) রাজ্যে আগামী দিনের রাজনীতির রংটাই কিন্তু পাল্টে যাবে। সীমান্ত-রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কাছে সেটা আশীর্বাদ, না অভিশাপ—ভবিষ্যৎই তার জবাব দেবে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
পশ্চিমবঙ্গকে যাঁরা ভাগ হতে দেব না বলে চিল চিৎকার করেন, সেই কবে তাঁরাই কিন্তু অজান্তে রাজ্যটাকে ভাগ করে দিয়েছেন। একটি পশ্চিমবঙ্গ, অন্যটি উত্তরবঙ্গ। দক্ষিণের তুলনায় তারা ব্রাত্য, এটাই উত্তরের চিরকালীন অভিমান। সেই অভিমানে প্রলেপ আজও কেউ সেইভাবে দিতে পারেননি। উত্তরের সব কিছুই কম কম। জনসংখ্যা কম, জমি কম, বৈভব কম, প্রভাব কম, লোকসভা-বিধানসভার আসনও কম। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও দার্জিলিংয়ের চারটি আসন বাদ দিলে বাকি থাকে রায়গঞ্জ, বালুরঘাট, মালদহের দুটি আসন। উত্তর ও দক্ষিণের সেতু হিসেবে মুর্শিদাবাদ জেলার আসন আরও তিনটি। এই ১১টা আসনই ঐতিহাসিকভাবে
কংগ্রেস ও বামপন্থীদের অকাতরে দাক্ষিণ্য বিলি করে এসেছে এত দিন। এই প্রথম দিদি মমতার দাপাদাপিতে সেখানেও ঘাসফুল ফোটার প্রতীক্ষা। দক্ষিণের পাশাপাশি উত্তরেও আধিপত্য বিস্তারে তৃণমূল কংগ্রেস মুখিয়ে আছে।
মুখিয়ে রয়েছে আরও একটি দল। বিজেপি। সারা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির উচ্ছ্বাস চোখে পড়ছে। শ্যামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজ্য হলেও পশ্চিমবঙ্গ কোনো দিনই ভারতীয় জন সংঘ কিংবা ভারতীয় জনতা পার্টিকে কোল পেতে দেয়নি। বরং গোটা রাজ্যটাই আড়ে-বহরে বিভাজিত ছিল বামপন্থা ও কংগ্রেসের মধ্যে। কংগ্রেস ক্রমে দুর্বল হয়ে জন্ম দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের, বামপন্থীরাও ভাঙতে ভাঙতে দুর্বল হয়ে গত কবছরে নখদন্তহীন সিংহে পরিণত। সেই ফাঁক দিয়ে নরেন্দ্র মোদির চওড়া কাঁধে চেপে টুক করে এ রাজ্যে ঢুকে পড়ে বিজেপি প্রবল চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এতটাই প্রবল সেই চাপ যে এযাবৎ ‘আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে’র মতো হাবভাব করে আসা মমতা প্রতিদিন নিয়ম করে বিজেপির বাপবাপান্ত শুরু করেছেন। যে-দলের সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্কের কাহিনি তুলে ধরে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা এতদিন কটাক্ষ করে আসছিলেন, সেই দলকেই তুলাধোনা করতে মমতা এখন ছাড়ছেন না মুসলমান ভোট হারানোর আশঙ্কায়।
সত্যি বলতে কি, পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচনে বিজেপিই হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল আকর্ষণ। দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে জমিয়ে রাখা বাঙালি এই রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও বামপন্থাকে আঁকড়ে বাঁচার রসদ খুঁজে পেতে ভালোবাসছিল। অযোধ্যা আন্দোলনেও তাই তারা সেভাবে আন্দোলিত হয়নি। ১৯৯৮, ১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটে দমদম কেন্দ্র থেকে তপন সিকদার এবং ১৯৯৯ সালে কৃষ্ণনগর থেকে সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় জিতে কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছিলেন। ’৯৮ সালে অশোকনগর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিজেপির বাদল ভট্টাচার্য জিতে বিধানসভাতেও গিয়েছিলেন। হাবড়া পুরসভাও দখল নিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু ওই পর্যন্ত। বিজেপির পদ্ম রাজ্যে আর প্রস্ফুটিত হয়নি। সেই নিরুত্তেজ, নির্বিষ বিজেপির হঠাৎ কী হলো, এই প্রবল বিক্রমে উঠে আসার কারণগুলো কী, সেসব নিয়ে রীতিমতো শুরু হয়ে গেছে গবেষণা। প্রধান কারণ হিসেবে যা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, সেটাই এত দিন ছিল মমতার ‘ইউএসপি’। নরেন্দ্র মোদির ‘কঠোর কঠিন নেতৃত্ব’।
২০০৯ কিংবা তারও আগে থেকে বামপন্থী নেতৃত্ব যে-চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে যায়, তার নাম ছিল মমতা। আজ গোটা রাজ্যে বামপন্থীদের নেতৃত্বহীনতার জন্য দায়ীও তাঁরাই। সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সেই বিমান বসু, সেই গৌতম দেব, সেই শ্যামল চক্রবর্তী ছাড়া সিপিএম বা অন্যরা নতুন নেতা তুলে আনতে পারল না। কংগ্রেসকে খান খান করে ভেঙে মমতা তাঁর দল ভারী করার পাশাপাশি শতাব্দী-প্রাচীন দলটিকেও তিনি অনাথ করে দিয়েছেন। রাজ্যে নেতা বলতে তিনিই এক থেকে ১০ নম্বরে। এই নেতৃত্বহীনতায় হঠাৎই জাতীয় স্তরে নরেন্দ্র মোদির উত্থান এবং তাঁর ডানায় ভর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আচমকাই বেড়ে ওঠা। মমতার শরীরী ভাষার সঙ্গে মোদির শরীরী ভাষার দুর্দান্ত মিল। দুজনেই বোঝাতে সফল যে তাঁদের নেতৃত্ব পলকা নয়। তাঁরা কঠিন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ নন। তাঁরা সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা প্রথম প্রজন্মের রাজনীতিক, তাঁরা সোনা বা রুপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি। তাঁদের ‘পেডিগ্রিও’ অতি সাধারণ। বাপ-চাচার উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁরা রাজনীতিতে আসেননি। এই যে আমি তোমাদেরই লোক, আমি নির্লোভ, আমি স্বজন-পোষণ করি না (দুজনেই অবিবাহিত), আমি চোরচোট্টা নই ভাবমূর্তি, এ থেকেই তাঁরা এক অন্য ধরনের স্বপ্ন বেশ ভালোভাবেই ফেরি করতে পেরেছেন। ফলে, বর্ষায় লাউগাছের লকলকিয়ে ওঠার মতো রাতারাতিই বিজেপি এই রাজ্যে আগাপাছতলায় ছড়িয়ে পড়েছে। সেটাই হয়েছে মমতার শিরঃপীড়ার কারণ।
বিজেপি এই রাজ্যে পাঁচ-ছয় শতাংশের বেশি ভোট সাধারণত পায় না। ১৯৯১ সালের অযোধ্যা আন্দোলন এ রাজ্যে বিজেপিকে ১১ শতাংশ ভোট এনে দিলেও কোনো আসন দিতে পারেনি। কংগ্রেসের প্রায় পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হাল, তৃতীয় ফ্রন্টের অকালমৃত্যু, ফেডারেল ফ্রন্টের আঁতুড়ঘরেই শেষ হয়ে যাওয়ার কাহিনি ও মোদি-রাজত্ব কায়েম হওয়ার জনপ্রিয় ধারণা এ রাজ্যে বিজেপিকে আশাতীত স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এতটাই যে এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ৪২টি আসনেই প্রার্থী দিয়ে অন্তত ১০-১২টিতে শাসক দলকে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। বিজেপি এতটাই আশাবাদী যে অন্তত আটটি আসনে তারা নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছে। স্বপ্ন দেখছে অন্তত তিন-চারটি আসন জেতারও।
উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং ও আলিপুরদুয়ার, দক্ষিণবঙ্গের কৃষ্ণনগর, বসিরহাট, বারাসাত, দমদম, কলকাতা (উত্তর), হাওড়া, শ্রীরামপুর ও আসানসোলে বিজেপি কার পৌষ মাস ও কারই বা সর্বনাশের কারণ হবে, এই মুহূর্তে তা বলা যাচ্ছে না। বিভিন্ন জরিপে অন্তত ১৫ শতাংশ ভোট বিজেপি পাবে বলা হয়েছে। এই পরিমাণ ভোট পেয়ে জেতা যে যায় না তা ঠিক, কিন্তু এটাও ঠিক যে এবার চতুর্মুখী লড়াই। ১০ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে বিজেপি কার জমি ঝুরঝুরে করে কাকে জেতাবে, সে কথা জোর দিয়ে কেউ বলতে পারছে না। বসিরহাটে দেখলাম, সিপিএম করা একদল লোক বিজেপির প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্যকে বলে গেলেন, তাঁরা বংশপরম্পরায় বামপন্থী হলেও এবার ভোট দেবেন বিজেপিকে। আবার শ্রীরামপুরে দেখলাম তৃণমূলে ভোট দেওয়া মুসলমানরা দলে দলে কংগ্রেসের পতাকা হাতে নিয়ে আবদুল মান্নানের মিছিলে পা মিলিয়ে আগেরবারের তৃণমূলের জেতা প্রার্থী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে গালমন্দ করছেন। এই কেন্দ্রে বিজেপির বাপ্পী লাহিড়ী সকাল ও সন্ধে ছাড়া হোটেলের বাইরে পা না ফেললেও লোকজন বলাবলি করছে, শাসক দলের লড়াইটা নাকি বাপ্পীরই বিরুদ্ধে। আসানসোলে বিজেপির আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী গায়ক বাবুল সুপ্রিয়র প্রভাব এমনই যে তৃণমূলের লোকজন হিমশিম খেয়ে একটার পর একটা অভিযোগ এনে বাবুলকে হেনস্তা করতে চাইছে। বিজেপি যেন নদীর কামট। নিঃসাড়ে কার পা কেটে নিয়ে যাবে জানা নেই। কেউ টেরও পাচ্ছে না ১৫ শতাংশ ভোট টেনে নিজের নাক কেটে কার যাত্রা ভঙ্গ করবে।
বিজেপি প্রথম ‘ফ্যাক্টর’ হলে দ্বিতীয় ‘ফ্যাক্টর’ মুসলমান মন। রাজ্যের ৪২টা আসনের মধ্যে ১৬টায় মুসলমান ভোট হারা-জেতার মালিক। তাদের দল বা গোষ্ঠীবদ্ধতাই ঠিক করে দেবে কে জিতবে কে হারবে। এই ১৬ আসনের মধ্যে ছয়টিতে মুসলমানরা বরাবর কংগ্রেসকে সাথ দিয়ে আসছে। বাকিগুলোতে তৃণমূল কংগ্রেসকে। বিজেপির সঙ্গে মমতার গোপন আঁতাতের খবর প্রচার করে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা মমতাকে প্রাথমিকভাবে ব্যাকফুটে ফেলেছিল। আশঙ্কিত মমতাও শেষ পর্যন্ত রাখঢাক না রেখে মোদিকে আক্রমণ শুরু করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলমান মন অনেকটা পেন্ডুলামের মতো দুলছে। বারাসাত, বসিরহাট, হাওড়া, উলুবেরিয়া, শ্রীরামপুরের মতো কেন্দ্রে মুসলমান ভোটে টাল খেলে মমতার কপালের ভাঁজ বাড়তে পারে।
এটা ঠিক, ভোটের বাজারে ক্ষমতাসীন দল বাড়তি সুবিধা পায়। তৃণমূল কংগ্রেস তা পাচ্ছেও। আবার এটাও ঠিক, বিভিন্ন জেলায় অন্তর্দ্বন্দ্ব তাদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোণঠাসা করে রেখেছে। রাজনৈতিক লোকজনের ওপর ভরসা না রেখে মমতা এই যে বিনোদনের জগৎকে প্রাধান্য দিলেন, তারও একটা অঙ্ক রয়েছে। ঘাটাল, বাঁকুড়া বা মেদিনীপুরে গোষ্ঠীবাজি এতই তীব্র যে শেষ পর্যন্ত দেব, মুনমুন, সন্ধ্যা রায়কে বেছে মমতা দল সামলালেন। রাজনীতিটা হলো, যুযুধান শিবির এটা বুঝবে যে মুনমুন, দেব বা সন্ধ্যা রায়েরা জিতে আর সেভাবে কেন্দ্রমুখী হবেন না। গোষ্ঠীপতিরা তাঁদের রাজত্ব চালিয়ে যাবেন, যেমন চালাচ্ছেন এখন।
গতবারের ভোটে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট ছিল। এবার কংগ্রেস একার শক্তিপরীক্ষায় নেমেছে। তারা যেটুকু ভোট পাবে, সেটুকুই কাটা যাবে তৃণমূলের ভোট। বামপন্থীরা কতটা শক্তি সঞ্চয় করেছে বা আরও হীনবল হয়েছে কি না, হবে তার পরীক্ষাও। বিজেপি কার পাকা ধানে মই দেবে জানা নেই। তবু তৃণমূল কংগ্রেস গতবারের ২০টা (জয়নগর আসন পেয়েছিল জোটসঙ্গী এসইউসিআই) আসন বাড়িয়ে ২৫-২৬টা পাবেই বলে ধরে নিয়েছে। চমক সেটা অবশ্য হবে না। কেন্দ্রে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার গড়লে এবং এ রাজ্যের সমতলে বিজেপি বহু বছর পর ফের খাতা খুললে (সঙ্গে ১৫-১৬ শতাংশ ভোট) রাজ্যে আগামী দিনের রাজনীতির রংটাই কিন্তু পাল্টে যাবে। সীমান্ত-রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কাছে সেটা আশীর্বাদ, না অভিশাপ—ভবিষ্যৎই তার জবাব দেবে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
No comments